সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে তনুশ্রী। আজ যে নববর্ষ শুরু। ১লা বৈশাখ, ১৪২৬ আজ থেকে শুরু। ছোটো বেলা থেকে অভ্যাস গড়ে দিয়েছেন মা। বর্ষ শুরুর দিন যদি ভাল কাজ করিস, ভাল খাওয়া দাওয়া করিস, ভাল চিন্তা করিস, আনন্দে সময় কাটাস তাহলে বছরটা এই দিনের মত ভাল কাটবে । তনুশ্রী নিজেতো নববর্ষের দিনটা উদযাপন করেই, ছেলে অরিন্দমকেও শিখিয়েছে। স্বামী মানসকেও অনুরোধ করে দিনটি ভাল ভাবে পালন করার জন্য। মানস তো কিছুতেই সকালবেলা বিছানা ছাড়তে রাজি হয় না।
গতকাল যখন মানসকে তনুশ্রী বলল, “মানস কাল নববর্ষ। জানোতো?
-মানস বলল, জানিতো।
-সকাল সকাল উঠে পড়বে।
-দূর! ১লা বৈশাখ তুমি আমাকে বড্ড জ্বালাতন কর।
তারপর তনুশ্রী মানসকে আর কিছুই বলেনি। অরিন্দম সাহেবদের দেশ লন্ডনে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যাম্পাসে থাকে। ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে পড়ছে।
তনুশ্রী ভোর ৫টায় উঠে পড়েছে। হারমনিয়ামটা নিয়ে একটু গলা সাধল। এসো হে বৈশাখ, রবীন্দ্র সঙ্গিত গাইল, দুখানা ভক্তিগীতি গাইল। তারপর রেডিওর দিকে এগোল। নবটা আগেই খুলে রেখেছিল। রেডিওতে তনুশ্রী প্রথম ঘোষণা শুনল “আজ ১৫ই এপ্রিল ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ শে চৈত্র ১৯৪১ শকাব্দ, ১লা বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ।” আঃ! কি আনন্দ যে হচ্ছে কী বলব! রবীন্দ্রনাথ অল ইন্ডিয়া রেডিওর নামকরন করেছিলেন আকাশবানী। বর্তমানে আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রের আর একটি চ্যানেল হয়েছে মৈত্রী চ্যানেল। ঘোষণা হয়, আকাশবানী কলকাতা গীতাঞ্জালি। আকাশবাণী মৈত্রী। সঞ্চয়িতা। টিভিতেও অনুষ্ঠান। টিভির অনুষ্ঠান দেখতে গেলে টিভির পর্দায় চোখ রেখে বসে থাকতে হয়। কাজকর্ম হয় না। রেডিও শুনতে শুনতে অনেক কাজ করা যায়। তাছাড়া রেডিওটা কাজের জায়গাতে রেখেও কাজ করা যায়। সেজন্য তনুশ্রীর রেডিওর অনুষ্ঠানই বেশি পছন্দ। কাজ ফেলে যদি বসে বসে টিভির পোগ্রাম দেখি তাহলে সারা বছর তাই করতে হবে। সেই জন্য টিভির দেখতে তার মন চায় না।
সাড়ে ৬টা বেজে গেল। স্নান সেরে নিল তনুশ্রী। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তনুশ্রী দেখল যে মানস বেসিনের সামনে দাড়িয়ে ব্রাশ করছে। বাবু তাহলে সকাল সকালই উঠেছেন।
তনুশ্রী বলল, “কিগো? সকাল সকাল উঠে পড়লে?”
“গিন্নির ইচ্ছে! না উঠে পারি?” হাসতে হাসতে উত্তর দেয় মানস।
মানস বলল, “এই বার বছরের প্রথম চা-টা জম্পেস করে কর দেখি। খেয়ে বাজার যাই। মটন আনি।“
তনুশ্রী বলল, “ না না না। আমরা বাঙালি মানুষ। এটা বাংলার নববর্ষ। কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি। আজকের দিনে মাছ ভাত খাওয়াই যুক্তিযুক্ত।“
তনুশ্রী তুলসী গাছে জল দিল। ঠাকুরের ছাবিতে নমস্কার করল। ভিখারীকে দেবার জন্য কৌটা করে চাল বের করে রাখল। তারপর দুমানুষে ডাইনিং টেবিলে বসল মৌজ করে চা খাবে বলে।“
চা খেতে খেতে মানস তনুশ্রীকে বলে,”তুমি তো ইতিহাসের ছাত্রী। শকাব্দ, খ্রিষ্টাব্দ, বঙ্গাব্দ তিনটে অব্দের কথা বলা হয়, কেন বলতো?”
-আরে বাবা ভারতের জাতীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী শকাব্দ গননা করা হয়। সাতবাহন রাজাদের রাজত্ব কালে শকাব্দের সূচনা। অনেকে মনে করেন কুষান সম্রাট কণিষ্ক শকাব্দ প্রচলন করেন, কিন্তু হিসাবে তা পাওয়া যায় না। শকাব্দের সূচনা ৭৮ খ্রিস্টাব্দে। আর কনিষ্কের রাজত্বকাল ৯৮ – ১১৭ খ্রিষ্টাব্দ।
আর, খ্রিষ্টাব্দ তো আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার।
-যিশু খ্রিস্টের জন্মের সঙ্গে খ্রিষ্টাব্দ জড়িত?
-তা কি করে হয়? জিশুর জন্মদিন তো ১লা জানুয়ারি নয় ২৫ শে ডিসেম্বর।
– তাহলে?
– আসলে অনেক বিতর্কের মধ্যে ধরা হয় ৪ খ্রিস্ট পুর্বাব্দে যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়। সুতরাং খ্রিস্টের জন্মের চার বছর পরে ১লা জানুয়ারি থেকে খ্রিস্টাব্দের শুরু।
– বাব্বা ! এ তো ঝামেলার চূড়ান্ত?
– আর বাঙালীর নববর্ষ থেকে শুরু বঙ্গাব্দ। বঙ্গাব্দ শুরু গৌড়ের সার্বভৌম রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে।
– বটে বটে! অব বাতাইয়ে বঙ্গাব্দের শুরু কবে থেকে?
– শোনো তাহলে। বানভাট্ট ও হিউয়েন সাং এর লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়, ৬০৬ খ্রিস্ট পূরবাব্দে শশাঙ্ক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন বঙ্গদেশ গৌড় নামে প্রসিদ্ধ ছিল। ঐ সময়েই আন্দাজ ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বাঙ্গাব্দের সুচনা।
– খুব ভাল
– নাও। এবার থলি নিয়ে বাজার যাও, ইতিহাস নিয়ে নিজের জ্ঞানকে এভাবে মুক্ত করতে পেরে নিজের একটু ভালই লাগছে তনুশ্রীর ।
– নববর্ষের দিন কী জল খাবার খাওয়াবে?
– লুচি, আলুরদম আর রসগোল্লা। বাজার থেকে রসগোল্লা আনবে।
– তাহলে সারাবছর ই ব্রেকফাস্টে এই মেনু?
– তা কেন? যে কোনও মেনু হতে পারে।
– দুপুরের মেনু কী?
– উচ্ছে ভাজা, মুগের ডাল, ঝিঙে আলুপোস্ত, মাছের ঝাল, আমের অম্বল।
-বা! খুব ভাল। আমি দাড়ি কামিয়ে নিই। তবেই তো সারাবছর দাড়ি কামাব।
– তোমার যত সব উদ্ভট কথা।
সারাদিন তনুশ্রী নিজেকে কাজের মধ্যে নিয়জিত রাখল। সন্ধায় মানসকে সঙ্গে নিয়ে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সারদা আশ্রমে গেল। ছোলা ভাজা, মুড়কি পুজো দিল। আরতি দেখল। ভক্তি গানে অংশ নিল।
রাতে ছেলের ফোন পেল। “মা আজকের দিনটা খুব ভাল ভাবে কাটিয়েছি। এখানে বেঙ্গলি এ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে সেতার বাজিয়েছি। সব বাঙালি খাওয়াদাওয়া, বাংলা ছাড়া একটাও কথা বলিনি। শুভ রাত্রি মা।”
মা বলল, “শুভ রাত্রি”। সারাদিন পর সাহেবের দেশ থেকে ছেলের ফোন পেয়ে তনুশ্রীর মনটা খুশিতে ভরে গেল।
Tags: অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, আজকের দিন, গল্প
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।