অনেকদিন ধরেই হাতে লেখা আসছে না নিখিলের। রোজই লিখব লিখব ভাবে কিন্তু যখনই একটু সময় বের করে মনের ভাব কলমের আঁচড়ে বাঁধবার চেষ্টা করে, সেই প্রচেষ্টা ডায়েরীর পাতা অবধি পৌঁছনোর আগেই হাজারো ব্যাস্ততার শাসন তার শিল্পীসত্তাকে দমিয়ে দেয়। চিফ এডিটর মিত্রদা রোজ একবার করে ফোন করে-
নিখিল, এবারের সংখ্যায় একটা লেখা দাও। তুমি তো রোম্যান্টিক লেখক। পাঠকদেরও তো একটা চাহিদা থাকে বোঝই তো!
হ্যাঁ মিত্রদা চেষ্টা করছি।
বলেই ফোনটা রেখে দেয় নিখিল। ভালোবাসা টাইপের লেখা লিখতে আর ইচ্ছে করে না নিখিলের। একসময় খুব লিখত। কিন্তু তারপর বারবার চরম বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে ভালবাসার নামে প্রতারণার নগ্ন চেহারাটা চাক্ষুষ উপলদ্ধি করে ঘৃণা ও হতাশার আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সে।
সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে সৃষ্টিশীলতার সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল এই যে সে তার লিখনশৈলীর গুনমানের সাথে আপোষ করতে পারবে না। আর যে ব্যাপারটা মন থেকে আসছে না, সেই সম্পর্কিত লেখা ভালো হবে কেমন করে? না! মিত্রদাকে বলে দেব- এবার নতুন কিছু ট্রাই করি মিত্রদা। অনেকদিন তো অনেক ভালোবাসার আগুনে তোমার ম্যাগাজিনের অনেক পাতা পোড়ালাম; এবার না হয় নতুন কিছু লিখি – কত কিছু তো আছে – সোশিয়লজি, সাইকোলজি, কমেডি, ডিটেকটিভ এমনকি প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি – লেখাই তো যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই অফিস থেকে ফিরছিল নিখিল। ট্রেনে বসেই মিত্রদাকে ফোন করে ব্যাপারগুলো জানালো। উত্তরে মিত্রদা যা বলল –
হ্যাঁ লেখাই যায়। লেখো না! হ্যাঁ পেয়েছি! এই তো! প্যারানরমাল অ্যাক্টিভিটি! রাইট; মানে ভূতের সাথে প্রেম!! এরকম কিছু একটা করলে কেমন হয় নিখিল? জমে যাবে কি বল?
পাক্কা পাঁচ সেকেন্ড সাইলেন্ট মোডে চলে গিয়েছিল নিখিল। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এখানে মানুষের মাথায় প্রেমের ভূত চাপছে না, আবার ভূতের মাথায় কিনা মানুষের প্রেম!!
রাত্রে খেয়ে দেয়ে একটু কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। অমনি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আগস্ট মাস। এ মাসকে বোঝা খুব মুশকিল। কখনো গরমে পোড়াবে কখনো আবার বৃষ্টিতে মন জুড়িয়ে দেবে। তাও ভালো, রাতের ঘুমটা ভালো হবে। ঘুমের মধ্যেও অনেকসময় প্লট চলে আসে নিখিলের মাথায়। হ্যাঁ এরকমটা বেশ কয়েকবার হয়েছে। কলমটা দাঁতে কামড়ে ধরে কি যেন ভাবল, তারপর টেবিলে ওভাবেই কাগজ কলম ফেলে রেখে সোজা চলে গেল শুতে। আজ প্রচুর ধকল গেছে। ঘুমটা না হলেই নয়।
রাত তখন পৌনে চারটে হবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। কেমন একটা থম্থমে শান্ত ভাব চারিদিকে। নিখিল জল খেতে উঠল। হঠাৎ যেন কেমনভাবে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার আর যেন এক অলৌকিক নিস্তব্ধতা। নিখিল খেয়াল করল সে যেন হঠাৎ টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। শরীর একটুও নাড়াতে পারছে না। এরই মধ্যে একটা গাঢ় নীল রঙের আলোকবিন্দু দেখতে পেল নিখিল। ধীরে ধীরে সেটা কাছে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে নিখিল বুঝতে পারল যে সেটা হল একটা একটা অপরূপ সুন্দর টিয়াপাখি। এরকম প্রাণী সে জীবনে দেখেনি। সারা শরীর নীল রঙের। পাখিটির চোখে এমন এক মায়াবী আভা রয়েছে তা যেন যে কাউকে মুহূর্তের মধ্যে বশে নিয়ে নিতে পারে।
নিখিল জিজ্ঞ্যেস করল – কে তুমি?
আমার নাম ‘ঘৃণা’।
আর তোমার চারপাশ ওটা কি দিয়ে ঘেড়া?
পাখিটি মৃদু হেসে বলল- খাঁচা।
আবার চকিতেই আরেকটি আলোকবিন্দু আগের মতই নিখিলের চোখের সামনে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু এবার সেটি হাল্কা সোনালি রঙের। বরেফর চাদরে ঢাকা পাহাড়ে দিনের প্রথম আলো এসে পরলে যেরকম দেখতে লাগে খানিকটা সেইরকম। যেন নিখাদ সোনা। আরও কিছুটা কাছে আসতেই নিখিল লক্ষ্য করল সেটি একটি ধবধবে সাদা পায়রা। আপন মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার ডানার গতিতে এক বাধনহীন স্বাধীনতা, তার আবির্ভাবের মোহ একটা চরম পবিত্রতায় আবিষ্ট করল নিখিলকে।
তুমি কে? – প্রশ্ন করল নিখিল।
আমার নাম ‘ভালোবাসা’।
তোমার চারপাশে কোন খাঁচা নেই কেন?
কারন আমি মুক্ত। আমাকে আটকে রাখতে হয় না গো। যারা আমায় বিশ্বাসের সাথে পালন করে তাদের মনে আমার পালিয়ে যাওয়ার কোন ভয় থাকে না। আমি বার বার ফিরে ফিরে আসি।
নিখিল এবার টিয়াপাখিটিকে প্রশ্ন করল – তাহলে তুমি খাঁচায় বন্দি কেন? উত্তরে টিয়াপাখি বলল-
আমি বড় সৌখিন। আমাকে যে পালন করে সে খুব যত্ন করে পুষে রাখে আমায়। কারন বাঁধন পোক্ত না হলে আমায় ধরে রাখা যায় না। আর আমিও বড্ড চালাক, যে খাঁচার বাঁধন যত মজবুত তাতে গিয়েই আশ্রয় নিই। আমাকে পোষণ করতে করতে কখনো কখনো আমার মালিক নিথর হয়ে যায় তবু আমি আরামে থাকি। যতক্ষণ না সে নিজে খাঁচা খুলে আমায় মুক্ত করছে, আমার মুক্তি নেই।
নিখিল কিছুক্ষন চুপ করে টিয়াপাখির বলা কথা গুলো বুঝবার চেষ্টা করল। পরক্ষনেই একটু ভেবে সে পায়রাটিকে জিজ্ঞাসা করল – আচ্ছা, তুমি যে এভাবে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেরাও, তুমি তো কখনো কারোর থেকে আঘাত পেতেই পার। তখন কি হয়?
উত্তরে এবার পায়রাটি নয়, টিয়াপাখিটি বলে উঠল –
আসলে আমাদের মালিক তো একজনই। যখন ও ব্যথা পায় তখন আমাদের মালিক আমাকে কিনে আনে। আমি খুব সস্তায় মন বদল করি কি না! যাই হোক, তখন আমার আদর বেড়ে যায়। তখন ও বার বার ফিরে এলেও মালিক ওকে উপেক্ষা করে। তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুখ তো কারো কপালে চিরকাল টেকে না। আবার একসময় দেখি যে মালিকের মন পরিবর্তন হয়েছে। তখন সে আবার রোজ সকালে দানা ছড়িয়ে ‘ভালবাসা’কে ডাকে। রোজ সন্ধ্যাবেলা হা পিত্যেশ করে ওর জন্য বসে থাকে। ও ফিরে এলে আমার অযত্ন শুরু হয়। আস্তে আস্তে আমি অসুস্থ হয়ে পরি। হয় মারা যাই নয় আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন আবার নতুন খাঁচা খোজার খেলায় মেতে উঠি।
কিন্তু এখন তো তোমাকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না যে তুমি অযত্নে আছ! কি সতেজ তুমি! তোমার মালিক এখন তোমায় নিশ্চয়ই খুব যত্ন করে পুষছে তাই না?
হ্যাঁ সে আমায় খুব যত্ন করে।
আচ্ছা, তোমাদের এই মালিকটা আসলে কে?
হঠাৎই এক মায়াবী হাসিতে হেসে উঠল ওরা দুজন। সে হাসি যে একইসাথে কি যন্ত্রণার ও মধুর তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একসাথে তারা গেয়ে উঠল-
তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানো না? তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা?
ধড়ফরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসল নিখিল। মোবাইলে দেখল ভোর পাঁচটা বাজে। এমন স্বপ্ন দেখে গলা শুকিয়ে এল তার। তখনও হৃতস্পন্দনের গতি কমেনি। বিছানা থেকে উঠে সোজা চলে গেল লেখার ঘরে। চেয়ারটা টেনে বসল। হাতে কলম তুলে নিল।
লিখতে লিখতে নিখিল উপলদ্ধি করতে লাগল যে তার এই রাতভোড়ের স্বপ্ন কি বার্তা দিয়ে গেল তাকে? প্রেমের নামে প্রতারণার আগুনে যে ঘর জ্বলে যায় সেখানে নিখাদ ভালবাসা আবার আশার আলো নিয়ে হাজির হলে তাকে তিরস্কৃত হয়ে ফিরেই আসতে হয়। তারা অন্ধকারকেই পছন্দ করে, আলোকে ভয় পায়। সেখানে নীল ঘৃণার পাখি আয়েশ করে থাকে। আজ এই শহরের প্রায় প্রতিটা ঘরেই হয়তো তার আস্তানা। যতদিন না খাঁচা খুলে তাকে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ততদিন ওই পায়রাটি কারো আঙিনায় এসে বসতে পারবে না। ভবঘুড়ে হয়ে উড়ে বেড়াবে।
সকাল নটা নাগাদ মিত্রদার ফোন এল –
কিরে লিখলি কিছু?
হ্যাঁ মিত্রদা। আর একটু পরে তোমার অফিসেই যাচ্ছিলাম।
বাহ! খুব ভালো কথা। এতদিন যে বলছিলি হাতে লেখা আসছিল না, লেখা এল তাহলে?
হুম।
ফোনটা রেখে মৃদু হেসে নিখিল মনে মনে বলে উঠল – শুধু খাঁচাটা খুলবার দেরি ছিল গো মিত্রদা। কাউকে তো শুরুটা করতেই হত!
Tags: খাঁচা, গল্প, দেবাশিস সাহা
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।