03 Oct

লিখে লাখ টাকা

লিখেছেন:সমীর ঘোষ


খবরটা গিন্নিই দিল। বলল, মাঝেমাধ্যেই তো পেন বই খাতা নিয়ে কী সব ছাইপাঁশ লেখ। পাড়ার দুর্গাপুজোর স্যুভেনির বা শখের কবি বন্ধুদের লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া আর কোথাও তো প্রকাশও হয় না সে সব। হাতে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন ধরিয়ে দিয়ে সে বলল যাও না এই সব জায়গায়। লিখলেই হাজার হাজার টাকা দেবে বলছে এরা। কোথাও যেতে হবে না। বাড়িতে বসেই লিখে রোজগারের বন্দোবস্ত।

গিন্নির হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে পেন দিয়ে গোল পাকানো বিজ্ঞাপনটা দেখেই চমকে উঠলাম। ঘরে বসে হাতে লি‍খে মাসে ৩০ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিশ্চিত রোজগার। সত্ত্বর যোগাযোগ করুন বলে একটা মোবাইল নম্বরও দেওয়া আছে।

বলে কী ? ঘরে বসে লিখেই হাজার হাজার টাকা আয়! স্বপ্ন দেখছি না তো। ধর্মতলায় একটা বেসরকারি অফিসে চাকরি করি। বড় সাহেবের ফাই-ফরমাশ খাটতে খাটতে যান জেরবার অবস্থা। অফিসে আধুনিক কমপিউটার, ওয়াই-ফাই, লুকোনো ক্যামেরা ইত্যাদি থাকলেও মাইনেটা সেই পুরাতন প্রস্তর যুগের। কিছুতেই বেড়ে আধুনিক হয় না। এই অবস্থায় ঘরে বসে লিখে  মোটা রোজগার হলে খারাপ কী?

বাঙালি লিখেছে সবথেকে বেশি, রোজগার করেছে সবচেয়ে কম – এমন একটা অভিযোগ এমনিতেই চালু আছে। দুটো পয়সার জন্য প্রকাশকের দরজায় দরজায় পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘুরতে হয়েছে কত কবি, কত সাহিত্যিককে। তাহলে কী দিন বদলের দিন এল? এমন একটা দুর্দান্ত খবর দেওয়ার জন্য গিন্নিকে খুব বাহবা দিলাম। আমি খবরের কাগজ পড়ি শেষ পাতা থেকে। খেলা, সাপ্লিমেন্ট, সিনেমা, সিরিয়ালের কুটকচালি, এটা কিনলে ওটা ফ্রি দেওয়ার ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন দেখা শেষ হতে হতেই অফিস যাওয়ার সময় হয়ে যায়। গিন্নি দুপুরবেলায় সাজগোজ, বিউটি টিপস, জ্যোতিষ, চলুন বেড়িয়ে আসির মত হরেকরকম বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতেই এ জিনিষ আবিষ্কার করেছে। অর্থ রোজগারের মত শুভ কাজে দেরী করা ঠিক হবে না বলে মনে করে বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করলাম। ভাবলাম আমরা হলাম অভাগার দল। যেদিকেই যাই সাগর শুকায়ে যায় – তাই হয়ত ফোনই কেউ ধরবে না। কিন্তু দিব্যি ফোন ধরলেন এক পুরুষকণ্ঠ। খুব শান্ত আর স্নিগ্ধ গলায় বললেন এভাবে তো ফোনে সব কথা বলা যায় না, সবিস্তারে সব জানতে হলে চলে আসুন আমাদের ঠিকানায়।

কী দারুণ অভ্যর্থনা। কী সুন্দর ভাষা। কোথা থেকে আসব জেনে নিয়ে বাসের নম্বর আর স্টপেজও বলে দিলেন তিনি। এ শহর এত ভাল কবে থেকে হয়ে গেল কে জানে। একটা লোকের রোজগারের জন্য আর একজনের কী আন্তরিক প্রচেষ্টা।

সব ঘি একা খাব এমন মনে করে অফিস, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী কাউকে কিছু না বলে একদিন কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে হাজির হলাম লেখালেখির কেন্দ্রে। কে জানে বাবা, পড়ালেখার ব্যাপার। যদি সাজ-পোশাকে সে রকম কোনও ইমেজ না থাকে তাহলে হয়ত বাতিলই করে দেবে। মনে মনে অনেকদিনই লেখক হওয়ার ইচ্ছে। কয়েকটা অতি লোকাল লিটল ম্যাগাজিনে ছড়া, কবিতা, গল্প লিখেছি। কিন্তু টাকা মেলা তো দূরের কথা বরং ট্যাঁক খসিয়ে কিছু চাঁদাও দিতে হয়েছে মাঝে মাঝে। এই বাংলায় লেখকের তো অভাব নেই। কিন্তু শুধু লিখে মোটা টাকা রোজগার করছেন এমন লেখকের সংখ্যা নেই বললেই চলে। হয় কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়, নয় সরকারি চাকরি করে। সে ক্ষেত্রে নিজেকে এক নতুন উচ্চতায় স্থাপন করলাম। লেখালিখির যা জ্ঞান আছে তাতে মনে হল ঘরে বসে হাজার হাজার টাকা রোজগারে কোনও সমস্যাই হওয়ার কথা নয়।

একটা নির্মীয়মান বহুতলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে দশ ফুট বাই পাঁচ ফুটের একটা ঘরে কোনওরকমে কাঠের চেয়ার টেবিল পেতে বসে রয়েছেন এক যুবক। টেবিলে একগাদা পুরোনো পুরোনো বই। ডাঁই করা সাদা কাগজ। এখান থেকেই মিলবে হাজার হাজার টাকা? কী জানি হতেও পারে। আজকাল তো সবই উল্টো। হয়ত কনস্ট্রাকশন শেষ হলে বিল্ডিংটাই হয়ে যাবে এর অফিস। আপাতত একটা ঘর নিয়ে কাজ চলছে। আমি যেতেই বসতে বললেন যুবকটি। বোঝালেন লিখে টাকা রোজগারের দশটি উপায় আছে। তবে এজন্য প্রথমে একটা রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যত বেশি আয় করতে চাইবেন তত বেশি রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে হবে। আর আছে ভুলের হিসেব। যত বেশি ভুল হবে তত নন্বর কাটা। একটা নির্দিষ্ট ভুলের পর লেখার পাতাটাই বাতিল হয়ে যাবে।

লিখে রোজগার আমায় পেয়ে বসল। গিন্নিকে এসে বলতেই দশ হাজার টাকার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে কাজে নেমে পড়ার পরামর্শ দিল। বলল, পরে তো রোজগারের সীমা-পরিসীমা থাকবে না তখন ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকাটা ভরে দিলেই হল। পরদিন টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের পর আমাকে একটা ধুমসো ইংরেজি বই, কতকগুলো সাদা কাগজ আর নির্দিষ্ট পেন ধরিয়ে দিল ছেলেটি। দেখলাম স্টিফেন হকিং থেকে জেমস হেডলি চেজ, ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে অরুন্ধতী রায় সকলেরই ইংরেজি ঢাউস ঢাউস বই রয়েছে সেখানে। এই সব বইয়েরই একটা নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা থেকে আর এক পৃষ্ঠা পর্যন্ত ওদেরই দেওয়া পাতায়, ওদেরই দেওয়া পেনে লিখে জমা দিতে হবে। কমা, ফুলস্টপ, উর্দ্ধকমা, ক্যাপিটাল লেটার সহ সবকিছু হুবহু লেখা হলে মিলবে লোভনীয় টাকা। ভুল হলেই নম্বর কাটা হয়ে গিয়ে সব ফাঁকা।

লিখে রোজগারের এমন অদ্ভূত কায়দা দেখে আশ্চর্য লাগল। যে বই একবার লেখা হয়ে গেছে, সেটাই আবার লিখে শিক্ষা জগতের কী উন্নতি হবে তা বুঝে পেলাম না। হতে পারে নামী লেখকের লেখা কপি করে ভাল লেখক তৈরির এটা একটা নতুন উপায়।

যাই হোক জয় মা বলে লেগে পড়লাম কাজে। এক লপ্তে গোটা পঞ্চাশ পাতা তৈরি করে প্রচুর উপার্জনের আশা নিয়ে হাজির হলাম লিখে রোজগারের দপ্তরে। দেখলাম এক মহিলা প্রচুর লিখেও একটিও টাকা পান নি এমন অভিযোগ তুলে প্রচুর চেঁচামেচি করছেন ছেলেটির সঙ্গে। আমি সাধারণ পাবলিক। সাতে-পাঁচে নেই। বিদ্রোহে কান না দিয়ে ওই মহিলার চেঁচামেচির মধ্যেই এক কিস্তি জমা দিয়ে নিয়ে এলাম পরের কিস্তির কাজ। এরপর জমা দিলাম আরও কয়েক কিস্তি।  কিন্তু কোথায় কী? দীর্ঘ দু মাস লেখালিখি করে মিলল না একটিও টাকা।

যাই লিখি সবই ভুল চিহ্নিত হয়ে কাটাকুটি করে বাতিল হ‍য়ে যায়। আমিও ছাড়বার পাত্র নই। ঘরে বসে লিখে রোজগার আমায় করতেই হবে। গিন্নির পরামর্শ মেনে ফের বসলাম খবরের কাগজ নিয়ে। দেখলাম এ এক আশ্চর্য জগৎ। লিখে রোজগারের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। এ যদি দশ হাজার দেয় তো ও দেয় কুড়ি হাজার। সে যদি তিরিশ দেয় তো তিনি দিচ্ছেন চল্লিশ। প্রথম ব্যর্থতা ঢাকা দিতে আমি গেলাম দ্বিতীয় একটা জায়গায়। দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে চতুর্থ। লোভে লোভে ছ’মাস ধরে বিভিন্ন ‘লিখে আয়’ প্রতিষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশনের জন্যই খরচা করে ফেললাম পঞ্চাশ হাজার টাকা। একদিন বোধদয়ের পর খুবই ভারাক্রান্ত মনে সন্ধ্যেবেলায় শুকনো মুড়ি আর চা খাচ্ছি আর টাকা না পেয়ে চেঁচামেচি করা সেই মহিলার কথা ভাবছি। এমন সময়ই গিন্নি এসে চুপি চুপি জানাল গোপন কথাটি। বলল লোভে পড়ে আমাকে না জানিয়ে সেও নাম লিখিয়েছিল কয়েকটা লিখে রোজগারের সংস্থায়। কয়েক দফায় তারও খসে গেছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। অনেকক্ষণ কোনও কথা না বলে আমরা চুপ করে বসে রইলাম। লিখে রোজগার নয়, জলেই চলে গেল লাখ টাকা।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ