আর্য তোমার সমস্যা টা কোথায়? কলকাতায় তোমার বাড়ি. আর ওখানে কস্ট অফ লিভিংও এখানের চেয়ে ঢের কম. ডেসিগন্যাশন টাও তোমার জন্য বেটার. তাহলে তোমার আপত্তি টা কোথায়?
-আপত্তি আছে স্যার. আই হ্যাভ সাম পার্সোনাল রিসন্স. এনিওয়ে স্যার, আই আম টেকিং দ্য আৰ্লি মর্নিং ফ্লাইট এন্ড কামিং ব্যাক টুমোরো.
-ওকে. এস ইউ উইশ ! বলে ফোনটা রেখে দিলেন অবিনাশ বাবু.
আর্য বন্দোপাধ্যায়. ব্যাঙ্গালোরে একটা নাম করা এম এন সি তে মোটা মাইনের চাকরি করে সে. একটা ক্লায়েন্ট এর সাথে মিট করতে কলকাতা এসেছিলো. এবার ফেরার পালা. ফোনের ওপাশে বস বারবার ওকে কলকাতার ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার নেওয়ার আবদার করছিলেন.কিন্তু আর্য তাতে রাজি নয়. কারণ? একমাত্র সেই জানে !
ট্রলিটা গোছাতে গোছাতে হোটেল এর খোলা ব্যালকোনিটার দিকে নজর গেলো তার. কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে এক চিলতে লাল আকাশ কোনো ফাঁকে ঢুকে পড়েছে. ঘড়িতে তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে. হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো.
বৃষ্টি পড়লে আর্য নিজেকে বন্ধ ঘরে রাখতে পারে না. ব্যালকোনিতে গিয়ে উপরে খোলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে. হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোটাও ধরলো কয়েকটা. এই শহর কলকাতার সন্ধের বৃষ্টি কোনো এক মায়াবী আবহে একসাথে অনেক পুরোনো সব স্মৃতি এনে মেলে ধরলো আর্যর মনে. ছেলেবেলা, স্কুল, কলেজ জীবন আর কলেজ জীবনের প্রথম আর শেষ………
ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা. বৃষ্টির গতির সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে এয়ারপোর্টের দিকে. রাতের বৃষ্টি মহানগরীকে এক অদ্ভুত শোভা দিয়ে যায় যেন. ধুলোমাখা শহরটার ভেজা মাটির গন্ধ ঠিক কিরকম হয় তা একমাত্র এইরকম বৃষ্টি হলেই অনুভব করা যায়. ল্যাপটপটা বন্ধ করে কোল থেকে নামিয়ে কাঁচের জানালাটার দিকে চেয়ে রইলো আর্য. রাতের আলোকছটায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত তিলোত্তমাকে.
আরো কিছুটা যাওয়ার পর হঠাৎ গাড়িটা একটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো. ড্রাইভার নামলো দেখবার জন্য. রিস্টওয়াচে আর্য দেখলো সোয়া একটা বাজে. বাইরে তখনো ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে. এরই মদ্ধ্যে জানালা দিয়ে বাইরের কোনকিছুতে নজর আটকে গেলো তার. কাচ নামিয়ে সে দেখলো দুটি মেয়ে একটি নাইট ক্লাব থেকে বেরোলো. একজন পুরো বেসামাল. অন্যজন তাকে নিয়ে এই পরে কি সেই পরে. এলোমেলো ভাবে ফুটপাত ধরে হাটছিলো তারা. এমন সময় টাল সামলাতে না পেরে দুজনেই ধপ করে বসে পড়লো রাস্তায়. দূর থেকে দেখেও ওই দুজনের মধ্যে একজনকে যেন খুব চেনা মনে হয়েছিল তার. গাড়ি থেকে নেমে এসে গিয়ে দেখলো একজনের হাঁটুর কাছে খানিকটা ছড়ে গেছে. আরেকজন, তাকে যে উঠতে হবে সেই জ্ঞানই লোপ পেয়েছে বোধ হয়. সামনে যেতেই… .
আর্য তুই?
রূপসা?
এবার মাটিতে পড়ে থাকা অপর মেয়েটিকে কোনোক্রমে তুললো সে. মেয়েটির মুখের দিকে চাইতেই আর্যর মনে শিহরণ খেলে গেলো.
লাবনী?
মেয়েটির চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে লাগলো আর্য. তারপর রূপসা কে জিজ্ঞেস করলো –
কিভাবে ফিরবি তোরা?
এই তো ক্যাব বুক করতে যাচ্ছিলাম.
থাক তার আর দরকার নেই. আমি ড্রপ করে দিচ্ছি তোদের.
গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো. রূপসা জিগ্যেস করলো –
সেই কনভোকেশন এর পর এই দেখা ! তুই কলকাতা কবে এলি? এখানেই আছিস নাকি এখন?
না.
ব্যাস. এটুকুই উত্তর দিলো আর্য. রূপসা বলতে লাগলো-
আসলে আজ তো তেরো আগস্ট. তুই তো জানিস ওর বার্থডে . তাই লাবনীকে আর কন্ট্রোল করা গেলো না. অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই করে ফেললো.
আবারো কোনো জবাব নেই আর্যর মুখে. জীবনে খালি একটা জিনিসকেই বরাবর ঘৃণা করে এসেছে সে. আজকাল কার তথাকথিত মডার্ন কালচারের কাছে আর্যকে বারবার এর জন্য ব্যাকডেটেড কথাটা শুনতে হয়েছে. তবু যে জিনিসগুলো আর্যর মনে আজ পর্যন্ত আবেদন করতে পারে নি, যেটি একসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ টার থেকে দূরে চলে যাওয়ার একটা বড়ো কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই একই জিনিসের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পরা সেই একই মানুষটির মুখের দিকে এতদিন বাদে প্রথমবার চাইতেই যেন সমস্ত শব্দ ভুলে গেলো সে ! চার বছর আগে লাবনীর সাথে হয়ে শেষ কথা গুলো মনে পড়তে লাগলো তার.
আর্য তুই কি বলতে চাস? আমি কারো সাথে মিশবো না? কোথাও যাবো না? নিজের মতো করে লাইফ লিড করতে পারবো না? আমারো একটা পার্সোনাল লাইফ আছে সেটা তুই ভুলে যাস মাঝে মাঝে?
আমি সেকথা বলি নি. আমি খালি এটুকুই বলতে চাই যে, যে জিনিস মানুষকে তার হুশেই না রাখতে পারে সেটা ছোয়ার কোনো দরকার আছে কি?
কোনদিন বেহুঁশ হতে দেখেছিস তুই আমাকে? আমি একজন অ্যাডাল্ট. তুই আমায় নিশ্চই শেখাবি না আমার কি করা উচিত আর কি উচিত নয়. গ্রো আপ আর্য !! এটা প্রথমবার নয় .
হ্যা জানি. আর এটা প্রথমবার নয় তার কারণ আই কেয়ার ফর ইউ.
দ্যাট আই নো. কিন্তু তাই বলে তোকে কেউ রাইট দেয়নি আমার সব ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার. সব রিলেশনশিপ এ একটা স্পেস থাকে সেটা বোঝা উচিত তোর.
ও. তো স্পেস দাওয়া মানে তোকে তোর মর্জি মতো যা খুশি করতে দেবো আমি তাইতো?
সে কথা আমি একবারও বলেছি? তুই এত ওভাররেয়াক্ট করছিস কেন? ইউ নো হোয়াট? আই আম জাস্ট ডান উইথ ইউ.
মানে?
অনেক হয়েছে ! এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না. কোনো অকেশান এলেই সেই এক জিনিস!
তো?
আমার সাথে আর কথা বলিস না তুই !
তুই জানিস তুই কি বলছিস?
ফোনটা কেটে দিয়েছিলো লাবনী. কোনো উত্তর আসে নি তারপর. ভেবেছিলো এতো সামান্য ব্যাপারকে এতো টা বড়ো করে না বললেই পারতো. হয়তো কিছুদিনের মদ্ধ্যে সব আবার আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে. কিন্তু হয়তো ততদিনে আর্যর প্রতি ভুল বোঝাবুঝি বিরক্তিতে আর বিরক্তি তিক্ততায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো ! হয়তো দিনের শেষে মানুষ থাকে তো একে অন্যের সাথে কিন্তু বাঁচে নিজের জন্যই !
একসাথে অনেক স্মৃতি আর্যর মস্তিষ্কে প্রহার করতে লাগলো. লাবনী ততক্ষনে অধঃচেতনা থেকে নিদ্রার কোলে ঢোলে পড়েছে. রূপসা বললো –
আর্য বলছি কি, আজকের রাতটার জন্য লাবনীকে আমার বাড়ি নিয়ে যাই. আঙ্কেল -আন্টি এভাবে দেখলে ভীষণ রাগারাগি করবে. বুঝতেই তো পারছিস !
কোনো সারা না দিয়ে ঘড়িতে তাকালো আর্য. রুপালি বেল্টের ঘড়ির একটা অংশে লেখা আর্য নামটা গাড়ির নিঃষ্প্রভ আলোয় একবার উঁকি মেরে গেলো. চার বছর আগে জন্মদিনে প্রিয় বন্ধুর থেকে উপহার স্বরূপ পাওয়া ঘড়িটি আজও নিজের থেকে দূর করতে পারে নি আর্য. আর সেদিনেই নিজের মনের বহুদিনের জমিয়ে রাখা কথাটা বলে লাবনীকেও সেরা উপহার টা দিয়েছিলো আর্য. আর্যর মনে আছে , আনন্দে চোখে জল বেরিয়ে এসেছিলো লাবনীর. সেটা যে আনন্দ আর সম্মতির কান্না বুঝেছিলো আর্য. কারণ আর্যর মনে হতো কোনো মানুষের চোখের জলের প্রকৃত অর্থ অপর কেউ তখনই বুঝতে পারে যদি সে কোনোদিনও সেই মানুষটির সাথে তার কষ্ট ভাগ করে নিয়ে থাকে বা অন্তত চেষ্টা টুকু করে থাকে. ভুল ছিল না সে. কিন্তু আজ কোন ভুলের জন্য যে সে তার একমাত্র মানসিক আশ্রয়টিকে হারিয়ে ছিল সেটার কোনো কুলকিনারা খুঁজে পেলো না আর্য.
আবেশ কাটলো রূপসার ডাকে –
কিরে কি বলছি?
থাক তার আর দরকার নেই. তুই বাড়ি যা আমি ওকে ড্রপ করে দেবো. ডোন্ট ওরি !
রূপসা কে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলো আর্য. আরো একটু এগিয়েই লাবনীর বাড়ি. বড়ো রাস্তা থেকে একটু ভিতরে. বাড়ি চিনতে খুব একটা অসুবিধা হল না . তখন সামান্য হুশ ফিরেছে লাবনীর. ড্রাইভার কে গাড়িতে বসতে বলে খুব সাবধানে লাবনীকে বাড়ি অবধি নিয়ে এলো আর্য. কলিং বেল বাজালো. লাবনীর মা দরজা খুললেন.
আর্য তুমি?
আন্টি এখন কথা বলার সময় নেই. ফ্লাইট এর দেরি হচ্ছে. বাকি আপনি রূপসার থেকে শুনে নেবেন. – বলে লাবনীকে তার মায়ের দায়িত্বে রেখে গাড়ির কাছে ফিরে এলো আর্য. গাড়ি ছুটে চললো এয়ারপোর্টের দিকে. তখন ভোর হয়ে এসেছে.
দোতলার ঘরের পুবদিকের জানালাটা দিয়ে সকালের ঝলমলে রোদ মুখে এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো লাবনীর. আলসি ভাঙতে ভাঙতে সে অনুভব করলো তার বা হাতে কি একটা যেন বাঁধো বাঁধো ঠেকছে. সে দেখলো একটা রুপালি চেনের ঘড়ি তার কব্জিতে কোনোভাবে জড়িয়ে রয়েছে. দেখেই সন্দেহ হল তার. ভালো করে দেখতেই আর্য নামটা পরিষ্কার দেখতে পেলো সে. নিমেষের মধ্যে কোথা থেকে এক নোনা জলের আবরণে তার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে এলো.
আর্য হয়তো তখন মাঝ আকাশে তার ভোরের উড়ান এর সাথে সব পুরোনো মায়া ত্যাগ করে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে ডানা মেলে দিতে উদ্যত হয়েছে. কে জানে? মানুষ দিনের শেষে নিজের জন্যেই তো বাঁচে !!
Tags: গল্প, দেবাশিস সাহা, ভোরের উড়ান
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।