“তাহলে! আপনি বলত চান যে আপনি ভুত দেখেছেন? তায় আবার সাহেব ভুত?” হালকা সুরে কথাটা ছুড়ে দিল নীলাভ।
” ভুত বা অশরীরীদের সম্বন্ধে আপনার কতটুকুই বা ধারণা আছে, মিস্টার সেন?অবশ্য এই আপনাদের মত শহুরে মানুষদের আর কি দোষ? ভুত বলতেই আপনাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওইসব বি গ্রেডের সিনেমার রাক্ষস বা কঙ্কালের মুখোশ পড়া কিছু উদ্ভট, বিকট মূর্তি।।” বিদ্রুপাত্মক ঢঙেই নীলাভের ব্যাঙ্গের জবাব দিলেন মাকলাস্কীগঞ্জের স্টেশন মাস্টার অর্যেন্দু বসাক।
নীলাভ কলকাতার ছেলে। সম্প্রতি রেলে চাকরি পেয়েছে আর চাকরিতে যোগ দেবার একমাস পরেই বদলি হয়ে এসেছে ম্যাকলাস্কীগঞ্জে। চারদিকে হালকা জঙ্গল আর দূরে সারি সারি পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছবির মতো সুন্দর এই জায়গাটা। শান্ত, নির্জন এই অঞ্চলটিতে প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। এখানে লোকজনের বসতি নেই। বেশিরভাগই নীলাভর মতো চাকরিসূত্রে এসেছে।
ও জেনেছে যে আর্নেস্ট টিমোথি ম্যাক্লাস্কি নামে এক সাহেব ১৯৩৩ সালে এই জায়গার পত্তন করেন যা তার নাম অনুসারে হয় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ|এখানে শপিং মল দূর অস্ত, একটা ভালো সিনেমাহল পর্যন্ত নেই। শহর থেকে এই নির্জন জায়গায় এসে প্রথম প্রথম নীলাভের একঘেয়ে লাগত। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয়। একদিন ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনে চলে আসে। আলাপ হয় স্টেশন মাস্টার অর্ধেন্দুবাবুর সাথে। উনারও একই অবস্থা। ছোট প্ল্যাটফর্ম, সারাদিনে কয়েকটি ট্রেন যায়। ফলে তেমন কিছু কাজ নেই। বাঙালি দেখে উনিও খুব আনন্দিত। তাই এরপর থেকে ছুটির দিনগুলোতে চলত আড্ডা, গল্প। ওদের মধ্যে রাজনীতি, খেলাধুলা সহ নানা বিষয়ে আলোচনা হতো, হতো তর্কবিতর্ক। কথায় কথায় একদিন উঠল ভুতের প্রসঙ্গ। আসলে “এরকম নির্জন জায়গায় ভুত থাকতে পারে কিনা’? – এই কথাটা হালকা চলেই ছুড়ে দিয়েছিল নীলাভ। কথাটা শুনে অর্ধেন্দুবাবু খানিক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। তারপরেই ছুড়ে দিলেন প্রশ্নটা – “আপনি ওয়াটসন সাহেবের বাংলোটা দেখেছেন?”
প্রত্যুত্তরে এরকম প্রশ্ন নীলাভ আশা করেনি। ও একটু থতমত খেয়ে গেল। তবে এটা ঠিক যে ও বাংলোটা দেখেছে। ছুটির দিনে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সেরকমই একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে বাংলোটা দেখে।স্টেশন থেকে প্রায় এক কিমি দূরে চারিদিকে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা জায়গাটা। এরকম পরিত্যক্ত বাড়ি অবশ্য মাকলাস্কীগঞ্জের এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে। তবে বাংলো না বলে এটাকে পোড়োবাড়ি বললেই চলে। চারিদিকে আগাছার জঙ্গল, বাড়ির দেওয়ালে প্লাস্টার নেই বললেই চলে, ইটের কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে যার প্রায় পুরোটাই শ্যাওলায় ঢাকা। গেটে টানানো আছে নিষেধাজ্ঞা -“এই বাড়িতে ঢোকা বারণ। নিষেধ অমান্য করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে” । দেখে কৌতূহল জাগলেও নীলাভ কিছু বুঝতে পারেনি।
তবে ওর বাড়িতে যে কাজ করে তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে যে ওটা একটা সাহেবের বাংলো ছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় সাহেবকে কেউ বা কারা গুলি করে। সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে আর কেউ ওখানে থাকে না। দুই একজন নাকি রাত কাটাতে গিয়েছিল। তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। অনেক খুঁজেও তাদের কোনই হদিস মেলেনি। তারপর থেকে সরকার ওই বোর্ডটা লাগিয়েছে লোককে বাঁচাবার জন্যে।
নীলাভ জানে এরকম নির্জন জায়গায় এমন বাংলো থাকলে ভুতের গুজব রটবেই। কিন্তু লোক দুটির অন্তর্ধানের মধ্যে তো রহস্য আছে!
অর্ধেন্দুবাবু পুরানো লোক। তাই তাকেই ও বাংলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে উনি একটা ঘটনার কথা বললেন যা থেকেই এই আলোচনার সূত্রপাত।
” সে অনেকবছর আগের কথা। আমি সবে এখানে পোস্টিং হয়ে এসেছি। আমিও এসে বাংলোটার ব্যাপারে শুনেছিলাম। লোকে বলে যে ওটা একটা সাহেবের বাংলো ছিল। সাহেবকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে আর কেউ ওখানে থাকে না।কেউ বাংলোর সামনে গেলে নাকি এক সাহেব তাড়া করে সবাইকে ভাগিয়ে দেয়। শুনে আমার খুব কৌতূহল হল। একদিন ঘুরতে ঘুরতে বাংলোটার কাছে পৌঁছলাম। দেখে মনে হয়েছিল কোনো পরিত্যক্ত বাড়ি। তখন এখানে এত লোকবসতি ছিল না। চারিদিকের জঙ্গল ছিল আরো ঘন।সূর্য অস্ত যায় যায়। অন্ধকার নামতে শুরু করছে। তবে দিনের আলো একেবারে মরে যায়নি। এদিক ওদিক দেখছি আর ভাবছি পাঁচিল টপকে ঢুকব কিনা। এমন সময় যেন কোথা থেকে একটা সাহেব আমার সামনে চলে এল। ওর হাতে ছিল একটা বন্দুক। সেটা আমার দিকে উচিয়ে জিজ্ঞেস করল ” টুমি কে আছে? এখানে কি কাজ? জাস্ট মুভ ওর আই উইল শুট!”
আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। সাহেবের পোশাক দেখেও আশচর্য হলাম। সেই ব্রিটিশ আমলের কিছু সাহেবের ছবি দেখেছিলাম, একদম সেরকম পোশাক পরে আছে। এদিকে অন্ধকার হয় হয়। একেই মনে হল সাহেব যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন। তার উপর আবার আমার শোনা গল্পগুলো মনে পড়ল। আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে দৌড় দিলাম। পিছনে ফিরে দেখার আর সাহস হল না। পাগলের মতো দৌড়াচ্ছি, দম প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এমন সময় দেখি একটু দূরে একটা লোক কয়েকটা ভেড়া চড়িয়ে ফিরছে।ওকে দেখেই একটা বিকট চিৎকার করে উঠি। তারপর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান হইতে দেখি যে একটা দাওয়ায় শুয়ে। বেশ কিছু লোক আমাকে গিরে বসে। উঠে বসতেই একজন জল দিলেন। ঘটনাটা বলতেই উপস্থিত লোকেরা আতকে উঠল -” আরে কি সর্বনাশ! আপনি তো ওয়াটসন সাহেবের পাল্লায় পড়েছিলেন। উনার আত্মা এখনো ওই বাংলোর আশেপাশে ঘোরে। ভাগ্য ভাল যে প্রাণে বেঁচে গেছেন।”
এই পর্যন্ত বলে অর্ধেন্দুবাবু চুপ করলেন। তখনই নীলাভের ওই ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন আর তার উত্তরে অর্ধেন্দুবাবুর ওই বিদ্রুপাত্মক উত্তর।
উত্তর শুনে নীলাভ একটু বিব্রত হল-” না, না! আমি ও ভাবে বলিনি। আসলে ওইরকম ভাঙ্গাবাড়িতে অনেকসময় সমাজবিরোধী কাজকর্ম হয়। কোনো দুস্কৃতী হয়ত আপনাকে ভয় দেখাতে…”
“ কোনো মানুষ সামনে এলে সে তো আচমকাই আবির্ভুত হতে পারেনা। শব্দ বা অন্য কোনো আভাস তো থাকবে। আমার কিন্ত মনে হল উনি যেন শূন্য থেকে উদয় হলেন।“ নীলাভকে কথা শেষ না করতে দিয়ে বলে উঠলেন অর্ধেন্দুবাবু।
নীলাভ চুপ করে থাকে। ও নিশ্চিত এগুলো কোনো বদমাশ লোকের কাজ। সেই ব্রিটিশ আমলের এক সাহেব এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভয় দেখাচ্ছে! এর থেকে হাস্যকর কিছু হতে পারেনা। কিন্তু আসল সত্যিটা জানতে হলে ওকে নিজে ওখানে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে হবে। তখনই এসব আজগুবি গল্পকথা বন্ধ হবে। তাই ও স্থির করল যে ওই বাংলোতে একটা রাত কাটাবেই। তবে ব্যাপারটা জানাজানি হলে বিপদ হতে পারে। তাই কাউকে কিছু বলল না। এর মধ্যে ও একবার বাংলোর সামনে গিয়ে আশপাশটা ভালো করে দেখে এসেছে।
সেদিন ছিল শনিবার। ও ‘শরীর খারাপ হয়েছে’ এই বলে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এল। কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ব্যাগে ভরে নিল যার মধ্যে ছিল মশা তাড়ানোর ধুপ, সাপ তাড়ানোর জন্যে কার্বলিক এসিড আর একটা লম্বা জোরালো টর্চ। এছাড়াও নিজের আত্মরক্ষার জন্য একটা বড় ছুরিও নিয়েছিল।
নীলাভ যখন বাংলোর সামনে এল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে।ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্চে। ও ইতিউতি দেখে পাঁচিল টপকে ভেতরে লাফিয়ে পড়ল। ঝোপঝাড়, আগাছার জঙ্গলে সাপ বা বিষধর পোকামাকড় থাকতেই পারে। তাই টর্চ জ্বালিয়ে সাবধানে হাঁটতে লাগল। দরজা ভেঙেচুরে গেছে। একটু ঠেলতে ক্যাঁচ করে খুলে গেল। ঘরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ ওর নাকে ঝাপটা মারল। চোখেমুখে মাকড়সার জাল এসে লাগল। পুরু ধুলোয় ঢাকা মেঝের উপর হেটে ও পাশের ঘরটায় গেল। ঘরের দেয়ালে একটা বিবর্ণ ছবি। সম্ভবত কোনো সাহেবের হবে। তবে ও আশচর্য হয়ে দেখল এই ঘরটা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বিছানায় পাতা চাদরটাও পাট করে পাতা।
নীলাভ সঙ্গে করে কিছু স্যান্ডুইচ নিয়ে এসেছিল। ওগুলো খেয়ে সময় কাটাতে মোবাইল নিয়ে ঘাঁটতে লাগল।তারপর কখন যে চোখ লেগে এসেছে খেয়ালই নেই ওর।
২
তখন বোধহয় মাঝরাত হবে। নীলাভের ঘুমটা ভাঙল একটা খোঁচা খেয়ে। প্রথমে ভাবল স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু কয়েকবার খোঁচা খেতেই ঘুমটা ভাঙল। ধড়ফড় করে উঠে দেখে এক সাহেব সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে বন্দুকের নল দিয়ে উনিই নীলাভকে খোঁচা দিচ্ছিলেন। নীলাভ তাকাতেই সাহেব রাগতস্বরে বললেন ” হু আর ইউ?আমার ঘরে কেন ঢুকিয়াছ? আই এম শিওর তোমার কোনো ব্যাড ইন্টেনশন আছে। তুমি ওই গুন্ডাগুলোর দলে আছো। তোমাকে ছাড়া যাবে না। আই উইল শুট ইউ।” এই বলে নীলাভের দিকে বন্দুক তাক করে হাঁক পাড়লেন “দাড়োয়ান” বলে।
নীলাভ ঘুম থেকে উঠে সাহেবকে দেখে হতভম্ব। এ কে? কোথা থেকে এল? এ কি পাগল না কোনো ছদ্মবেশী দুষ্কৃতী? এদিকে সাহেবের চিৎকারে দুজন পাগড়ি পড়া লোক ছুটে আসলে উনি ওদের নীলাভকে বাঁধতে বললেন। নীলাভ এত অবাক হয়ে গেছে যে পালাবার কথা ওর মাথাতেও এলনা। আর দুটো বলশালী লোককে বাধা দেবার শক্তিও ওর ছিল না। তাই ওকে বাঁধতে বিশেষ বেগ পেতে হল না ওদের।
নীলাভকে একটা পিলারের সাথে বাঁধা হয়েছে। সামনে বন্দুকের নল উচিয়ে সাহেব দাঁড়িয়ে। এমন সময় ওর চোখ গেল জানলা দিয়ে বাইরে আর ও দেখতে পেল বাইরে অসংখ্য আলোকবিন্দু ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা চাপা কোলাহলও কানে এল। ও কিছু বুঝতে না বুঝতেই আওয়াজটা বাড়তে বাড়তে একসময় গর্জনের রূপ নিল আর সমুদ্রের স্রোতের মত মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ল ওদের ঘরের দরজায়। লোকগুলো ঘরে ঢুকল “বন্দে মাতরম” ধ্বনি দিতে দিতে। একটা লোক চেঁচিয়ে উঠল ” ওয়াটসন! মনিদাকে ছেড়ে দাও।” সাহেব বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল ” আমি উহাকে গুলি করিয়া মারিবে।” বলে নীলাভের দিকে বন্দুক তাক করে ট্রিগার টিপতে যাবেন, এমন সময় ওই বিপ্লবীদের ছোড়া পরপর গুলির আঘাতে উনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। একজন নীলাভের হাত ধরে টানল ” মনিদা! শিগগির পালাও।”সিকিউরিটির সাথে তখন ওই বিপ্লবীদের খণ্ডযুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে কয়েকজন নীলাভের হাত ধরে দৌড় দিল বাড়ির পিছন দিকে।
তিনটে মোটরসাইকেল বাইরে দাঁড়ানো ছিল। ওরা প্রচন্ড গতিতে বাইক চালিয়ে এসে হাজির হল একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে। এদিক ওদিক দেখে ওরা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা চাপা শিস দিতেই এক প্রৌঢ় দরজা খুলল। ওরা ভেতরে ঢুকে গেল।
এসব কি হচ্ছে নীলাভের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। ওরা ভেতরের একটা ছোট ঘরে বসল। টেবিলের উপর একটি খবরের কাগজ রাখা ছিল। নীলাভ কাগজটা তুলেই চমকে উঠল। দেখল সাল লেখা আছে ১৯৪২। ও এটা কবেকার কাগজ জিজ্ঞেস করতে একজন বলল -” কেন, আজকের !” শুনে নীলাভের মাথা ঘুরতে লাগল। ওর যে সন্দেহটা এতক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটার ব্যাপারে ও নিশ্চিত হল। ওয়াটসন সাহেবের বাংলো ওকে নিয়ে এসেছে ১৯৪২ সালের ভারতে। ও টাইম ট্রাভেলের অনেক গল্প শুনেছে, বইতে পড়েওছে। কিন্তু এরকম কোনো ঘটনা যে ওর সাথে ঘটবে ও সেটা কল্পনাও করতে পারেনি।
কিন্তু ওকে সবাই মনিদা বলে কেন ডাকছে তা ও এখনো বুঝতে পারেনি। এই যুগে কি ওর মত দেখতে আরো কেউ আছে। কিন্ত তাহলে এদের ভুল তো ভাঙ্গানো দরকার। ও সামনের লোকটাকে বলল ” দেখুন! আমার নাম মনি নয়।আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আসলে সেদিন আমি ওয়াটসনের বাংলোয় গিয়ে…” পুরোটা বলতে গিয়েও নীলাভ থমকে গেল। এরা কি টাইম ট্রাভেলের গল্প বিশ্বাস করবে, না ওকে পাগল মনে করবে? এই ভেবে ও থমকে গেল, কথা শেষ করল না।
এতে সামনের লোকটি বলল” আমরা জানি মনিদা! কয়েকমাস লকাপে তোমায় উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। আর তাতে মাথায় চোট পেয়ে তোমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি ওয়াটসনের বাংলোয় ঢুকে ধরা পড়ে গেছ ঠিকই কিন্তু আমরা তো তোমার কাজ করে দিয়েছি। এখন আমাদের মিশন ওই অত্যাচারী ব্রাইট সাহেব।”
এরপর লোকটির সাথে নীলাভের কথাবার্তা চলল। নীলাভ বুঝতে পারল যে মনিদা লোকটিকে একদম ওর মতো দেখতে। বোমাবাজি, পুলিশকে পেটানো এমনকি এক সাহেবকে খুনের চেষ্টা সহ অনেক ক্রিমিনাল মামলা ঝুলে আছে ওর নামে। কিছুদিন আগেই ও লকাপ থেকে পালিয়েছে। তবে মুখের আদল এক হলেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে ওর চেহারায়, পোশাকে আর আচার ব্যবহারে।
নীলাভ প্রমাদ গুনল। ও ছোটবেলা থেকেই শান্তিপ্রিয়। কোনোদিন থানা পুলিশের ঝামেলায় থাকেনি। আর এই পুরানো আমলে এসে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ যে কিনা পুলিশের চোখে একজন সন্ত্রাসবাদী। ধরা পড়লে লকাপের মারধরের কথা ভেবে ওর মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেলে। ও কিভাবে এখন থেকে পালাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একরাতের এডভেনচারের পরিণতি যে এমন হবে তা কে জানত?।এদিকে ওর কাছে যে টাকাপয়সা আছে তা এই যুগে অচল। ও কাউকে চেনেও না যে টাকা ধার দেবে। ওকে কি শেষে না খেয়ে মরতে হবে?
লোকটা ওকে কি চিন্তা করছে জানতে চাইলে নীলাভ টাকাপয়সার কথা তুলল। লোকটা হেসে বলল ” আরে টাকার জন্যে তুমি চিন্তা করছ? আমাদের কেন লজ্জা দিচ্ছ বলতো? “এই বলে নীলাভের হাতে কিছু নোট ধরিয়ে দিল। তবে পইপই করে বলে দিল যে বেরবার আগে ও যেন ছদ্মবেশ ধরতে না ভোলে।
সেইমত ভোল বদলে পরদিন সকালে নীলাভ খেতে বেড়িয়েছে। বাইরে বেরোলেই কানে আসে ” বন্দে মাতরম ” চিৎকার। সবসময় চলছে মিছিল, পুলিশের ধরপাকড়। মাঝে মাঝে গুলির আওয়াজ, আর্তনাদ কানে আসে। সবমিলিয়ে এ এক উত্তাল সময়।
হোটেলে খাওয়া শেষ হলে কত হয়েছে জিজ্ঞেস করতে জবাব এল ” আট আনা”। নীলাভ বিষম খেল। ভুল শুনেছে ভেবে জিজ্ঞেস করতে একই জবাবে পেল। সাথে এল জবাব ” যুদ্ধের বাজারে জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।”
নীলাভ যখন রাস্তায় নেমে এল তখনো ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। কে জানে আরো কত বিস্ময় ওর জন্যে এই যুগে অপেক্ষা করে আছে!
এভাবেই দিন কাটছিল।ওর সঙ্গীরা সাবধান করে দিয়েছে যে পুলিশ ওদের বিশেষ করে মনিকে পাগলের মত খুঁজছে। ও যেন বাড়ির বাইরে বেশি না বেরোয়। এদিকে বাড়িতে সারাদিন বসে থাকতে থাকতে নীলাভ হাঁফিয়ে উঠেছিল। অবসরের সঙ্গী হিসেবে ছিল একটা বড় রেডিও আর কিছু গল্পের বই। কিন্ত রেডিওতে সেই সাদা কালো যুগের গান বাজে। খবরে শোনা যায় নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছেন জাপানের সহায়তায়। সেই বাহিনী বর্মা থেকে আসছে ভারতকে স্বাধীন করতে। ও গান্ধীজীর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপারেও নানা খবর পেত। একদিন শুনতে পেল গান্ধী ও নেহেরু গ্রেপ্তার হয়েছেন। শুনে রোমাঞ্চিত হয় নীলাভ। ভাবে কখনো কি চাক্ষুস করতে পারবে এদের? তাহলে ২০১৮ এয় ফিরে বন্ধুদের গল্প করতে পারবে যে আমি সেই ভাগ্যবান যে ইতিহাসের এই চরিত্রদের দেখেছে।
এদিকে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে প্রতিনিয়তই ওরা রাতের অন্ধকারে ঘর বদল করত। বাড়িতে চলত ব্রাইট সাহেবকে মারার প্রস্তুতি। বিভিন্ন জায়গা থেকে চর মারফত খবর আসত আর সেই অনুসারে চলত প্ল্যান বানানো।
নকশা প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু পুলিশের কানে কিভাবে যেন ওদের গোপন আস্তানার খবর পৌঁছল। একদিন রাতে ওরা জানতে পারল ওদের বাড়িটিকে পুলিশ চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। শুনেই নীলাভের গলা শুকিয়ে গেলে। ওই সঙ্গী বিপ্লবীরা বলল ” পিছনের গেট দিয়ে পালাতে হবে। আর যদি মরতেই হয় তো কয়েকটাকে মেরে তবে যাব।” এরপর সবাই সমস্বরে বলে উঠল “বন্দে মাতরম।“ কিন্তু ওরা পিছনের দরজায় এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই পুলিশ এসে হাজির হল সেখানে। পুলিশ প্রথমে চিৎকার করে ওদের সারেন্ডার করতে বলল। কিন্তু তা না শোনায় গুলি চালাতে লাগল। বিপ্লবীরাও পাল্টা জবাব দিতে থাকল। নীলাভকে কভারে রেখে চলছিল ক্রসফায়ারিং। আচমকাই নীলাভের সামনের লোকটির গায়ে গুলি লাগল। সে ‘বন্দে মাতরম’ বলে লুটিয়ে পড়ল আর পুলিশের নজর গিয়ে পড়ল নীলাভের উপর। পুলিশ দেখে ও ভয়ে দৌড়ে পালাতে গেল। পরমুহূর্তে দুটো গুলির শব্দ আর মনে হল ওর শরীরে কে যেন গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে। পিঠটা রক্তে ভিজে উঠল। নীলাভ চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। আর এগোতে পারল না, সামনে মুখ থুবড়ে পড়ল। চেতনা হারাবার আগে শুনতে পেল ভারী বুটের আওয়াজ আর ” মনিদা! মনিদা!” বলে চিৎকার। কিন্তু শব্দগুলো ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গেল আর নীলাভ যেন কোন অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে গেল।
৩
কে যেন নীলাভকে ধাক্কা দিচ্ছিল। ও বুঝে উঠতে পারছিল না যে ও বেঁচে আছে না মরে গেছে। চোখে আলো পড়তে ও চোখ মেলল। চোখ মেলতেই দেখে কিছু দেহটি মানুষের মুখ। ও চোখ মেলতেই তাদের একজন বলল ” হোস আ গিয়া লাগতা হ্যায়। মাস্টার কো বুলাও কই জলদি।”
কি হয়েছে নিজ্ঞেস করতে ওই লোকগুলো বলল যে ওদের মধ্যে কয়েকজন এদিকে ছাগল চড়াতে এসে নীলাভকে মাঠের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে। কাছে এসে দেখে ও বেঁচে আছে। তখন ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেয় আর কিছু বন্য লতাপাতা পুড়িয়ে শোকায়। নীলাভের মনে পড়ল দুটি গুলি ওকে ফুঁড়ে দিয়েছিল। এরপর তো ওর আর বেঁচে থাকার কথাই নয়। আর ও এই মাঠেই বা এলো কথা থেকে?
এমন সময় ও দেখতে পেল অর্ধেন্দুবাবুকে। হন্তদন্ত হয়ে এদিকেই আসছেন। ওকে দেখেই চিৎকার জুড়লেন ” আরে মশাই! কোথায় গায়েব হয়ে গেছিলেন বলুন তো? কয়েকদিন ধরে আপনাকে নিয়ে যা তোলপাড় হচ্ছে! আমি তো চাকরি বাদ দিয়ে থানা পুলিশের চক্কর কাটছি। পেপারেও তো বেড়িয়েছে আপনার নিখোঁজ হবার খবর।আপনার মা, বাবাও চলে এসেছেন। বুড়ো মানুষগুলো চিন্তায় যেন আধমরা হয়ে আছেন। আগে আপনার বাড়িতে চলুন। ওখানেই সব শুনবো।”
বাড়িতে ফিরে নীলাভ মা বাবাকে বলল যে ও কদিনের জন্যে ঘুরতে গিয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় ফোন করতে পারেনি। কিন্তু আসল কথাটা অর্ধেন্দুবাবুকে খুলে বলল। শুনতে শুনতে উনার তো চোখ ছানাবড়া। ” মশাই! করেছেন কি? আপনি তো টাইম ট্রাভেল করে এসেছেন। আপনার মত ভাগ্য কজনের হয় বলুন তো? তা নেতাজি, গাঁধী এদের দেখলেন নাকি সামনা সামনি?”
ও ঘাড় নেড়ে না বলল। এরপর মনির ব্যাপারে জিগ্গেস করতে উনি বললেন ” দাঁড়ান ! মনি বলতে মনে হয় মনিলাল মুখার্জীকেই বোঝাচ্ছে। ও ছিল পুলিশের আতঙ্ক। বোমাবাজি, খুন সহ অনেক অভিযোগ ছিল ওর নামে। পুলিশ ধরলেও কিভাবে যেন পালিয়ে যেতে লক আপ থেকে। ওয়াটসনকে খুন করতে লুকিয়ে ওর বাংলোয় ঢোকে। কিন্তু ধরা পড়লেও ওর বিপ্লবী সাথীরা ওকে বাঁচিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পরে ওই মণি মুখার্জী পুলিশের সাথে একটা এনকাউন্টারে মারা যায়। পুলিশ কিভাবে যেন ওদের গোপন আস্তানার খবর পেয়েছিল। ”
নীলাভের অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে উনি বলে উঠলেন ” আপনি ঠিকই ভাবছেন। আপনি যখন ওয়াটসনের বাংলোয় রাত কাটাতে যান তখন ওই মনিলালের আত্মা আপনার উপর ভর করেছে। হয়ত চেহারার সাদৃশ্যের কারণে।সেই আপনাকে ওই যুগে নিয়ে যায়। আর হ্যাঁ, আপনি ওই পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন বলেই এই যুগে ফিরতে পারলেন। না হলে সারাজীবন ওখানেই কাটাতে হত। যে দুজন ওখান থেকে অন্তর্হিত হয়েছে তারা হয়ত আপনার মতোই ওই যুগে চলে গিয়ে আর ফিরতে পারছে না।” নীলাভ শিউরে উঠল। তাহলে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়ে শাপে বর হয়েছে। না হলে কে জানে হয়ত এই সময়ে ওর আর ফেরাই হত না।
অর্ধেন্দুবাবু আচমকা বলে উঠলেন ” আরে! আমার কাছে তো ওই মনিলালের একটা ছবি আছে, অবশ্য আঁকা ছবি। আসলে ও অনেকদিন ফেরার থাকাতে পুলিশ ওর হুবুহু একটা স্কেচ আকিয়েছিল। আমার বুড়ো চাকরটার বাবা ওই ওয়াটসনের বাংলোয় কাজ করত। ওয়াটসন মারা যাবার পর ওর বাড়ি থেকে যখন জিনিসপত্র সরানো হচ্ছে, তখন সে ওটা চেয়ে নেয়। আসলে উনি এই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বড় ভক্ত ছিলেন। দাঁড়ান, আনছি।” এই বলে উনি ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। একটু পরে ঘর থেকে একটা বড় তৈলচিত্র নিয়ে বেরিলেন। নীলাভ দেখে চমকে উঠল। এ যেন ওকেই কেউ এঁকেছে।
নীলাভ চিন্তা করতে থাকল – অন্যদের মত ওয়াটসনের বাংলোয় ওকে ঢুকতে তো কেউ বাধা দেয়নি। কেন? ওখানে ওর রাত কাটানোর পেছনেও কি ছিল কোনো অদৃশ্য ইছাশক্তি? ও উত্তর হাতড়াতে থাকে, কিন্তু খুঁজে পায়না।
ও ভাবতে থাকল এখম আমরা যে স্বাধীনতা ভোগ করছি তা এরকম কত মনিলালের রক্তের বিনিময়ে এসেছে। এরা নিজের পরিবার,নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে দেশের মানুষের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছিল। আর এই নিঃস্বার্থ নিবেদনের ফল দেশের এই স্বাধীনতা। অগ্নিযুগের ওই বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধায় ওর মাথা নুয়ে এল। মনে মনে স্যালুট করল ছবিটাকে। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ” জয় হিন্দ।”
(এই গল্পের সব চরিত্র এবং ঘটনাই সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে এর কোনোরকম যোগাযোগ নেই)
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।