এতক্ষণ পাশের ঘরেই ছিলাম । তৃষা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে । অন্তত আমার তাই মনে হয় । বেশ খানিকটা হুইস্কি খেয়ে এমনিতেই কিছুটা বেসামাল ছিলো । সেই সুযোগে ওর গেলাসে খুব সন্তর্পনে আমি মিশিয়ে দিয়েছিলাম যত্নে রাখা সেই সাদা গুঁড়ো । সেই গেলাসটা নিশ্চিন্তে একটু একটু করে শেষ করার পর তৃষা ঘুমিয়ে পড়লো, গভীর ঘুম, একেবারে অকাতরে । ওর বুকটা খু্ব ধীরে ধীরে ওঠানামা করছিলো । মনে হয় আর কিছুক্ষণ , তারপরেই ও স্থির হয়ে যাবে , চিরকালের মতো । আমি নিশ্চিত । একেবারে নিঁখুত একটি খুনের পরিকল্পনা । আমার এই সাহস এবং কৃতিত্বে আমি নিজেও কিছুটা অবাক হয়ে গেছি । মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি । শুধু ভাবছি যে-আমি কোনোদিন জোরে একটা কথা বলিনি , কখনো কাউকে একটা চড় পর্যন্ত মারিনি সেই আমি কেমন করে ঠান্ডা মাথায় একটি হাড়হিম করা খুনের পরিকল্পনাই শুধু নয় , তাকে নিঁখুতভাবে বাস্তবায়িত করে এই মুহূর্তে পাশের ঘরে এসে সোফায় বসে সিগারেটে লম্বা টান দিচ্ছি ।
কিন্তু কেন আমি হঠাৎ ফাঁকা বাড়িতে রাত দশটার সময় তৃষার হুইস্কির গেলাসে সেই সাদা গুঁড়োগুলো মিশিয়ে দিলাম । ঠিক করেছিলাম দুজনেই নিজের নিজের গেলাস হাতে নিয়ে দশ বছর পরে আমাদের দেখা হওয়াটা ভালো করে সেলিব্রেট করার জন্যে একদম নিট গলায় ঢালবো । তাই করলাম । সেই মুহূর্তে আমার মনের তোলপাড় বা চোখের তারায় ফুটিয়ে তোলা সরল দৃষ্টি দেখে তৃষার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিলোনা আমার আসল মতলব । একটু একটু ভয়ও করছিলো । ও যদি কিছু সন্দেহ করে বসে কী হতে পারে । কিন্তু কিছুই হলনা । নিজের সফল অভিনয়ে আমি নিজেই অবাক। বুঝতে পারছি তৃষা এখন ঘুমোচ্ছে এবং হয়তো আর কোনদিন জাগবেনা । আর যদি বরাতজোরে সে বেঁচে যায় তাহলেতো আমার ফন্দিটা ধরে ফেলবে । আমার বহু যত্নে গড়ে তোলা সুন্দর, মার্জিত চেহারার ভেতরে গুটিয়ে থাকা ভীষণদর্শন একটা জন্তুকে দেখতে পেয়ে যাবে । তারপর হয়তো ভয়ে কেঁপে উঠবে অথবা চিৎকার করে বলবে — ” ছি:, তুমি এইরকম জঘন্য এক ভয়ঙ্কর অমানুষ ?” এইসব ভাবতে ভাবতে একবার মনে হলো ওর নাকটা আমার আঙ্গুল দিয়ে এমনভাবে চেপে রেখে দেবো যাতে ও কোনোভাবেই বাঁচতে না পারে ।
সবকিছু আমাকে শেষ করতে হবে কাল সকালে নন্দিতা আসার আগেই । নন্দিতা আমার স্ত্রী । সুন্দরী , করিৎকর্মা ও সবসময় সুসজ্জিতা । ফিগার ঠিক রাখার জন্যে সে রীতিমতো সাধনা করে । সেটা তার পেশার কারণেও বটে । নন্দিতা একজন অভিনেত্রী । আউটডোর শুটিংএ একসপ্তাহ আগে গেছে দুমকা । কাজ শেষ । আজকে ফোনে জানালো আগামীকাল সকালে বাড়ি ফিরবে । তারপর থেকেই তৃষার ব্যাপারে আমাকে একটা প্ল্যান করতেই হলো তড়িঘড়ি এবং অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই । আমি তখন শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম আমার ফাঁকা বাড়িতে আমি আর তৃষা , সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে নন্দিতা । উঃ কী সাংঘাতিক । কী জবাব দেবো। কেমন করে তাকে বোঝাবো যে এতবছর বাদে তৃষার পক্ষে আমার ঠিকানা জানা , তারপর কিছু না জানিয়ে বাড়ি খুঁজে হঠাৎ চলে আসা নিছক কাকতালীয় । আমি কিছু জানতাম না, তাকে আসতে বলার কোনো প্রশ্নই নেই । নন্দিতা যেদিন তার ইউনিটের লোকজনের সঙ্গে শুটিং করতে বেরিয়ে গেলো , ঠিক তার পরের দিন হঠাৎ তৃষা এসে হাজির । আমি অবাক ।অফিস থেকে ফিরে বাড়িতে আমি একা । হ্যাঁ , একথা অস্বীকার করবোনা যে কিছুক্ষণ কথা বলার পর তৃষা যখন সেদিন থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করলো, আমি রাজি হয়ে গেলাম আর এও বললাম যে সে কয়েকদিন থাকতে পারে । তার যদি অসুবিধা না হয় আমার আপত্তি নেই। শুনলাম সে এখন ডিভোর্সি । লক্ষ্য করলাম সে এখনো আগের মতই সুন্দরী ও অপ্রতিরোধ্য । বুঝলাম আমার মুখোশের আড়াল থেকে সেই জন্তুটা একটু একটু করে জেগে উঠছে ।
তৃষা এসেছিলো সন্ধ্যার পর । কাজের লোকদের ছুটি আগেই দেওয়া ছিলো । এইরকম মাঝে মাঝেই করি যখন নন্দিতা বাইরে শুটিং করতে যায় । কাজেই ফাঁকা বাড়িতে আমি আর তৃষা ।কয়েকদিন ভালোই কাটালাম । তারপর একদিন সে তার বিগত দশবছরের ফেলে আসা জীবনের ইতিবৃত্ত একটানা বলে যাচ্ছিলো। আমি তাকে বলে যেতে দিলাম । যাখুশী বলুক । ইচ্ছে করেই ঘরের আলো জ্বালিনি । তৃষা শেষ পর্যন্ত একটু হেসে দম নিলো । তারপর সে বেশ হিসেব করেই তার মোক্ষম তীরখানি আমায় ছুঁড়ে মারলো । ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে সব কাগজপত্র এখনো আছে। অবশ্য শুধু নোটিসটা । শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর রেজিস্ট্রি হয়নি । কিন্তু তাতে কী ? তারপরও তো দুজনে কতো গোপন ডেরায় রাত কাটিয়েছিলাম । কতো প্রতিশ্রুতি , কতো স্বপ্ন একসাথে দেখতে শুরু করেছিলাম । তারপর একদিন তৃষাকে কিচ্ছু না জানিয়ে আমি পালিয়ে গেলাম । আমাদের একসাথে মাঝে মাঝে থাকার সব প্রমাণ তার কাছে আছে । এবার সে এসেছে এবং নন্দিতাকে সব বলবে ।
সেই প্রায়ান্ধকার ঘরের ভেতর এরপর আমরা দুজনে কতক্ষন বসে ছিলাম জানিনা । তৃষা হয়তো ভাবছিলো তার জীবনটা যখন ছারখার হয়েই গেছে তখন আমাকেও সে নিশ্চিত সুখের মধ্যে থাকতে দেবেনা । আর আমি ভাবছিলাম আমার অভিনেত্রী স্ত্রী নন্দিতা আর আমার সযত্নলালিত পারিপাট্যে সে ফাটল ধরাতে এসেছে । প্রতিশোধ । বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা কেউ কোনো কথা বলছিলাম না । নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হঠাৎ তৃষা বলে উঠলো, — ‘ কেন আমাকে ঠকালে ? কেন আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলে ?
অনেক অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত আমিও একজনকে বিয়ে করেছিলাম । তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা জানাজানি হয়ে যাবার পর থেকে অপমানে আর তীব্র লাঞ্ছনায় আমার জীবন সে যন্ত্রণার বোঝা বানিয়ে দিলো । অনেক ধৈর্য ও জোড়াতালি দিয়েও সে জীবন বেশিদিন চালানো যায়নি । তাই বছর দুয়েকের মধ্যেই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম । আমার এই পরিণতির জন্যে একমাত্র তুমিই দায়ী। আমি অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি । এবার নন্দিতাকে সব জানাবো । বলবো আমার সঙ্গে সব সম্পর্ক তুমি কেমন করে চুকিয়ে তোমার অতীতকে গোপন করে তাকে নিয়ে সুখের নীড় বেঁধেছো ।’
এই কথার উত্তরে আমি অনেক কিছু বলতে পারতাম । বলতে পারতাম ‘ তৃষা তুমি বাইরে থেকে যা দেখছো , যা শুনেছো তার সবটাই সত্যি নয়। আমি যখন নন্দিতাকে বিয়ে করি তখন সে কিছুই ছিলোনা । সে এমন পরিবারের মেয়ে যে তাদের দুবেলা অন্নসংস্থান হতোনা। কিছু রোজগারের তাগিদে সে অফিসক্লাবে নাটক করতে আসতো । সে ছিলো অতি সাধারণ। তার সঙ্গে আলাপ ও কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হবার পর মনে হয়েছিল একে বিয়ে করে ঘর বাঁধলে আমি নিরাপদে থাকবো কারণ এর জীবনে আমার অস্তিত্ব খুব মূল্যবান হয়ে উঠবে। তৃষা, আজ আমার স্বীকার করতে কোনো কুণ্ঠা নেই যে তোমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক সত্ত্বেও আমি নিজেকে ঠিক খুঁজে পেতামনা । জীবন সম্বন্ধে তোমার গভীর অনুভূতি আমি কিছুই বুঝতে পারতামনা । তোমার বৌদ্ধিক উচ্চতা আমাকে ভয় পাইয়ে দিতো । আমি অসহায় বোধ করতাম । সেদিক থেকে নন্দিতা ছিলো খুব সাধারণ, আটপৌরে । আমার সহজ নাগালের মধ্যে । অবশ্য সেই নন্দিতা আর আজকের নন্দিতার মধ্যে আকাশপাতাল পার্থক্য। আমাদের বিয়ের কিছুদিন পরে সে এক প্রযোজকের নজরে পড়ে গেলো। একটা দুটো ছবি হিট করার পর এখন আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়না । অবশ্য এতটা সাফল্যের জন্যে তাকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে বা হচ্ছে সেসব আমি জানিনা বা জানতে চাইনা । শুধু দেখি তার চেহারায় জেল্লা ক্রমশ বাড়ছে এবং পয়সা আসছে প্রচুর । আমার জন্যে তার আর সময় নেই। আমি একাই , মাঝে মাঝে খুব অসহায় বোধ করি ।’
আমার আর নন্দিতার কোনো সন্তান নেই। বাড়িতে দুজন কাজের লোক নিয়ে আমাদের সংসার । মাঝে মাঝে তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় ,যেমন এখন কয়েকদিনের জন্যে তাদের ছুটি দিয়েছি । তখন খাবার আসে বাইরে থেকে। না, কোনো সাধারণ হোম সার্ভিস থেকে নয়। আসে একটি নামকরা রেস্তোরাঁ থেকে কারণ এর সাথে এ বাড়ির স্ট্যাটাস জড়িত। বাড়িতে কখনো কখনো প্রযোজক, পরিচালক ইত্যাদির নিমন্ত্রণ ও খানাপিনা হয়। ভালো না লাগলেও আমি নিজেও সেখানে থাকি। সেটা যতটা সৌজন্যের খাতিরে ততটা মনের তাগিদে নয়। যে নন্দিতা একদিন আমার জন্যে হাপিত্যেশ করে অপেক্ষায় থাকতো, এখন তার বৈভবসমৃদ্ধ জীবনে আমার জন্যে সেই জায়গাটা আর নেই বুঝতে পারি।
তার সঙ্গে আলাপের পর আমি কিন্তু তাকে তৃষার কথা সব বলেছিলাম। সে এখনো হয়তো বিশ্বাস করে যে তৃষার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই আমার। দশবছর হয়ে গেলো। ইদানিং অর্থাৎ যখন থেকে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সে দোলায়িত হতে শুরু করলো, তখন থেকেই তার জীবনে একটু একটু করে আমার ভূমিকা হয়ে গেলো গৌণ , তারপরও সে আমাকে তৃষার প্রসঙ্গ টেনে অহরহ সন্দেহ করতে শুরু করলো ।
আমি চুপ করে থাকি। আমি তাকে অনেক কঠিন কথা বলতে পারতাম । বলিনা । আমার কানে অনেক কথাই আসে। শুনেছি পরিচালক দীপক মালহোত্রার সঙ্গে তার মাখামাখি নিয়ে নাকি ইন্ডাস্ট্রি মহলে কান পাতা যায়না । লক্ষ্য করেছি বাড়িতে সে প্রায় প্রতি রাতেই এ্যালকহলের মাত্রা বাড়িয়ে চলে এবং বেশিরভাগ সময় একা একা ।
আমাদের মাঝখানে ক্রমশঃ একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও সে দেয়াল সরাতে পারিনি । কাছাকাছি তবু আমাদের অবস্থান বহুদূরে ।
সেই নন্দিতা খবর দিয়েছে সে কাল আসছে ।
আমি ভাবছি আমার কি মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল । এই যে কিছুক্ষণ আগে আমি পাশের ঘরে তৃষাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করে ফেললাম সেটা কেমন করে ঘটে গেলো নিজেই বুঝতে পারছিনা। এর কী সাংঘাতিক পরিণতি হতে পারে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। ধরা যাক আমার প্ল্যান অনুযায়ী তৃষার ঘুম আর কখনও ভাঙলো না তখন সেই লাশ আমি কোথায় সরাবো ? মনে মনে চমকে উঠলাম । অল্প কিছুটা আগের জীবন্ত মানুষটি যে একদিন আমার প্রেমিকা ছিলো সেই তৃষাকে এখন লাশ ভাবছি । তাকে এখন কোথায় রাখি। কোথায় লুকিয়ে রাখবো এই গোপন পাপ । লোক জানাজানি হবে , আসবে পুলিশ , আদালত, বিচার — উঃ একি করে ফেলেছি!
আসলে ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে গেলো । দশবছর পর আমার ফাঁকা বাড়িতে তৃষাকে দেখে তার সঙ্গে কয়েকটি দিন কাটানোর ভীষন ইচ্ছে হলো। সে এককথায় রাজি হয়ে গেলো । বাড়িতে আমি একা এবং লোকলজ্জার ধার সে ধারেনা । কয়েকদিন বেশ ভালোই কাটলো কারণ আমরা কেউ কোনো পুরোনো কথা আলোচনাই করিনি । ভাবলাম এবার সে নিজেই চলে যাবার কথা বলবে । কিন্তু সে হঠাৎ বলে বসলো এখন সে যাচ্ছেনা কারণ নন্দিতার সঙ্গে তার দেখা হওয়াটা খুব জরুরী । আমরা দুজনেই একটু বেশি পান করে ফেলেছিলাম । আমাদের কথাবার্তায় উত্তেজনা বাড়ছিলো।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, — না, তুমি আজই চলে যাবে । ‘
তৃষার কণ্ঠস্বর একটুও কাঁপলোনা । সে বললো,
— আমি একটা হিসেব মিলিয়ে তবে যাবো ।
হঠাৎ গর্জন করে উঠলো,
— কী ভেবেছিলে তুমি , কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলে আমি আর কোনোদিন খুঁজে পাবোনা তোমাকে ?
এই মুহূর্তে তার সুন্দর মুখের ওপর গানিতিক চোখের ভাষা পড়তে আমার ভুল হয়নি । ওর গর্জনের কাছে আমার অস্ফুট উচ্চারণ নিজেই
শুনতে পাচ্ছি না । আমি চুপ করে রইলাম । সেই মুহূর্তে ওর সুন্দর মুখটা বিভৎস লাগছিলো, যেন এক বিষধর সর্পিনি এখনি ঢালবে তার বিষ। আমি শিউরে উঠলাম । আমাকে সে রীতিমতো শাসালো , আমার মুখোশ সে খুলে দেবে । আমি বুঝতে পারছি তিল তিল করে তৈরি করা আমার এই নিরাপদ জীবন , মোটা মাইনের চাকরি, প্রতিপত্তিশীল বন্ধুবান্ধব , সামাজিক সন্মান , সুন্দরী স্ত্রী , পুষ্টিকর ভোজন , পরিপাটি সাজানো বিছানা এসব সে সহ্য করতে পারছেনা । এসবের ওপর সে বিষ ঢালবে ।
এই পরিস্থিতিতে কাল সকালে নন্দিতা আসছে।
আমার মাথার মধ্যে ওলটপালট । কিছু না ভেবেই ঠিক করলাম যেমন করে পারি তৃষাকে সরাতে হবে । আমার মাথায় আগুন জ্বলতে লাগলো । কোনো শুভবুদ্ধি কাজ করছিলো না । না হলে অনেক বছর আগে যাকে ভালোবেসেছিলাম, যে আমার এতো প্রিয় ছিলো, তার হৃদয়ের স্পন্দন চিরকালের মতো স্তব্ধ করে দেওয়ার এই আয়োজনে আমার একটুও হাত কাঁপলোনা ।
আমি আর বেশী ভাবতে পারছিনা । পাশের ঘরে শুয়ে আছে তৃষা । আমাদের নতুন করে দেখা হওয়াটা সেলিব্রেট করার ভান করে তাকে একটু আগেই আমি নিজের হাতে বিষ দিয়ে এলাম ।
ভোর হয়ে আসছে । একটু পরেই এসে যাবে নন্দিতা । এখন আমার কী করা উচিত? আমি কি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবো ? একজন ফেরারী আসামীর মতো পালিয়ে পালিয়ে থাকবো ? অথবা নন্দিতা এলে তাকে সবকথা খুলে বলবো । লাভ হবেনা । সবকিছু শোনার পর সে হয়তো একটা নির্লিপ্তভাব দেখিয়ে মুচকি হাসবে । বলবে, — ‘এ আর এমন কী ব্যাপার? তোমার কাছ থেকে আমি বা তৃষা কেউই কোনো সততা আশা করিনি । মেরুদণ্ডহীন স্বার্থপর । ‘ কিম্বা হয়তো এসব কিছুই বলবেনা । কারণ এতো সব শোনার মতো তার মন বা ধৈর্য বা অনুভূতি কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই । আর তৃষা ? সব জাগতিক অনুভূতির বাইরে সে এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছে । জীবনের কোনো টানাপোড়েন তাকে স্পর্শ করবেনা । আমার এই মুহূর্তের একটাই ভাবনা সকাল আটটা বাজতে আর কতো দেরি।
তখন নন্দিতা আসবে ।
ঠিক পাশের ঘরে শুয়ে আছে তৃষা । আমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি । এই ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবেনা ।
ঠিক এই সময়ে বেজে উঠলো ডোরবেল। একবার , দুবার , তিনবার । পাশের ঘরে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে তৃষা । একটি নিঁখুত খুন ।
সেই দরজা সামান্য ফাঁক করা আছে । সেখানে থেকে কোনো আওয়াজ আসছেনা । সব নিঝুম। মনে হচ্ছে এখানে কখনো কেউ আসেনি এবং ছিলোনা ।
এই একটা ঘরে দরজার ভেতরে মৃত তৃষা , ওদিকে দরজার বাইরে অপেক্ষায় নন্দিতা আর দুয়ের মাঝখানে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি ।
আবার বাজলো ডোরবেল । একবার, দুবার, তিনবার — বারবার বেজেই চলেছে।
ভাবছিলাম আমার এখন কী করা উচিৎ । পেছনে একটা দরজা আছে যেখান দিয়ে পালিয়ে যেতে পারি । কিন্তু সেভাবে তো বাঁচতে পারবোনা । আমার মাথাটাই কাজ করছেনা । সেই মুহূর্তে আমার দৃষ্টিপথে টেবিলে রাখা ঘুমের ট্যাবলেট ভর্তি একটা শিশি যা ইদানিং আমার শোবার আগে একটা করে খেতে হয়। সেই শিশিটা এখনও প্রায় ভর্তি । খুব শান্ত ভাবে আমি তার সবগুলোই একটা গেলাসে অল্প জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম । হাতে শক্ত করে ধরে রইলাম ।
এবার আমি কী করবো ? আমার একদিকে একটি মৃতদেহ আর অন্যদিকে এক জীবন্ত মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে । একজন বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষায় আর অন্যজনের সবকিছু শেষ, সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। এইরকম একটি জীবন আর একটি মৃত্যুর মাঝখানে আমি একটা সেতু যে মৃত নয় আবার মানসিকভাবে জীবিতও নয় । আমি ঘরের ভেতর চুপচাপ দাঁড়িয়ে , হাতে আমার অব্যর্থ মৃত্যুবান ।
* *
শুনতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে কেউ বলে যাচ্ছে ,—– তন্ময় , তুমি কি এখনো ঘুম থেকে ওঠোনি? আমি তখন থেকে দাঁড়িয়ে ।
এবার দরজায় ধাক্কা , জোরে জোরে । একবার, দুবার , বারবার ।
সব আওয়াজ আস্তে আস্তে বহুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ।
আমি দরজা খুলতে পারছিনা…
Tags: অনিলেশ গোস্বামী, গল্প, সমান্তরাল
email:galpersamay@gmail.com
সুদীপ বসু on March 24, 2020
রীতিমত বানানটা দুইবার “রিতিমত” দেখলাম (৩ প্যারা এবং ১২ প্যারা সম্ভবত) … সম্পাদনা হলে ভালো হয় … গল্পটায় অন্তরমুখী আবেদন ার একটু ঋজু হবার সম্ভাবনা ছিলো … সুবসু
admin on April 14, 2020
পাঠক সুদীপ বসুকে ধন্যবাদ।…গল্পের সময়।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।