[ক ]
“চা কি খাবো না আমরা? …
আমরা কি চা খাবো না??”
খবরের চ্যানেলে সম্প্রচারিত এই বৈপ্লবিক আহ্বান শুনে শুরুর সেদিন-ই রক্ত একেবারে টগবগ করে উঠেছিল কন্দর্পবাবুর।
সে’সব অবশ্য অনেক দিন আগের কথা।
বাজারে করোনা বা COVID-19 এর খবর তখন নতুন-নতুন এসেছে। আমাদের এলাকার পথে ঘাটে, দোকান-পাটে তখনও লোকে পাইকারি রেটে ভাইরাস ছড়াতে আরম্ভ করেনি। তবে দেশ জুড়ে ‘লক-ডাউন’ঘোষণা হয়ে গেছে।
কিন্তু সে-ই দৈববাণী শোনা অবধি কন্দর্পবাবু দোর্দন্ডপ্রতাপ হয়ে উঠেছেন। কিচ্ছু মানছেন না। হ্যাঁ, এখনও। মুখে-পরার মাস্ক কে নাক-মুখ ছাড়া অন্য যে কোন জায়গায় (অধিকাংশ সময়ে মুখের প্রতিবেশী এলাকা গুলোতেই ) পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও-সখনও আবার বুক-পকেটে-ও ঝুলতে দেখা গেছে। তার উপর সে-ই মাস্ক-ও এমন যে পুরোনো মশারী লজ্জা পাবে। কেউ কিছু বলতে আসলে অনেকদিনের অব্যবহৃত শার্টে জমা ধুলোর মত স্রেফ ঝেড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি নাকি জীবনে অনেক কঠিন সময়, ভয়ানক পরিস্থিতি দেখেছেন; সুতরাং, কাউকে, কিছুকে ভয় করেন না।
সে যা-ই হোক, কিন্তু রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শুধু নয়, কন্দর্পবাবু আজকাল যেখানে যাচ্ছেন, জমিয়ে আড্ডা মারছেন। ডেকে ডেকে লোক জড়ো করছেন এবং তাদেরও ভুল বোঝাচ্ছেন। সাত-সকালে ‘ঘরে কিছু খাবারনেই’ দোহাই দিয়ে বাজারে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনিতে হাড়-কৃপণ, কিন্তু এখন বাজার করার সে কি ধুম! তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে পাড়ার ওষুধের দোকানে ‘খুব দরকারী’ ওষুধ আনতে গিয়ে আষাঢ়ে গল্প করতেও ভুলছেন না। শেষে দুটো ভিক্স ট্যাবলেট কিনে ঘরে ফিরছেন। এই হল তার ‘জরুরী’ ওষুধ।
এদিকে এলাকায় সংক্রমণ দিন-দিন বেড়ে-ই চলেছে। দেশের অবস্থা তো আলাদা-ই।
কন্দর্পবাবু সব জানেন। তিনি মূর্খ নন। অন-পেপার অন্তত। কিন্তু তিনি কিভাবে যেন জেনে ফেলেছেন, তার করোনা হবে না। আর তার হ’লে সবার-ই হবে। হোক।
তা-ই বলে “চা কি খাবো না আমরা? …”
[ রো ]
রোহন ওরফে আমাদের ভুতো অবশ্য কন্দর্পবাবুর এই আচরণ নিয়ে বেশ চিন্তিত। প্রথমে ভেবেছিল যে পুলিশে রিপোর্ট করবে। কিন্তু নিজের নাম জানাজানি হতে পারে। তার উপর বাড়িতে জানলে অশান্তি হবে। তাছাড়া সে নিজে যত-ই মাথামোটা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত একজন পরিচিত আধা-বয়স্ক লোকের নামে রিপোর্ট করতে-ও বাধে।
কিন্তু কাল যখন সে দোতলার বাড়ির বারান্দা থেকে মাস্কবিহীন কন্দর্পবাবুকে কোথা-থেকে-জানি কেনা তেলেভাজা খেতে খেতে আর গুনগুন করতে করতে বাড়ি ফিরতে দেখল, তার সাংঘাতিক মাথা গরম হয়ে গেল। সে এবং তার বন্ধুরা যে এভাবে ঘরে বসে বসে দিনের পর দিন বোর হচ্ছে, এই যে ক্রিকেট খেলা বন্ধ, এই যে দেবর্ষি কতদিন ধরে কোন জ্যান্ত মেয়ে সামনাসামনি চাক্ষুষ করেনি, এই যে ‘পচার দোকানের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’গানটা লেখার সময় হতে চলেছে, আর বৃন্দাবনবাবুর মতন ‘সব জানা আছে, কুছ পরোয়া নেহি’লোক পর্যন্ত যে “ওসব সর্দি-কাশি ছাড়া আর কিছু নয়!” বলতে বলতে-ও হাতে স্যানিটাইজার ঘষতে ভুলছেন না – এ’গুলোর কোনো দাম নেই? সবাই বোকা?
ব্যাপারটা সে তা-ই পরের দিন বন্ধুদের চ্যাটগ্রুপে শেয়ার করে-ই ফেলল।বন্ধু বলতে কচু, দেবর্ষি, পচা। আর সে নিজে তো আছেই। বৃন্দাবনবাবুকে গ্রুপে অ্যাড করার কথা উঠেছিল। দেবর্ষির সৌজন্যে। কিন্তু তাকে ছাড়া সর্বসম্মতিক্রমে সেই প্রস্তাব না-মঞ্জুর হতে সময় লাগে নি …
ওহো! … বলা হয় নি। এরা হচ্ছে আমাদের পাড়ার চার ধুরুন্ধর ক্যারেক্টার। বৃন্দাবনবাবু হচ্ছেন ভুতোর কাকা। তিনি তো আরও বড় মাপের জিনিস। তাছাড়া দাশুবাবু আছেন। তিনি-ও লেজেন্ড। আরও অনেকে রয়েছে। এদের যা সব কান্ড আছে না …পরে সময় হ’লে বলব’খন। আজকের কথা সংক্ষেপিত-ই থাক।
তা গ্রুপের চ্যাটে একপ্রস্থ গালাগালির পালা চলল। সে’সব আর লিখছি না। হে পাঠক/পাঠিকা, আমার ‘গালাগালি’ বলামাত্র আপনার মনে যা বা যা যা শব্দগুচ্ছ মনে আসবে, এলেবেলে বাজার-চলতি বা সুচিন্তিত বাছাই-করা,সুনিশ্চয় জানবেন যে— না, সেটা-ও বাদ যায়নি।
অনেক রাত অবধি সবাই সেদিন অনলাইন ছিল।
একসাথে।
[ না ]
“নারায়ণ। আমি নারায়ণ পাকড়াশি। এই এলাকাতে-ই থাকি। পাশের গলি। এবার চিনতে পেরেছ’?”
না। একদম চিনতে পারছেন না কন্দর্পবাবু। কে লোকটা?
ভোরের আলো এখনও জোরদার হয়নি। খুব মৃদুরাত-রাত ভাব চারপাশে। এর মধ্যে কে এই লোকটা? পাশে থাকে বলছে, কিন্তু কন্দর্পবাবু আজকের আগে এনাকে দেখেছেন বলে তো তার মনে হয় না। এই গরমে আবার গায়ে-মাথায় শাল বা কম্বল কিছু একটা জড়ানো। চোখে মোটা কাচের চশমা। মাথায় আবার মাঙ্কি টুপি। বাপ রে! আলাস্কা-ফেরত নাকি?
চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুললেন কন্দর্পবাবু। পুরো খোলা হাই। তারপর পেট চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘না, চিনলাম না তো! কে আপনি? কি চান?’
নারায়ণ পাকড়াশি নামের লোকটা বেশ মিনমিনে গলায় বলল, ‘বলছি বাবা, তোমার স্বর্গীয় পিতা আমার বন্ধু ছিলেন।’
বিরক্ত হলেন কন্দর্পবাবু। এই কাক-ভোরে এ কেমন খেঁজুরে-আলাপ?! ঝুলে-পড়া মুখে খালি বললেন, ‘তো?’
লোকটা হঠাৎ যেন বেশ জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। তারপর শরীরের সাথে গলার আওয়াজটা-ও কাঁপিয়ে সে বলল –“তো … তিনি আমার থেকে হাজার তিনেক টাকা ধার নিয়ে ছিলেন, আর দিয়ে যেতে পারেন নি। আমিও এতদিন আসিনি। কিন্তু এখন যা কষ্টে পড়েছি বাবা কি বলব! … তাই আজ জ্বর-গায়ে-ই এলাম। তোমার এই টাকাটা পেলে একটু হাসপাতালে গিয়ে টেস্ট করা’ব ভাবছি। চারদিন ধ’রে জ্বর … তা তুমি যদি এখন আমার ওই হাজার তিনেক টাকাএকটু …” এবার আবার খক-খক করে কাশতে লাগল লোকটা!কন্দর্পবাবু এবার লক্ষ্য করলেন, এর মুখেও মাস্ক নেই!
ঘুম ছুটে গেছে কন্দর্পবাবুর। বলে কি লোকটা? তিন হাজার?! … এ তো অনেক টাকা! … বাপ রে!
তিনি তা-ও কনফার্ম করার মত ক’রে আরেকবার প্রশ্ন করলেন, ‘এই! … সেকি! … আ … আ … আপনি কি মানে, … পাওনাদার নাকি মশাই ?’
— “হ্যাঁ, হ্যাঁ তো! আবার করোনা-ও মনে হয় হয়েছে!” লোকটার প্রকম্পিত গলায় কিছু সুর উঁকি দিল।
“এই রে! সর্বনাশ!!” — আর্তনাদ করে ঘরের ভেতরে পালালেন কন্দর্পবাবু। নারায়ণ পাকড়াশির মুখের উপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করতে অবশ্য ভুললেন না।
পেছন থেকে নারায়ণ পাকড়াশি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে … পরে আসব’খন। পাড়াতেই তো আছি। রাস্তায় তো এখনও খুব বেরোচ্ছ দেখেছি … পথেঘাটে একসময় ঠিক দেখা হয়ে যাবে …’
***
এরপরে-ও কয়েকবার ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলেন কন্দর্পবাবু। তবে খুব কম। এবার কিন্তু মুখ-জোড়া মাস্ক পরে। সামান্য দিনের আলোতেও টুপি আর চোখে চওড়া সানগ্লাস পরতে ভোলেন নি। হাতে গ্লাভস-ও ছিল। যাকে বলে আন্ডারকভার। আড্ডা বা আড্ডার বাসনা পুরোদস্তুর অন্তর্হিত, বাজার-ও সপ্তাহে মেরেকেটে এক কি দু’দিন। কাজটুকু সেরে-ই সোজা বাড়ি। আর বাইরে নয়।
করোনাকে হোক না হোক, পাওনাদারকে তিনি ভীষণ ভয় পেয়েছেন। লোকটা বলেছিল, আশেপাশে-ই থাকে। কোনোভাবে একবার দেখা হলে-ই একদম মহাকেলো! মাস্ক-টুপি-চশমা যে ছদ্মবেশ হিসেবে মন্দ নয় সেটা কন্দর্পবাবু বেশ বুঝেছেন। উনি খুব বুদ্ধিমান।
খালি সেদিন ভোরে পচাকে উনি চিনতে পারেন নি।
পচার গেট-আপঅবশ্য নিঃসন্দেহে খুব ভালো হয়েছিল। এ’সবে কচুর হাত-ই আলাদা! আর অভিনয় তো পচার সহজাত।
দেবর্ষির প্রশংসার জবাবে দাঁত বের করে একান্ত স্বভাবসিদ্ধভাবে ও বলেছিল, “ বাবা! … এ’ আর এমন কি! … ”
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।