“ওফফফফ!!…বাব্বাঃ!!…বাঁচা গেল।”
লোকটা তো বড্ড তড়বড়ে! পরনে ছোট ঝুলের পাঞ্জাবি আর জিন্স।চোখে চড়া পাওয়ারের চশমা। লোকটাকে কার মত যেন ঠিক একটা দেখতে। কিছুতেই মনে করতে পারল না বাবাই। ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে সরু প্যাসেজটা দিয়ে এদিকে আসতে আসতে, ভারী ব্যাগটার কানায় দুজনকে জোরদার ধাক্কা লাগিয়ে, খুব বিনয়ের সঙ্গে সরি বলতে গিয়ে, আরও দুজনকে ধাক্কা লাগাল! তারপর কাঁচুমাচু মুখে, এদিকে বেঁকে ওদিকে বেঁকে, সবকটা লোককেই একসাথে ‘দুঃখিত ম্যাডাম’, ‘সরি দাদা’ — এই করতে করতে এসে, প্রথমেই ওপরে লেখা নম্বরটা ভাল করে পড়ে নিল…তারপর, ওই টঙে লেখা কথাটা বলে, বাবাই-এর সামনের সিটটায় ধপ করে বসে পড়ল। সত্যি সত্যিই! মানে বাবাই-এর কানে ধপ আওয়াজটা সত্যিই ঢুকেছে।
-“কি ভিড়, কি ভিড়! তাই না! বলো! এটা এস ফোর-ই তো?…মানে এটা কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসই তো, তাই না?…মানে, এত তাড়াহুড়ো পড়ে গেল শেষের দিকে… চোখে যেন সর্ষেফুল দেখছি!! … ওফফফফ!”
প্রশ্নগুলো সব বাবাইকে-ই করা।উত্তরও বাবাই-এরই দেওয়ার কথা। বাবাই উত্তরে হাত নাড়িয়ে বিজ্ঞের মত বলবে ঠিক করেছিল, “ইয়ে, মানে, আমি ঠিক জানিনা। এই যে আমার বাবা। বাবা বলতে পারেন।” অথচ, হাত একটুখানি নাড়িয়েছে কি নাড়ায়নি, বাবা-ই পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
-“ঠিক ট্রেনেই চেপেছ। মানে, কোন ট্রেনে চাপতে চাও যেন?”
-“কাঞ্চনকন্যা!…কাঞ্চনকন্যা!”
-“পাক্কা আছে।”
-“থ্যাংক ইউ কাকু। বাঁচালেন।” বলেই, হামলে পড়ে এগিয়ে এসে সিটের তলায় ব্যাগগুলো চালান করতে লেগে গেল।
ট্রেনে উঠে অবধি, পেন্সিল থেকে যতগুলো প্রজাপতি বেরিয়েছে, একটাকেও বাবাই ধরতে পারল না। সবকটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে! মোট বেরোল পাঁচটা। তার মধ্যে একটা, পাশের বার্থে উড়ে, জায়গা খুঁজতে গিয়ে একটা মেয়ের হাতব্যাগে বসেছে। বাকী চারটে জানলা গলে বেরিয়ে, স্টেশন লাগোয়া লালে লাল কৃষ্ণচূড়া গাছটার এ ডালে, ও ডালে ওড়াউড়ি করছে। রাগ যদিও হয় নি খুব একটা, কিন্তু তাই বলে বিরক্তও লাগবে না একটু? মনখারাপও হবে না? তাই আবার হয় নাকি! একটা নয়, দুটো নয়…পাঁচ পাঁচখানা প্রজাপতি!! একটাও হাতে বসল না বাবাইয়ের! ট্রেনে কি আর একটাও বের হবে? যদিও বাবাই জানে, হবে। একটু একা একা বসে ছবি আঁকলে বা গল্প লিখলেই প্রজাপতিগুলো আবারও বেরোবে। কিন্তু সেটা তো এখন, এই ভিড়ের মধ্যে করাটা সম্ভব নয়। একটু আগেও ট্রেনটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকাই ছিল। এই স্টেশনটায় এসেই এমন ভিড়ভাট্টা হয়ে গেল, এত এত লোকজন উঠে পড়ল, যে এতক্ষণ ধরে যে কামরাটায় মনে হচ্ছিল বাবাইরা কয়েকজন মাত্র-ই যাবে, সেখানে এখন গিজগিজ করছে মানুষজন। কোন স্টেশন এটা?! এত লোক ওঠে!! খুব কৌতূহলী হয়ে, বাবাই জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল। ও…আচ্ছা…নিউ জলপাইগুড়ি।সেইজন্য এত ভিড়। বাবার ঘড়িতে এখন ঠিক রাত্তির আটটা।এখান থেকে অনেকেই মালদা যাবে, বর্ধমান যাবে। আবার শেষ অবধি শিয়ালদাতেও যাবে। তাই এত ভিড়!
বাবাইরা ফিরছে আলিপুরদুয়ার থেকে। সেখানে বাবাই-এর মাসির বাড়ি। মেসোমশাই কোন এক খবরের কাগজের আপিসে মস্ত বড় পদে চাকরি করেন। তাছাড়া মেসোদের পৈতৃক ব্যবসাও রয়েছে নানারকম ওই অঞ্চলে। সেসবের কিছু শাখাপ্রশাখা কোলকাতাতেও আছে। সেই সূত্রে, অথবা খবরের কাগজের কাজে, মেসো প্রায়ই কোলকাতায় আসেন। আর এলে অন্য কোথায়ই বা উঠবেন বাবাইদের বাড়িটা থাকতে! দুই জামাইতে খুব ভাব। হইচই করে দুয়েকটা দিন কাটিয়ে, মেসো ফিরে যান ট্রেন ধরে। প্রতিবারেই যাওয়ার সময় বাবাইকে বলেন, “কি রে! কবে আর যাবি আমাদের ওখানে?!” বাবাই তখন একটু লজ্জা পেয়ে, মাথা নিচু করে বলে, “বা রে! বাবা মা নিয়ে গেলেই যাব।” মেসো তখন বাবাই-এর মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে একটু আদর করে নিয়ে বলেন, “অ, আমাদের বাবাইবাবু তাহলে মাসির বাড়িতে একা একা যাওয়ার মত অতটা বড় এখনও হন নি।তাহলে দেখ, তোর বাবা মার কবে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়।তদ্দিন না হয় গণ্ডারগুলো, হাতিগুলো সব কান্নাকাটি করুক। চলি রে।”
-“চলি নয়, বলো আসি। আসি বলতে হয়।”
আর সেই শুনে মেসো, “আচ্ছা বাবাইবাবু, তাহলে আজ আসি” বলে হাসতে হাসতে, টা টা করতে করতে সোজা রাস্তায় হেঁটে গিয়ে মোড়ের মাথা থেকে ট্যাক্সি ধরেন।
তা এই এতদিন বাদে, সেইসব গণ্ডারদের, হাতিদের দুঃখ দূর করার একটা উপায় এসেছিল।গ্রীষ্মের ছুটি পড়ার ঠিক চারদিন আগে, বাবা দুটো এক্সপ্রেস ট্রেনের একদম সত্যিকারের, নতুন টিকিট, বাবাই-এর কোলে ফেলে দিয়ে মা-কে, বাবাইকে চমকে দিলেন। আর সেই সন্ধেটার পর থেকে বাকী দিনগুলো, ঠিক যেন ঝড়ের মত উড়ে গেল! দেখতে দেখতে মাসীর বাড়ি থেকে ফেরার ট্রেনে চাপার দিনটা চলে এল। ওরা আলিপুরদুয়ারে সব মিলিয়ে ছিল হপ্তাদুয়েক। বাবা অবশ্য অতদিন ছিলেন না। আপিস আছে তাঁর। বিরাট ব্যস্ততা! বাবাইদের সঙ্গে দিন দুয়েক কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন কোলকাতায়।তারপর আবার ওদের নিতে এসেছিলেন, এই ত দিন দুই আগে। এই দু’সপ্তাহ ধরে বাবাই আর মাসীর ছেলে তাতাই যে কি কি কাণ্ড করেছে, রাজাভাতখাওয়ায় গিয়ে তাদের সব কীর্তিকলাপ, বক্সার জঙ্গলে কি কি সব হয়েছিল, সেইসব নিয়েই একখানা মস্ত বই হয়ে যায়। সুতরাং, সেসব গল্প অন্য কোনদিন হবে না হয়। আজ আপাততঃ ট্রেনের গপ্পোখানাই হোক।
যা বলছিলাম…বাবার ঘড়িতে ঠিক রাত্তির আটটা। এখনও খুব একটা খিদে-টিদে পায় নি বাবাই-এর। ট্রেনে ওঠার আগেই মাসিমনি, আর মাসিমণিদের বুড়ো রাঁধুনি মণিরামদাদু, যা ঠেসে খাইয়ে দিয়েছে, তাতেই মোটামুটি দশটা পর্যন্ত টানা যেতে পারে। মণিরামদাদুর রান্নার হাতখানা জম্পেশ। দুপুরে কাতলামাছ দিয়ে যা একটা অদ্ভুত পদ রেঁধেছিল না, বাবাই যে বাবাই মাছ ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখে না, সে-ও দু’পিস খেয়েছে। মাসিমনি রাতের খাবার দাবারও বাঁধাছাঁদা করে দিয়ে দিয়েছে। ন’টা নাগাদ খেতে বসে যাবে ওরা।
লোকটার সিট সাইড লোয়ার।শিয়ালদায় প্রথমবারে ট্রেনে চড়ার সময় থেকেই এই সিটটা বাবাই এর ভারী পছন্দ ছিল। দু’খানা জানালা! দুটোই, যে বসবে তার একদম বেশ নিজের।তখন ফাঁকা ছিল না। দুজন প্যাসেঞ্জার বসেছিলেন।এখন ফেরার সময়ে খালি দেখে, একবার মা-এর দিকে, আরেকবার বাবার দিকে তাকিয়ে ঝপ করে ওই সিটে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসেছিল। ওই সিটে বসেই স্কেচগুলোও করছিল।ট্রেন ছুটতে শুরু করলে জানলাগুলো দিয়ে যখন হু হু করে হাওয়া ঢোকে, আর সেই হাওয়ার ঝাপটা যখন চুলের মেঘগুলো উড়িয়ে দেয়, সে’সময় বাবাই-এর মাথার ভেতর এলোমেলো হয়ে যাওয়া মেঘগুলো ভেঙ্গে-চুরে বৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েকবারই। এখন অবশ্য একেবারে শুকনো খটখটে।
-“তুমি বসবে এইখানে?”
সেই কার মত যেন দেখতে লোকটা বাবাইকে জিজ্ঞেস করছে।বাবাই ভারী তন্ময় হয়ে, জানলার বাইরে দেখতে দেখতে একটা মা-হাতি আর তার ছানা-হাতির ছবি ভাবছিল।ট্রেন ছেড়েছে বেশ খানিকক্ষণ হল। এখন হয়ত উত্তরবাংলার কোন গ্রামের মধ্যে দিয়ে ট্রেনটা যাচ্ছে। বাইরে ঘুটঘুটে আঁধার। মাঝেমাঝে বহুদূরে বা খানিকটা কাছে ছোট্ট দানার মত একটু আলো। কাছে এসে, আবার লজ্জা পেয়ে ছুটে পিছন দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।এরাও ধরা দেওয়ার নয়, বাবাই জানে। লোকটা হঠাৎ জিজ্ঞেস করাতে বাবাই-এর ঘোর কেটে গেল।লোকটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ভারী লজ্জা পেয়ে গিয়ে সে তড়াক করে নেমে, মা-র কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে বসল।
-“আরে! কি হল! তুমি কি রাগ করলে? এখানেই বসো। আমি ত রাত্তিরে শোব। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। এসো, এসো…চলে এসো!”
বাবাই মা-এর আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসতে যেতেই, মা হাঁউমাউ করে উঠল।
-“ওঃ…এই গরমের মধ্যে, গায়ে ঠেসিস না তো! সরে বোস।দিব্যি তো বসেছিলি ওখানে।”
মায়ের শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে জড়াতে জড়াতে মিনমিন করে, আদুরে গলায় বাবাই বললে-“ওঁ ওঁ ওঁ, ও মা…আঙ্কেলটা ডাকছে।তুমিও চলো।”
-“আমাকে কি ডেকেছে?…তোমাকে ডেকেছে তুমি যাও। আমি কেন যেতে যাব! বা রে আবদার!!”
-“ওঁ ওঁ ওঁ,চলো না মা…ভয় লাগে।”
-“ও মা! কেন?! আঙ্কেল কি বাঘ না ভাল্লুক, যে ভয় লাগে! ডাকছেন, যাও…তুমি গেলে উনি এদিকে চলে আসবেন।”
বাবাই আশপাশটা দেখে নিল একটু। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। একজন বয়স্ক লোক,যাঁকে অনেকটা বাবাইদের স্কুলের বন্ধু তীর্থঙ্করের দাদুর মত দেখতে, কিন্তু ইনি তীর্থঙ্করের দাদু নন,কারণ, তীর্থঙ্করের দাদু ধুতি পরেন, গায়ের রঙটাও এনার চাইতে ফরসা, বাবার উলটো দিকে বসে আছেন…তিনিও একইরকমভাবে হাসছেন।মনে হচ্ছে, কিসব যেন সুগন্ধী মশলা খান। বেশ ভুরভুরে গন্ধ বের হচ্ছে। এমনকি বাবাও হাসছে! এ বড় অন্যায়! সোজাসুজি মানুষের সাহসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ব্যপার। বাবাই, খুব গম্ভীর মুখে মায়ের পাশ থেকে উঠে লোকটার পাশে বসল।
বাবাইরা থাকে বাগবাজারে। বিরাট পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি। ইঁট বেরিয়ে গেছে। সারাই করাও হয়না বহুকাল। তবে এখনও সে বাড়ি মজবুতই আছে বেশ। দুর্বল হয়ে পড়েনি। কাকা আর জ্যেঠামশাইদের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়ার পর বাবার ভাগে যেটা আসে সে-ও কম কিছু নয়। জ্যেঠামশাইরা বহুবছর কলকাতা ছাড়া। এমনকি ভারতবর্ষেই থাকেন না তাঁরা। সুদূর নরওয়ের রাজধানী অসলো শহরে স্ত্রী-পুত্র সমভিব্যাহারে বসবাস তাঁদের। বাবাই-এর যখন পাড়ার সত্যডাক্তারের নার্সিংহোমে জন্ম হল, জ্যেঠামশাই-এর ছেলের ক্লাস টুয়েলভের টেস্ট। বছর দুয়েক বয়স অবধি বাবাই, রূপাই-এর পিঠে চেপেছে, কাঁধে চেপেছে। এখন বাবাই নিজেই তেরো বছর। কত্ত আদর করত রূপাই! খুব আবছা, হালকা মনে পড়ে বাবাই-এর। তারপর কি যে হল, জ্যেঠামশাইরা সক্কলে মিলে চলে গেলেন নরওয়ে।উনি তো ভারী পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানে ভারতের নামকরা এক পণ্ডিত। সেই সূত্রেই গবেষণার কাজে গেছিলেন।আর ফেরেননি। কোন যোগাযোগও নেই তেমন, আলে-কালে বাবাকে পাঠানো দুয়েকটা ই-মেল ছাড়া। কোলকাতায় থাকার দরুণ, বাবা আর ছোটকাকাকেই বাড়ির দেখাশোনাও করতে হয়। বাবাই-এর বাবা, বড় একটা ওষুধ কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। খুবই কেজো মানুষ।সারাদিন কাজ আর কাজের শেষে বাড়ি, এই তাঁর জীবন। নেহাৎ কোম্পানির কাজে ঢেঁকি গিলে মাঝেমাঝে ট্যুরে যেতে হয় তাই, নাহলে এমনিতে খুব একটা ইচ্ছে নেই। রোজ সক্কালবেলা অফিস বেরোবার আগে একতলা থেকে চেঁচিয়ে কাকাইকে ডেকে বলেন, “কি হে রুনুচন্দ্র! এবার বাড়িটার দিকে একটু মন দাও! কখন কার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে!” কাকা-ই তখন ছুটতে ছুটতে এসে উত্তর দেয়, “আরে চুপ করো মেজদা, চুপ করো। এত চেঁচিয়ে বোলো না। দেওয়াল ধসে যেতে পারে।” বলে দুজনেই যে যার কাজে চলে যায়। আর বাবাই এইসব নানারকম কথা শুনে আঁকতে বসলেই, তার পেন্সিলটা থেকে নানারকম ফুল ফুটতে থাকে।জবা, গোলাপ, গাঁদা, জুঁই, টগর….এরকম সব। কিছু ফুল ভেসে ভেসে ছাদে ঠাকুরঘরের দিকে রওনা দেয়। কিছু আবার বারান্দার ভাঙ্গা টবের পাশে গিয়ে, কোথাও মিলিয়ে যায়। খাটে আর মেঝেতেও পড়ে থাকে কিছু। একটু বাদে ঝাপসা হতে হতে আর থাকে না। প্রজাপতি বেরিয়ে সারা বাড়িময় উড়তে থাকে। দুয়েকটা প্রজাপতি উড়ে গেলে বা ফুল ফুটলে বাবাই-এর আঁকাগুলোও বেশ খোলে।
রাত প্রায় এগারোটা হল। খাওয়াদাওয়া বেশ কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে সবারই। নিচের সিট সাফ-সুতরো করে, মাঝের বার্থ তুলে নিয়ে, বিছানাপত্র পেতে ফেলে, প্রায় সব প্যাসেঞ্জারই হয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নয়ত মোবাইলে কিছু করে চলেছেন। বাবাই-এর মাঝখানের বার্থে শোয়াটা পছন্দ। বৃষ্টি পড়ার রাত আজ। ভেতরকার কাঁচের জানলা, বাইরের কাঠের জানলা, দুটোর শাটারই ফেলে দেওয়া থাকলেও বাইরে যে বেশ জোরেই বৃষ্টি হচ্ছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মাঝেমাঝেই চা-ওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে “গরম চায়ে, চায়ে গরম”, জলের বোতলওয়ালা ব্যাগ ভরা জলের বোতল বাঁহাতে আর একটা বোতল ডানহাতে তুলে ধরে ডাকতে ডাকতে চলে গেল, “পানি বটল, ঠাণ্ডা পানি বটল”। বাবাই এমন নানারকম চেনা-অচেনা ডাক শুনে চলেছে ভারী মন দিয়ে। খানিকবাদে খেয়াল হচ্ছে, তখন আবার একটু ছবি এঁকে নিচ্ছে। অন্ধকারে ছবি আঁকার সময়ে, বাবাই-এর পেন্সিলটায় একটা নরম আলো জ্বলে ওঠে। সে আলোয় বেশ স্পষ্ট হয়ে যায় চারপাশটা। পরিষ্কার দেখা যায় সবাইকে।তখন আর প্রজাপতি, খরগোশ, মুরগীছানাগুলো বেরোয় না।সবাই ঘুমিয়ে থাকে বোধহয়! বাবাই-এর পেন্সিলের এই আলোটা; ফুল, প্রজাপতি, খরগোশ, মুরগীছানাগুলোর মাঝেসাঝেই বেরিয়ে আসাটা বা, মাথার মধ্যে হওয়া বৃষ্টিটা আর কারুর হয় কিনা বাবাই জানেনা। হয় নিশ্চয়ই। তবে বাবাই কিন্তু দেখতে পায়না। যেমন, মনে হয় না বাবাই-এর আলো, বৃষ্টি, পশুপাখিগুলোও কেউ দেখতে পায় বলে।পেন্সিলটা খুব অন্যরকম। বাবাই, তাদের বাড়ির একটা পুরোন ঘর থেকে পেন্সিলটা খুঁজে পেয়েছিল। খুব বেশী ছুলতেও হয়না। শিসটাও বেশ ভাল আর মজবুত।
এখন যে ছবিটা বাবাই আঁকছে, সেটা একটা ছেলের ছবি। ছেলেটা বাবাইও হতে পারে, আবার অন্য কেউও হতে পারে।ছেলেটা গভীর একটা জঙ্গলের সামনে একটু বেকায়দায় দাঁড়িয়ে আছে। পরণে হাফপ্যান্ট, হাফহাতা জামা। পায়ে জুতো, মোজা। একটা ঘাসজমির ওপরে পিছন ঘুরে দাঁড়ান ছেলেটার সামনে, দুধের মত সাদা দাঁতওয়ালা এক দাঁতাল হাতী! ছেলেটা হাতিকে দেখছে, হাতিটাও ছেলেটাকে দেখছে মন দিয়ে, কিন্তু আক্রমণ করছে না…এইরকম একটা হবে ভেবেছে পুরো আঁকাটা।হয়ত হাতিটার খুব বিশ্বাস, ছোট্ট মানুষটা কোন ক্ষতি করবে না। তাই তেড়ে যাচ্ছে না। অনেকটা এঁকেও ফেলেছে।তবে বাকীও এখনও অনেকটাই। এই বাকীটুকুই পেন্সিলের নরম আলোয়, বাবাই শেষ করার চেষ্টা করছিল।
-“তুমি এই অন্ধকারে দেখতে পা’চ্ছ?…চোখ খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু!! এই আমার মত।”
বাবাই মুখ তুলে নিচের দিকে তাকাল। সাইড লোয়ারের ওই চশমা পরা লোকটা ফিকফিক করে হেসে জিজ্ঞেস করছে।
-“নাঃ। আমার কিছু হবে না।”
-“কি করে জানলে?”
-“উঁ?”
-“বলছি, কি করে জানলে যে কিছু হবে না। আমিও তো ভাবতাম আমারও কিছু হবে না।এরকম করে পড়াশুনো করতাম। কিন্তু সেই হয়েই গেল তো! এখন নাও …এই অ্যাত্তো বড় চশমা পরে ঘুরে বেড়াও।খুব জ্বালা!”
-“আমি জানি।কিছু হবে না”
-“সেটাই ত জানতে চাইছি,কি করে জানলে?”
-“এমনিই…. জানি। আচ্ছা আঙ্কল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়।”
-“তোমাকে আমার খুব চেনা লাগছে। কেন বলো তো?!”
-“তা তো জানি না! তুমিই বলো, কেন!”
-“কি জানি! টিভিতে দেখেছি কি? বা, মোবাইলে?”
-“না, সেরকম কিছু তো হওয়ার কথা নয়। তুমি কি খুব মোবাইল দেখো নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি শুধুই ছবি আঁকো।”
-“মা, দেখতে দেয় না তেমন। আমারও খুব একটা ভাল্লাগে না অবশ্য।”
-“ভালই হয়েছে। মোবাইলও চোখ খারাপ করে দেয়। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে আমার না খুব দরকারী কিছু কথা আছে।”
বাবাই একটু অবাক হয়ে চুপচাপ, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার সঙ্গেও আবার দরকার থাকতে পারে নাকি কারুর?! উপুড় হয়ে শুয়েছিল। একটু নড়েচড়ে উঠে বসে বলল, “বলুন। কি কথা?”
-“বলছিলাম কি, ইয়ে মানে, তোমার পেন্সিলটা আমাকে একটু দেবে?কিছু যদি মনে না করো আর কি। আমার কিছু দরকারী নোট লেখালিখি করার ছিল। কিন্তু আমার পেনটা ট্রেনে ওঠার সময়েই মনে হচ্ছে পড়ে গেছে কোথাও একটা।”
হঠাৎই বাবাই কেমন আলো হারাবার ভয় পেল। আচমকাই তার মনে হল, সে যেন পেন্সিল থেকে চেনা আলোটা আর কখনও পাবে না। একান্তই যে আলো, যে বন,প্রজাপতি,পশুপাখি তার নিজের ছিল এতদিন, এবার হয়ত হারিয়ে যেতে পারে। লোকটা যদি পেন্সিলটা নিয়ে আর ফেরত না দেয়? লোকটা যদি জানতে পেরে যায়, পেন্সিলে আলো আছে? অন্য কোন পেন্সিলে যদি সেই ব্যপারটা না হয়। বলা ত কিছুই যায় না, তাই না? যদিও বাবাই যত পেন্সিল ব্যবহার করেছে এতদিন, কোনটাই ব্যতিক্রমী হয় নি। তবুও, স্বজন হারাবার মত কেমন একটা কষ্ট বাবাইকে চেপে ধরল। কিন্তু তারপর আবার এটাও মনে হল, একজন মানুষ বিপদে পড়ে সাহায্য চেয়েছেন, আর সে তার পাশে থাকবে না! স্কুলে ত সবসময় স্যারদের বলতে শুনেছে বাবাই, মানুষ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করার মত বড় কাজ আর নেই।যেসব বড় বড় মানুষের কথা বাবাই বইতে পড়েছে, তাঁরা সক্কলে অন্যের ভাল করার জন্য চেষ্টা করেছেন। আর এ তো শুধু একটা সামান্য পেন্সিল দিয়ে উপকার। মনস্থির করে ফেলল বাবাই।
-“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চই নিশ্চই। এই নিন। আমি তো ঘুমিয়ে পড়ব এখন। আপনি কাজ করুন।”
-“দেখো, কিছু মনে করলে না তো আবার?এতক্ষণ ধরে আকাশ-পাতাল কিসব ভাবলে দেখলাম!”
-“না, না। এ মা!! কিছু মনে করিনি। আপনি লিখুন, লিখুন।”
-“থ্যাংক ইউ। তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি এবার একটু লিখে নিই, কেমন।”
-“আচ্ছা!”, বলে বাবাই দুটো পাতলা চাদর একসঙ্গে ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ল। ট্রেনের দুলুনি, আলো-আঁধারির খেলা, স্টেশনের শব্দ, হকারদের ডাকাডাকি, আর লোকজনের যাতায়াতের জন্য ঘুমটা কেমন যেন ভাসাভাসা হয়। ঠিক ঘুম নয়, কেমন একটা ঘোরের মত হয়। বাবাই এই ঘোরটার মধ্যে ঢুকে পড়ল আস্তে আস্তে। ট্রেন চলতে থাকে। ঘোর কখনও বাড়ে, কখনও কমে। আধোজাগা-আধোঘুম এমন মুহূর্তগুলিতে সারি দিয়ে স্বপ্নেরা ধরা দেয়। এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি জানা নেই…কিন্তু বাবাই দেখল, লোকটা সাইড লোয়ারে পা দুটো টানটান করে আধশোয়া হয়ে, খুব মন দিয়ে যে খাতাটায় লিখছে, সে খাতার চারপাশে আলোকিত ফুল, পাতা, ছোট্ট বাগান।সেখানে প্রজাপতি উড়ছে দুটো। বাগানের মধ্যে একটা বড় আমগাছ। তার মোটা একটা ডাল থেকে ছোট্ট একটা কাঠের দোলনা ঝুলছে। সেখানে কেউ এখন নেই যদিও, কিন্তু একটু বাদেই হয়ত একটা লাল, নীল ফুলছাপ ফ্রক-পরা ছোট্ট একটা মেয়ে এসে বসবে। দুলবে। পেন্সিলটা থেকে নরম সেই আলোটা বেরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে লোকটার মুখ। ট্রেনের চারদিকে অন্ধকার, তার মধ্যে লোকটাকে আলোবাগানের মধ্যে বসে থাকা ঠিক একজন আলোমানুষের মত দেখাচ্ছে…..
-“এই বাবাই! ওঠ! ওঠ! বর্ধমান এসে গেল তো! মুখ হাত ধুয়ে নে।”
-“উঁ উঁ উঁ?”
-“আরে, কি উঁ উঁ!! ওঠো এবার। সকাল হয়েছে বহুক্ষণ। সব্বাই উঠে পড়েছে। তুমি যাও, ব্রাশ করে নাও। কিছু খেয়ে নিতে হবে এবার।প্লেট রেডি।”
-“একটু পরে…”
-“না! কোন একটু পরে নয়। ওই দেখো। সাইড লোয়ারটা খালি হয়ে গেছে। আঙ্কল নেমে গেলেন।যাও ওখানে বসে লোক দেখো গিয়ে।”
বাবাই চমকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সিটটার দিকে তাকাল।খালি! ফাঁকা! কেউ নেই! তাহলে পেন্সিল!! গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে ধড়মড় করে মিডল বার্থ থেকে নামতে গিয়ে চাদর তো ঠিকঠাক সরল-ই না। মাঝখান থেকে সবসমেত জড়িয়ে- মড়িয়ে বাবাই হুমড়ি খেয়ে, গুঁজড়ে-মুজড়ে নিচে পড়ল একেবারে।
‘হায়! হায়!’ করে ছুটে এল আশপাশের লোকজন, “লাগে নি তো? দেখেছ! ওরকম হুড়োহুড়ি করে নামে কেউ! ওঠো, ওঠো দেখি।” এদিকে বাবা, কাঁধে তোয়ালে, ডান হাতে ব্রাশ,বাঁ হাতে পেস্ট, আর একমুখ ফেনা নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর মা যেমনটা তেমনই। কাগজের প্লেটে সন্দেশ, কলা এইসব সাজাচ্ছিলেন। সেসব বন্ধ করে, “দেখেছ! দেখেছ! কতখানি গাধা হলে এরকম হয়!” বলেই, এঁটো হাতে বাবাইয়ের পিঠে গুমগুম করে দুই কিল!!
বাবাইয়ের তখন সেসব কোন কিছুর দিকেই কোন মন নেই। সে সিটের ওপরে, নিচে, সিটের পাশের খাঁজগুলোয় যেখানটা খুব সংকীর্ণ, সবখানে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে লেগেছে তখন। যদি লোকটা ফেলে যায় ভুল করে। সে তো ঘুমোচ্ছিল। তাই ডাকেনি হয়ত তাকে। কিন্তু নাঃ। কোত্থাও নেই! সিটের নিচে পড়ে থাকা ঠোঙা, কলার খোসা, কমলালেবুর খোসা, চিপসের প্যাকেট সব ঘাঁটাঘাঁটি শেষ। বাবাই-এর মা চিৎকার করে চলেছেন। “এই ছেলে আমার হাড়-মাস কালি করে দিল! উঠলি হতচ্ছাড়া! এখুনি যদি না উঠিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।ওঠ বলছি! উঠে পড়! নোংরা মেঝেয় শুয়ে উনি ময়লা ঘাঁটছেন! এখুনি না উঠলে আজ তোর হাড় আর মাংস আলাদা করব!ওঠ বলছি! উঠলি?!” সঙ্গে পিঠে ছোটখাট দুয়েকটা চড়-চাপড়।রেগে গেলে, ওগুলো কথার সঙ্গে আপনিই আসে মায়ের। আলাদা করে আনতে হয়না।কিন্তু বাবাই-এর কোন হুঁশ নেই। সে কোনদিকে তাকাচ্ছে না। কোনদিকেই তাকাবার মত পরিস্থিতি এখন নয় তার।
-“আরে থামুন থামুন। মারছেন কেন!! মারবেন না অত!” সেই তীর্থঙ্করের দাদুর মত দেখতে, বয়স্ক ভদ্রলোক বোধহয় বাথরুমে গেছিলেন।এখন দুজনের মাঝে এসে মা-কে থামালেন। তারপর সাদা জামার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে “ও খোকা! তুমি কি খুঁজছ এত!ওখান থেকে ওঠো। তোমার জন্য তো এই সিটের ছেলেটা এই কাগজটা দিয়ে গেছে। তোমাকে দিয়ে দিতে বলে গেল আমায়।ঘুমোচ্ছিলে বলে ডাকিনি আর। এই নাও।ধরো।”
বাবাই আবারও একটু ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে নিল। চৌকো একটুকরো সাদা কাগজ। চারভাঁজ করা। তাড়াতাড়ি করে কাগজটা খুলে ফেলল বাবাই। একটা ছোট্ট চিঠি। চিঠি বললে অবশ্য ভুল হবে। অল্প একটুকরো বার্তা। ওই পেন্সিলটা দিয়েই মনে হচ্ছে লেখা।
“পেন্সিলটা বেশ ভাল, বুঝলে। নিয়ে গেলাম। কাজে লাগবে অনেক। দেখা হলে দিয়ে দেব। ততক্ষণ থাক আমার কাছেই।”
বাবাই এর চোখ ফেটে জল এল। পেন্সিলখানা যে তার ভারী প্রিয় ছিল। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবা, মা কতজনে কত কিই না জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু বাবাই এখন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তার সামনে সব সাদাকালো। আর সামলাতে না পেরে বাবাই ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলল। তাতে আশপাশের সকলে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ল।তারপর চলল সারা রাস্তা ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার পালা।কেউ বলল, “আহা গো! ছোট মানুষের জিনিস কেউ এমনিভাবে চুরি করে?!” আরেকজন বলল, “কেমনধারা লোক কি জানি বাবা!” একটি বৌ বললে,”ভাগ্যিস আমাদের টাকাপয়সা কিছু চুরি করেনি। শুধু পেন্সিলই একটা…” আর সবশেষে তীর্থঙ্করের দাদুর মত দেখতে বয়স্ক ভদ্রলোক যখন বললেন, “বলেছে যখন, একদিন দিয়ে দেবে নিশ্চয়!” বাবাই-এর ভারী ইচ্ছে করছিল লোকটার পা-টা মাড়িয়ে দিতে। নেহাৎ বয়স্ক মানুষ আর মা-এর হাতে মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তাই এ-যাত্রা বেঁচে গেল।
গাড়ি ঢুকতে বেশ লেট আজ।লাইনে বোধহয় কোন গোলমাল হয়েছে।শিয়ালদায় যে ট্রেনের ঢোকার কথা সকাল আটটা কুড়িতে, সেই ট্রেন কিনা ঢুলতে ঢুলতে, ঝিমোতে ঝিমোতে শিয়ালদা ঢুকল যখন, ঘড়িতে পাক্কা বারোটা।খিদেয়, তেষ্টায়, গরমে, ক্লান্তিতে সকলেই ভারী কাহিল হয়ে পড়েছে। বাবাই-এর তো শুধু এইসব নয়, সঙ্গে গভীর শোকও যোগ হয়ে আছে। স্টেশনে নেমে হাতমুখ ধুয়ে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে সবাই সামান্য টিফিন করে ফেলল। কিন্তু বাবাই প্রায় কিছুই মুখে তুলল না। ট্যাক্সিতেও সারাটা রাস্তা মুখ ভার। সব ব্যপার-স্যাপার শোনার পরে মা-ও আর বাবাইকে তেমন ঘাঁটাচ্ছে না। ট্রেনে দুয়েকবার “হাঁদা ছেলে, বোকা কোথাকার, কেউ আবার এরকম দেয় নাকি”, এমনি কিছু কথা বললেও আর বিশেষ কিছু বলছে না। মেজাজ খারাপ আছে। বেশী কিছু বললে বাবাই-ও দেবে দু’চার কথা শুনিয়ে, ঠিকই করে নিয়েছে।
বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড়াল।মা বাবা গাড়ি থেকে লাগেজ নামাচ্ছেন। ড্রাইভারটিও হাত লাগিয়েছে তাঁদের সঙ্গে।বাবাই এর একটাই ব্যাগ, নিজেই নামিয়ে ফেলল। কারুরই হাত লাগাবার দরকার পড়ল না। ব্যাগটা কাঁধে ফেলে বাবাই সদরদরজার বেল জোরে জোরে চার-পাঁচবার বাজাতেই, কাকাই-এর “আসছিইইই, দাঁড়া বাবাই…দাঁড়াও দাদা” এইসব হাঁকডাক শুনতে পেল।কাকা দুড়দাড় করে বালতি টালতি উল্টোতে উল্টোতে ছুটে আসছে। এসে ঝড়াং করে দরজাটা খুলে দিল।
এ কি!!…ইনি কোথা থেকে এলেন!!…বাবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সামনেই দাঁড়িয়ে বাবাই-এর ট্রেনের পেন্সিলচোর! ফিকফিক করে হাসছে। বাবা-মা-ও দেখে হতভম্ব। পেন্সিলচোর বাবাই-এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। পেছনে পেছনে হাসিমুখে কাকাই। লোকটা আগে পেন্সিলটা বাবাই-এর হাতে দিয়ে হাসল একটু।তারপর সোজা মা- বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল,
-“ট্রেনে ইচ্ছে করেই আপনাদের পরিচয় দিই নি।ভেবেছিলাম চমকে দেব।আমাকে কি মনে আছে আর মেজকা?…আমি রূপাই!”
ওমনি বাবাই-এর মনে পড়ে গেল।কেন এত চেনা চেনা লাগছিল ট্রেনে। ছেলেবেলার অ্যালবামে বাবাই এই ছেলেটিকে বেশ কয়েকবার দেখেছে।তবে সেখানে চোখে এত হাই পাওয়ারের চশমা নেই।ছেলেটাও ছোট ছিল অনেকটাই। আর তার সঙ্গে তার নিজের মধ্যে সেই ঝাপসা হয়ে যাওয়া কোলে চড়া, ঘাড়ে চড়ার স্মৃতি তো আছেই। এর পরের অংশ? আশীর্বাদ, বুকে জড়িয়ে ধরা, “ও মা! কত্ত বড় হয়ে গেছে সেই আমাদের ছোট্ট রূপাই! একদম অন্যরকম দেখতে হয়ে গেছে! চিনতেই তো পারিনি। বলবি তো ট্রেনে। কি রে! চল চল, ভেতরে চল…….”
সন্ধেয় একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। ভ্যাপসা গরমটা অনেকখানিই কম। আকাশ সামান্য মেঘলা এখনও। কখন যে আবার ঝরাবে, বলা কিছুই যায়না। রূপাই নরওয়ে থেকে ফিরে, ভারতের বেশ কয়েক জায়গায় ঘুরে আলিপুরদুয়ার থেকে কলকাতায় এসেছে। ঘটনাচক্রে বাবাইরাও একই ট্রেনে। সেদিন অনেক গল্প, খোঁজখবরের পালা, স্মৃতিচারণ শেষ করে, খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে গভীর রাতে…
-“রূপাইদাদা, আমার দুটো প্রজাপতি হয়ে গেল কিন্তু…”
-“আমার একটা খরগোশ হয়েছে, বুঝলি। বাগানে চন্দ্রমল্লিকা ফোটাব এবার।”
-“চন্দ্রমল্লিকা! আমার খুব ভাল লাগে। তুমি বাগান করো কি করে? আমার ফুলগুলো ফোটে আর ভেসে চলে যায়।”
-“ওই…. খুব জোর দিয়ে বিশ্বাস করি, বাগান হচ্ছে। গোলাপ ফুটল, চন্দ্রমল্লিকা ফুটল…ব্যস! আর কি!”
-“কিন্তু রূপাইদাদা…আমি ত কোনদিন বিশ্বাস করিনি! ভাবিও নি এসব কথা। তাহলে আমার পেন্সিল থেকে কি করে বের হয়?!”
-“করেছিস…বুঝতে পারিস নি। তোর একটা ভারী সুন্দর মন আছে বাবাই। সেখানটাতে অরোরা বোরিয়ালিস, অরোরা অস্ট্রালিসের মত আলো জ্বলে। সেইখানটা থেকেই তো সবকিছু। এই যে ট্রেনে, তুই বিশ্বাস করে পেন্সিলটা দিয়ে দিলি…ওটা কিন্তু তুই দিসনি…ওই আলোটা দিল…”
-“তাই?…আলো আছে?”
-“হ্যাঁ রে। বিশ্বাসের আলো। তাই তো পেন্সিলটা আবার তোর হাতে ফিরে এল।আলো থাকলেই তো তার কাছে আসে সক্কলে। ভরসা করে … “
-“অরোরা বোরিয়ালিসের আলো?!…অরোরা অস্ট্রালিসের আলো?!…সে কি অনেক আলো রূপাইদাদা?!….কেমন হয় দেখতে?”
-“সে অনেক আলো রে বাবাই! তাহলে বলি শোন…..”
ক্রমশঃ রাত বাড়ে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের চোখে ঘুম আসে না। তারা দেখতে পায় উত্তরের আলো, দক্ষিণের আলোয় ভরে যাচ্ছে ঘরের সিলিংটা। ফ্যানের হাওয়ায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে চারদিকে। তাদের ঘরটা যেন আলাস্কা, উত্তর কানাডা, ফিনল্যাণ্ড বা রূপাইদের নরওয়ের মত কোন দেশের মত হয়ে যাচ্ছে। আর ছায়ায়, মায়ায় ভরে যাওয়া ঘর জুড়ে রঙ-বেরঙা প্রজাপতিরা, কোনদিন ধরা-না-দেওয়া প্রজাপতিরা সব, উড়ে বেড়াচ্ছে…শয়ে শয়ে…হাজারে হাজারে…..
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।