22 Oct

বেনামী

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সান্যাল




যন্তর মন্তরের উলটো দিকেরদি পার্ক ‘  হোটেলটায় বেশী আসা হয় নি আমার
বোধ হয় বিয়ের রিসেপশনের নেমন্তন্ন রাখতে বার দুয়েক আসতে হয়েছিল
যে কোনো কারণেই হোক বড়ো মাপের টেকনিক্যাল সেমিনার বা কনফারেন্স বিশেষ হয় না এখানে
সেজন্যেই এই স্টার হোটেলে আমার আসার কোনো কারণ ঘটেনি
সত্যপ্রকাশের ফোনটা পাওয়ার পর ইন্টারেস্টিং লাগছে এই জন্যে যে এই ব্যয়বহুল ফোর স্টার হোটেলের একতলার কফিশপে সে আমার সঙ্গে দেখা করে চা খাওয়ার কথা বলেছে
আবার এও বলেছে যে ওর তরফ থেকে এটা নাকি ট্রিট হিসেবে ধরতে হবে
কারণ গত মাসে রিটায়ার করার পর খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অফিসের বন্ধুদের নিয়ে যে চায়ের নিমন্ত্রণ রেখেছিলো সেখানে আমাকে পায়নি 
সত্যিই, গত মাসে আমি আর্নড লিভ নিয়ে স্ত্রীপুত্রসমভিব্যহারে তিন সপ্তাহের জন্য কলকাতা গিয়েছিলাম । 
সত্যপ্রকাশ খুব মিস করেছিল নাকি আমাকে সেদিন
কারণ পঁচিশ বছরের অফিসজীবনে নাকি ব্যানার্জী স্যারের মতো সিনিয়র বন্ধু, ফিলজফার, গাইড নাকি আর একজনও পায়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি 

 

#

গল্প সত্যপ্রকাশের গল্প 
পঁচিশ বছরের লম্বা সরকারী অফিসকেন্দ্রিক জানাশোনা আমাদের  
তাই ঠিকঠাক গল্পটা পেশ করতে গেলে সময়ের পেছনের দিকে একটু হাঁটতেই হবে 
ওই যে সত্যপ্রকাশ কদিন আগে ফোনে আমাকে ফ্রেন্ড ফিলোসফার গাইড এসব বলেছে না, আমার দিক থেকে দেখতে গেলে এই ব্যাপারটা ছিল কিছুটা উভয়ত 
কারণ প্রায় পঁচিশ বছর আগে এই অরুণ ব্যানার্জী, তখন অবিবাহিত যুবক অরুণ ব্যানার্জী, যখন সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে এম টেক পাশ  করে ইউ পি এস সি তে ভর দিয়ে কলকাতা থেকে সোজা সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের খাসতালুকে এসে মিনিস্ট্রির সমুদ্রে ঝাঁপ দিলো, তখন হাতের কাছে ভাসবার জন্যে  খড়কুটো ছিল সেকশনের এই সবেধন নীলমনি এলডিসি সত্যপ্রকাশ কুমার 
আমার অফিস জয়েনিংয়ের প্রথম দিনটা থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে কেমন যেন একটা ন্যাচারাল বন্ডিং তৈরী হয়ে গিয়েছিলো 
আজও জানিনা সেদিন সেটা কি করে সম্ভব হয়েছিল 
কারণ পুরোপুরি টেকনিক্যাল সেই সেকশনটার আমি ছিলাম তথাকথিত হেড, ক্লাস ওয়ান গেজেটেড অফিসার, আমার নীচে সেকশনে আটজন ক্লাস টু ননগেজেটেড টেকনিক্যাল অফিসার আর সত্যপ্রকাশ আমার অন্তত পাঁচধাপ নীচে একমাত্র এলডিসি, যার প্রধান কাজ ছিল ফাইল আর অন্যান্য চিঠিপত্রের মুভমেন্টের হিসেব রাখা, চিঠি, নোট টাইপ করা ইত্যাদি  
শ্রেণীসচেতন রাজধানীর ব্যুরোক্রেসী আর যাই হোক এলডিসির সঙ্গে ক্লাস ওয়ান অফিসারের বেশী দহরম মহরম একেবারেই ভালো চোখে দ্যাখে না 
মিনিস্ট্রির অন্যান্য সেকশনের প্রমোশন পেয়ে ননগেজেটেড পোড়খাওয়া বয়স্ক সেকশন হেডরা তাদের এলডিসিদের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করে সেটা তো ধীরে ধীরে টের পেয়েছি পরে 
কিন্তু এই সব মনুটাইপ শ্রেণীবিভাগ নিয়ে কোনোদিনই আমার কোনো মাথাব্যথা ছিলো না 
বুদ্ধিমান চটপটে সত্যপ্রকাশের বোধহয় সেটা বুঝে নিতে একেবারেই সময় লাগেনি 
তাই বোধহয় সিঁড়ির সব থেকে নীচের ধাপে থেকেও সত্যপ্রকাশ নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে কথা বলতো, পরামর্শ  দিতো, নানারকম ঘটনা শেয়ার করতো, সেই প্রথম দিনটা থেকেই 

 

#

শীতকালে দিল্লিতে পোস্টিং হয়েছিল আমার 
দিল্লির শীত সম্বন্ধে আমার ধারণাটা কালীপুজোর রাত থেকে মাঙ্কিক্যাপ পরতে শুরু করা গড়পড়তা কলকাতার বাঙালির মতো না হলেও দশটার আগে সূর্য দেখতে না পাওয়ার দিল্লির সকাল সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা তো ছিল না 
আর সেই রকম সকালে রাজধানীর কুখ্যাত ঠান্ডা হাওয়া সামলে, ব্যাচিলর বাসার সব রকম কৃচ্ছসাধন অন্তে, সাড়ে নটার মধ্যে অফিসে ঢুকে পড়াটা ছিল একটা দৈনন্দিন প্রজেক্ট 
যুবক অফিসারের দিল্লির প্রথম শীতের অভিজ্ঞতায় সেই বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়াটা সত্যপ্রকাশ তার সন্ধানী দৃষ্টিতে লক্ষ করেছিল ঠিক 
তাই শীতের সকালবেলায় অফিসের কাজ আমার দ্বারা মসৃণ ভাবে শুরু করতে তার সমাধানটা ছিল খুবই সরল 
অফিসের  পিওন কেবলরামের সকালবেলায় সেকশনে এসে কাজই ছিল হলের  কোণে ছোট্ট ক্যাবিনেটের ওপরে রাখা হিটারটার সাহায্যে বড়ো এক কেটলি দুধ দেওয়া কষকষে গরম চা তৈরী করে ফেলা 
তার পরবর্তী কার্যক্রম ছিল সেকশনের প্রত্যেকের টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসে গ্লাসে সেই ধোঁয়াওঠা চায়ের পরিবেশন 
সেই যুবক বয়েসে আমার  সকালবেলায় ব্রেকফাস্টের সঙ্গে এক কাপ, বা বড়ো জোর দুকাপ চা খাওয়ার অভ্যাস 
অফিসে আমার  সেই প্রথম দিনের সকালে কেবলরাম কেটলি নিয়ে সবার আগে আমার কাছে আসতে তাকে হাত নেড়ে ফেরত যেতে ইশারা করলাম 
একটু ইতস্তত করে কেবলরাম পাশের টেবিলের দিকে যাবে এমন সময় সেকশনের শেষ প্রান্ত থেকে সত্যপ্রকাশ হাঁ হাঁ করে প্রায় দৌড়ে এলো,
চাটা নিয়ে নিন স্যার   ওই কাঁচের গ্লাসেই নিন  নিয়ে তারপর এইভাবে দুহাতের তালু দিয়ে ধরুন আর সিপ্ করুন  তা না হলে আপনার হাতের আঙ্গুলগুলো খুলবে কি করে দিল্লীর এই শীতের সকালে ! কিভাবেই বা ফাইলের পাতা উল্টোবেন আর নোট লিখবেন !
সারমনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের টেবিল থেকে খালি গ্লাস তুলে নিয়ে এসে মক ডেমোনস্ট্রেশন !
সেকশনের সকলের হালকা হাসির সঙ্গে আমি চমৎকৃত 
সত্যপ্রকাশ বলতে থাকলো,
-‘আপনার জন্যে স্যার টিসেট, ট্রে এসব তো আজ রিকুইজিশন করে দেবো  তিন চার দিনের মধ্যে স্টোর থেকে এসেও যাবে  সে সব গেস্ট আর মিটিংয়ের জন্য রেখে দেবেন   এই শীতকালটার জন্য স্যার  কাঁচের গ্লাসে কেবলরামের  তৈরী গরম চা খাওয়া অভ্যাস করুন, সকালে, দুপুরে, বিকালে দেখবেন সারাদিন আর ঠান্ডা লাগছে না 

 

#

এই ছিল আমার সত্যপ্রকাশের সঙ্গে আলাপের প্রথম দিন 
ওর বয়েসটা, মানে অফিসিয়াল বয়সটা, জেনেছি বেশ কয়েক মাস পরে, সি আর লেখার সময় 
তবে প্রথম দিন দেখে মনে হয়েছিল আমার থেকে বছর দশেক বড়ো তো হবেই 
সেই বছর পঁয়ত্রিশ বয়সের সত্যপ্রকাশ প্রথম দিনটা থেকেই আমার লোকাল গার্জেন হয়ে দাঁড়াল 
রাজধানীর অফিসের কাজকর্ম তো শুরু করে দিলাম প্রবল উৎসাহে 
কিন্তু বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ালো ভাষা 
হিন্দি ভাষায় বলা কথার মানে মোটামুটি অনুধাবন করতে পারলেও গড় বাঙালীর হিন্দি বলা নিয়ে মহা সমস্যা 
বাঙালীর এই  ভালো করে হিন্দি বলতে না পারার ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবর ইন্টারেস্টিং লেগেছে 
পশ্চিমবঙ্গ হিন্দিভাষাভাষী রাজ্য দিয়ে ঘেরা 
কাজের খাতিরে হাজার হাজার  হিন্দিবলিয়ে লোক ভিন রাজ্য থেকে এসে আমাদের রাজ্যের  আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে  রয়েছে 
কিন্তু তারপরেও আমরা ঠিক করে হিন্দি বলাটা শিখলাম না   

ওই ভাষাতে জেন্ডার প্রয়োগের ব্যাপারটা বাঙালির ডিএনএ প্রব্লেম হয়েই থাকলো 
মুশকিল হচ্ছে হিন্দিটা শিখবো কাদের সঙ্গে কথা বলে ?
সেই হাজার হাজার হিন্দিবলিয়ে মানুষগুলো তো দুমাস যেতে না যেতেই গড়গড় করে বাংলা বলতে শুরু করে !
সে যাই হোক, এখন তো হিন্দিভাষী ভারতের রাজধানীর বুকে অফিস করতে বসে আমি পড়লাম  মহা সমস্যায় 
যা ভাবি, বুঝি, তা ঠিক করে বোঝতে পারি না 
অধস্তন সাধারণ কর্মচারীদের সঙ্গে সবসময় ইংরাজীতে কথা বলা বা কথার জবাব দেওয়াটাও ঠিক ব্যাপার নয় সেটাও বুঝতে পারছি 
একটা ভুল বার্তা যেতে পারে নতুন অফিসারের এটিচুডের ব্যাপারে 
সমস্যার সমাধানে সত্যপ্রকাশের নিদান ছিল সরলতর 
দুতিন সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের দুজনের একটা বন্ডিং তৈরী হয়েছে 
একান্তে আমার সমস্যাটা খুলে বলতেই সত্যপ্রকাশ বললো,
-‘এক মাস বড়ো জোর লাগবে স্যার  আপনি রোজ সকালে অফিসে এসে ভাও নিন, আজ একটাও ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করবেন না  আস্তে আস্তে বলুন, কিন্তু বলে যান  হয়তো ভুল হবে কিন্তু বলে যাবেন, থামবেন না  দেখবেন স্যার, এক মাসের মধ্যে কাজ চালানোর থেকে বেটার হিন্দি আপনি বলছেনবজরংবলীর গ্যারান্টি 
একমাসের মধ্যে না হোক, তিন মাসের মধ্যেই যে সত্যপ্রকাশের প্রেসক্রিপশন বেশ ভালো ফল দিতে শুরু করেছিল আজ পঁচিশ বছর দিল্লিতে কাটাবার  মনে আছে আমার 

 

#

ইতিমধ্যে একদিন লাঞ্চের সময়, সকলেই বেরিয়ে গেছে শীতের রোদ্দুরে একটু শরীর সেঁকে নিতে, আমি উঠবো উঠবো করছি হাতের ফাইলটার কাজ শেষ করে, টেকনিক্যাল য়াসিসট্যান্ট পবন তেওয়ারি এসে বসলো সামনে 
আমি চোখ তুলে তাকালাম, ‘কিছু বলবেন পবনজি ?’
তেওয়ারি ঘোরতর ব্রাহ্মণ, বাইরের খাবার খায় না মনে হয় 
রোজ তো দেখি টেবিলে বসে বাড়ি থেকে আনা খাবারে লাঞ্চ সারে 
বোধহয় ঘরেই সাজা পান চিবোতে চিবোতে প্রৌঢ় পবন তেওয়ারী বললো,
-‘না, তেমন কিছু না সার ভাবলাম, বোধহয়  আপনি আজ লাঞ্চ করতে বেরোচ্ছেন না 
ওয়ার্কিং শিটে  একটা ক্যালকুলেশন করছিলাম, লিখতে লিখতেই বললাম, ‘না, না, যাবো   এই মিনিট পাঁচেক  তারপর ক্যান্টিনে যাবো 
তেওয়ারি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপর বললো,
-‘না, মানে, আমি বলছিলাম স্যার, আমাদের সত্যপ্রকাশকে আপনার কেমন লাগছে ?’
এবার আমি অঙ্ক কষা থামিয়ে মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে 
ব্যাপারটা কি…অফিস রাজনীতি শুরু হয়ে গেলো না কি !’ 

পাশের অ্যাডমিন সেকশনের ইনচার্জ দীনেশদা, দীনেশ মিত্র, কদিন আগেই সাবধান করছিলেন,
-‘প্রথম বছরটা ভায়া নিজের সেকশনের  কারুর ব্যাপারে কক্ষণো বেশী  জাজমেন্টাল কথা বলবে না খুব সাবধান  অফিসটা খুব খারাপ জায়গা হে, বুঝবে ধীরে ধীরে 
সাবধানে বললাম, ‘বেশ ভালো তো, চটপটেউপকারী বটে
কথাটা বলেই আমি পবন তেওয়ারীর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের ভাব বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম 
প্রৌঢ় তেওয়ারী গলায় উৎসাহ এনে বললো,
-‘ওহী তো ! বহোত আচ্ছা লড়কা হ্যায়  আট বছর আমি দেখছি তো ওকে  খুব খাটিয়ে, কাজের ব্যাপারে সিনসিয়ার  তারপর আপনি ওই যে বললেন, রকম প্রবলেমের সলিউশন ওর কাছে পাবেন আপনি  ভেরি ইন্টেলিজেন্ট ঔর স্মার্ট ভি আছে 
ভাবলাম, নাঃ, ইউ পি ব্রাহ্মণের কথার ধরণটা তো জেনুইন মনে হচ্ছে, চুকলি কাটার মতো নয় 
পবন তেওয়ারী আবার বলে উঠলো,
-‘ব্যানার্জী সার, আপনি তো জানেন না কত খেটে, কষ্ট করে পরীক্ষা পাশ করে আজ সত্য ক্লার্ক হতে পেরেছে ।  এটাওয়া থেকে গ্রাজুয়েট ছেলে, কানপুর ইউনিভার্সিটি ! সাত সাতটা বছর এই সেকশনেই কন্ট্রাক্ট পিওন হয়ে ছিলডেলি ওয়েজ পিওন আমি দেখেছি তো, বিশ বিশ বছর লোক কন্ট্রাক্টে ডেলি ওয়েজে কাজ করে যায়, কনফার্মড হয় না  পোস্ট  হ্যায় কিধর স্যার !’
আমি এবার একটু কৌতূহলী হলাম 
গত দুমাসে অনেক কথাই হয়েছে, কিন্তু সত্যপ্রকাশ এসব তো কিছু বলেনি 
তবে বলবেই বা কেন ! দুঃখের দিনের কথা কে বা মনে রাখতে বা ঘটা করে বলে বেড়াতে চায় 
মিথ্যে বলবো না, সত্যপ্রকাশের কথাটা জানার জন্য মনের মধ্যে কৌতূহল হলো 
তবু কিছুটা নিস্পৃহভাবে বললাম, ‘আচ্ছা ! বেশ, ভালো তো !’
তেওয়ারী বলে চললো, ‘হ্যাঁ সার  সার্ভিস কমিশন থেকে পরীক্ষা পাশ করে সত্য ক্লার্ক হলো  এখানে সব অফিসার ওকে পছন্দ করতো, এখনও করে   আমাদের জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন মেহরোত্রা সাব, আই এস, এখন নেই, ট্রান্সফার হয়ে গেছেন  উনি পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট অপনার ব্যাচমেটকে বলে কয়ে এখানেই ওর পোস্টিং করিয়ে দিলেন দু বছর আগে  এখন আবার যদি তিন বছর বাদে পরীক্ষা দিযে পাশ করে,  তাহলেই ওর অন্য জায়গায় পোস্টিং হবে   খাটিয়ে ছেলে, ঠিক উঠে যাবে দেখবেন  এয়সা তো  ইউ পি কায়স্থ সার, শ্রীবাস্তব কিন্তু আমি ওকে আমার নিজের ছোট ভায়ের মতোই দেখি 
পবন তেওয়ারীর শেষ বাক্যটায় উত্তরপ্রদেশের জাতপাতবিচারের হালকা গন্ধ থাকলেও প্রৌঢ় মানুষটার আন্তরিক উক্তিটায় আমার কোনো সন্দেহ হলো না 

 

#

সেকালে মাসের প্রথমদিকে  স্টোর থেকে একজন পিওন এসে সেকশনের টেবিলে টেবিলে নতুন ইয়েরা কাঁচের গ্লাস রেখে দিয়ে যেতো 
এর পেছনের সরকারী আইডিয়াটা ছিল একমাসের মধ্যে আগের জল খাবার গ্লাসটা তো ভেঙে  যাবেই, তাই নতুন গ্লাসের  প্রয়োজন পড়বে 
অফিসে আমার দিন দশেক কেটে যাওয়ার পর সেদিন বোধহয় মাসের প্রথম সোমবার 
স্টোরপিওন যথারীতি নতুন গ্লাসের ঢের নিয়ে সেকশনে হাজির 
সেকশনইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের টেবিলের কাছে সে এগিয়ে আসতেই আমি আমার টেবিলের অক্ষত গ্লাসটার দিকে ইশারা করে ( তখনও হিন্দি কথোপকথন চালানোর ব্যাপারে সত্যর অমূল্য আশ্বাসবাণী আমার কর্ণগত হয়নি ) হাত নেড়ে আমার জন্য গ্লাসের অনাবশ্যকতা ঘোষণা করলাম
সত্যপ্রকাশ নিশ্চয়ই যথারীতি ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলো !
তাড়াতাড়ি  চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সে ইশারা করে  পিওনকে গ্লাস  প্লাস্টিকের ঢাকাটা আমার টেবিলে রাখতে নির্দেশ দিলো
তারপর নীচুগলায় সত্য উবাচ, ‘সার, নেবেন না কেন নিয়ে রেখে দিন টেবিলের নীচের ড্রয়ারে ! আপনার দুতিনজন গেস্ট আসতে পারেন যখন তখন গেস্টদের জল দেওয়ার জন্য পিওন তখন কোথায় খুঁজবে এক্সট্রা গ্লাস আপনি নিজেই অপ্রস্তুত হবেন
তারপর চারদিক একটু দেখে নিয়ে আরও নীচু গলায় বললো,
-‘আপনি না নিলেই বা কি ! ওই পেটি কনজিউমেবল একটা গ্লাস আর তার প্লাস্টিক ঢাকা আপনার নামে স্টোরে ঠিক ইস্যু হয়ে যাবে
বলেই তাড়াতাড়ি নিজের সীটের দিকে পা বাড়ালো 
আজ মনে পড়ছে, সত্যপ্রকাশের ওই ছোট্ট বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কিন্তু আমাকে দুটো পাঠ দিয়েছিলো 
প্রথমটা যদিও অফিসের ব্যাপারে অর্বাচীন আমার কাছে তখনও অচেনা, কিন্তু সহজবোধ্য  চালু সরকারী পাঠ
আর দ্বিতীয়টা ছিল শুস্ক বাতাবরণের দিল্লীর সাধারণ সামাজিক পাঠকেউ দেখা করতে এলে প্রথমেই তার সামনে খাবার জল রাখাবর্ষাসিঞ্চিত আর্দ্র বঙ্গের অধিবাসীদের মধ্যে সামাজিকতার  বিশেষ চল নেই



সত্যপ্রকাশের গল্প, তাই হোটেলে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে সত্যপ্রকাশকে জড়িয়ে এই সব পুরোনো কথা ভাবছিলাম
শীতকালের ছোট বিকেলের রোদ মরে আসতে শুরু করেছে
রাজধানীর রাস্তায় সপ্তাহান্তে গাড়ীর ভিড় কিছু কম নেই
বরং দিন যত গড়াবে সন্ধ্যেরাতের দিকে  বিনোদনপ্রিয় দিল্লীর মানুষ আরও বেশী সংখ্যায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে
ঘড়িতে দেখলাম চারটে বেজেছেসাধারণভাবে গেলেও আর কে পুরম থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে কনট প্লেস পৌঁছে যাবো
ওই সময়ের মধ্যেই সত্যপ্রকাশ হোটেলের কফিশপে থাকবে বলেছে
ড্রাইভারকে সেইরকম বলে দিয়ে আবার স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিলাম
আজকাল বেশ ভালো লাগে পুরোনো দিনের কথা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে
মনে মনে হাসলাম
বয়েস তার কোটার শেষ চতুর্থাংশে ঢুকে পড়বো পড়বো করছে, এখন এটাই তো স্বাভাবিক

 

#

কত কথাই তো মনে পড়ে যাচ্ছে
সর্দার প্যাটেল ভবনের সেকেন্ড ফ্লোরে, কোলকাতার হিসেবের  তিনতলায়, তিন বছর সময় কাটানোর কত ছোটখাটো অভিজ্ঞতা
তাড়াহুড়ো করে একবার লিফট বন্ধ হবার শেষ সময়ে না দেখে ভি আই পি লিফটে উঠে পড়েছিলাম
উঠেই ভীষণ বিব্রত, স্মিতমুখে আমার মন্ত্রী মাধবরাও সিন্ধিয়াজী  দাঁড়িয়ে, পাশে দাঁড়িয়ে একমাত্র মানুষটির চোখে ভ্রূকুটি
আমি সরি বলবো কিনা ভাবতে ভাবতেই মন্ত্রী বোধহয় পরিবেশটা সহজ করতেই  হাসিমুখে নাম জিজ্ঞাসা করলেন
পদবীটা শুনেই বললেন, ব্যানার্জী ফ্রম ক্যালকাটাসিটি অব টেগোর এন্ড রেইউ নো, ইওর প্রিয়রঞ্জন ইজ মাই ভেরি গুড ফ্রেন্ড
আমি চমৎকৃত হয়ে কিছু বলার আগেই ঘট করে লিফট থার্ড ফ্লোরে থেমে গেলো
মন্ত্রী হাতটা একটু তুলে হাসিমুখে দ্রুত নেমে গেলেন, সহচর দৌড়োলো পেছন পেছন
অফিসে ঢুকে এক অবসরে সত্যপ্রকাশকে বলেছিলাম আমার অভাবিত  অভিজ্ঞতার কথা
সত্যপ্রকাশ তখন মন্ত্রীর প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে গিয়েছিলো…’মন্ত্রীজি খুব অমায়িক, সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা, পার্সোনাল স্টাফও ওঁর সম্বন্ধে সবসময় ভালো ভালো কথা বলে‘, ইত্যাদি ইত্যাদি

 

#

সেকশনে ব্যবহারের জন্য স্টেশনারি, ফাইলকভার, নোটপ্যাড, পেন, পেন্সিল, ইরেজার এরকম অনেক জিনিসের জন্য স্টোরে রিকুজিশন মেমো যাচ্ছে
মেমো তৈরী করে সত্যপ্রকাশ আমার সইয়ের জন্য ফাইলটা নিয়ে এসে বললো,
আপনি দেখে সই করে দিন সার আপনার জন্য দরকারী স্টেশনারির এন্ট্রিও করে দিয়েছি  এছাড়া আপনার যদি কিছু লাগে, আপনার লাইনে জুড়ে দিন
আমি মেমোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সত্যকে জিজ্ঞাসা করলাম,
ক্যালকুলেটর ? ক্যালকুলেটর পাওয়া যাবে কি ?’
-‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সার আপনার এনটাইটেলমেন্ট আছে তো আপনি লিখে দিন সার
লিখে দিলাম একটা ক্যালকুলেটর, আমার নামের পাশে অন্যান্য স্টেশনারীর সঙ্গে
সই হয়ে রিকুইজিশন মেমো চলে গেলো স্টোর সেকশনে
পরদিন স্টোর থেকে আমার ইন্টারকমে ফোন
-‘ব্যানার্জী সার বলছেন ?
-‘বলছি কোথা থেকেকে বলছেন ?’
-‘স্যার, নমস্তে, আমি স্টোর এসিস্টান্ট হরবন্স বলছি
-‘নমস্তে, বলুন
-‘স্যার, আপনি ক্যালকুলেটর রিক্যুজিশন দিয়েছেন
-‘হ্যাঁ কিন্তু কোনো অসুবিধা থাকলে ঠিক আছে মেমোটা  চেঞ্জ…’
-‘ না না স্যার তা নয় আপনার লেভেলে, ম্যাথেমেটিক্যাল কেন, আপনি তো সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর পেতে পারবেন আপনি স্পেসিফাই করেননি তাই ফোন করলাম স্যার মেমোটা পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার আপনি প্লিজ লিখে দেবেন ক্যাসিও সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর
স্টোর সেকশনের কাজের দক্ষতায় বেশ অবাক বলতে গেলে কিছুটা খুশীই হলাম !
সেই আশির দশকে ক্যাসিও এফ এক্স  সিরিজের সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরের মালিক হওয়াটা বেশ গর্বের বিষয় ছিল 

আমার মতো সরকারী অফিসারের মাসমাইনের অর্ধেকের বেশী দাম ছিল সেই  ছোট্ট গ্যাজেটের
কিছুক্ষণের মধ্যে স্টোর পিওন এসে রিকুইজিশন মেমোতে লিখিয়ে নিয়ে গেলো
এবার রঙ্গমঞ্চে সত্যপ্রকাশের প্রবেশ
-‘কি হলো সারস্টোরের পিওন এলোরিকুইজিশন মেমোতে কিছু ভুল ছিল ?’
-‘না, তোমার কিছু ভুল নয় ওই আমার জন্য ক্যালকুলেটর লিখেছিলাম নাআমি তো ম্যাথমেটিকাল ক্যালকুলেটরই চেয়েছিলাম স্টোর বললো আমি ক্যাসিও সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর পেতে পারি  তাই লিখিয়ে নিয়ে গেলো
-‘, তাই !’ সত্যপ্রকাশের চোখের কোণায় যেন একটু হাসির আভাস দেখলাম
আমি বললাম, ‘ ওই হরবন্স না কে কথা বললো বেশ এফিসিয়েন্ট স্টোর এসিস্ট্যাণ্টকি বলো ? সিনিয়রদের এনটাইটেলমেন্টের খেয়াল রাখছে !’
-‘সার, ম্যাথেমেটিকাল ক্যালকুলেটরের দাম মেরেকেটে একশো টাকা আর ওই সায়েন্টিফিক ক্যাসিও দাম আমি ঠিক জানি না, তবে বেশ দামী হবে নিশ্চয়ই
-‘তা ক্যাসিও এফ এক্স হলে আটশো থেকে হাজার টাকা তো হবেই
-‘সেই তো ! মোদ্দা কথাটা হচ্ছে টেন পার্সেন্ট কমিশনের হিসেবে তো ক্যাসিওটাই তো কেনা উচিততাই না সার ?’




শীত  কেটে গিয়ে দিল্লীর গরম  এসে গেলো হুড়মুড় করে
ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়া দিল্লী শহরের অতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার রকমসকম কোলকাতানিবাসী এই বঙ্গসন্তানের জানা ছিল না
ছিল না পরিচয় বাংলা কালবৈশাখীর দিল্লী ভার্সন আঁধির সঙ্গে
সুতীব্র শীত কেটে যাবার পর বসন্তের আগমনী হোলির পর তড়িঘড়ি গরমকাল এসে গেলো
মাঝখানে বসন্তের প্রায় উঁকি দিয়ে চলে যাওয়াটা ধরা পড়লো কচিৎ কখনো নিস্তব্ধ দুপুরে কোকিলের ডাকে আর সংসদ মার্গের দুধারে লাগানো অজস্র জামগাছের শুকনো পাতা রোজ ঝরে পড়ে  সুন্দর লালরঙের টালিবাঁধানো ফুটপাথের রং বদলে হলুদ করতে থাকলো
কর্পোরেশনের  লোক এসে ঝাঁট দিয়ে পাতার ঢের একজায়গায় করে তাতে জল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়, সারা দুপুর ধিকি ধিকি আগুন জ্বলতে থাকে
আমাদের বিরাট অফিস হলটার ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশনে কিছু বদল হলো
এক সোমবার অফিসে এসে দেখি সপ্তাহান্তে হলঘরের বড়ো বড়ো জানলায় ওপর থেকে নীচে ঝুলে গেছে খসখসের বিরাট বিরাট পর্দা
খসখসের একটা মিষ্টি বুনো গন্ধের সঙ্গেও সেই প্রথম পরিচয় আমার
দেখি একটা নতুন লোক সেকশনে আসছে দিনে দুবার, একবার সকালে, অফিস শুরু হওয়ার মুখে, আর একবার লাঞ্চের সময়
তার কাজ হচ্ছে বালতি থেকে জল নিয়ে সেই খসখসের পর্দাকে আগাগোড়া ভিজিয়ে দেওয়া
আমার চলমান সরকারী অভিধান অযাচিত ভাবে জানালেন, এরা সব কন্ট্রাক্ট ডেলি ওয়েজ লেবার, চারমাস কাজ পায় প্রতি বছর এই গরমকালটায় এক একজনের দায়িত্বে তিনচারটে করে হলঘর
ভাবলাম, বাঃ, বেশ ভালো ব্যবস্থা তো !
একবার ভাবলাম সত্যপ্রকাশকে জিজ্ঞাসা করি, তার সরকারী চাকরির জীবনও তো এইরকম কন্ট্র্যাক্ট  ডেলি ওয়েজ দিয়ে শুরু হয়েছিল
ভেবেই তক্ষুনি সামলে গেলাম, ব্যাপারটা ঘোর অনৈতিক হবে
যে মানুষটা এই প্রায় নির্বান্ধব বিদেশে দিনের মধ্যে আটঘন্টা আমার সবকিছুর খেয়াল রাখছে, তাকে অপ্রস্তুত করে দুজনের জন্যেই এক অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করা একেবারেই অনুচিত কাজ হবে
এই সব কথা মনের মধ্যে আনাগোনা করছে, ঠিক সেই সময়েই সত্যপ্রকাশ একটা সবুজ নোটশিট নিয়ে এসে বললো,’সার, আপনার তো একটা কুলার পাওয়ার কথা এই গরমকালের চারমাসের জন্য ডিমান্ড নোট  টাইপ করে এনেছি, সই করে দিন  এটা জেনারেল ওয়ান সেকশনে যাবে ওখানকার এস মানুষটা চোপড়া খুব ঢিলা, তিনচারদিন তো লাগিয়ে দেবেই
সত্যপ্রকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নোটটা সই করতে করতে আমার একমিনিট আগেকার সিদ্ধান্তের কথা ভেবে খুব স্বস্তি বোধ করলাম

 

#

কুলার তো এসে গেলো দিন সাতেকের মধ্যেই, পুরোনো লোহার কাঠামো আর চাকা লাগানো স্ট্যান্ডে  নতুন সিলভার পেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে
সত্যপ্রকাশের শব্দময় তত্ত্বাবধানে সেকশনের পিওন সেটা আমার চেয়ারের ঠিক পিছনে স্থাপন করলো
তার পরের দিন সকালে ডেলি ওয়েজ খসখসওয়ালা সেই কুলারকে জলপূর্ণ করলো
যথাযথ গাম্ভীর্যের সঙ্গে সত্যপ্রকাশ তাকে জানিয়ে দিলো এই কুলারের জলস্তরের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজনীয় জল ভরে একে পূর্ণ করার কাজ তার রোজকার কর্তব্যের মধ্যে পড়ছে
এরপর সেই কুলারকে চালু করা হলো
সত্যপ্রকাশকে প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি পৃষ্ঠদেশে অপেক্ষাকৃত মনোরম আবহাওয়ার মধ্যে কাজ করতে শুরু করলাম
কিন্তু সেই কুলার ঘন্টাখানেক চলবার পরেই মহা বিপত্তি শুরু হলো
কুলারের ঠান্ডা হাওয়ার সাথী হয়ে যে অতিক্ষুদ্র জলকণার রাশি উড়ে এসে আমার প্রীতিবর্ধন করছিলো তাদের আকার দ্রুত বাড়তে থাকলো
চালু হওয়ার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই  কুলার থেকে এমন জলবিন্দুর  বৃষ্টি হতে থাকলো যে আমার জামার পিঠের অংশ ভিজে  সপসপে হওয়ার উপক্রম
বাধ্য হয়ে কুলারের সুইচ অফআমার ক্ষণস্থায়ী সুখের বদলে আপাতত স্বস্তি ফিরে এলো
এবার সত্যপ্রকাশের পালা
অনতিবিলম্বে সে আবার সেই ডিমান্ড নোটের ফাইলটা, যেটা দিন চারেক আগেই জেনারেল সেকশন থেকে  ফেরত এসেছিলো, সেটা নিয়ে আমার সামনে হাজির
-‘সার, একটা কমপ্লেন দিতে হবে তোটাইপ করে এনেছি সই করে দিনএখনই পাঠিয়ে দিই
সত্যপ্রকাশের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে সেই এক লাইন নোট পড়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ
-‘আরে সত্য ! এটা কি টাইপ করেছো, ‘…I requested for a cooler….not a shower !’  যাহ রকম  লেখা যায় নাকিঅফিসিয়াল নোট ! আমি সাইন করবো না
সত্যপ্রকাশ নির্বিকার মুখে বললো, ‘চোপড়ার এমন কাজের ওইরকমই জবাব হবে সার সই করে দিন , কিচ্ছু হবে না  আপনি ইউপিএসসি অফিসারকুলার চেক করে পাঠায়নি কেন !’
ওপাশ থেকে পবন তেওয়ারি, ডানদিক থেকে জৈন, শর্মা, সবাই মিলে হৈ হৈ করে বলে উঠলো,
-‘দিন, দিন, স্যার নোটটা পাঠিয়ে টেকনিক্যাল সেকশনগুলো যেন ওদের জন্য সব ডাম্পিং গ্রাউন্ড পারবে ফাইনান্স সেকশনে  পাঠাতেডিফেক্টিভ কুলার ?’
সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সই করে দিলাম সেই অসাধারণ কমপ্লেন নোটে
এক ঘন্টার মধ্যেই ইন্টারকমে চোপড়া মহোদয়ের ফোন,
-‘ব্যানার্জি সাব বোল রহে হ্যায় ? নমস্তে ! ইয়ে আপনে কুলার কা লিয়ে কেয়া লিখ দিয়া সার ! এক ফোন কর দেতে আপ
আমিঅফেন্স ইজ দি বেস্ট ডিফেন্সনীতি ফলো করে,
-‘শ্যুড আই কাম টু ইউ টু শো মাই ওয়েট সার্ট ?’
-‘নহী নহী জি ঠিক হ্যায়….কোই বাত নহী সারদেখতে হ্যায়কুছ করতে হ্যায়
এর ঠিক সাত দিনের মাথায় ব্র্যান্ড নিউ কুলার এসে গেলো আমার সেকশনে



এহেন সত্যপ্রকাশকে আমাদের ওই সেকশনে চার বছরের বেশী রাখা যায়নি
তিন বছরের মাথায় আমি দিল্লিতেই মিনিস্ট্রির আর একটা অফিসে টেম্পোরারি ট্রান্সফার হয়ে গেলাম একটা প্রজেক্টের কাজে
সেখানেই একদিন ফোনে সত্যপ্রকাশ একটু উত্তেজিত স্বরে ভালো খবরটা জানালো, এস এস সির প্রোমোশনের পরীক্ষায় পাশ করে গেছে
এর পরে নাকি এমপ্যানেলড লিস্ট  বেরোবে
তার পরে ভেকেন্সি অনুযায়ী এসিস্ট্যান্ট পোস্টে প্রমোশন হবে
খবরটা শুনে আন্তরিকভাবে  খুশী হয়ে ওকে কংগ্র্যাচুলেট করলাম
আর সঙ্গে সঙ্গে আমার পবন তেওয়ারীর কথাটা মনে পড়ে  গেলো, কি যেন বলেছিলো…’ইউ পির কায়স্থ স্যার , খাটিয়ে ছেলে, ওপরে উঠবেই
নাঃ, ছেলেটা সত্যি পরিশ্রমী আছে এইসব ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষাগুলোর পাশ পারসেন্টেজটা জানি তো ! সিলেকশন নয়, প্রসেস অফ এলিমিনেশনটাই সুচারুভাবে ফলো করা হয়
আমার অভিনন্দনের উত্তরে একটু দুঃখের গলায় সত্য বলেছিলো যে, প্রমোশন পেলে এবার তো তার বদলি অবশ্যম্ভাবী
আমি উৎসাহ দিয়ে হেসে বলেছিলাম যে, তাতে কি হয়েছে, সেকশন অফিসার হয়ে একদিন হয়তো এই অফিসেই ফিরে আসবেমিনিস্ট্রিগুলোতে এরকম  হামেশাই হচ্ছে
সত্যপ্রকাশ, ‘আপনার শুভেচ্ছার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার, অনেকটা সময় নিলাম আপনার, এবার ছাড়ি স্যার‘, বলে ফোনটা নামিয়ে রেখেছিলো
কোন মাহেন্দ্রক্ষণে কথাটা বলেছিলাম কে জানে, আমার ভবিষ্যৎবাণীর প্রথমাংশ ফলে গেলো আরও  বছর দশেক পরে
ততোদিনে আমার পদ বৃদ্ধি হয়েছে কয়েক ধাপ
পদমর্যাদা যত না বেড়েছে দায়িত্ব বেড়েছে তার অনেক বেশী
দিল্লীর সরকারী কাজের ধারা অনুযায়ী প্রায় প্রতিদিন  বিকেল চারটে অবধি তো কেটে যায় অপ্রয়োজনীয় কিঞ্চিৎ প্রয়োজনীয়  মিটিংগুলো সারতে
তারপরে বসতে হয় নিজস্ব অফিসিয়াল কাজ  নিয়ে
 এই সব নানারকম চাপের মধ্যে সত্যপ্রকাশের সঙ্গে যোগসূত্র কেবল দূরভাষের মাধ্যমে থেকে গেছে
তাও বলতে গেলে সে প্রায় একতরফা, মাসের মধ্যে একটা ফোন আসবেই তার কাছ থেকে, দেওয়ালী, দশেরা আর  হ্যাপি নিউ ইয়ার সমেত
হ্যাঁ, আমার সার্ভিস বুকের বার্ষিক এন্ট্রিগুলো ভেরিফিকেশন করার সুবাদে আমার  জন্মদিনের তারিখটাও সত্যপ্রকাশের জানা ছিল
তাই  একটা হ্যাপি বার্থডে ফোনও আসতো নিয়ম করে প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে
সেইরকম এক জন্মদিনের শুভেচ্ছার ফোনের মধ্যে সত্য জানালো যে সে সেকশন অফিসারের  সিলেকশন গ্রেডের জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলো এবং ভেতরের খবর অনুযায়ী সে পাশ করে গেছে
সুতরাং ব্যানার্জী স্যারের দশ বছর আগে করা ভবিষ্যৎবাণীর অসম্মান সে হতে দেয়নি, এখন সে বদলি হয় কিনা, কোন মিনিস্ট্রিতে পোস্টিং পায় সেটাই দেখার, ইত্যাদি, ইত্যাদি
আমি দারুন খুশী হয়ে বললাম,
-‘আমার জন্মদিনে তুমি এমন একটা ভালো খবর দিলে সত্য, এবার আমি তোমাকে খাওয়াবো চলে এস একদিন, শাস্ত্রী ভবন থেকে অফিসের পরে ডেফ কলেলেট্ আস মিট



সেই দেখা হয়েছিল সত্যপ্রকাশের সঙ্গে, সেও প্রায় বছর আটেক  হয়ে গেলো
ছোটোখাটো চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে দেখলাম, ঝুলফিতে সাদারঙের সঙ্গে চুলেও পাক ধরেছে
কথাবার্তা একটু ধীরে বলছে, কিন্তু আমার প্রতি সেই সম্ভ্রম মেশানো আন্তরিক ভাবের কোনো কমতি নেই
আমি সেদিন রেস্টুরেন্টে বসে আমার প্রাক্তন অধস্তন কর্মচারীকে কিছুটা শ্রদ্ধার চোখে দেখছিলাম
দেখছিলাম একজন সফল পরিশ্রমী সরকারী কর্মচারীকে, যে কেবল নিজের অধ্যবসায়ের জোরে সরকারী চাকরির সিঁড়ির কষ্টকর তিনটে ধাপ পার করে আজ এইখানে এসে পৌঁছেছে
সেদিন সন্ধ্যায় সত্য কিন্তু বেশীক্ষন বসতে পারেনি, কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিল
আশ্চর্য্য, সেদিনই প্রথম জানলাম যে থাকে দিল্লীর পশ্চিম প্রান্তে জনকপুরীর সি ব্লকের ডিডিএ ফ্ল্যাটে 

আরও বললো, সাড়ে সাতটায় মধ্যে বেরোতে  না পারলে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত  দশটা বেজে যাবে
আমিও সেদিন জোর করিনি
আজ সত্যপ্রকাশ একজন রিট্যায়ার্ড সিলেকশন গ্রেডের সেকশন অফিসার
যতদূর মনে পড়ছে চাকরির শেষ দুবছর ডেপুটেশনে ছিল, বোধহয় নির্মাণ ভবনে
আমাকে ফোনে বলেছে, সময় নিয়ে আসবেন স্যার, আজ আর ফেরার তাড়া থাকবে না
তারপর হেসে বলেছে, কাল তো আর অফিস নেই আমার, কোনোদিনই নেই
আর তাছাড়া কাল তো রবিবার, আপনারও ছুটির দিন

 

#

দি পার্কহোটেলের একতলার কফিশপের  চারটে দেওয়ালের প্রায় পুরোটাই কাঁচের
বাইরে থেকে ঢুকলে ভেতরের কৃত্রিম হালকা ডিজাইনার আলোতে প্রথমে কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে
কাঁচের বিশাল দরজা ঠেলে ঢুকে এদিক ওদিক দেখছি, দূরে একেবারে কোণার দিকে একটা ছোট দুজনের টেবিলে দেখলাম সত্যপ্রকাশ, উঠে দাঁড়িয়ে হাত  নাড়ছে
টেবিলের কাছে এগিয়ে যেতেই সত্যপ্রকাশ একটু এগিয়ে এসে দুহাতে আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা জড়িয়ে ধরলো ওর মনের উত্তেজনা আঙুলে সঞ্চারিত হয়েছে সেটা টের পেলাম
উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,
-‘তারপর সত্যপ্রকাশ, কতদিন পর ! দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে দিলে তাহলে !’
সত্যপ্রকাশের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে মনে হলো একটা ক্লান্তির ছায়া
হালকা হেসে বললো,’ হ্যাঁ স্যার কাজ করার ইচ্ছা আর ক্ষমতা থাকলেও এই সময়টা তো সব  সরকারি কর্মচারীকেই একদিন দেখতে হয়
ভালো করে দেখলাম সত্যকে  চুল কিছুটা সাদা কালো হয়ে যাওয়া ছাড়া বয়সের লক্ষণ বিশেষ ছাপ ফেলেনি ওর শরীরে  চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে অবশ্য
সে যাক, একটু ঝুঁকে পড়ে নীচু গলায় বললাম,’কিন্তু সত্য, তুমি এই ভীষণ এক্সপেন্সিভ হোটেলে আমাকে চা খাওয়াতে  ডাকলে কেন ? আমরা তো সিপিতে অন্য অনেক জায়গায় যেতে পারতাম বা  ডেফ কলে যেতাম শোনো, এই ট্রিটটা কিন্তু আমার তরফ থেকে
-‘ না স্যার সেটা হয় না আপনাকে এই হোটেলে যে ডেকেছি তার একটা কারণ আছেএবার সত্যর গলার স্বরেও  যেন ক্লান্তির আভাস
সত্যপ্রকাশ ধীরে ধীরে আবার বললো, ‘পেছনের দিকে হাঁটতে চাই স্যার  আপনার মনে আছে ঠিক এই হোটেলটার জায়গায় পঁচিশ বছর আগে কি ছিল ?’
ঝট করে আমার মনে পড়ে  গেলো, তাইতো, ঠিক এই জায়গাটায় একটা বড়ো প্রাইভেট বাগানের সামনের দিকে  ছোট একতলা হলুদ রঙের বিল্ডিং ছিল, সামনের দুটো কামরায় একটা কফি শপ
কতদিন বিকেলে আমরা দুজনে অফিসের পর এখানে এসে কফি আর পনীর পকোড়া খেয়েছি
আমি কিছু বলার আগেই সত্য আবার বললো,
-‘কত দিন বিকেলে অফিসের পর আপনি আর আমি হেঁটে হেঁটে এখানে আসতাম  যন্তরমন্তর থেকে আপনি বাস ধরার আগে, ঠিক এই জায়গাটায় যে  কফি শপটা ছিল, সেখানে আপনি কতবার আমাকে কফি, পকোড়া খাইয়েছেন  কত গল্প করেছেন, কলকাতার গল্প, আপনার ছাত্রজীবনের  মজার গল্প সবসত্য স্নিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো
আমি বললাম, ‘তুমি বলতেই আমার সব মনে পড়ে গেলো তাইতো, কতোগুলো সুন্দর বিকেল এখানে কেটেছিল আমাদের  এখন ভাবতেই ভালো লাগছে
-‘হ্যাঁ স্যার অসম হলেও আপনার বন্ধুত্বটা বোধহয় এখানেই আমি পেয়েছিলাম কিন্তু সেসময়ে  আমার যে কথাগুলো আপনাকে বলা উচিত ছিল তা আমি বলিনি, বলতে পারিনি তাই ভাবলাম আজ ঠিক এইখানে, এই রেস্ট্যুরেন্টে বসে  আপনাকে সে নাবলা কথাগুলো বলি
সত্যপ্রকাশের চোখ বাইরের দিকেকাঁচের দেওয়াল পেরিয়ে দূরে কোথাও
আমি সত্যপ্রকাশের দিকে তাকিয়ে আছি
মনের মধ্যে দ্রুত প্রশ্ন জাগছে, ‘কি কথা বলতে চায় !’
ইতিমধ্যে ওয়েটার এসে দুজনের সামনে দুটো প্লেট স্যান্ডুইচ আর পনীর পকোড়া রেখে গেলো
বুঝলাম সত্যপ্রকাশ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিলো
সত্য বললো, ‘খান স্যার, প্লিজ আমি ভুলিনি, জানি তো দুটো জিনিসই আপনার প্রিয়
আমি খালি প্লেটে খাবার  তুলে নিতে নিতে বললাম, ‘তুমি কি যেন বলবে বলছিলে
সত্যপ্রকাশের ক্লিষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
-‘হ্যাঁ স্যার আজ তো বলবো বলেই ঠিক করে এসেছি আপনাকেই প্রথম বলবো, আর হয়তো বা শেষ বার সে সব কথা শুনলে আপনি হয়তো আমাকে নীচ ভাববেন আপনার মনে যে জায়গাটা আছে আমার জন্যে, সেটা হয়তো আমি হারাবো চিরদিনের জন্যে  কিন্তু  না বলে আমার আর কোনো উপায় নেই আজ
আমি যারপরনাই আশ্চর্য হলাম, ওর গলার স্বরে, ওর কথায়
সামলে নিয়ে হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে দিয়ে বললাম,
-‘এরকম কখনো হবে না তুমি নিশ্চিন্ত থাকো সত্যপ্রকাশ
সত্যপ্রকাশ ঝটিতি আমার চোখে চোখ রেখে চাপা ফিসফিসে গলায় বলে উঠলো, ‘আমি সত্যপ্রকাশ কুমার নই স্যার
আমি একটু হতভম্ব হয়ে গেলাম, সত্য এটা আবার কি বলছে !
পরক্ষনেই চারদিকটা একটু দেখে নিয়ে আমিও নীচু গলায় বললাম,
-‘জানি তো ! ইউপিতে অনেক কায়স্থরা পদবী না লিখে কুমার লেখে, তুমি বলেছিলে তোমার পুরো নাম বোধহয় সত্যপ্রকাশ শ্রীবাস্তব
-‘ না স্যার আমি শ্রীবাস্তব নই, ওটা ফলস, মিথ্যে আমার আসল নাম সত্যপ্রকাশ মাথুর‘ 

সত্যের গলার স্বরে চাপা উত্তেজনার সঙ্গে যেন একটা আকুতি
আমি একমুহূর্তের জন্য প্রায় হতবাক হয়ে গেলাম 

একমুহূর্ত চুপ থেকে হাসির গলায় বললাম,
-‘ওই একই হলো সারনেমটা অন্য  তুমি জানো না, হোয়াট ইন নেম‘ ?
-‘জানি শেক্সপীয়ার, রোমিও জুলিয়েট, বিএ ফাইনাল ইয়ারে ছিল স্যার কিন্তু উনি ভুল বলেছেন নামে অনেক কিছু আসে যায় এই আমি, আপনার সামনে বসে আছি, আমিই তার প্রমাণ
সত্যপ্রকাশ কথাটা বলে কাঁচের দেওয়ালের মধ্য দিয়ে বাইরের বড়ো রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলো
কি বলবো বুঝতে পারছি না
সত্যপ্রকাশের মনের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে বুঝতে পারছি
এতদিনের চেনা মানুষটা কেমন যেন অচেনা লাগছে আমার কাছে
চুপ করে রইলাম সত্যপ্রকাশ বাইরের থেকে মুখ ফিরিয়ে আনলো, দুঃখের চোখ তার
-‘আমরা স্যার মাথুর, কায়স্থ কোনো কালে হয়তো আমার পরদাদারা মথুরা অঞ্চল থেকে এসে এটওয়াতে বাস করতে শুরু করেছিল কিন্তু আমার বাবার সময় থেকেই আমরা কুমার লিখি, বাবা মাথুর পদবী বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন এটওয়ার কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে আমি দিল্লী চলে আসি কাজের খোঁজে তেমন কিছুই পাচ্ছিলাম না ধীরে ধীরে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম  দেশোয়ালী চাচার বাড়ি আর কতদিনই বা থাকে যায় শেষে আমাদের মিনিস্ট্রিতে ডেলি ওয়েজে কন্ট্রাক্ট পিওন হয়ে ঢুকেছিলাম স্যার সাত বছর সেই কাজ করেছি যে সেকশনে আপনি প্রথমে এসে আমাকে এলডিসি দেখেছেন, সেখানেই পিওন ছিলাম স্যার, সকালে বিকালে চা করেছি, ফাইল আনানেওয়া করেছি এসব কথা কোনোদিন বলিনি আপনাকে স্যার, বলতে পারিনি
সত্যপ্রকাশ থামলো আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি 

আজ আর সত্যকে বলা যায় না সেই পঁচিশ বছর আগেই আমি পবন তেওয়ারীর কাছ থেকে একথা জেনেছিলাম
কফি দিয়ে গিয়েছিলো আমি কফির কাপ তুলে নিয়ে সত্যের দিকে ইশারা করলাম
কফির কাপে চুমুক দিয়ে সত্য আবার বলতে শুরু করলো,
-‘স্যার আপনার মনে আছে, তখন গরমকালে টেম্পোরারী কনট্র্যাক্ট লেবার নেওয়া হতোমাস চারেকের জন্য..জানলার খসখসের পর্দায় জল ছেটাতো, কুলারে জল ভরতো ? এখন আর নেই,সব বিল্ডিংয়ে এসি
আমি ঘাড়  নাড়লাম, মনে আছে আমার
যেন অনেক দূর থেকে সত্যপ্রকাশের কথা ভেসে আসতে লাগলো,                    .
-‘আমি তখন পিওন, সাত বছর চলছে আমাদের সেকশনে সেরকম একজন কনট্র্যাক্ট লেবার এলো, আমার নেমসেক, সত্যপ্রকাশ কুমার মার্চ থেকে জুনপরপর দুটো সীজন, জল ছেটাতো খসখসের পর্দায়, কুলারের জল পাল্টাতো আমার মতোই গ্র্যাজুয়েট, হাপুরে বাড়ি আমার থেকে বয়সে বেশ ছোটই ছিল ছিল শ্রীবাস্তব নতুন নতুন দিল্লিতে এসে পাক্কা কিছুই পাচ্ছিলো না যা পেতো, তাই করতো সেবার জুন মাসে ওর কনট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেলো জুলাই মাসের একদিন রেজিস্ট্রি সেকশন থেকে ডাক বেছে আনছি, দেখি হলদে সরকারী খামে একটা চিঠি, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে, সত্যপ্রকাশ কুমারের নামে ছেলেটা বোধ হয় আমাদের অফিসের ঠিকানাটা দিয়েছিলো এক্সচেঞ্জে নাম এনরোলমেন্টের সময় দেখেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো স্যার এর আগে বছরের পর বছর নাম রিনিউ করিয়েছি, কোনো চিঠি আসেনি, কোনো কল পাইনি আর এই ছেলেটা, আমার পরামর্শে এক বছর আগে নাম লিখিয়েইকান টান গরম হয়ে গেলো স্যার এক ফাঁকে চিঠিটা খুলে দেখি এক মাস পরে রিটন পরীক্ষা সকালে, তারপরে বিকালে ইন্টারভিউ পরীক্ষার আগে সমস্ত একাডেমিক টেস্টিমোনিয়াল জমা দিতে হবে
একমাস এস চাঁদএর  এলডিসি পরীক্ষা আর কারেন্ট এফেয়ার্স পড়ে নিয়ে চলে গেলাম স্যার, নির্দিষ্ট দিনটায় মনে আছে সফদরজং এনক্লেভের একটা স্কুলে পরীক্ষা হয়েছিল
আমি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম সত্যপ্রকাশ সেটা লক্ষ করে থেমে গেল
আমি তখন বললাম, ‘ কিন্তু সত্যআই ডি, পুলিশ ভেরিফিকেশন ?’
সত্য ম্লান হেসে বললো, ‘তখন কোথায় ফটো আই ডি স্যার ! তার  কত বছর পরে ইলেকশন কার্ড এলো। এটাওয়াতে তিনপুরুষের জানাশোনা আমাদের পরীক্ষা আর ইন্টারভিউয়ের চিঠিটার ডিটেল অনুযায়ী একটা ফলস রেশন কার্ড আর একটা ব্যাকডেটে এফিডেভিট করালামশ্রীবাস্তব থেকে কুমার আমার বাবার নামটাও বদলে গেলো স্যার সত্যপ্রকাশের স্বর প্রায় বন্ধ হয়ে চুপ করে গেলো
প্রৌঢ় মানুষের, বিশেষ করে অতি পরিচিত মানুষের রুদ্ধ আবেগের সাক্ষী হওয়াটা বেশ বেদনার
কিন্তু কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলাম
একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে আবার বলতে শুরু করলো,
-‘ পুলিশ ভেরিফিকেশন ম্যানেজ করতে সেই তখনকার দিনে চারহাজার টাকা লেগেছিলো স্যার পরিবারের কেউ জানলো না  আজ পর্যন্ত জানে না এমন কি আমার স্ত্রী না পরীক্ষা দিলাম বিকেলে দিলাম ইন্টারভিউ শুনেছিলাম বিভিন্ন সেন্টারে সব মিলিয়ে দশ হাজারের বেশী বসেছিল পরীক্ষায়, দুশোটা ভেকেন্সির  জন্য পাশ করে গেলাম স্যার এল ডি  সি প্যানেলে নাম বেরিয়ে গেলো আমাদের সেকশনের লোকেদের সে কি আনন্দ সবাই মিলে চাঁদা তুলে আমাকে একটা স্যুটের কাপড় কিনে দিলো মেহরোত্রা সায়েব আই এস ছিলেন আমাদের মিনিস্ট্রির জে এস এডমিন, আপনি তাঁকে দেখেননি খুব ভালোবাসতেন আমাকে ব্যাংকের সব কাজ, নির্মাণ ভবনে যাওয়া, অন্য টুকিটাকি সব  কাজ করে দিতাম সব শুনে খুব খুশী হয়ে আমাকে বললেন, তেরা পোস্টিং ইধারি করাতা  হুঁ তু ইঁহাই রহেগা যে কথা সেই কাজ  সত্যপ্রকাশ কুমারএলডিসিপোস্টিং হয়ে গেলো সেই একই মিনিস্ট্রিতে মেহরোত্রা সাহেবের দয়ায় যে সেকশনে টুলে বসে চা বানাতাম, ফাইল নিয়ে যেতাম, সেখানে পেলাম বসার চেয়ার বদলে গেলাম আমি, আপাদমস্তক সময়ে সেকশনের লোকজনও  বদলাতে থাকলো তেওয়ারি স্যার ছিলেন সব থেকে বেশী দিন আমার জায়গায় এলো কেবলরাম আমার ছেড়ে দেওয়া টুলে বসে চা বানাতে থাকলো প্রায়ই চোখ চলে যেতো আমার কেবলরামের দিকে  তারপর দেখতাম নিজেকে  বিশ্বাস হতো না স্যার, স্বপ্ন দেখছি মনে হতো সবসময় মনে হতো আমার অনধিকারের চেয়ার  অন্য এক মানুষের জায়গা দখল করে বসে আছি তখনি ঠিক করে ফেলেছিলাম এই চেয়ার, এই এলডিসি চেয়ার থেকে আমাকে বেরোতে হবে, হবেই পাঁচ বছরের কাটলেই পরের ধাপের পরীক্ষাটা আমাকে ক্লিয়ার করতেই হবে তারপর স্যার এলেন আপনি আপনার আন্ডারে কাজ করে কেন জানি না গ্লানিটা অনেকটাই ভুলে গিয়েছিলাম  যতদিন আপনার সঙ্গে কাজ করেছি এতো আনন্দ পেয়েছি সে আমি আজ আর আপনাকে কি বলবো স্যার
সত্যপ্রকাশ হঠাৎ চুপ করে গেলো আমিও চুপ
কফিশপের নিরবচ্ছিন্ন গুঞ্জনও সেই নীরবতা কাটাতে পারছে না
আমি সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেই অন্য সত্যপ্রকাশ ? সে তো আর আসে নি আমি তো তাকে  দেখিনি
সত্য বাইরের দিকে তাকিয়েছিলো মুখটা ফিরিয়ে আনলো আমার দিকে, চোখে তার কষ্টের ছায়া
মাথা নাড়লো প্রথমে, তারপর আস্তে বললো,
নাহ স্যার  সে আর কখনো আমাদের বিল্ডিংয়ে আসেনি এই ডেলি ওয়েজের কাজগুলো তো সব জেনারেল সেকশনে জানাশোনাতে পাওয়া যায়  কে জানে, হয়তো তার চেনা দেশোয়ালি এস বা অন্য কেউ বদলি হয়ে গেছিলো
আমি চুপ করে পনীর পকোড়া নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম খাবার ইচ্ছে চলে গেছে একেবারে
হঠাৎ চাপা হাহাকারের মতো সত্যপ্রকাশ বলে উঠলো, ‘বাবাকে তার মৃত্যুশয্যায়ও বলতে পারলাম না স্যার সত্যি কথাটা কি বলতাম আমি, আপনি বলুন ? মৃত্যুপথযাত্রী বুড়ো মানুষটাকে একটা অতো বড়ো ধাক্কা আমি দিতে পারিনি তার দেওয়া নামটার মর্যাদা আমি রাখতে পারিনি স্যারসত্যর চোখের কোণ চিকচিক করছে স্পষ্ট দেখতে পেলাম
আমি প্রমাদ গুণলাম এবার তো অন্য টেবিলের লোকেরা নজর করবে
তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে সত্যপ্রকাশের হাতে চাপ দিয়ে নীচু গলায় বললাম,’সত্য, কুল ডাউন, কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ সব ঠিক আছে
সত্যপ্রকাশ মাথাটা নেড়ে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে জল খেলো তারপর  চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলো পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে
আমি বললাম, ‘ তুমি পুরোনো কথা ভেবে এতো কষ্ট পেওনা  তোমাকে যারা ভালো করে জানে, যেমন সেই পবন তেওয়ারী, আমিও তার মধ্যে একজন, তারা জানে তুমি তোমার ভবিষ্যৎ নিজেই গড়েছো  তুমি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আজ সে জায়গাটা তুমি নিজের মেরিটে অর্জন করেছো
সত্যপ্রকাশ আবার যেন হাহাকার করে উঠলো, ‘ কিন্তু স্যার সে তো সত্যপ্রকাশ শ্রীবাস্তব নয়, সে তো অন্য মানুষ
তো মহা মুশকিল হলো সরকারী সিনিয়র সিটিজেন এতো অবুঝ হলে তাকে বোঝাই কি করে !
বললাম, ‘মানুষটা তো বদলায় নি সত্য, তার মেধাবুদ্ধি নিয়ে সে একই আছে বাইরের পরিচয়টা তার  যাই  হোক না কেন
সত্য দুহাতের তালুর মধ্যে মুখটা নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন
আমি ঠান্ডা কফির কাপে চুমুক দিলাম একটা
সত্যপ্রকাশ মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে আমার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত ধীর কিন্তু ক্লান্তস্বরে বললো,
-‘স্যার, আজ আপনাকে যা বললাম, তা আপনি ভিজিলেন্সে জানাতে পারেন লম্বা ইনকোয়ারি শুরু হবে  আমার পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে হয়তো পঁচিশ বছরের মাইনের টাকা তো আর ফেরত দিতে পারবো না তাই জেল হয়ে যাবে নিশ্চয়ই আমি এখন সব কিছুর জন্য…’
আরে এর মাথা তো একেবারে গেছে‘…ভেবে আমি তাড়াতাড়ি ওর কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠলাম,
-‘তুমি আমার ব্যাপারে এরকম কথা ভাবলে কি করে ! আমি, দিল্লীতে আমার প্রথম বন্ধু সত্যপ্রকাশ কুমারকে, সে আদতে শ্রীবাস্তব বা মাথুর যাই হোক না কেন, সেই মানুষটাকে ভালো করে চিনি তার ব্যাপারে কি করতে হবে না হবে আমি ভালো করে জানি
এবার সত্য দুহাত দিয়ে আমার ডানহাতটা জড়িয়ে ধরলো
আমি বললাম,’ তবে তুমি আমাকে, তোমার ব্যানার্জী স্যারকে, একটা কথা দেবে  তুমি আমাকে আজ যা যা কথা বলেছো আর কোনোদিন কাউকে এসব কথা বলবে না সত্য তুমি একজন যথার্থ ভালো মানুষ তাই এতো বছর ধরে এসব কথা চেপে রেখে তোমার মনের মধ্যে অসহ্য চাপ সৃষ্টি হয়েছিল  এখন আমাকে বলেছো, মন হালকা হয়ে গেছে এখন ওসব পুরোনো কথা ভুলে যাও, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলো
আমার কথাগুলো শুনে সত্যপ্রকাশ আবার কেমন যেন উদাসভাবে বললো,
-‘আজ আর মিথ্যে বলবো না স্যার আমি বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলাম সবকিছু আপনাকেও হয়তো বলতাম না কিছুই আমার ক্রিমেশনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যেত সত্যপ্রকাশ শ্রীবাস্তবের কাহিনী  কিন্তু স্যার, বজরংবলীর যে ইচ্ছে ছিল অন্যরকম তাই রিটায়ারমেন্টের দিন সাতেক আগে এমন একটা ঘটনা ঘটলোসেই দিন থেকে মনের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করছিলামতার পর যেদিন ঠিক করলাম আপনাকে, শুধু আপনাকেই সব খুলে বলবো, সেদিন থেকে মনের যন্ত্রণাটা একটু কমলো
কি হয়েছিল, কি ঘটনা ঘটেছিলো সত্য ?’
বলছি স্যার
সত্যপ্রকাশ একটু জল খেয়ে বলতে শুরু করলো,
-‘আমার একটাই তো মেয়ে, আপনার মনে আছে বোধহয়
-‘হ্যাঁ  মনে আছে বৈকি আমি সেকশনে জয়েন করার  কয়েক মাস পরেই তো তুমি বাবা হলেতুমি টানা চারদিন ছুটি নিয়েছিলে অফিসে সবাই বলছিলো যে তুমি এরকম টানা ক্যাজুয়াল লিভ কখনো নাওনি
হ্যাঁ মাসদেড়েক আগে মেয়ের বাড়ি মীরাট থেকে জামাই খবর দিলো, মেয়ের শরীর ঠিক নেই, প্রেগন্যান্ট ছিল, অ্যাডভান্সড স্টেজ, ইন্দোর থেকে জামাইয়ের বাবা মা আসার আগে যদি আমার স্ত্রী এসে কদিন মেয়ের কাছে  থেকে যান  মেয়ের মা তো সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলো আমি রোজ লাঞ্চে নির্মাণ ভবন থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক খাচ্ছি, রোজ রোজ নতুন নতুন রেড়ীতে যাই একদিন একটা ফলের ঠেলাগাড়ীর কাছে প্লেট এক প্লেট মিক্সড ফ্রুট নিচ্ছিচমকে দেখি সেই সত্যপ্রকাশফল কেটে  বিক্রি করছে আমাকে চিনতে পারেনি, চেনার কথাও নয় আমি কিন্তু একেবারেই ঠিক চিনেছি সঙ্গে এক  কলিগ ছিল, বোধহয় ওর নিয়মিত খদ্দের, সেও সত্য সত্য করে ডাকাডাকি করছিলো সেদিন আর ফলগুলো খেতে পারিনি স্যার, কলিগের চোখ এড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম পুরোনো সব কথা মনের মধ্যে খুঁচিয়ে উঠলো আবার সেরাতে ভালো করে ঘুমোতে পারলাম না তারপর দিন দুই কাছ থেকে ওকে দেখলাম ফল কেনার অছিলায় কথাও বললাম বুঝতেই পারলাম সরকারি চাকরি আর কোনোদিনই পায়নি অপরাধবোধটা দুগুণ হয়ে ফিরে এলো স্যার অপরাধবোধে দগ্ধে দগ্ধে দুদিন পরে ঠিক করলাম, আর নয়, আপনার কাছে সব কথা খুলে বলি, যা হয় হোক
সত্য থেমে গেলো
আমার মনে হলো সত্যপ্রকাশ আবার বিমর্ষ হয়ে পড়ছে
কথা ঘোরাবার জন্যে বলে উঠলাম,
-‘ভালো করেছো  কিচ্ছু  হবে না  শোনো সত্য, তুমি আর এসব পুরোনো কথা নিয়ে অতো ভেবো না মনে করো যেটা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে চলো, তোমাকে আজ আমি ছেড়ে দিই তোমার বাড়িতে বাকি গল্প গাড়িতে করবোআমি ওঠবার উপক্রম করলাম
সত্য ওয়েটারকে বিল নিয়ে আসতে ইশারা করে বললো,
-‘না স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ  আপনার অনেক দেরী হয়ে যাবে বাড়ীতে ঢুকতে  আমি চলে যাবো সেভেন টোয়েন্টি ধরে, ফ্রিকোয়েন্ট সার্ভিস, একেবারে বাড়ির সামনে নামবো

 

#

হোটেল থেকে বেরিয়ে পার্কিং এরিয়াতে আমার গাড়ির কাছে এলাম দুজনে  আমি বললাম,
-‘ হ্যাঁ সত্য, তুমি যে বলছিলে, তোমার মেয়ের…’
এতোক্ষণ পরে সত্যপ্রকাশ উজ্জ্বল মুখে বললো,
-‘ওহ স্যার, আমি তো আপনাকে তখন বলতেই মিস করে গেছি, আমি নানা হয়ে গেছি, আমার মেয়ের একটা ছেলে হয়েছে স্যার, এই তো এক মাস হলো 
আমি হেসে বললাম, ‘কংগ্র্যাচুলেশনস ! তুমিও যেমন সত্য !  এই ভালো খবরটা না দিয়ে যত সব  উল্টোপাল্টা ইনফরমেশন দিয়ে শনিবারের সন্ধেটা আমার ভারী করে দিলে  যাক, খুব ভালো  তোমার মেয়েকে সেই দেখেছিলাম কত ছোট, একবার অফিসের স্পোর্টস ডেতে নিয়ে এসেছিলে  নামটা তো ভুলেই গেছি 
সত্য পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একমুহূর্ত  আমার দিকে তাকালো  তারপর মুখটা ফিরিয়ে দূরের দিকে চোখ রেখে ম্লান হেসে থেমে থেমে বললো,
-‘মেয়ের নামআমি কোনো রিস্ক নিইনি স্যার  আমার মেয়ের নাম স্যার অনামিকা ! একটা বেনামী মানুষের সন্তানের আর কি নাম হতে পারে স্যার, বলুন তো আপনি ?’ 

তারপর মুখ ফিরিয়ে হাতটা কপালে ঠেকিয়ে ক্লান্তস্বরে বললো,  

-‘আজ চলি স্যার, ভালো থাকবেন, গুডনাইট স্যার ‘          

ধীর পায়ে আমার প্রাক্তন সহকর্মী, সত্যপ্রকাশ শ্রীবাস্তব, নাকি মাথুর, রাস্তা পেরিয়ে লোকের ভীড়ে মিশে গেলো 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • Priyadarshi Dutta on October 24, 2020

    গল্পের আসল চমকটা শেষের দিকে অনুভূত হল। বেআইনি ভাবে সরকারি চাকরি জোগাড় করার ঘটনা বাস্তবে কিছু হয়েছে। কিন্তু এই গল্পটির ক্লাইম্যাক্স ছাড়াও একটি মানবিক দিকও রয়েছে। বেশ ভালো লাগল। ডেফ কল কথাটা দিল্লির বাইরের বাঙালিরা হয়তো জানবে না। সেটা ডিফেন্স কলোনির জন্য সংক্ষেপ। দক্ষিণ দিল্লির একটি অভিজাত পাড়া ও নামকরা বাজার।।

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ