‘পাকু বুড়হিকে বিশ্বাস লাগে না। উ তুকতাক জানহে!’
‘তোহকে বলেহেচে!’
‘তো শিবেনের বাপ যিরাতে মইরলো উ রাইতেই তো কেশবের সাঁড়াটা গলা কাটা পড়হে ছিল বাঁশ ঝাড়হে ——- সি রাতেই তো সবাই ঘুমাই গেলে বুড়হি জোরে জোরে লাগরা গাইছিল।’’
‘শিবেনের বাপ মরার সাথে, খটাশের সাঁড়া ধরার আর বুড়হির লাগরার কি সাথ আছেহ?’
‘তুই দেখেহেচিস কে সাঁড়া ধরহেছিল? শিবেনের বাপ উ বাঁশ ঝাড়হের কাহচেই তো মরে পড়হে ছিল, উ নিজহে নিজহে মরে গেল? সি রাতেই কেনে বুড়হি লাগরা গাইবে?’
গায়ের উপর আলো চিরিক মেরে যাওয়ায় কেবল মুরমু আর সনাতন মান্ডির এই তর্ক-বিতর্ক আচমকাই থেমে গেল। বাঁকুড়ার জঙ্গল সংলগ্ন লোকেরা এই আলোর রহস্য জানে। এটা হুলাপার্টির আলো। আলোটা তাদের পেছনদিক থেকে এল। মানে হাতি তাদের পেছনদিকের কাছাকাছিই কোথাও আছে। দুজনে সতর্কভাবে প্রায় দৌড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
দৌড়তে দৌড়তে সনাতন বলল, ‘শালহা এক দিনহেই কেন্দাশোল পার করহে চলহে আলোহ!’
গতকাল লোকমুখে খবর পেয়েছিল দলমার বারো চোদ্দটা হাতির একটা ছোট দল কেন্দাশোল জঙ্গলে এসে পৌঁছেছে। বনদপ্তর থেকে রাতে মোবাইলে মেসেজও এসেছিল। মরাবাঁধ, কাদাশুলি আর বাগমারীর জঙ্গল এলাকার মানুষেরা একটু স্বস্তির শ্বাস নিয়েছিল। কেন্দাশোলের জঙ্গলটা বেশিই ঘন আর আয়তনেও বড়। এখানে হাতির দল ঢুকলে দশ বারো দিনের আগে এই জঙ্গল থেকে বাইরে আসেনা। এবার যেহেতু ধানের শিষে কিছুদিন আগেই পাক ধরেছে, তাই সকলে অনুমানও করেছিল অন্য বছরের থেকে আগেই হাতি আসবে। হাতির দল গতকাল কেন্দাশোল পৌছনোয় বাগমারীর জঙ্গল সংলগ্ন লোকেরা কয়েকদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হয়েছিল। কিন্তু তা আর হল কই? সার্চ লাইটের আলো সে আশায় জল ঢেলে দিল।
‘প্যাটে টান পড়লে গামছা ভিজায় প্যাটে দিবে?’ কেবলের উত্তর সনাতনের কানে পৌঁছল কিনা বোঝা গেলনা। দুজনের দৌড়নোর গতির কোন তারতম্য হলনা।
চরণ মুরমুর মাকে কালসাপে দংশন করেছে। বাঁচার কোন আশা নেই। নাইকে পরাণ নিজের মোটরসাইকেলে করে লোধাশুলি থেকে জানগুরুকে নিয়ে এসেছে। বিরাট বড় গুণিন। বোঙ্গারা ওর কথা শোনে। সে নিজে বলেছে – ‘সাপে লয়, ডাইন সাপের ভেশ ধরে ই কাজ করহেচে।’ অবিশ্বাস করার মতো কথাও নয়! এই কার্ত্তিক মাসে সাপ আসবে কোথা থেকে? সাপতো সব গর্তে ঢুকে আছে, শীতঘুমে। ডাইন ছাড়া অন্য কারো কাজ এটা হতেই পারেনা।
শিবেনের বাপের বাঁশ বাগানে মরে পড়ে থাকা কিংবা তার পাশে লাল মোরগের রক্কাক্ত কাটা মাথা উত্তরমুখো হয়ে থাকা আর কার্ত্তিক মাসে চরণের মাকে সাপে কাটা – ঘটনাগুলোকে কোন যুক্তিতেই মেলানো যাচ্ছে না! তাই কারোর মনে আর কোন সন্দেহ নেই। গ্রামে ডাইন আছে। আছেই। এই সবই ডাইনের কাজ! কিন্তু ডাইনটা কে? প্রশ্নটা ভাগার ডাঙ্গার দিকে দিকে ফিরছে। অনেকেই মনে মনে পাকু বুড়িকে সন্দেহ করছে। কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছে না। না বললেও কিভাবে যেন কথাটা গোপনে গোপনেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে।
চরণের মা মেয়েলোকটা খুব ভাল ছিল। সকালে চারটি খেয়ে মাথায় জ্বালানি কাঠের বোঝা নিয়ে বাজারে বেচে আবার সোজা জঙ্গলে যেতো। শুকনো ডাল-পালা জোগাড় করে রাখত পরের দিনের জন্য। সন্ধ্যে বেলা রান্নার জন্য শুকনো তাল বাগড়া আনতে বনের পুকুরের পাড়ে গিয়েছিল। সেখানেই কিসে যেন কামড়েছিল। বাড়ি এসে লণ্ঠনের আলোয় দেখে পায়ের পাতায় দুটো দাঁতের দাগ। চরণকে ডেকে দেখিয়েছিল। চরণের সন্দেহ হওয়ায় সে পরাণকে ডেকে আনে। পরাণ ব্লেড পুড়িয়ে জায়গাটা কেটে রক্ত বের করে দেয়। ততক্ষণে চরণের মার হুঁশ চলে গেছে। পরাণ আর দেরী না করে যায় জানগুরুকে আনতে।
চরণের মায়ের বাঁচার আশা শেষ। চরণের বাড়ি ভীরে ভীরাক্কার। শেষকৃত্যের আয়োজন করার প্রস্তুতি চলছে। চরণের দু’বোন আছাড়ি-পিছাড়ি দিয়ে কেঁদে চলেছে। চরণের বেটাও। অনেকেই পাশে বসে চোখের জল মুছছে।
খানিকটা দূরে জানগুরু বিড়ি টানছে। তার পাশে বসে পরান তার সঙ্গে নিচু স্বরে কি সব কথা বলে চলেছে। পাশাপাশি কেউ বুঝতে না পারলেও আলোচনা যে গুরুত্বপূর্ণ তা তাদের আচরণেই স্পষ্ট।
আজ নিয়ে গত তিন রাত বাগমারী বনাঞ্চলের বিট অফিসার পাল বাবুর চোখে ঘুম নেই। হাতির দলটার সঙ্গে যেন লুকোচুরি খেলা চলছে। এইমাত্র খবর এল, হাতির দল বনপুকুরের মাঠে সবজি ক্ষেতে নেমেছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল মাঠ তছনচ। চাষিদের বিক্ষোভ। সেসব সামাল দিতে দিতে আবার মোবাইলের রিংটোন বাজছে। হাতি এখন মঙ্গলপুরের পাকা ধানের জমিতে। সেখান থেকে কাদাশুলি রেঞ্জ কাছেই, কোনরকমে হাতির দলকে ওখানে ঢুকিয়ে দিতে পারলে বাগমারী বনাঞ্চলের বিট অফিসারের মুক্তি। কিন্তু তা হবার নয়। হাতি তার নিজের খেয়ালে যেদিকে যাবে সেদিকেই তাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। দিক পরিবর্তন করতে গেলে ক্ষতিতো বেশি হবেই, আবার মানুষও মারা যেতে পারে। হাতির দল তাড়াবার সময় খেয়াল রাখতে হয়, কোন হাতি যেন দলছাড়া না হয়। দলছাড়া হাতি খতরনাক!
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এইসব এলাকায় বছরে দুবার হাতির দল আসতো। একবার ধানের শিষে দুধ জমলে। আর একবার পাকা ধান মাড়াই করার সময় হলে। এখন হাতি প্রায় সারা বছরই আসছে। কোন ফসল চাষ করেই আর শান্তিতে থাকার জো নেই। শাক-সবজি থেকে আলু সবই যদি রাত জেগে পাহারা দিতে হয়। তো, কত আর পারা যায়! তাও কি রক্ষে আছে! এই এলাকার চাষিরা ধরেই নিয়েছে সব ফসলই অর্ধেক পাওয়া যাবে। লোকসান হবেই। এছাড়া আর তো কোন উপায়ও নেই। চাষ ছাড়া চাষি আর করবেই বা কি!
হাতির উৎপাতে চাষিদের যত ক্ষতিই হোক না কেন, বন্দপ্তরের সব স্তরের কর্মচারীদের এটা বাড়তি রোজগারের একটা মোক্ষম সুযোগ। হাতি তাড়ানোর ব্যবস্থা করা থেকে উপকরণ যোগাড় সবেতেই দু’পয়সা থাকে। তাই চাষিরা হাতি না আসার প্রার্থনা করলেও বন্দপ্তরের কর্মচারীরা চায় হাতি আসুক। এই দুয়ের মাঝে পড়ে উপরওয়ালা কি চায় বোঝা না গেলেও, হাতি পেটের টানে আসতেই থাকে।
আজকাল চাষিরা আর আগের মত নিরীহ নেই। হাতির উপদ্রবে ফসলের ক্ষতি হলে বা তাদের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে গেলে রাস্তা অবরোধ করা থেকে বন্দপ্তরের অফিস পর্যন্ত আক্রমণ করতেও পিছপা হয় না। হাতির মতো মানুষেরও আচরণ বদলে যাচ্ছে।
পালবাবু বললেন, ‘জঙ্গলের হাওয়ায় ধোঁওয়া লেগেছে।’
‘এ ধোঁওয়ায় শুধু চোখই জ্বলে না, পেট আর গায়ের চামড়া জ্বালাতেও ছাড়ে না!’ দেবেন কিস্কু কথাগুলো বলে আবার কম্পিউটারের পর্দায় মনোনিবেশ করে।
বাগমারী রেঞ্জটা একটা চক্কর দিয়ে এইমাত্র অফিসে এসে বসলেন পাল বাবু। দেবেন এই অফিসের ক্লার্ক। কাল পর্যন্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণের যতগুলো দরখাস্ত জমা পড়েছে সেগুলোর টাকার অংকে হিসেব করে জেলা বনাধিকারিককে পাঠাবার কাজে আবার মনোনিবেশ করে।
ভাগাড় ডাঙ্গা গ্রামে সমর্থ মেয়ে পুরুষ আর কেউ নেই। সকলেই পুলিশের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। সকাল থেকে দু’তিনবার পুলিশের গাড়ি গ্রামে চক্কর দিয়েছে। প্রতিটা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সমর্থ কোন মেয়ে-মরদের দেখা পাওয়া যায়নি। গ্রামের উত্তর প্রান্তে জাহের থানে পূজার কিছু উপাচার আর পশুবলির চিহ্ন ছাড়া কিছু নেই।
গত রাতে হাতির পাল কোথায় আছে তা অনুসন্ধান করতে বেড়িয়ে পালবাবু ভাগাড় ডাঙ্গার দিকে গেলে তাঁর সন্দেহ হয়। গাড়ির আলোয় আবছা দেখেন, লাল ধূতি লাল চাদর পড়া গুণিন জাতীয় একটা লোকের সঙ্গে কয়েকটা লোক মিলে সন্তর্পণে কিছু একটা যেন করছে! সারা জীবন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরা পালবাবুর আর বুঝতে বাকি থাকেনা কি হতে চলেছে! তিনি গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে গেলেন। গাড়ির আলোতে খেয়াল করলেন, কিছু লোক দৌড়ে এদিকে ওদিকে জঙ্গলের ভিতর পালিয়ে গেল। ঘটনাস্থলে পৌঁছে টর্চের আলোয় কাছাকাছি জায়গাটা ভাল করে খুঁজেও কোন লোক দেখতে পেলেন না। গাড়িতে উঠে ফেরার পথে থানায় ফোন করলেন।
রাতে থানার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। একে তো জঙ্গলে হাতির সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়। আর অন্যদিকে মেন রাস্তায় ওভারলোড বালির লড়ি থেকে উপরি রোজগারের সম্ভাবনা। দুয়ে মিলে পুলিশ তার সুনামের প্রতি সুবিচার করেছে। সব কিছু ঘটনা মিটে গেলে ভাগাড় ডাঙ্গায় পৌঁছেছে। পুলিশ গিয়ে দেখে ভাগাড় ডাঙ্গা শুন্য। খালি হাতে ফিরলে মান থাকেনা। তাই হতাশ হয়ে রাগে কয়েকটা বাচ্ছা ছেলেমেয়ে আর বরকা সরেন নামে একটা বুড়োকে ধরে এনেছে।
থানার বারান্দায় বাচ্ছাগুল ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। বুড়ো বরখাকে নিয়ে থানার ছোটবাবুর হম্বিতম্বি চলছে। এমনিতেই সাধারণ মানুষের কাছে পুলিশ মানে বাঘের বাপ! সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের পরিচয় – হেলমেটহীন মোটরসাইকেল আরোহীর কাছে টাকা নিতে অথবা লড়ি ট্রাক্টর থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোলা তুলতে অথবা কখনো রাস্তা অবরোধ হলে তা হটাতে। এর বাইরে পুলিশের সাক্ষাৎ এইসব মানুষেরা এড়িয়েই চলে। তাই বরখা সারা জীবনে কখনো থানা দেখেনি। সেই বরখাই এখন থানায়। এবং পুলিশ বাবুদের সামনে!
বুড়ো একে কালা। তার ওপরে এতগুলো পুলিশ সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে গটমট করে ঘুরে বেরাচ্ছে। তাই বোধহয় ছোটবাবুর কোন কথারই সে উত্তর করতে পারছে না। অবশ্য বেশিরভাগ কথা সে শুনতেও পাচ্ছেনা। যা শুনতে পাচ্ছে, তার আবার মানে বুঝছে না। ফলে হাবাগোবার মতো এদিক ওদিক চাইছে। কোন উত্তর না পেয়ে ছোটবাবুর মেজাজ যাচ্ছে চড়ে। লাঠি উঁচিয়ে মারতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন। আর চিৎকার করে খিস্তি ঝাড়ছেন বৃদ্ধের ঊর্ধ্বতন ও নিম্নতর চোদ্দপুরুষের নামে।
অসহায় ছোটবাবু হাঁক পারলেন, ‘ঘোষ বাবু আসুন তো এদিকে।’
ঘোষ বাবু নামের আর একজন পুলিশ ছোটবাবুর কাছে এসে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে দাঁড়ালে ছোটবাবু তাঁকে বললেন, ‘কি করা যায় বলুন তো? শালা শুনতে পাচ্ছে না, নাকি টেটিয়া বুঝতে পারছি না। দু’ঘা যে দেব, তাও ভয় হচ্ছে, চেহারার যা হাল, যদি মরে যায় ——-’
‘না, না, ভুলেও ওকাজ করবেন না। দেখতেই পাচ্ছেন আদিবাসী —-’
কথা অসামপ্ত রেখেই ঘোষবাবু দ্রুত এক মগ জল নিয়ে ছোটবাবুর টেবিলের ওপর রাখলেন।
‘জল কি হবে?’
‘ঝাপটা দিয়ে নাকে জল ঢুকিয়ে দিন, তাহলে শালা ভয় পেয়ে ——–’
ঘোষ বাবু ও ছোটবাবুর কথপোকথনের মাঝে বড়বাবু থানার বারান্দায় উঠতে উঠতে ছোটবাবুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন, ‘ভাগাড় ডাঙ্গা থেকে কতজনকে তুলতে পেরেচ্ছেন?’
বড়বাবুর হঠাৎ আগমন ও কথার শব্দে থানার সকলে তাঁর দিকে চাইলেন। রারান্দায় বসে থাকা ভীত বাচ্চাগুলো আরও ভয়ে কেঁপে উঠলো।
ছোটবাবু বলে উঠলেন, ‘শালা এত হারামি, পেট থেকে কথা বের করা যাচ্ছেনা।’
বড়বাবু কাছাকাছি পৌঁছাতেই ছোটবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বুড়ো বরখা বড়বাবুর মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলো।
দিন সাতেকের মধ্যে ভাগাড় ডাঙ্গার জনা পাঁচেক লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। একে জঙ্গলে হাতির ভয় তার ওপরে বাড়ির গরু ছাগল হাঁস মুরগি ছেড়ে কতদিন বাইরে বাইরে থাকা যায়! জান আর মাল বাঁচাতে বাড়ি ফিরতেই পুলিশের খপ্পরে। শিবেন সনাতন বুধন চরণ আর মংলাকে ধরে থানার গারদে রাখা হয়েছে। বরখা ও বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে ছেড়ে এসেছে পুলিশের গাড়ি। মেয়েদের ধরেনি। বরং গ্রামে গিয়ে মেয়েদের ঘরে ফিরতে বলে এসেছে।
ভাগার ডাঙ্গার ঘটনা নিয়ে কেউ কোন লিখিত অভিযোগ জানায়নি থানায়। তাই এই ঘটনার তেমন কোন গুরুত্ব নেই। তবুও আদিবাসীদের ব্যপার। আবার ডাইনি প্রথার ঘটনা। যদি জানাজানি হয়, থানার উপর – ওপর থেকে চাপ আসতে পারে। একটু বেচাল হলে, বিজ্ঞানমঞ্চ বা কোন না কোন সমাজসেবী সংগঠন বা এলাকার নেতা মন্ত্রীরাও জল ঘোলা করতে বেশি সময় নেবেনা।
এমনিতে এলাকা শান্ত। অশান্তি বলতে, হাতির দ্বারা কৃষকের ফসল বা ঘর বাড়ির ক্ষতি হলে, রাস্তা অবরোধ বা বন দপ্তরের অফিস ঘেরাও। আর পুলিশের কাজ, বনদপ্তর থেকে ফোন পেলে, তার দু’চার ঘণ্টা পর সেখানে পৌঁছে তা মুক্ত করা আর রাত্রে ওভারলোড গাড়ি আটকানো।
থানার সামনে এটা একটা বড় সুযোগ। ডাইনি প্রথার বিরুদ্ধে পুলিশের সামাজিক আন্দোলন। প্রথম দিকে ছোটবাবু ও অন্যান্য পুলেশের কাছে এটা ছেঁদো কেস মনে হলেও বড়বাবুর আচরণে সকলে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে। পুলিশ নিজেই সুয়োমোটো কেস করেছে। বিষয়টা স্বয়ং বড়বাবু দেখছেন।
বড়বাবু মাঝরাতে ভাগার ডাঙ্গার আসামীদের সঙ্গে বসলেন। ‘সত্যি করে বল, পাকু বুড়িকে কে কে মিলে খুন করেছিস?’
বড়বাবুর ঠাণ্ডা গলার স্বরে সকলে ভীত হয়ে মুখ নিচু করে আড়ে আড়ে পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। কোন উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বললেন, ‘আমি সব জানি। তোদের কাছে মিলিয়ে নিতে চাইছি। না বললে তোদেরও জুড়ে দেব। হয় যাবজ্জীবন জেল, নয় ফাঁসি।’
এবার কথায় কাজ হল। বুধন সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘পাকু বুড়হিকে কেউ মারেনি।’
‘পাকু বুড়ি কোথায়?’
চরণ, ‘মারাং বুরুর দিব্বি, উ বাঁচে আচেহ।’
এরপর বড়বাবু তাদের অনেক প্রশ্ন করেছে, যেমন, পাকু বুড়ি যে ডাইন, এটা কে বলেছে? অথবা, এর আগে আর কি কেউ ডাইন ছিল এই গ্রামে? অথবা, কারা, কিভাবে ডাইন হয়? অথবা, পাকু বুড়ির সম্পত্তি কি ছিল? অথবা পাকু বুড়ির সঙ্গে কারোর ঝগড়া হয়েছিল কিনা? অথবা, পরাণের অবস্থা কেমন? সে কি করে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
সব উত্তরই খাপছাড়া। তবে কয়েকটি তথ্য তিনি পেলেন। যেমন, পরাণ গ্রামের মোড়ল গোছের একজন। তার অবস্থা অন্যদের থেকে ভাল। আর গতবছর পাকু বুড়ির বেটা আর বউ পুবে খাটতে গিয়ে আর ফেরেনি। সেই থেকে পাকু বুড়ি একা রয়েছে। বয়সের ভারে দুর্বল হওয়ায় জনমজুরিও করতে পারেনা, জঙ্গলের কাঠও প্রতিদিন যোগাড় করতে পারেনা। তাই অর্ধাহারেই রয়েছে বহুদিন। প্রতিবেশীদের অবস্থাও তথৈবচ! সম্ভবত, এইভাবে থাকতে থাকতে তার মানসিক সমস্যাও অস্বাভাবিক নয়! তাই সে রাতে বিরেতে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। সেটা বয়সকালে ঘুম কম হওয়ার জন্যও হতে পারে। আবার ছেলের শোকেও হতে পারে।
আবার উল্টো দিকে এই অবস্থায়, পরাণ হয়তো ভেবেই নিয়েছে, পাকু বুড়ির ছেলে আর ফিরবেনা। তাই পাকু বুড়ির সম্পত্তি দখলের পথ হল, তাকে ডাইন বানিয়ে দেওয়া। সম্ভবত মারতে সে চায়নি। সে হয়তো চেয়েছিল, ডাইন হিসেবে মোটা জরিমানা করলে পাকু বুড়িকে সে সাহায্য করবে টাকা ধার দিয়ে। ধার শোধের ক্ষমতা পাকুর নেই। অতএব পাকুর বাড়িটা আর বর্গার দশ কাঠা জমি তার হাতে আসতে শুধু সময়ের অপেক্ষা! ঠিক এই সময়েই গ্রামের ওই দুটি অঘটন। দেখা যাচ্ছে, গুণিন আনাতেও তার উদ্যোগই বেশি। আর চরণের মায়ের শেষকৃত্যের চেয়ে ডাইন খোঁজা তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।
সবটাই বড়বাবুর অনুমান। কোন প্রমাণ নেই। তাঁর কুড়ি বছরের চাকরি জীবনে এমন নিরামিষ কেসে তিনি হাত দেননি। কাউকে প্রকাশ না করলেও তিনি নিজে জানেন, বরখা বুড়োর জন্যই তিনি এই কেসে হাত দিয়েছেন।
বড়বাবু হুগলী জেলার সম্পন্ন চাষি পরিবারের ছেলে। বাল্যকালে কয়েকদিন আগের দেখা এই বরখা, কয়েক বছর পরিযায়ী জনমজুর হিসেবে তাঁদের চাষের কাজ করেছিল। লোকটা খুব ভালো। খাটতেও পারত অসুরের মত। সেই বরখাকেই এই বুড়ো বয়সে থানাতে দেখে তিনি চিনতে পেরেছিলেন, বরখাও তাঁকে চিনেছিল। তাঁর বিশ্বাস বরখা কোন অন্যায় করতে পারেনা। তাই বরখার অসহায় অবস্থা দেখে তিনি এই কেসটা হাতে নিয়েছিলেন।
থানা থেকে বরখাকে তিনি তাঁর কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। বরখাও বলেছে। কিন্তু সে তেমন কিছু জানেনা। বরং সে-ই ভয়ে ছিল, তাকেই না ডাইন ভাবে। তারও যে রাতে ঘুম হয়না, ঘুরে বেড়ায় মাঝ রাতে। তাই যেদিন গুণিন এসেছিল, সেদিন বরখা ভয়ে লুকিয়েছিল। সকালে গ্রামে পুলিশ পৌঁছানর আগে সে গোপনস্থান থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। তখনই পুলিশ তাকে ধরে।
অনেকক্ষণ জেরার শেষে বড়বাবু বুঝলেন, পাকু বুড়ি মরেনি, অথবা এরা মরার বিষয়টা জানেনা, অথবা, —। সম্ভাবনা অনেকগুলো। সবকিছু পরিষ্কার হবে ওই শালা, পরাণ আর জানগুরুকে ধরতে পারলে। পাকু বুড়ি যদি না মরে থাকে তাহলে সে এখন কোথায়? এরা জানেনা। বরখা বলেছে, সেও ভয়ে লুকিয়েছিল পাছে তাকেই ডাইন সাব্বস্থ করে মেরে ফেলে বা গ্রাম থেকে বের করে দেয় বা জরিমানা করে! তাহলে?
বড়বাবু চিন্তা করে দেখলেন, পাকু বুড়িকে যদি মেরেও থাকে তাহলে জঙ্গলেই কোথাও তার লাশ পাওয়া যাবে। গর্ত করে পুঁতে দেবার মত সময় ওরা পায়নি। পালবাবুর গাড়ির শব্দেই ওরা তখন পালিয়েছিল। পুলিশ গ্রামে গিয়ে কাকেও খুঁজে পায়নি। বাচ্চাগুলো কাছ থেকে যা খবর জোগাড় করা গেছে, তার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, পাকু বুড়ি ভয়ে কোথাও পালিয়েও গিয়ে থাকতে পারে।
তাহলে? তাহলে? পালবাবু কিছু বলতে পারেন কিনা দেখা যাক।
‘হ্যালো!’
‘কি ব্যপার! আউট গোয়িং-এর কল ইন কামিং-এ?’
‘এখন কোথায় আছেন আপনি?’
‘আজ মনে হচ্ছে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেতে চলেছি।’
‘মানে, হাতির পাল —-’
‘হাঁ, কাদাশুলির দিকে মোড় নিয়েছে, আর কিলোমিটার খানেক খেদাতে পারলেই —-’
বড়বাবু কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে বেড়িয়ে গেলেন থানার বাইরে।
‘মা কালী প্রেসে’ রাত জেগে কাজ চলছে। দুর্গা পুজোর পর এমনিতেই কাজ কম। এখন পোস্টার ব্যানার বা প্রিন্টিঙের কাজ পেতে মফঃস্বলের প্রেসগুলো মাথাকুটে মরে। সেইসময়ে হঠাৎ করে দশ হাজার লিফলেট, পাঁচশো পোস্টার, পাঁচশো ব্যানারের কাজ পাওয়া লাখ টাকার লটারি পাওয়ার সমান! কিন্তু খুশি হওয়াতো দূরের কথা, মালিক থেকে কর্মচারী সকলেই প্রচণ্ড বিরক্ত। থানার কাজ, পয়সা কবে পাওয়া যাবে কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি কেউ নিশ্চিত নয়! এই বড়বাবু এই থানায় থাকাকালীন যদি টাকা আসে তাহলে কিছু কম হলেও পাওয়া যাবে। আর যদি ইনি বদলি হয়ে যান, নতুন জন এলে এই বিল আর আদায় করা যাবেনা।
লিফলেটে ডাইনি প্রথার কুসংস্কার বিষয়ে মাধ্যমিক স্তরের প্রায় আস্ত একটা রচনা লেখা আছে। পোস্টার আর ব্যানারে কত রকমের কথা। কোনটাই, স্লোগান, তো কোনটাই, সেন্টিমেন্টের সুড়সুড়ি, তো কোনটাই, পুলিশের গুনগান, তো কোনটাই, সরকারের গুনগান! পোষ্টার ব্যানারের বয়ান কম্পিউটারে তৈরি করতে করতে ক্লাস এইট পাশ প্রশান্ত লোহারও বলতে ছাড়ে না, ‘শালা! এতসব খরচ না করে, ওই লোকগুলোর তিনবেলা খাবার ব্যবস্থা করলে আর এসব থাকতো না।’
কথাটা শুনে ‘মা কালী প্রেসে’র মালিক উজ্জ্বল বাড়ুই হেসে বলে, ‘কথাটা তুই মন্দ বলিস নি।’
‘তা ছাড়া কি? খেতে পায়না বলেই, লেখাপড়া শিখতে আসেনা। লেখাপড়া করেনা বলেই অন্ধবিশ্বাস। আর এই সুযোগে ওদেরও সমাজের কোন ধান্দাবাজ হয়তো বুড়িকে মেরে ওর জমিটুকু বা বাড়িটা দখল করার তাল করেছে!’
‘তুই এতসব জানলি কি করে?’
‘গুরু! এটা সাধারণ হিসেব। সম্পত্তির লোভ ছাড়া কেউ এতবড় রিস্ক নেয়?’
পুলিশ চাইলে পারেনা এমন কাজ নেই। কাল রাতেই জঙ্গল থেকে বেহুঁশ পাকু বুড়িকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। কয়েকদিনের অনাহারে অবস্থা খুবই সঙ্গিন ছিল। আপাতত সুস্থ। বাঁকাশোলের জঙ্গল থেকে পরাণকেও ধরেছে পুলিশ। গুণিনের এখনও কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। শালা ঝাড়খণ্ডের দিকে পালাতে পারে!
কাল সারাদিন পুলিশের জেলা আধিকারিক থেকে এম.পি., এম.এল.এ. সকলেই পাকু বুড়িকে দেখে গেছে হাসপাতালে। পুলিশের এই ভাল কাজের জন্য রাজ্যস্তরে পুরষ্কারের জন্য সুপারিশ করা হবে, বলেছেন জেলা পুলিশ আধিকারিক। সব খবরের কাগজে খবর হয়েছে। দু’একটা কাগজে তো থানার বড়বাবুর ছবি পর্যন্ত বেরিয়েছে। আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ফোন আর মেসেজে এই থানার সবার মোবাইল উপচে পড়ছে। যে সিভিক ভল্যান্টিয়ার দুজন বড়বাবুর ফাই-ফরমাশ খাটতো তাদের আচরণে মনে হচ্ছে, তারাই যেন এই কাজের একমাত্র দাবীদার।
শুধু থানার ছোটবাবুর মনটা খচখচ করছে। একটুর জন্য তার কপালটা খুললো না। কেসটা প্রথম তার হাতেই এসেছিল! আদিবাসী কেসে টাকা পয়সা নেই তাই প্রথম থেকেই সে গুরুত্ব দেয়নি। এখন এতসব ভিভিআইপির আনাগোনা আর তাদের মুখে বড়বাবুর প্রশংসা শুনে বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। কিন্তু কিছু করার নেই। মনের কথাটা কাউকে বলাও যাচ্ছেনা।
আজ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ভাগার ডাঙ্গা গ্রামে ডাইনি প্রথা বিরোধী আলোচনা সভা। সকাল থেকে পুলিশ আর নেতা মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে সভা গমগম করছে। পাল বাবুকেও স্টেজে বসিয়ে যথেষ্ট সম্মান জানানো হয়েছে। তাঁর তৎপরতাতেই এতবড় একটা সামাজিক অপরাধের পর্দা ফাঁস করা গেছে। টিভি আর খবরের কাগজের লোকেরও কমতি নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেতা মন্ত্রী এসে বক্তৃতা করে চলে যাচ্ছেন। বেলা গড়িয়ে গেলে এলেন পুলিশ মন্ত্রী। এই আসরের তিনিই সবচেয়ে হেভিওয়েট। তাঁর দপ্তরের কাজের প্রশংসা করে, এই বড়বাবুকে পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেন। পাশ থেকে জেলা পুলিশ আধিকারিক তাঁকে ফিসফিস করে জানালেন, ‘স্যার, বেলা পড়ে আসছে। আর বেশী সময় নেবেন না, হাতির পাল —‘ । কথা শেষ করতে হলনা। মন্ত্রী সরাসরি বক্তৃতার শেষপর্বে পৌঁছে গেলেন। তিনি সভাতে ডেকে নিলেন পাকু দেবীকে। যাকে কেন্দ্র করেই কুসংস্কারটি আবার প্রকাশ পেতে চলেছিল। আর যার মহামূল্যবান জীবনরক্ষার জন্যই আজকের এই মহতী সভা।
জেলা পুলিশ আধিকারিক নিজে আজকের সভা সঞ্চালনা করছেন। তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ইশারায় জানানোর আগেই চার-পাঁচজন পুলিশ পাকু বুড়িকে প্রায় চ্যাংদোলা করে মঞ্চে তুলে তাকে ধরে রইল। একে বয়স্কা মহিলা, তার ওপর অনাহার ক্লিস্টা। আবার আজ সেই সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। স্বভাবতই খুবই দুর্বলা। তার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে তাকে কিছু বলতে বললেন, সভার সঞ্চালক।
এত সংখ্যক ভদ্রলোক একসঙ্গে পাকু বুড়ি জীবনে দেখেনি! আর আজকে তো শুধু দেখায় নয়, তাদেরই চেয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়েছে। সে তার মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষাতে কখনই তো গুছিয়ে কিছু বলেনি। বলার দরকার হয়নি। এখানে মাতৃভাষায় বললে তো কেউ কিছু বুঝবেনা। তাহলে! এতসব কিছু ভেবেছিল কিনা কে জানে!
ভয়ে কাঁপুনিটা সারা গায়ে পায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। থরথর করে কাঁপছে সে। খিদেতে চোখেও আঁধার দেখছে। মাইক্রোফোনে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো, বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে আবার থেমে গেল। কি যে বলল, স্টেজের লোকেদের কানে বিষয়টা অবোধ্য রয়ে গেল।
সভার শেষপ্রান্তে বসা দর্শকদের কানে ভেসে এল, “বাবু! আমার ভুক লাগেচে, টুকু ভাত দে।”
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।