– “যদি বাঁচতে চান তো এখনও ভালোয় ভালোয় সত্যি কথাটা বলে দিন। দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে। জেলের ঘানি টানাটা কি খুব সুখকর হবে?”…চোখের কোণ দিয়ে তাকাল ডিউটি অফিসার।দৃষ্টিতে পরিষ্কার অবিশ্বাস ফুটে উঠেছে।
– “আমি সত্যিই কিছু জানিনা স্যার।আপনাকে তো বললাম, আমার কিছুই মনে পড়ছে না।”
– “পড়বে, পড়বে। এখন শুধু মুখে জিজ্ঞেস করছি তো,তাই মনে পড়ছে না। এরপর ঠিক ঠিক দাওয়াই পড়লেই সঅঅব মনে পড়ে যাবে।তা হঠাৎ গুম করতে গেলেন কেন? না পোষালে ডিভোর্স নিতে পারতেন। নাকি সেখানেও সমস্যা ছিল কিছু?”
– “বিশ্বাস করুন স্যার, আমি ওকে কিছু করিনি। আমি কেন…?” শুকনো মুখে আবারও একই কথা বলল গৌরব।
– “সেই কারণটাই তো জানতে চাইছি। আপনি যে গল্পটা দিচ্ছেন সেটা তো কাঁচা ঢপ ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।ওদিকে মেয়ের বাড়ির লোক তো প্রেস-ফ্রেস জড়ো করে একটা কিচাইন বাঁধিয়ে ফেলেছে। বধূহত্যার কেস আবার আজকাল পাবলিক হেব্বি খাচ্ছে কিনা।”
– “হ..হত্যা!স্যার মালবিকা বেঁচে আছে।ওকে আমি…”
– “অ..খুনের কেস নয় বলছেন? হুম, মেয়ের বাবাও অবশ্য খুনের অভিযোগ দায়ের করে করে নি। তবে কিনা সম্ভাবনার কথা উড়িয়েও তো দেওয়া যায় না? তার ওপর মিডিয়াও কেসটায় খুনের গন্ধ পাচ্ছে।”
– “গন্ধ পাচ্ছে মানে? খুনের আবার গন্ধ থাকে নাকি? আর আপনারা মিডিয়ার কথা শুনে ইনভেস্টিগেশন চালাবেন?”
– “আরে মশাই, থামুন। এখনই অত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি তো শুধু সম্ভাবনার কথাই বললাম।কিন্তু আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে খুনের গন্ধের বিষয়ে আপনি বেশ ওয়াকিবহাল।সত্যি কথাটা কি? হুম?”
– “স্যার,আমি কিন্তু সত্যিই…”
– “আরে রাখুন তো..তখন থেকে এক কথা প্যান প্যান করেই চলেছে। এই স্বপনবাবু, একে লকআপে নিয়ে যান।” একটা মোটা গোঁফওলা লোক ভুঁড়ি বাগিয়ে গৌরবের দিকে এগিয়ে এল। এরকম গোঁফওলা লোক গৌরবের একদম পছন্দ নয়। মালবিকার বাবারও ঐরকম একটা গোঁফ আছে।
– “লক..লকআপ!”
– “লেঃ…বৌ পিটিয়ে মেরে এখন খাবি খাচ্ছে। লকআপে যাবেন না তো কি বাড়ির বাগানে হাওয়া খাবেন? এতক্ষণ ভালো কথায় জিজ্ঞেস করলাম,কিন্তু আপনি তো মুখ খুলবেন না ঠিক করেছেন। যান এখন লকআপে থাকুন। ফালতু খানিক সময় নষ্ট হল,যত্তসব।”
গৌরবকে প্রথম থেকেই মালবিকার বাবা পছন্দ করেন না। কোন এক এনআরআই ছেলের সঙ্গে মালবিকার বিয়ের ছক কষেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু মালবিকাও তো ঐ বাপেরই মেয়ে। ঠিক সময়মতো বাড়ি থেকে কেটে পড়ে গৌরবের সাথে রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলেছিল। পরে অবশ্য বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন ওঁরা। কিন্তু সেটা যে মন থেকে নয়, শুধুই পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে গৌরব। সুযোগ পেতেই এখন আছোলা বাঁশ হাতে নিয়ে হাজির হয়েছে।কি সব ধারায় কেস ডায়েরি সাজিয়েছে বুড়োটা! আইপিসি 363,349,498…উফ্, নম্বর গুলো শুনলেই মনে হচ্ছে একেকটা মিসাইল ধেয়ে আসছে।এদিকে রজতেরও দেখা নেই। সকালে হঠাৎ ফ্ল্যাটের দরজার পুলিশ, তায় আবার একেবারে ওকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। দেখেশুনে খুব ঘাবড়ে গেছিল গৌরব।তাড়াহুড়োতে তখন মাথা কাজ করছিল না। তার মধ্যেই কোনোমতে রজতের নম্বরটা ডায়াল করেছিল। রজত ওর সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। ল পাস করে এখন হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে।দুজনের বন্ধুত্বটা বরাবরই গভীর। সব শুনে তখনই তো থানায় আসবে বলল।দুপুর হতে চলল। ওকে একটা ফোন করলে হত। কিন্তু মোবাইলটাও তো এখন পুলিশের জিম্মায়। ফোনের কথা মনে পড়তেই আরেক সমস্যার কথা মনে পড়ল। বাবা-মা গত সপ্তাহ থেকে দুর্গাপুরে দিদির বাড়িতে রয়েছে। রোজ সকালে একবার করে ফোন করে এদিকের খোঁজ নেয় মা। আজ যদি এইসময় ফোন করে? ঐ অফিসার যদি ফোনটা রিসিভ করে তাহলেও কেলো। আর না রিসিভ করলে তো আরও কেলো। মা কলের পর কল করে করে লোকটার কানে তালা লাগিয়ে দেবে। উফ্! কি ফ্যাসাদেই না ফেললে মালবিকা!
“ঐ,আপন মনে কী বিড়বিড় করছিস?এই তো সবে ভেতরে ঢুকলি। এরমধ্যেই পেগলে গেলি?”
কখন যে রজত এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি গৌরব। রজতের কথাগুলো শুনেই গা জ্বলে গেল ওর। মূহুর্তে ও খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো – “কোন চুলোয় পড়ে ছিলিস?সেই সাতসকালে ফোন করেছি আর এতক্ষণে তোর সময় হলো? জানিস, এরা আমাকে কীভাবে…হত্যা-টত্যা কিসব বলছে রে….”।
নিজের ডানহাতটা ওপরে তুলে আশ্বাসের ভঙ্গিতে রজত বলল- “আর কোনো চিন্তা নেই বস। আমি দেখে নিয়েছি।তোকে যে কটা কেস দিয়েছে,সব বেইলেবল। আজই আমি তোর বেইল করিয়ে নিচ্ছি। রাতের মধ্যে তুই বাড়ি ফিরে যাচ্ছিস।”
“রাত?..সেই রাত পর্যন্ত আমাকে এখানে এইভাবে থাকতে হবে?”
“অমন চোখ কপালে তুলছিস কেন? এটুকু সময় তো লাগবেই। কোর্টের ব্যাপার।আর এখন আমার ওপর চেঁচিয়ে কী হবে? তখন পইপই করে বারণ করেছিলাম ঐ মেয়েকে বিয়ে করিস না।ওর ঐ খিটকেল বাবাটাকে দেখলেই বোঝা যায় ফ্যামিলিটা ছিটেল। শুনলি সেকথা? এখন দেখছিস তো মেয়েটা কেমন ডেন্জারাস?”
“মালবিকার নামে ভুলভাল বকাটা বন্ধ কর। তুই কিছু করতে পারলে কর,নাহলে ছেড়ে দে। আমার যা হওয়ার হবে।”
“উঁ..বাবুর আবার রাগ আছে ষোলোআনা। তা সেই দেবী কোথায় এখন? ফোন করেছিল?”
“না। ফোনটা তো কাল রাতেও সুইচ অফ বলেছে। হ্যাঁরে, কেউ কিডন্যাপ-টিডন্যাপ..”
“ধুস্, তোর বৌকে কিডন্যাপ করবে কে রে? বুকের পাটা চাই বস। আর হঠাৎ কিডন্যাপ করবেই বা কেন? তোর সঙ্গে ঝগড়া হল আর অমনি কিডন্যাপার এসে ওকে কিডন্যাপ করে নিল। এরকম হয় নাকি?কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি…”
“নাহ্, সব জায়গাতেই তো খোঁজ নিলাম।”
“সেদিন কি নিয়ে ঝগড়া করেছিলিস রে?”
এইসময়ই সেই গুঁফো লোকটা এসে হেড়ে গলায় হাঁক দিল- “একটু তাড়াতাড়ি করুন।”
স্নান সেরে ঘরে এসে বসতে একটু আরাম লাগল। সারাদিন স্নান নেই। চিন্তার চোটে খাওয়াও হয়নি কিছু। বাবা-মা যদি জানতে পারে,মল্লিক বাড়ির ছেলে এভাবে সারাদিন থানায় আটক ছিল! রজত ছিল তাই কোনোরকমে বেইলটা আজই পাওয়া গেল। কেসও তো জেতা যাবে বলল। কিন্তু সবার আগে মালবিকাকে খুঁজে বের করাটা দরকার। রজত একবাটি ম্যাগি এনে সামনে রাখল।
সবে একচামচ ম্যাগি তুলে মুখে দিয়েছে অমনি কলিং বেল বেজে উঠল। রজতই উঠে গিয়ে দরজা খুলল। চারজন লোক হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে এল। তার মধ্যে দুজনের চেহারা তো বেশ ষন্ডামার্কা। লোকগুলোকে দেখে মুখের থেকে চামচটা আবার বাটিতে নামিয়ে রাখল গৌরব। কোনোরকম আপ্যায়নের তোয়াক্কা না করে লোকগুলো সামনের সোফায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়েছে। দরজার পাশ থেকে রজত হাঁ-হাঁ করে উঠল- অ্যাই, কে আপনারা?এইভাবে ঘরে ঢুকে..কি চাই এখানে?
গৌরবের একেবারে মুখোমুখি যে লোকটা বসে আছে তাকে ততটা ভয়ানক দেখতে নয়। অন্তত অন্য তিনজনের মত মুখের চামড়ায় কাটা-ছড়ার দাগ নেই। সেই লোকটাই প্রথম মুখ খুলল।
– “নমশ্কার দাদা।আমরা এপাড়ারই ছেলে।আমি বিসু।ও হল ধনা, এ বল্টু আর ওর নাম টিটো। আপনি থানা থেকে ফিরেছেন শুনে একটু দেখা করতে এলাম।তা জামিন পেতে কত পড়ল?”…লোকটার কথায় স-শ ঘেঁটে একাকার।
গৌরবও হাতজোড় করে প্রতিনমস্কার জানাতে যাচ্ছিল। বিশুর পরের কথাগুলো শুনে মাঝপথেই হাতদুটো আটকে গিয়ে পেটের কাছে গুটি মেরে ঝুলে রইল। গৌরবের এমন হতভম্ব ভাব দেখে রজতই আবার প্রশ্ন করল- “আপনারা খবর পেলেন কীকরে?”
– “আরে দুর,এসব খবর কি আর চাপা থাকে? থানায় তো আমাদের যাতায়াত লেগেই থাকে। তবে হ্যাঁ, কথাটা কিন্তু এখনও আমাদের মধ্যেই আছে। পাড়ার কাউকে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দিইনি। কিরে বল্টু, ঠিক কিনা।”
– “হ্যাঁ,হ্যাঁ একদম..” .বল্টু ছেলেটাও ঢক করে মাথাটা নেড়ে দিল।
– “আপনি ভদ্দরবাড়ির ছেলে,এলাকায় আপনাদের একটা নাম আছে।এসব কথা পাঁচকান হলে আপনাদের পেস্টিজ থাকবে? কিন্তু দাদা বলছিল, আপনার সসুরমশাই নাকি অলরেডি লোকজন জোগাড় করতে শুরু করে দিয়েছে। কাল পরশুর মধ্যেই হয়ত দেখবেন আপনার বাড়ির সামনে মিছিল-জমায়েত-শ্লোগান সব ফুলদমে চালু হয়ে গেছে।”
– “অ্যাঁ .. মিছিল!…স্লোগান!…”
– “যাব্বাবা, এতে এতো চমকাচ্ছেন কেন? আপনি ওঁর মেয়েকে মেরে লাস গুম করে দিলেন আর উনি কি আপনার পুজোর ব্যবস্থা করবেন?”
– “লা..লাশ?খুউউন?..এই র..রজত কি সঅঅব ব..বলছে রে এরা?” কথা বলতে গিয়ে গৌরব দেখল, গলায় গিটকিরি বেঁধে যাচ্ছে।
রজত হাত তুলে অভয় দিয়ে গৌরবের পাশে এসে বসে ওদের জিজ্ঞাসা করল -“আপনাদের এই দাদাটা কে?”
-“দাদাকে চেনেন না? এলাকার কাউনসিলার বিজন মিত্তির। সুখে-দুখে মানুষের পাসে সবসময় পাবেন।
-“বাহ্, খুব ভালো লাগলো জেনে। আপনার দাদাকে গিয়ে বলবেন গৌরব খুনটুন কিছু করেনি।একটু পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ও ঠিক হয়ে যাবে। আজ জামিন পেয়েছে এরপর কেসও জিতে যাবে।”
– “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু পাবলিক কি আর অতো কথা সুনতে চাইবে?রাতারাতি একজন মহিলা হাপিশ হয়ে গেল। এলাকার লোকজন তো জানতে চাইবেই..”
– “আপনারা একটু বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই শুনবে।আপনার দাদা, আপনারাই তো সবার বল-ভরসা।”
-“খালি হাতে কি আর ভরসা দেওয়া যায় দাদা?কিছু মালকড়ি ছাড়ুন!এতগুলো মানুষকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠান্ডা করতেও তো কিছু দম লাগে নাকি?”
– “তা তো ঠিক। কত লাগবে বলুন?”
– “আপাতত হাজার পঞ্চাসেক দিন।”
– “প..প..পঞ্চাশ হাজাআর?…গৌরব আর চুপ থাকতে পারে নি। রজত ওর হাঁটুর উপর হাতের চাপ দিয়ে চুপ করতে ইশারা করল।”
লোকগুলো চলে যেতেই গৌরব রজতের ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠল-“তোর কি মাথা খারাপ না পেটখারাপ? এককথায় অতোগুলো টাকা দিতে রাজি হয়ে গেলি?”
রজত ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বলল-“না দিয়ে কোনো উপায় আছে? ওরা সাতপাঁচ ভুজুং-ভাজুং দিয়ে পাড়ার লোকেদের যদি ক্ষেপিয়ে তোলে,তুই কি আর আস্ত থাকবি? এসব বধূনির্যাতন-টির্যাতন এমনিতেই সেনসিটিভ ইস্যু। একাদশীতেই না নরবলি হয়ে যায়।”
-” এসব কি বলছিস তুই? নির্যাতন…আ..আম্মি…আমি কখনো…”
গৌরবের কথার মাঝেই মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে রজত বলল-“হ্যাঁ,জানি জানি,তুই ওসব করিসনি। কিন্তু সেকথা সবাইকে বোঝাব কিকরে? ”
অসহায় ভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল গৌরব।
“উফ্, কোন কুক্ষণেই যে সেদিন ঠাকুর দেখতে গেছিলাম!”
“অ্যাই, এতক্ষণে আসল পয়েন্টে এসেছিস।ভালো করে ভেবে বল তো।পরশু রাতে ঠিক কী হয়েছিল?”
– ” আরে এতে ভেবে বলার কী আছে? আগেই তো বললাম। পরশু রাতে দুজনে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম শ্রীভূমি দিয়েই শুরু করব। কত আনন্দ করে দুটো পাস জোগাড় করেছিলাম। শালা, এই ঠাকুর দেখার চক্কর আমার লাইফ এন্ড করে ছাড়ল!”
“হুম,তারপর?”
“যাওয়ার সময়ে রাস্তায় মালবিকার সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি..”
কি নিয়ে?”
“বিশেষ কিছু না।পরদিন,মানে নবমীর সকালে মালবিকা ওর বাড়িতে ফিরতে চাইছিল। আমি বলেছিলাম, ওর ইচ্ছে হলে যাক কিন্তু আমি যাব না। ও চাইছিল আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে। সেই নিয়েই …”
“তোরই বা এত জেদ কীসের রে?”
“জেদ নয়। ওর ঐ বাপটাকে দেখলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়।বুড়োটার কথায় কথায় খালি দেখনদারি। কত্ত বড় উকিল উনি,ওঁর কত টাকা আছে,ক্ষমতা আছে,আর আমি কত্ত মামুলি!”
“সে নাহয় একটু-আধটু সহ্য করতিস। হাজার হোক, শ্বশুর তো।”
“হুঁঃ, শ্বশুর না অসুর।..এই সত্যি,অষ্টমীর রাতে রাস্তার ওকে ওইভাবে একা ছাড়া খুব ভুল হয়ে গেছে রে।”
“কাকে? তোর শ্বশুরকে?”
“ধুস্, না,মালবিকাকে। সেদিন এমন ঝগড়া শুরু হল!আমিও রেগেমেগে একটা পাস ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে,একাই প্যান্ডেলের দিকে ঢুকে গেছিলাম। ঘন্টা খানেক পরে বেরিয়ে দেখি মালবিকা গাড়ির কাছে নেই। ফোন করলাম, সুইচ অফ। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত ফোনটা একইভাবে…”
“তারপর? লোকাল পুলিশকে বা পুজো কমিটির কাছে একটা মিসিং… ”
“সবকিছু করেছিলাম। তাও ওর খোঁজ পেলাম কই? তারপর ভাবলাম, রাগ করে একাই ওর বাড়িতে চলে গেছে হয়ত। ওর খোঁজ নিতেই কল করেছিলাম ওর মাকে। শুনলাম,ওঁরাও তখন বাইরে। প্যান্ডেল হপিংয়ে বেরিয়েছেন। বাধ্য হয়েই পরদিন সকালে আবার ফোন করি। ওর খারুশ বাপটা ঠিক বুঝতে পেরে গেল আর আজ সাতসকালেই কেসটা ঠুকে দিল।কী ডেন্জারাস লোক মাইরি!”
“তাহলে পুলিশকে বলেছিস কেন ‘কিছু মনে নেই’?”
“সে তো ভয় পেয়ে..না মানে একটু ঘাবড়ে গিয়ে..”
“অ, তুইও তাহলে ভয়-টয় পাস?”
রজতের গলার স্বর আর কথা বলার ধরণে এমন কিছু ছিল যাতে গৌরবও একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে মুখ তুলে তাকালো। আর তখনই প্রায় ভূত দেখার মতই চমকে উঠল ও।
“তুমি আবার আমার বাবার নামে যা তা কথা বলছ?” হঠাৎ মালবিকাকে চোখের সামনে দেখে সত্যিই নাকি স্বপ্ন বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো গৌরবের। তারপরই চেঁচিয়ে উঠলো- “মলি!!কোথায় ছিলে তুমি?”
“সেটা আর জেনে কি লাভ বলো। অতো রাতে মাঝরাস্তায় আমাকে একা ফেলে…” মালবিকার গলায় অভিমানের সুর।
“হ্যাঁ,এখন তো কথা শোনাবেই। গত চব্বিশ ঘণ্টায় আমার ওপর দিয়ে কি গেছে জান?তোমার জন্য দুশ্চিন্তা, পুলিশি হাঙ্গামা, কোর্টের ঝামেলা,লোকাল গুন্ডাদের দাদাগিরি কী কী সহ্য করতে হয়নি? তার ওপর কড়কড়ে পন্চাশ হাজার টাকা গচ্চা।”
“আমার জন্য দুশ্চিন্তা? সত্যি হচ্ছিল নাকি?”..কেটে কেটে কথাগুলো বলল মালবিকা।
“মানে?”…আবার একটা গন্ডগোল হওয়ার সম্ভবনা আছে বুঝেই থমকে গেল গৌরব।
“না,আমি ভাবলাম ঐ পন্চাশ হাজারের শোকটাই বোধহয় বেশি কষ্ট দিচ্ছে তোমায়, যেভাবে আমাকে ওয়েলকাম করছ,তাতে…”
“এই মলি,কি হচ্ছে কি? দেখছ,বেচারা কেমন ঘেঁটে আছে। তার ওপর তুমি ওকে আরও প্রেসার দিচ্ছ..বাই দ্য ওয়ে, আমি কিন্তু ওকে বাজিয়ে দেখে নিয়েছি, তোমার প্রতি প্রেমে ওর কোনো ফাঁকি নেই। শুধু মাথাটা চট করে গরম করে ফেলে তাই। নচেৎ ছেলে একদম খাঁটি।”…দরাজ সার্টিফিকেট দিল রজত।
“সে আমি খুব ভালো করে জানি।” মলির মুখে সলজ্জ হাসি।
ওদের কথাগুলো কেমন যেন সন্দেহজনক লাগল গৌরবের। ঘুরে তাকাল গৌরব।
সন্দেহের চোখে গৌরব তাকিয়ে আছে দেখে রজত দুহাত মাথার ওপর তুলে হাসতে হাসতে বলল- “ওরকম খুনে দৃষ্টিতে তাকাস না ভাই। আমার এতে কোনো দোষ নেই। পুরো প্ল্যান তোর বৌ এর মাথা থেকে বেরিয়েছে।”
“মানে?” গৌরবের ভ্যাবাচাকা ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি এখনও। সেটা বুঝতে পেরেই রজত বলল- “সেদিন রাতে মালবিকা লেকটাউন ফুটব্রিজটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমিও তখন ঐ রাস্তা দিয়েই ফিরছিলাম। ওর মাথায় তো তখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। আমার সঙ্গে সেদিন আমাদের বাড়িতেই ফিরল। পরদিন সকালেই তোকে টাইট দেয়ার প্ল্যান করে চলে গেল দুর্গাপুরে,তোর দিদির বাড়ি।”
“দিদির বাড়ি! তারমানে মা-বাবাও”…আঁতকে উঠল গৌরব।
“না না…ওঁরা বোধহয় কিছু জানেন-টানেন না। কি মলি?”
” না এবারটায় ছেড়ে দিলাম।কিন্তু এরপর কখনো আমার সঙ্গে ঝামেলা করলে ঠিক বলে দেব ওঁদের।”…ছদ্ম গাম্ভীর্য মালবিকার মুখে।
“আর কাউকে বলতে হবে না দেবী। আমাকে প্যাঁচে ফেলতে তোমার বাবা একাই একশ।”..গৌরবের গলায় রাগের আভাস।
“সত্যি, বাবা যে কী করে না!আমার সমস্ত প্ল্যান চৌপাট করে দিল।এদিকের ঘটনা শুনেই তো আমাকে সাততাড়াতাড়ি দুর্গাপুর থেকে চলে আসতে হল। নয়ত অন্তত দিনসাতেক তোমাকে নাকানিচোবানি খাইয়েই ছাড়তাম আমি। মাঝখান থেকে এসব থানা- পুলিশের হাঙ্গামা…যাক্গে, গেট রেডি গৌরব। কুইক।”
“এখন? আবার কোথায়?”
” আমাদের বাড়িতে যাব।আমার বাবার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা খুব দরকার। আমার বরের নামে কথায় কথায় কেস ঠুকবে,বাড়িতে গুন্ডা এসে শাসাবে আর আমি ছেড়ে দেব ভেবেছ?”
“এই মেরেছে!বলছিলাম কি মলি,ব্যাপারটা তো ওঁকে একটু বুঝিয়ে বললেই হয়।”
“না,হয়না। তুমি এখনি রেডি হও।” গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেল মলি। গৌরবের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে রজত কাঁধদুটো ঝাঁকিয়ে আপনমনে গুনগুনিয়ে উঠল- “সকলই তোমারই ইচ্ছা…”
Tags: গল্প, ঝগড়ার পরবর্তী অংশ, সাগরিকা দাস
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।