১
পাদুটো মুঠোয় ধরে উলটো করে ঝুলিয়ে দ্রুত পিঠে হালকা কয়েকটা চাপড় মারার পরই বেবী কেঁদে উঠলো ।
ওটি নার্স, ডাক্তার অলোক, পেডিয়াট্রিশিয়ান আর এনাসথেটিসটদের সারজিক্যাল মুখোশ ঢাকা মুখগুলো থেকে একটা ক্ষীণ ও-ও আওয়াজ বেরিয়ে এলো ।
সুমিতাভ হাঁফ ছেড়ে একটা নিশ্বাস নিয়ে তাড়াতাড়ি বাঁপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সের প্রসারিত হাতের মধ্যে বেবিকে দিয়ে দিলেন ।
তারপর ডানদিকে ঘুরে গিয়ে বললেন,
-‘অলোক, তুমি তাহলে সেলাইটা…’
-‘ হ্যাঁ স্যার, আপনি বেরিয়ে পড়ুন, আমি সেলাইটা করে দিচ্ছি।’
-‘ঠিক আছে । সেকশন করার সময় ইউটারিয়ান আর্টারি যেন একটু ড্যামেজ হয়েছে মনে হোল । ওটা ঠিক করে দেখে নিও । আমি পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি । তুমি বেবি ক্লিন করার পর বাইরে বলে দিও মেয়ে হয়েছে…সব কিছু ঠিকঠাক আছে ।’
শেষ দুটো কথা সিস্টারকে বলে সুমিতাভ, ডঃ সুমিতাভ হাজরা, মাস্ক আর ক্যাপ খুলতে খুলতে পাশের চেঞ্জ রুমে ঢুকে গেলেন ।
#
গত এক ঘণ্টা আগেও ডঃ হাজরা কিছুটা চিন্তিত ছিলেন এই ডেলিভারি পেসেন্টকে নিয়ে ।
নিম্নমধ্যবিত্ত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির প্রথম সন্তান ।
প্রথমদিনের পরীক্ষা থেকেই দেখেছিলেন মায়ের পুষ্টির অভাব ছিল, সাতমাসের সুপারভিশনে হিমোগ্লোবিন দশের ওপরে ওঠেনি একবারও ।
তার ওপরে শেষ আলট্রাসাউনড দেখাল বেবির মাথা নামেনি নীচের দিকে ।
সুমিতাভ প্রমাদ গুনে পেশেনট পার্টিকে, মানে ওই মেয়েটির স্বামীকে ডেকে বলে দিয়েছিলেন, তেমন বুঝলে অপারেশন করে বাচ্চা ডেলিভারি করতে হবে ।
কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে সুমিতাভ-র দিকে চেয়ে থেকে পেশেন্ট রেজিনার স্বামী আখতার প্রশ্ন করেছিল,
–‘ অপারেশন ! আমাকে কি করতে হবে ডাক্তারবাবু ?’
-‘তোমাকে কিছুই করতে হবে না । দুজন ডোনার লাগতে পারে, তার জন্য কথা বলে রেখো । রক্ত যতোটা লাগবে হাসপাতাল থেকে দিয়ে দেওয়া যাবে,কিন্তু সে রক্ত তোমাকে রিপ্লেস করে দিতে হবে ।
-‘ডোনার !’
-‘আরে বাবা, যারা রক্ত দান করে ! শোনো, তোমার বিবির শরীরে রক্ত কম আছে । অপারেশনের সময় রক্ত লাগতে পারে তাই বলছি । হাসপাতাল থেকে দরকারমত রক্ত দিয়ে দেবে, কিন্তু তোমাকে ততটা রক্ত হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কে ফেরত দিয়ে দিতে হবে । যে কোনও গ্রুপের মানে যে কোন সুস্থ মানুষের রক্ত হলেই চলবে । এবার বুঝলে ?’
আখতার ঘাড় নাড়ল ।
সুমিতাভ প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন,
‘চিন্তার কিছু নেই, বন্ধুবান্ধবদের বলে রেখো, অনেকেই তো রক্তদান করে ।’
আখতার আলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে বলেছিল,
-‘সরকারি বাস ড্রাইভারের বিবির জন্যে কে আর রক্ত দিতে চাইবে ডাক্তারবাবু । দেখি, আমাদের ইউনিয়নের কাউকে বলে যদি কিছু হয় ।’
সেই দিনই সুমিতাভ প্রথম জানতে পারলেন রেজিনার স্বামী আখতার আলি সরকারি বাস চালায় ।
সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের ভিড়ে কে-ই বা পেশেনট পার্টির বিস্তারিত খবর নেওয়ার সময় পায় ।
প্রেসক্রিপশন আখতারের হাতে দিয়ে তিনি বলেছিলেন,
-‘শোন, এই ওষুধগুলো খাইয়ো নিয়ম করে । ডিম খাওয়াবে রোজ । আর দু সপ্তাহ পরে বৌকে নিয়ে আসবে আবার, ডেট লিখে দিয়েছি । আমি সেদিন পরীক্ষা করে অপারেশনের দিন আর সময় বলে দেবো । এই হাসপাতালে অপারেশনের খরচ তোমার লাগবে না । কিছু ওষুধের খরচা আছে আর রক্তের ব্যবস্থাটা করতে হবে । সবকিছু ঠিকঠাক চললে তিন চারদিনের মাথায় বাচ্চা নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারবে । ঠিক আছে ?’
আখতার মাথা নেড়ে চলে গিয়েছিল ।
সুমিতাভ ড্রয়ার খুলে নিজের ডায়েরিটা বার করেছিলেন ।
ডায়েরিতে দুসপ্তাহ পরে নিজের ওপিডি-র তারিখের পাতায় খসখস করে লিখেছিলেন,
‘পেশেন্ট রেজিনা,হাসব্যানড আখতার আলি, ব্রিচ, অ্যানিমিক, ইলেকটিভ সিজার, ডেট টিবিডি ।’
সেই পেশেন্টের আজ সিজারিয়ান হয়ে গেলো ।
আউট করার পর বেবি কেঁদে না উঠতে কয়েক মুহূর্তের জন্য অবশ্য সুমিতাভ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন ।
এখন অনেকটা ভারমুক্ত লাগছে ।
রক্ত-ও লাগেনি এক ইউনিটের বেশী । বাড়তি ইউনিটটা হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কে জমা দিয়ে টাকাটা আখতারকে পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, ভাবলেন সুমিতাভ ।
রেজিনার সেকশন করতে করতে অবশ্য মনের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের দোলাচল হয়েছিল তাঁর ।
বিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে ডঃ সুমিতাভ হাজরা অন্তত দশ হাজার নতুন প্রাণ এই পৃথিবীতে এনেছেন ।
কিন্তু তাঁর নিজের ঘর শূন্য থেকে গেছে, স্ত্রী অরুণার কোলে সময়ে কোন সন্তান আসেনি ।
তাই বোধহয় প্রতিবার ডেলিভারী বা সিজার করার সময় সুমিতাভর মনে সেই করুণ সত্য দোলা দিয়ে যায়, এক পলের জন্য তাঁর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে ।
আজও সেই কারণেই বোধহয় অভিজ্ঞ হাতের স্ক্যালপেল এক মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হয়েছিল ইউটারিয়ান আরটারির আশপাশে।
‘সে যাক, অলোককে বলে এসেছি, ওর ভালো হাত, ঠিক করে দেবে’… সুমিতাভ কিছুটা নিশ্চিন্তমনে গাড়িতে উঠে ড্রাইভার গৌরকে স্টার্ট দিতে বললেন ।
আটটায় ক্লিনিক, ঘণ্টাখানেক সময় হাতে আছে, একটু রিলাক্স করা দরকার, ঝট করে ক্লাবটা ঘুরে যাবেন ।
#
ডঃ সুমিতাভ হাজরা মানুষটাই এইরকম ।
মিষ্টভাষী, বিদেশী ডিগ্রী থাকা সত্ত্বেও বিনয়ী এবং বেশ ভালোরকম পেশেন্টবৎসল ।
সমবয়সী কলিগদের মধ্যে এবিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ।
অসূয়াহীন ডাক্তারেরা তাঁকে বেশ পছন্দই করে।
আর বাকিরা কানাঘুষোয় বলে বেড়ায়…‘সরকারি হাসপাতালে সব কেসই এতো সিরিয়াসলি নিলে চলবে ? সুমিতাভর কাছে সব পেশেন্টই ক্যাচ পেশেন্ট…বোঝো !’
তবে ভরসার কথা এই যে, সিনিয়র রেসিডেনট আর হাউস স্টাফেদের কাছে ডঃ সুমিতাভ হাজরা উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ইউনিটে ঢোকার জন্য প্রতি বছর লম্বা লাইন ।
হাসপাতালের প্রসুতিবিভাগে তাঁর ইউনিটের এই খ্যাতির কথা এম এস এবং ডিরেক্টর ভালোরকম অবগত আছেন ।
আবার এই কারণেই ডঃ হাজরার নির্ধারিত আউটডোরের দিনে উত্তর কোলকাতার এই সরকারি হাসপাতালের প্রসুতিবিভাগে টিকিটের সংখ্যা অনেক বেশী হয়ে যায় ।
বেলা দুটো অবধি হাজরা ডাক্তারের জনাকীর্ণ আউটডোর চলতে থাকে ।
কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে ওই দিনগুলোতে নির্ধারিত লাঞ্চের সময় দীর্ঘায়িত হয়ে বেলা তিনটের অপর দিকে হেলে পড়ে ।
সুমিতাভর অবশ্য তাতে বিশেষ কোনও হেলদোল থাকে না, কারণ বাড়িতে দুপুরবেলায় চব্বিশঘণ্টার লোক বিপিন ছাড়া আর কেউ অপেক্ষায় থাকে না ।
অরুণা মধ্য কোলকাতার এক কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপিকা, সপ্তাহের পাঁচটা দিন তিনি থাকেন কলেজে ।
বিপিনের তাই বিশেষ কাজ থাকে দাদাবাবু ঘরে ফিরে এলে লাঞ্চ গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া ।
২
ইউনিয়নের অফিসঘরে সেক্রেটারি তারাপদ সাঁতরার টেবিলের সামনে কুণ্ঠিত ভাবে দাঁড়িয়েছিল আখতার ।
প্রায় মিনিট পাঁচেক হয়ে গেলো , সাঁতরা চোখ বুজে কান খুঁচিয়ে চলেছে ।
প্রথম চোটে আখতারের অনুরোধ শোনার পরই কানখুস্কি কানের ভেতরে নিয়ে সেই যে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল, তারপর আর চোখ খুলছেই না ।
আখতার ডাকবে ডাকবে ভাবছে, এমন সময় তারাপদ সাঁতরা চোখ খুলে আখতারকে দেখে একটু হতাশ হলো ।
তারপর যেন প্রথমবার আখতারকে দেখছে এইরকম একটা ভাব করে টেবিলের ড্রয়ার খুলে সযত্নে কানখুস্কিটা রাখতে রাখতে বললো,
-‘ হ্যাঁ, কি যেন সাহায্য চাই বলছিলে ?’
-‘ তারাদা, রক্ত চাই বলছিলাম । আমার বউয়ের বাচ্চা হবে, রক্ত কম আছে, তাই ডাক্তারবাবু…’
-‘ হুম ! নেতাজীর মতো রক্ত চাই, রক্ত দাও বলছো যে, মেম্বারশিপ আপ টু ডেট আছে ?’
-‘অ্যাঁ !’ এমন অভাবিত প্রশ্নের আক্রমণে আখতার হতভম্ব হয়ে গেলো ।
-‘চাঁদা, চাঁদা ! তোমার মেম্বারশিপটা বেঁচে আছে তো, না কি ? বলছি যে, এবছরের চাঁদা অ্যাডভান্স দেওয়া আছে তো ? নইলে তো বাবা…’
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আখতার হাঁফ ছেড়ে বললো,
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদা, নিশ্চয়ই । সে তো বছরের প্রথমেই…এই যে, কার্ডের নম্বরটা দেখে কেষ্টদাকে বলুন না দেখে নিতে ।’
আখতার পকেট থেকে ইউনিয়নের মেম্বারশিপের কার্ডটা বার করে ঘরের কোনায় গিয়ে সেখানে একটা টেবিলে বসা কেষ্ট হালদারের হাতে দিল ।
ইউনিয়নের ক্যাশিয়র কেষ্ট হালদার একটা মোটা লেজার খাতা দেখতে দেখতে তারাপদ সাঁতরাকে বললো,
-‘এ বছরের টাকা দেওয়া আছে দাদা । এই যে, আখতার আলি, রুট ৪৪, ২০২১-২২, বারশো টাকা ।’
-‘তাহলে তো তোমাকে হেল্প করতেই হয় ।’
তারাপদ সাঁতরা এবার ড্রয়ার থেকে ধীরেসুস্থে, পৃথিবীর বার্ষিক গতিতে, একটা পানের কৌটো বার করে পান মুখে দিলো ।
তারপর পান চিবোতে চিবোতে বললো,
-‘দেখি, তোমার এই বিশেষ কাজের জন্য ১২সি-র রমেন ঘোষকেই বলি । কেষ্ট, হরির চায়ের দোকানে রমেনকে একবার দ্যাখ তো । একটু আগে পান নিয়ে অফিসে ঢোকার সময় দেখেছিলাম তো বসে চা খাচ্ছে ।’
কেষ্ট চেয়ার থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে গেলো ।
আখতার একটু গদগদ হয়ে বললো,
‘তারাদা, আমার খুব উপকার করলেন । আপনাকে যে কি বলে…’
তারাপদর মুখভরতি পান, হাতটা তুলে আখতার আলিকে থামালো ।
তারপর টেবিলের তলা থেকে একটা প্লাস্টিকের বড়ো মগ বার করে তাতে পানের পিক ফেলে বললো,
-‘রমেনের আবার এই সব সমাজসেবার বাই আছে…প্রায়ই রক্ত-টকত দেয় শুনি, তাই ওকেই ডাকলাম । সুভাষদার শেষ বয়েসের চেলা তো…ঝাণ্ডাটা ধরে আছে এখনো । দ্যাখো আবার, তোমার বউয়ের জন্যে রক্ত তো…কি বলে দ্যাখো।’
তারাপদ সাঁতরার কথা শেষ হতে না হতেই কেষ্ট হালদার একজন মধ্যবয়েসি হৃষ্টপুষ্ট লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
লোকটা সোজা তারাপদর টেবিলের সামনে এসে বললো,
-‘কেষ্ট বললো তুমি আমাকে খুঁজছো ।’
-‘এই যে, এর জন্যে। এর নাম আখতার আলি, ফরটিফর রুটে চালায় ।ওর বউয়ের বাচ্চা হবে, রক্তের দরকার । তাই তোকেই ডাকলাম ।’
রমেন ঘোষ এতক্ষণ আখতারকে লক্ষ্য করেনি । এবার ওকে দেখলো এক মুহূর্ত । তারপর জিগ্যেস করলো,
-‘অপারেশন কবে ?’
-‘ডাক্তারবাবু এখনো বলেননি । দশদিন পরে বলবেন বলেছেন ।’
-‘ওহ, দেরি আছে ! হয়ে যাবে ।’
আখতার আবার তারাপদ সাঁতরার দিকে ফিরে বললো,
-‘কিন্তু…’
-‘আবার কিন্তু কি ! এই তো, সব ঠিক হয়ে গেলো !’ তারাপদ সামান্য বিরক্তির ভাব দেখালো ।
-‘ডাক্তারবাবু বলেছিলেন দুজনের কথা…’
রমেন ঘোষ আখতারের মুখের কথা না থামতেই বলে উঠলো,
-‘ দু ইউনিটের কথা বলেছেন তো ? সেও হয়ে যাবে, তুমি চিন্তা কোর না । আমার অনেক কমরেড আছে যারা রক্ত দ্যায়, একজনকে নিয়ে যাবো । তুমি আমার ফোন নাম্বারটা নিয়ে নাও ।’
-‘রক্তটা আখতার আলির বউয়ের জন্য…আখতার আলি, বুঝেছিস তো । সেই কথাটা তোমার বন্ধুকে আগে জানিয়ে তারপর কিন্তু নিয়ে যেও বাবা ।’
রমেন ঘোষ একবার ইউনিয়ন সেক্রেটারির দিকে তাকালো ।
তারপর আখতারের দিকে তাকিয়ে যেভাবে মাথা নাড়লো তার মানে হয়, কোন সমস্যা নেই ।
তারাপদ সাঁতরা আবার কানখুস্কি বের করে ফেলেছে ।
-‘আর এই যে আখতার…সব মুশকিলের আসান হয়ে গেলো তো ! বউ বাচ্চা ঘরে ফিরলে এখানে তোমাদের ওই বাগবাজারের মিষ্টি নিয়ে আসবে…খাও তোমার আল্লার কসম !’
-‘আল্লা কসম, নিশ্চয়ই আনবো দাদা, এতো উপকার করলেন ।’
৩
রাজারহাটের এই হালফিল ক্লাবটা ছাড়া আরও একটা জবরদস্ত একটা মেম্বারশিপ আছে ডঃ সুমিতাভ হাজরার…সেটা ক্যালকাটা ক্লাবের ।
তবে সপ্তাহের দিনগুলোতে, মধ্য কোলকাতার শেষ প্রান্তে অতোটা দূরের ক্লাবে সময় কাটাতে যাওয়া হয়ে ওঠে না তাঁর ।
সন্ধ্যায় ক্লিনিক থাকে ।
তাছাড়া রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক , আটটার পরে কাঁকুড়গাছি থেকে সেই গোখেল রোডের কাছে দশ মাইল রাস্তা পৌঁছতেই লেগে যাবে ঘণ্টা খানেক ।
এর পরে কতক্ষণই বা বসতে পারবেন সেখানে !
ড্রাইভারকে ছুটি দেওয়ার তাড়াটাও থাকে ।
কিন্তু নিয়ম করে প্রায় প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় নিজেই ড্রাইভ করে ক্যালকাটা ক্লাবে চলে যান সুমিতাভ ।
বাড়তি আগ্রহটা থাকে মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট আর অন্যান্য প্রফেশনাল বন্ধুবান্ধবদের আড্ডার প্রতি ।
ক্লাবে পরিবারসমেত মজলিশের আগাম খবর থাকলে কদাচিৎ অরুণাও সুমিতাভর সঙ্গী হন ।
তবে এই ধরণের আড্ডায় বাবা মা আর তাদের ছেলেমেয়েদের ভিড়ের মধ্যে অরুণার লুকোনো অস্বস্তি সুমিতাভ ঠিক বুঝতে পারেন ।
তাই অরুণা যদি কোনবার যেতে আপত্তি করেন তিনি একেবারেই অনুযোগ করেন না ।
বদলে তিনি নিজে বাড়িতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব করলে বরং অরুণা জোরাজুরি করে স্বামীকে পাঠিয়ে দেন ।
সপ্তাহব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সুমিতাভর মনের ভার হাল্কা করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা অরুণা পুরোপুরি বোঝেন ।
তাই ওইসব সন্ধ্যায় তিনি হিস্ট্রি চ্যানেল বা নেটফ্লিক্সে নতুন সিরিজ দেখার বাহানা দেন ।
পরস্পরের মনের গোচরে এই লুকোচুরি খেলা এভাবেই বহু বছর ধরে চলছে ।
#
হঠাৎ কি মনে হলো, সুমিতাভ বললেন,
-‘গৌর, রাস্তার বাঁদিকে নিয়ে গিয়ে গাড়িটা একটু থামাও তো ।’
রাজারহাটের ডবল রাস্তায় পরপর উজ্জ্বল আলো, রাস্তার ধারের নতুন মালটিষ্টোরিড বাড়িগুলো ঝকঝক করছে, সোঁ সোঁ করে গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে আপ ডাউন দুদিক দিয়ে।
রাস্তার ডানদিকে দূরে অনেকটা অন্ধকার ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে আলোকিত ক্লাবের কমপ্লেক্সটা দেখা যাচ্ছে ।
ক্লাবের এতো কাছে এসে ডাক্তারবাবুর গাড়ি থামাবার কথায় ড্রাইভার গৌর একটু অবাক হয়েই গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিলো ।
সুমিতাভ গাড়ি থেকে নেমে অলকের নাম্বারে ফোন করলেন ।
-‘হ্যাঁ স্যার, বলুন ।’
-‘ অলক, সব ঠিক আছে ?’
-‘হ্যাঁ স্যার । সব তো ঠিক আছে । কেন বলুন তো স্যার ?’
-‘ না…মানে…ওই যে সিজারিয়ান কেসটা, পেশেন্ট রেজিনা ? ওর সেন্স ফিরেছে তো ?’
-‘ হ্যাঁ স্যার । বেশ কিছুক্ষণ আগে । সেডেশনে আছে তো, এখনও ঘুমোচ্ছে, অবসারভেশন ওয়ার্ডে । শিফটিং এর সময় বেশ কাশি এসেছিলো অবশ্য । ডঃ সরকার ফোনে বললেন এন্ডোট্রাকিয়াল টিউবটা ট্রাকিয়াতে ঘষে গেলে অনেক সময় কাশি…’
-‘আচ্ছা, তাই বলেছেন ! তবে কাশিটা ঠিক নয় অলক…সেলাইয়ে চাপ পড়বে । দেখবে কাশি যেন আর না হয় । দরকার হলে অ্যানটিহিস্টামিন পুশ করবে । তোমার রাতের ডিউটি তো ।’
-‘হ্যাঁ স্যার । আর কিছু স্যার ?’
– ‘না, গুড নাইট, অলক ।’
-‘গুড নাইট স্যার ।’
#
রাত প্রায় এগারটা বাজে ।
একটু আগে রাতের খাবার শেষ করে হাজরা দম্পতি এখন বেডরুমে ।
বিছানায় উঠে সুমিতাভ চাদরটা কোমর অবধি টেনে নিয়ে টিভিটা মিউট করে দিলেন ।
স্ক্রিনের নীচের স্ক্রোল করে যাওয়া ব্রেকিং নিউজগুলো দেখতে দেখতে মাথাটা নেড়ে বেড সাইড টেবিল থেকে ফগসি-র জার্নালটা টেনে নিলেন ।
অলসভাবে জার্নালের পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে সুমিতাভ বলে উঠলেন,
-‘অরু, আজ একটা ইলেকটিভ সিজার ছিল, ব্রিচ, অ্যানিমিক পেশেন্ট,আমাকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।’
অরুণার মেদহীন উজ্জ্বল চেহারা, ঘাড় অবধি লুটিয়ে পড়া চুলে স্মার্ট বহিরঙ্গ, রাতের পোশাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে ক্রিম ঘষছিলেন ।
প্রায় বিশ বছর গাইনিকোলজিস্ট স্বামীর ঘর করে ইতিহাসের অধ্যাপিকা অরুণা এইসব ডাক্তারি শব্দের সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত হয়ে গেছেন ।
হাসপাতালের মেডিক্যাল বোর্ডে কঠিন কেসগুলোর আলোচনা হওয়ার পর বাড়িতে সেগুলোর একপ্রস্থ বিবরণ তাঁকে প্রায়ই শুনতে হয় ।
ইতিহাসের কোন বর্তমান হয় না, তাই অরুণার নিজের সাবজেক্টের ওপর গল্প করার বিশেষ কিছু থাকে না, তাই তিনি প্রত্যয়িত শ্রোতার ভূমিকা পালন করেন ।
স্বামীর দিকে ঘাড় না ঘুরিয়ে চুলে ব্রাশ করতে করতে তিনি জিগ্যেস করলেন,
-‘বাচ্চা ঠিক আছে তো ?’
-‘হ্যাঁ, দুজনেই ঠিক আছে । প্রাইমি বেবি, মেয়ে । সে একদম ঠিক আছে, ওজনও যেমন ভেবে রেখেছিলাম তার থেকে একটু বেশীই । তবে আউট করার পর তার প্রায় দুমিনিট কান্নাকাটি নেই । তারপর চড় চাপড় খেয়ে…।’ সুমিতাভ মৃদু হেসে জার্নালে মন দিলেন ।
অরুণা ধীরেসুস্থে হাতের কাজগুলো শেষ করে খাটের এপাশ দিয়ে ঘুরে এসে সুমিতাভর দিকের বেডসাইড আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন ।
তারপর ঘরের টিউবলাইটটা নিভিয়ে দিয়ে গায়ের ওপর চাদর টেনে শুয়ে পড়লেন ।
সুমিতাভ একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে জার্নালে মন দিলেন ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অরুণা ঘুমিয়ে পড়লেন, নিস্তব্ধ ঘরে তাঁর স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের হালকা আওয়াজ ভেসে বেড়াতে লাগলো ।
#
লেকটাউনের বাঙ্গালি বিগ বেন ঢং ঢং করে রাত বারোটার সময় ঘোষণা করলো ।
গভীর রাতের নৈঃশব্দ্যে এ ঘড়ির শব্দ নাকি সুমিতাভর নাগেরবাজারের মামাবাড়ি থেকেও শোনা যায় ।
সুমিতাভর সুবিধা হয়েছে এই বারোটার ঘণ্টাধ্বনি তাঁর কাছে শুয়ে পড়ার অ্যালারম বেলের মতো ।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি আই ভি এফ-এর ওপরে লেটেস্ট প্রবন্ধটা বন্ধ করে জার্নালটা বেডসাইড টেবিলে রেখে দিলেন ।
তারপর ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত ।
একচল্লিশের অরুণা একত্রিশ বছর বয়েসের সুন্দরী যুবতীর মতো প্রস্ফুটিত মুখ নিয়ে গুটিসুটি হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, বেড সাইড ল্যাম্পের তেরছা আলো তার গালের একাংশে পড়ে চকচক করছে ।
সন্তানহীনতার জন্য অরুণার দেহসৌষ্ঠব অক্ষুণ্ণ ।
অপরিচিত কেউ তাকে দেখলে তাঁর বয়েস তিরিশের সামান্য ওপরেই আন্দাজ করবে ।
সুমিতাভর ঘনিষ্ঠরা অরুণার অনুপস্থিতিতে বন্ধুর স্ত্রীসৌন্দর্যের ভাগ্য নিয়ে তাঁর সামনেই কপট ঈর্ষা প্রকট করেছে অনেকবার ।
ত্রস্ত হয়ে সুমিতাভ অরুণার মনের কষ্টটা বন্ধুদের মনে করিয়ে দিয়েছেন ।
এসব প্রসঙ্গ ঠাট্টাছলেও অরুণার সামনে উত্থাপন না করা জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি ।
স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সুমিতাভ একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেললেন আবার ।
এই মুহূর্তে তাঁর মনের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে এখনই পড়া প্রবন্ধটার বিষয়বস্তু…বয়স্ক আই ভি এফ প্রসূতির শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ।
পাঁচ বছর ধরে অনেক বুঝিয়েও তিনি অরুণাকে আই ভি এফ এর প্রস্তাবে রাজি করাতে পারেননি।
তিনি আজ পর্যন্ত ধারণা করে উঠতে পারলেন না অরুণার আপত্তিটা কোথায়, কি কারণে ।
সুমিতাভর এম আর সি ও জি-র কোর্সমেট বিকাশ আই ভি এফ-এর স্পেশালিষ্ট হয়ে দারুণ প্র্যাকটিস করছে বালিগঞ্জে।
তার ক্লিনিকে সন্তানকামী দম্পতির এন্ড টু এন্ড ট্রিটমেন্ট হয়।
প্রথম দিকে দু তিন বার তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন সুমিতাভ ।
বলেছিলেন অরুণার আপত্তির কথাও ।
বিকাশ বলেছিল, তোরা নিজেরা আগে ঠিকঠাক ডিসাইড কর, তারপর একদিন দুজনে সময় করে আমার চেম্বারে চলে আয়, সব হয়ে যাবে ।
সে দিন আর আসেনি সুমিতাভ আর অরুণার জীবনে, প্রধানত অরুণার জোরাল আপত্তির কারণে ।
সুমিতাভ আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ার উদ্যোগ করতে যাবেন, এমন সময়ে পাশের টেবিলে রাখা মোবাইলটা মধ্য রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে ঝনঝন করে বেজে উঠলো ।
সুমিতাভ সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকালেন, অরুণা ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে শুলেন ।
সুমিতাভ ফোনটা তুলেই দেখলেন অলক ফোন করছে ।
বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নিয়ে ভীষণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে সুমিতাভ জিগ্যেস করলেন,
-‘ হ্যাঁ অলক বলো, কি ব্যাপার, কি হয়েছে ?’
-‘স্যার, এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত । কিন্তু পেশেন্টকে ম্যানেজ…।’
-‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে ঠিক আছে।তুমি বলো তাড়াতাড়ি, কি হয়েছে ? কোন পেশেন্ট ? কি ব্যাপার ?’
সুমিতাভ উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারছেন না ।
অলকের গলার স্বরে তাঁর মনে হচ্ছে ও যেন কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছে ।
-‘ স্যার, ওই যে সন্ধ্যেবেলায় সিজার করলেন, পেশেন্ট রেজিনা । তার সিভিয়ার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে স্যার । আমি আইসিইউ টু-তে দিয়েছি । ওখানে মেট্রন রমাদি ডিউটি করছেন, পেশেন্টের অবস্থা দেখেই বললেন আপনাকে খবর দিতে । তাই স্যার আপনাকে…’ অলক থেমে গেলো ।
সুমিতাভ এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন ।
তারপর একটু সামলে নিয়ে বললেন,
‘অলক, সরকারকে আসতে বলো, বলবে আমি রিকোয়েস্ট করেছি । আর দ্যাখো ট্রমা সেন্টারে কাউকে পাও কিনা । আমার নাম কোরো, দরকার হলে । আমি পনের মিনিটে পৌঁছে যাবো ।’
সুমিতাভ খাট থেকে নেমে পড়ে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে বেডরুমে ফিরলেন ।
অরুণা একইভাবে ঘুমিয়ে আছেন ।
সুমিতাভ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গলা খুব নামিয়ে বললেন,
-‘অরু, হসপিটালে যাচ্ছি, এমারজেন্সি । বাইরের দরজা টেনে দিয়ে গেলাম ।’
অরুণা ধড়ফড় করে উঠে পড়লেন ।
ঘুমচোখে স্বামীকে দেখলেন এক পলক । তারপর বললেন,
-‘সাবধানে ড্রাইভ করবে । শোন, রাশ চালিয়ে কিন্তু দু-তিন মিনিটের বেশী সময় বাঁচানো যায় না ।’
বড়ো হাসপাতালের ব্যস্ত ডাক্তারের স্ত্রী অরুণা, এইরকম এমারজেন্সীতে তিনি অভ্যস্ত ।
স্বামী ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আলোটা নিভিয়ে দিয়ে তিনি আবার শুয়ে পড়লেন ।
৪
আইসিইউ টু-র কাঁচের দরজাটা ঠেলে ঢুকে সুমিতাভ দেখলেন একটা বেডের পাশে ডিফ্যাব্রিলেটরের ট্রলি, চারপাশে ডাক্তার, মেট্রন, নার্সের ছোটখাটো ভিড়, ডঃ সরকার দুহাতে ডিফাব্রিলেটরের প্যাডল দুটো নিয়ে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, বেডের মাথার দিকে সুইচবোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে অলক ।
সুমিতাভ একবার সকলের মুখের দিকে তাকালেন, সকলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে হতাশার ভাব স্পষ্ট ।
ডঃ সরকারের দিকে তিনি এগিয়ে যেতেই অ্যানাসথেটিসট সরকার তাঁর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ।
সুমিতাভ রেজিনার নিস্পন্দ দেহের কাছে গিয়ে চোখের পাতা টেনে দেখলেন, হাত দিয়ে ঘাড়ের পেছনে স্পর্শ করে থাকলেন কিছুক্ষণ ।
তারপর হাতটা সরিয়ে এনে ধীরে ধীরে মুখ তুলে অলকের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘বেবি ?’
-‘নার্সারিতে শিফট করেছি স্যার ।’
একজন নার্স বলে উঠলো, ‘ভালো আছে স্যার, এইমাত্র দেখে এলাম নার্সারি থেকে ।’
সুমিতাভ এবার ডঃ সরকারের দিকে ফিরলেন,
-‘কি মনে হচ্ছে তোমার ?’
ডঃ সরকার এক মুহূর্ত ভাবলেন, তাঁর কপাল কুঁচকে গেলো । তারপর বললেন,
-‘ইন্টারনাল হেমারেজ নয়, আমি তো তোমার সেকশন, প্রসিডিওর পুরোটা দেখেছি । আর তোমার হাতে রাপচার, হেমারেজ হবে না । আমার মনে হয় অ্যামনিওটিক ফ্লুইড এমবলিজম হয়েছে ।’
সুমিতাভ ডঃ সরকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন একদৃষ্টে, তাঁর মনের অবস্থা মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না ।
অ্যানাসথেটিস্ট সরকার একবার তাকালেন রেজিনার নিষ্প্রাণ দেহের দিকে ।
তারপর চিন্তান্বিত মুখে আবার বললেন,
-‘প্রসিডিওরের চার ঘণ্টা পরে পেশেন্টের শ্বাসকষ্ট শুরু, শেষে কার্ডিয়াক ফেলিওর… হ্যাঁ,ওটাই হয়েছে । ভেরি ব্যাড লাক সুমিতাভ…রেয়ার কেস…ওয়ান্স ইন এ ল্যাখ । সেলাই করার সময় যদি কিছু …।’
কথা শেষ না করে ডঃ সরকার সিনিয়র রেসিডেনট অলকের দিকে তাকালেন ।
অলকের মুখ চোখ বিধ্বস্ত ।
ও সুমিতাভর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বলতে গেলো,
‘আমি তো স্যার, লেয়ার বাই লেয়ার দেখে দেখে…’ ।
সুমিতাভ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন ।
গত বিশ বছরে চোখের সামনে অনেক মৃত্যু দেখেছেন সুমিতাভ ।
কিন্তু আজ এই গভীর রাতে, গত কয়েক মিনিটেই তীব্র অবসাদ যেন তাঁর সারা শরীর মন গ্রাস করে ফেললো ।
মেট্রনের দিকে ঘুরে গিয়ে তিনি ক্লান্ত স্বরে বললেন,
-‘আপনি যা ফরম্যালিটী করার আছে সেগুলো করুন । পেশেন্টের স্বামীকে খবর দিন । কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট-এর নোট লিখে রাখুন । এখন চার ঘণ্টা তো বডি এখানেই রাখতে হবে । আমি সাড়ে সাতটা নাগাদ এসে সার্টিফিকেট লিখে দেবো । অলক, তোমার ডিউটি শেষ হলে একটু ঘুমিয়ে নিও । আর এগারটার সময় আমি এম এসের অফিসে থাকবো । ভিজিটর রুমে থেকো । আমি ওখানে আসবো । এসো সরকার ।’
এতগুলো কথা বলে সুমিতাভ অবসন্ন ভাবে ধীর পায়ে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
#
বেডরুমে ঢুকে সুমিতাভ খুব সন্তর্পণে এক গ্লাস জল খেয়ে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ।
কিন্তু বিছানা সামান্য নড়ে উঠতেই অরুণা ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলেন ।
স্বামীর দিকে তাকিয়ে, তাঁর মুখ দেখেই বোধহয় পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পারলেন, ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘কি হলো ? সব ঠিক আছে তো ?’
সুমিতাভ স্ত্রীর উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে তাকালেন ।
এক মুহূর্তের জন্য তাঁর মনে পড়লো, অরুণার সবসময় কি অসীম আস্থা আর প্রচ্ছন্ন গর্ব স্বামীর দক্ষতার ওপর ।
তিনি কোন শক্ত কেস করতে যাওয়ার আগে অরুণা জানতে পারলে সবসময় সে তাঁকে পজিটিভ ভাইব দিয়ে ভরিয়ে দেয় ।
সুমিতাভ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন ।
তারপর ক্লিষ্ট স্বরে ম্লান হেসে বললেন,
-‘অপারেশন ইজ সাকসেসফুল অরু, বাট পেশেন্ট ইজ ডেড ।’
অরুণা স্তব্ধ হয়ে গেলেন ।
তাঁর স্বামীর মুখ থেকে এমন কথা শোনার দুর্ভাগ্য কবে হয়েছে সেই মুহূর্তে মনে করে উঠতে পারলেন না তিনি ।
স্বল্প আলোয় বিছানার ওপরে দুজনে চুপ করে বসে থাকলেন ।
কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙ্গে খুব মৃদুস্বরে অরুণা বললেন,
-‘কি হয়েছিল মায়ের ?’
-‘অ্যামেনিওটিক ফ্লুয়িড এমবলিজম…প্রসব চলাকালীন, ওয়াটার ব্যাগের ফ্লুয়িড অ্যাকসিডেন্টালি যদি লাংসে চলে যায়, তাহলে…রেয়ার কেস, বোধহয় লাখে একটা হয় ।’ খুব ধীরে ধীরে, যেন কষ্ট করে সুমিতাভ জবাব দিলেন।
অরুণা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন,
-‘তাহলে, ওটা তো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, যে কোন ডাক্তারের হাতে হতে পারতো । তুমি অতো ভেবো না ।’
সুমিতাভ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রীর দিকে । তারপর ক্লান্ত স্বরে বললেন,
-‘এই যুক্তিটা তুমি আমায় আখতারকে দিতে বলছো অরু, আমি তাকে বলবো যে তাদের প্রথম সন্তান প্রসব হতে গিয়ে তার বিবি অ্যাকসিডেন্টে…?’
সুমিতাভ কথা শেষ না করে একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেললেন।
অরুণা বুঝলেন মৃত পেশেন্টের স্বামীর নাম আখতার, সুমিতাভ তার কথা বলছেন ।
একটু চুপ করে থেকে বললেন,
-‘এটাই তো সত্যি যে এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট, তুমি বলছো লাখে একটা হয় । ঠিক আছে, এসব কথা এখন থাক। তুমি শুয়ে পড়ো তো এখন, রাত অনেক বাকি । সকালে উঠতে হবে তো ।’
সুমিতাভ একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললেন,
-‘ হ্যাঁ, অ্যালার্ম দিচ্ছি, সাড়ে সাতটা নাগাদ হাসপাতালে যাবো । ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখতে হবে তো ।’
অরুণা চুপ করে নির্নিমেষ দেখতে লাগলেন সুমিতাভর মুখ, বুঝতে পারলেন তাঁর মনের কষ্ট। সুমিতাভ থেমে থেমে বললেন,
-‘কতো বছর যে ওসব সার্টিফিকেট লিখিনি অরু । আখতারকে বলেছিলাম সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে তিন চারদিনে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে, কাল আমি তাকে কি বলবো অরু?’
৫
সাদা চাদরে ঢাকা রেজিনার মৃতদেহের ট্রলির সামনে একটা ছোট টুলের ওপর বসেছিল আখতার ।
ট্রলির পায়া ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কতোক্ষণ ফোঁপাচ্ছিল সে ।
সম্ভবত কোন ওয়ার্ড বয়, কোথা থেকে একটা টুল এনে ওকে বসিয়ে দিয়ে গেলো ।
তিন চার জন পুরুষ , ওর ভাই বেরাদরই হবে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে, শববাহী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে ।
এই শেডটার নীচে অন্যসময় সারি সারি অ্যামবুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকে, এখন অনেকটা জায়গা ফাঁকা ।
সুমিতাভ পাশের গেটটা দিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু দেখতেই ওদের দেখতে পেলেন ।
এখানে তাঁর আসা, পেশেন্ট পার্টির সঙ্গে দেখা করা একেবারেই জরুরী ছিল না, থাকে না ।
পেশেন্ট ডিসচার্জের হাজার ফর্মালিটি, দরকারি সব সার্টিফিকেট, এসব সুচারুভাবে হ্যান্ডল করার জন্য হাসপাতালের রিসেপশন আছে ।
তবু সুমিতাভ তাঁর মনের সঙ্গে গত কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ করে ঠিক করে ফেলেছেন একবারের জন্য আখতার আলির সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন, তাকে বুঝিয়ে বলবেন,
‘আখতার, ভগবান বা তোমার আল্লারও ভুল হয়, এই যেমন তিনি এই ভুল করলেন, অসময়ে তোমার বৌকে কেড়ে নিলেন, সদ্যোজাত মেয়েটার কথা ভাবলেন না । আর আমি তো সামান্য মানুষ, আমাকে পারলে তুমি মাপ করে দিও আখতার ।’
সুমিতাভ জানেন না এইসব কথা সত্যিই তিনি ওকে বলে উঠতে পারবেন কি না, কিন্তু মনের ভেতর তিনি ছটফট করছিলেন, একবার অন্তত আখতারের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন, তার সঙ্গে কথা বলবেন ।
সুমিতাভ ধীরের ধীরে আখতারের দিকে এগিয়ে গেলেন ।
আশপাশের মানুষ ওঁর সাদা গাউন দেখে ডাক্তার বুঝতে পেরে একটু সরে গেলো ।
দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা নীচু করে আখতার টুলের ওপর বসে ছিল ।
একটু ইতস্তত করে সুমিতাভ তার কাঁধে হাত রাখলেন ।
আখতার মুখ তুলে তাকাল, তার চোখে বর্ণহীন দৃষ্টি ।
সুমিতাভ তার কাঁধে হাত রেখে বলতে গেলেন, ‘আখতার, আমি…’
আখতার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, তারপর চোখটা মুছে ভাঙ্গাস্বরে বলে উঠলো,
-‘আল্লার মর্জির ওপরে কারুর হাত নেই স্যার, আপনি তো যা করার করেছেন, আমার ঘরে ‘আল্-লাত’ এনে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আমার এই নাদান বাচ্চির কি হবে, কে দেখবে তাকে…’ আখতারের গলায় কথাগুলো হাহাকারের মতো শোনালো ।
সুমিতাভ এবার বিব্রত বোধ করলেন ।
সরকারি হাসপাতালে পেশেন্ট পরিবারের সঙ্গে তাঁর যেটুকু যোগাযোগ তাতে এতকাল শুধু ফুল আর মিষ্টির প্রাধান্য ছিল ।
যা বলবেন বলে ভেবে এসেছিলেন সব কেমন গোলমাল হয়ে গেলো ।
চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে তিনি বলে উঠলেন,
-‘যতদিন তুমি একটা ব্যবস্থা করতে না পারছো, একমাস, দুমাস, আমি তোমার মেয়েকে নার্সারিতে রাখার ব্যবস্থা করবো আখতার, এটা আমি করতেই পারবো ।’
আখতার সুমিতাভর হাতদুটো জড়িয়ে ধরতে গিয়ে পর মুহূর্তে সন্ত্রস্ত হয়ে পিছিয়ে গেলো,
-‘আপনার অনেক দয়া ডাক্তারবাবু, আল্লা আপনার হাত ভরে দিয়ে খিদমত করবেন ।’
সুমিতাভ বলতে গেলেন,
-‘আখতার, অপারেশন করার সময় আমার হাত…’
সুমিতাভ কথা শেষ করার আগেই শববাহী গাড়িটা হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে ট্রলির কাছে এসে দাঁড়ালো ।
মাথায় ফেজ, একজন মধ্যবয়েসী মানুষ আখতারের কাছে এসে বললো,
-‘আখতারভাই, এবার রওনা দিতে হয়, অফিসটাইমে বেলঘরিয়া যেতে তো সময় লাগবে ।’
আখতার আলি মাথা নেড়ে সুমিতাভর দিকে ফিরে বললো,
‘ডাক্তারবাবু, আল্লার মর্জিতে এখন আমার বিবিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি । তাড়াতাড়ি একটা ব্যবস্থা করেই ইনশাল্লা আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে যাবো । আমি ওকে আপনার ভরসায় রেখে গেলাম, দেখবেন আপনি, খোদা হাফিজ ।’
সুমিতাভ আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না ।
আখতার আর কয়েকজন ধরাধরি করে রেজিনা আলির নিস্পন্দ দেহটা ভ্যানটায় তুলে দিলো ।
বাইকে চড়ে আখতারের সঙ্গীসাথীরা বেরিয়ে গেলো ।
সুমিতাভর চোখের সামনে আখতার আলি আর রেজিনাকে নিয়ে শববাহী ভ্যানটা ধীরে ধীরে হাসপাতালের কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে গেলো ।
সুমিতাভ কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর খেয়াল ছিল না ।
একটা ওয়ার্ডবয় তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সের পারকিং-এ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
-‘স্যার, কাউকে খুঁজছেন ?’
সম্বিত ফিরলো তাঁর । নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘নাহ ।’
ডঃ সুমিতাভ হাজরা ধীরপায়ে হাসপাতাল বিল্ডিঙয়ে ঢুকে গেলেন ।
৬
ডঃ অমল ভাদুড়ী সুমিতাভর দেওয়া তাঁর হাতের কাগজটার ওপর চোখ বুলিয়ে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন।
কিছুটা অবাক আর কিছুটা ক্ষুব্ধ স্বরে প্রশ্ন করলেন,
-‘এর মানে কি সুমিতাভ ? ব্যাপার কি, পারসোন্যাল কারণে রিজাইন করতে চাও ? কেন, কি হয়েছে ?’
ডঃ ভাদুড়ী শুধু এই হাসপাতালের মেডিকেল সুপারিন্টেনডেন্টই নন, তিনি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে সুমিতাভর শিক্ষক ছিলেন, তাকে খুবই স্নেহ করেন।
সুমিতাভ সামনের চেয়ারে বসে আছেন । একটু নড়েচড়ে বসে বললেন,
-‘কথাটা ঠিক স্যার, ব্যক্তিগত একটা কারণেই আমি এই সিদ্ধান্ত …।’
-‘আরে আমি তো সেটাই জানতে চাইছি । সেটা কতোটা ব্যক্তিগত কারণ ? বস হিসেবে না হোক, শিক্ষককেও বলা যায় না নাকি ?’
বলেই অমল ভাদুড়ী টেবিলের সামনে একটু ঝুঁকে এলেন,
-‘অরুণা জানে…এই যে তুমি রেজিগনেশন দিতে চাও ?’
সুমিতাভ মাথা নাড়লেন, না জানে না ।
ডঃ ভাদুড়ী সোজা হয়ে বসে চেয়ারে হেলান দিলেন ।
-‘এ তো বেশ মিসটিরিয়াস ব্যাপার ! ব্যক্তিগত কারণে তুমি তোমার পাকা চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছ , আর সেটা তোমার স্ত্রী জানে না ! সেই ব্যক্তিগত কারণটা কি সেটা জানে, না কি তাও জানে না ?
-‘ না স্যার, কারণটা অরুণাকে বলিনি এখনও । ভেবে রেখেছি সব বলবো, বাড়ি ফেরার পর ।
ডঃ ভাদুড়ী কিছুটা সন্দিগ্ধস্বরে বললেন,
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভাবতে দাও । তার আগে…’
কথা থামিয়ে তিনি ইনটারকমটা তুলে বললেন, ‘বাসবী, এখন আমি জরুরী মিটিঙয়ে ব্যস্ত আছি, কাউকে আসতে দিও না । ওকে ?’
ফোনটা রেখে ডঃ ভাদুড়ী শান্তস্বরে বললেন,
‘সুমিতাভ, দেখ, আমি প্রথমে তোমার মাস্টারমশাই, সেই প্রথমদিকের মাস্টারমশাই, আমার কাছে তোমরা অ্যানাটমি পড়েছিলে । তার পরে কর্মস্থলে এখন অবশ্য তোমার সুপারিন্টেনডেন্ট । তুমি কোনরকম সঙ্কোচ না করে আমাকে বলো তো কি হয়েছে । তোমার মতো একজন নলেজেবল স্কিলফুল ডাক্তারকে কোন হাসপাতাল কখনও ছাড়তে চাইবে না । সুমিতাভ, বলো আমাকে খোলাখুলি । এটা আমার অনুরোধ ধরে নাও।’
সুমিতাভ ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে ভারি পরদা সরিয়ে বাইরের দিকে দেখতে লাগলেন । ডঃ ভাদুড়ী ওঁর দিকে চেয়ে আছেন ।
বাইরের দিক থেকে চোখ না সরিয়ে সুমিতাভ দুঃখী গলায় বললেন,
-‘আপনার কাছে শেখা অ্যানাটমি বোধহয় পুরো আত্মস্থ করতে পারিনি স্যার । নইলে কাল আমার হাতে কেন পেশেন্টের ইউটারিয়ান আরটারিটা ড্যামেজ…’
সুমিতাভ কথা শেষ না করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখের দৃষ্টি ভেজা, এক হতমান ক্লান্ত মানুষের ।
ডঃ ভাদুড়ি যেন এতক্ষণে কিছুটা আঁচ করতে পারলেন । হাতটা তুলে বললেন,
-‘তুমি এসে এখানে বোস তো সুমিতাভ, বোস।কাল তোমার ওটি ছিল, সিজারিয়ান
করেছো ?’
সুমিতাভ এসে বসলেন চেয়ারে ।
তারপর ডঃ ভাদুড়ীর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন,
-‘রেজিনা আলি, ছাব্বিশ বছর বয়েস, প্রাইমি, ব্রীচ ছিল স্যার, অ্যামিনিওটিক ফ্লুয়িড এমবলিজম-এ সিজার করার পর পাঁচ ঘণ্টা বাদে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মারা গেছে ।’
ডঃ ভাদুড়ী কিছুক্ষণ সুমিতাভর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন ।
তারপর টেবিলের ফাইলপত্রের মধ্যে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বললেন,
-‘ দেখছি কালকের ডেলি রিপোর্টের ফাইলটা এখনও আসেনি । সে এসে যাবেখন ।’
তারপর সুমিতাভকে বুঝিয়ে বলার স্বরে বললেন,
-‘ কিন্তু সুমিতাভ, তুমি তো ভালো করে জানো, অ্যামনিওটিক এমবলিজম একটা রেয়ার আনফরচুনেট অ্যাকসিডেন্ট । যে কোনো সময়ে যে কোন সার্জনের হাতে হতে পারে । তবে খুব রেয়ার, এই যা স্বস্তির ।’
সুমিতাভ খুব ধীরে ধীরে বললেন,
-‘সেকশন করার সময় ইউটারিয়ান আরটারিটা একটু ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিলো স্যার । আমার স্থির বিশ্বাস তখনই ফ্লুয়িড…’
ডঃ ভাদুড়ী শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন । তারপর বললেন,
-‘সেলাই ? তুমি করেছিলে ?
-‘ না স্যার, আমার ইউনিটের সিনিয়র রেসিডেন্ট অলক ঘোষ । ভিজিটর রুমে অপেক্ষা করছে । কিন্তু স্যার ওর হাত খুব ভালো । আমার সিজারগুলোতে বেশীর ভাগ সময়ে ও-ই আমাকে অ্যাসিস্ট…’
ডঃ ভাদুড়ী ডান হাতটা একটু তুলে সুমিতাভ কে থামিয়ে দিলেন ।
-‘তোমার অ্যাসেসমেন্টে আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে ।’
-‘তাছাড়া স্যার, ও খুব ভালো ডাক্তার, বয়সে তরুণ, ভাবছিলাম ওকে আপনি ইনটারোগেট করলে ওর কনফিডেন্স জোর ধাক্কা খাবে স্যার ।’
-‘ তুমি বলছো, আমি করবো না । এনি ইস্যু ফ্রম পেশেন্ট পার্টি সাইড ?’
-‘নো স্যার । নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি । ভোরে পেশেন্টের স্বামীর সঙ্গে পাড়াপড়শি দু চারজন এসেছিলো । বডি নিয়ে চলে গেছে ।’
-‘বেবি ?’
-‘নার্সারিতে । স্যার, এ ব্যাপারে আপনার একটা পারমিশন চাইছি । নার্সারি ইন চার্জ কে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি । যতদিন না বাড়িতে একটা ব্যবস্থা করে মেয়েটাকে আখতার আলি নিয়ে যেতে না পারে ততদিন…..’
-‘আখতার আলি ?’
-‘পেশেন্টের স্বামী স্যার ।’
-‘ আই সি । ওকে, কন্সিডার ইট ইজ ডান । বাট, আই রিজেক্ট ইয়োর রেজিগনেশন । যদি খুব স্ট্রেসড ফিল করো, তাহলে ব্রেক নাও, অরুণাকে নিয়ে সাতদিন কোথাও ঘুরে এসো, সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ে ।’
-‘এক্সট্রিমলি সরি স্যার, আপনার সঙ্গে এভাবে কথা বলার জন্য । আপনি বিশ্বাস করুন স্যার, আমি অত্যন্ত গিলটি ফিল করছি…নিজের কাছে । গত রাত থেকে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছি, ঘুমোতে পারিনি । এই মানসিক অবস্থা থেকে আমি অব্যাহতি চাই স্যার, প্লিজ হেল্প মি । আমাকে রেজিগনেশন উইথড্র করতে বলবেন না স্যার, প্লিজ ।’
ডক্টর ভাদুড়ী কিছুক্ষণ সুমিতাভর বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ।
হাতের কাগজটা পড়লেন আবার ।
পড়ে রেখে দিলেন টেবিলের ওপর । তারপর বললেন,
-‘বেশ, তুমি যা চাইছো তাই হবে । তবে সরকারি চাকরিতে তো এইভাবে রেজিগনেশন দেওয়া যায় না, মিনিমাম একমাসের নোটিস দিতে হয় । আমি অ্যাডমিনে পাঠানোর আগে এর ওপরে লিখে দেবো এই চিঠিটা রেজিগনেশনের নোটিস হিসেবে ট্রিট করার জন্য ।’
একটু থেমে ডঃ ভাদুড়ী ড্রয়ার থেকে একটা সাদা কাগজ বার করে সুমিতাভর দিকে এগিয়ে দিয়ে গাড়স্বরে বললেন,
-‘তুমি এখন সত্যিই স্ট্রেসড আছো সুমিতাভ । একমাসের ছুটির দরখাস্ত করো । একমাস অনেক সময়, ভাবো তুমি, অরুণার সঙ্গে ডিসকাস করো । জানো তো, নোটিস পিরিয়ডের শেষ দিনেও তুমি এই ভলেনটারি রেজিগনেশন উইথড্র করতে পারো ।’
সুমিতাভ সাদা কাগজটা নিয়ে ক্লিষ্টস্বরে বললেন,
-‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ স্যার । তবে আমি অনেক ভেবে মনস্থির করেছি, আই শুড পানিশ মাইসেলফ ফর মাই ফলট । এই সুন্দর হাসপাতাল, আপনার এই পিতৃতুল্য স্নেহচ্ছায়া, ভেবে দেখেছি এসব থেকে আমার নির্বাসন জরুরী, নইলে আমি শান্তি পাব না স্যার । তাই আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না স্যার ।’
সুমিতাভ যতক্ষণ ছুটির দরখাস্ত লিখলেন, ডঃ ভাদুড়ী তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ।
দুদশকেরও বেশী সময় ধরে তাঁর এই ছাত্রটিকে তিনি বিশেষ স্নেহ করে এসেছেন ।
আজ সেই ভাবপ্রবণ ছাত্রের প্রফেশনাল ট্রমা তাঁকেও স্পর্শ করছে ।
তিনি সুমিতাভর মানসিক অবস্থার জন্য প্রকৃত দুঃখ অনুভব করলেন ।
সুমিতাভ ছুটির দরখাস্ত লিখে উঠে দাঁড়িয়ে কাগজটা ডঃ ভাদুড়ীর হাতে দিয়ে বললেন,
-‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ স্যার…ফর অল দি সাপোর্ট । আমি আসি স্যার । গুড ডে ।’
সুমিতাভ বেরিয়ে যাচ্ছেন , এমন সময় ডঃ ভাদুড়ী তাঁকে ডাকলেন,
-‘সুমিতাভ, শোন ।’
সুমিতাভ ঘুরে দাঁড়ালো । ডঃ ভাদুড়ী ধীরে ধীরে শান্তস্বরে বললেন,
-‘সুমিতাভ, আমি আন্তরিকভাবে চাই তুমি সিদ্ধান্ত বদল করো । যদি সেটা না-ই হয়, তাহলে জেনে রাখো, আমার এই হাসপাতাল থেকে রিটায়ারমেন্টের দুবছর বাকি আছে, তুমি যদি সেই সময়ের মধ্যে কোনদিন এখানে ফিরে আসতে চাও, আমাকে জানিও, আমি যেমন করেই হোক, তোমাকে নিয়ে আসবো । ইয়েস, দ্যাটস এ প্রমিস মাই বয়।’
সুমিতাভ একমুহূর্ত তাঁর প্রিয় শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বেরিয়ে গেলেন ।
#
সুমিতাভ এম এস-এর ভিজিটর রুম-এ ঢুকতেই অলক সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো ।
সুমিতাভ তাকে সঙ্গে যাবার জন্যে ইশারা করলেন ।
করিডরে হাঁটা শুরু করে সুমিতাভ বললেন,
-‘অলক, আমি আজ থেকে ছুটিতে যাচ্ছি ।’
-‘ইউ ডিসারভ ইট স্যার ।’
-‘ হ্যাঁ । আই অলসো থিংক সো । শোন, নার্সারিতে আখতারের বেবির বিশেষ খেয়াল রাখবে । রোজ অবশ্যই একবার খবর নেবে, এটা আমার অনুরোধ । আর একটা কথা, তুমি ইউনিট বদল করার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে দাও, বাকি সকলকেও করতে বলে দাও।’
অলক অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলো,
-‘বাচ্চাটার অবশ্যই খেয়াল রাখবো স্যার । কিন্তু আমার…আর সবাইয়ের.. ইউনিট চেঞ্জ কেন স্যার ….মানে কতদিনের ছুটি নিচ্ছেন আপনি ।’
-‘ এক মাস । আর, তার পরে হয়তো আমি এখানে আর থাকবো না । আমি রেজিগনেশনের নোটিস দিয়েছি অলক ।’
#
চৈত্রের শুষ্ক বনানীতে দাবাগ্নির মতো সারা হাসপাতালে বিকেলের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লো গাইনি অবস-এর ডঃ সুমিতাভ হাজরা ভলেনটারি রেজিগনেশন দিয়েছেন ।
আপাতত এক মাসের নোটিশ, তবে মাস কেটে গেলে তাঁকে এই হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আর দেখা যাবে না ।
খবরটা পেয়ে কলীগ আর স্টাফ যারা রীতিমত বিভ্রান্ত হলো তাদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু তাদের ডঃ হাজরার সঙ্গে কথা বলে কারণটা জানবার কোনও উপায় থাকলো না।
ডঃ সুমিতাভ হাজরা একমাসের ছুটিতে গেছেন, মোবাইল নট রিচেবল ।
পনেরশ বেডের বিশাল সরকারি হাসপাতালে রোজই গড়ে সাত আটটি দুর্ভাগা রোগীর মৃত্যু ঘটছে, কে-ই বা তার খেয়াল রাখে ।
সুমিতাভ হাজরার রেজিগনেশনের কারণ অনুসন্ধানী সন্দিগ্ধ ও ছিদ্রান্বেষী কয়েকজন তাই কোন রোগীমৃত্যুর সঙ্গে এই ঘটনার যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করলো না ।
বরং শহরের আনাচে কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ধনাঢ্য কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর কোনও একটায় হাজরার উচ্চপদে যোগদানের সম্ভাবনার দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটাতে লাগলো ।
৭
তারাপদ সাঁতরা নীচু হয়ে ড্রয়ার থেকে পানের ডাব্বাটা সবে বার করছে এমন সময় তার মনে হলো টেবিলের সামনে কেউ এসে দাঁড়ালো ।
মাথা তুলে দেখলো আখতার আলি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা মিষ্টির বাক্স ।
তারাপদ মুখে পানটা মুখে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হেসে হেসে বললো,
-‘বাহ, এই তো আমাদের…কি যেন…হ্যাঁ আখতার, আখতার আলি হাজির, মিষ্টি নিয়ে । তার মানে বাচ্চা হয়ে গেছে ! বাঃ বাঃ ! তা এসব মিষ্টিটিষটি আনবার কি ছিল হে…তুমি দেখছি আমার ঠাট্টাটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিলে ।’
আখতার ম্লান হাসলো । তারপর বললো,
-‘কসম খেয়েছিলাম তো দাদা, বাচ্চা হলে মিষ্টি খাওয়াব ।’
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমাদের আবার কসম খাওয়া মানে তো…নাও নাও এখানে রাখো । কেষ্ট, একবার দ্যাখ তো রমেনটা আবার রুটে বেরিয়ে গেছে কি না, ওই তো এই মিষ্টির বড়ো হকদার ।’
কেষ্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে যেতে যেতে অনুচ্চস্বরে বললো,
-‘এই তো দেখলাম টাইম অফিস থেকে বেরোল, বোধহয় টাকা জমা করে । এখন তো ও চা খাবে ।’
তারাপদ মিষ্টির বাক্সটার লেবেলটা দেখে খুশী হয়ে বলে উঠলো,
-‘ বাঃ, সেনমহাশয় থেকে এনেছ, তোমার টেস্ট ভালো হে আখতার ।’
বলেই তাড়াতাড়ি টেবিলের তলা থেকে মগটা বার করে মুখের পানটা পুরো ফেলে দিয়ে আখতারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো ।
এর মধ্যেই কেষ্টর সাথে রমেন ঘোষ ঘরে ঢুকে আখতারকে দেখে বললো,
-‘এই যে আখতার, সব ঠিকঠাক ?’
আখতার নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লো ।
তারাপদ সাঁতরা তাড়াতাড়ি বাক্স খুলে একটা সন্দেশ মুখে পুরে বললো,
-‘আরে নাও নাও রমেন, এখন বাচ্চা হওয়ার সন্দেশ খাও । কার বাবা হলে আখতার, ছেলে না মেয়ে ?’
-‘মেয়ে হয়েছে, দাদা ।’
-‘ আরে, ঠিক আছে । সব এখন একই ব্যাপার । সময় বদলে যাচ্ছে । ওই মেয়ে যখন বড়ো হবে তখন তোমাকে আর তার বিয়ের জন্য চিন্তা করতে হবে না । সব ওরা নিজেরাই ঠিক করবে ।’
বলে তারাপদ আর একটা সন্দেশ মুখে পুরে দিলো ।
আখতার পকেট থেকে তিনশ টাকা বার করে রমেন ঘোষের হাতে দিলো ।
রমেন টাকাটা হাতে নিয়ে বললো,
-‘এটা কিসের টাকা আখতার ?’
-‘ দাদা, হাসপাতালের রিসেপশন থেকে আমাকে দিয়েছিল । ওই একটা প্যাকেট রক্ত লাগেনি, ওটা বোধহয় ডাক্তারবাবু জমা করে দিয়েছিলেন, তার জন্য সার্টিফিকেটের সঙ্গে এই টাকাটা ওরা দিলো ।’
সন্দেশ খেতে খেতে কেষ্ট বললো, ‘ওই ডিসচার্জ সার্টিফিকেট ! তোমার বিবি, মেয়ে সব কবে বাড়ি এলো ?’
আখতার কেষ্টর দিকে ঘুরে গেলো, তার দৃষ্টি ম্লান, চোখ আদ্র, থেমে থেমে বললো,
-‘মেয়েটাকে ঘরেতে এখনও আনতে পারিনি কেষ্টদা, হাসপাতালের নার্সারিতে আছে । আমার তো ডিউটি আছে । ওকে দেখাশোনার করার একটা ব্যবস্থা করেই আমি…’
রমেন ঘোষ অত্যন্ত অবাক হয়ে জিগ্যেস করলো,
-‘কেন, ওর মা, তোমার বিবি ! সে বাচ্চা দেখতে পারবে না ? তোমার বৌ চাকরি করে নাকি ?’
আখতার রমেনের দিকে তাকালো, শূন্য দৃষ্টি তার , তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
-‘দাদা, আমার বিবি রেজিনা, বাচ্চা প্রসব করার ছ ঘণ্টা পরে হার্টফেল করে মারা গেছে…তিনদিন আগে । তাই দুদিন ডিউটি করতে পারিনি ।’
ঘরের মধ্যে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো । কারুর মুখে কোনও কথা নেই ।
কয়েক মুহূর্ত পরে রমেন ঘোষ প্রথমে কথা বলে উঠলো, তার গলায় প্রকৃতই ক্ষোভের সুর,
-‘তুমি কি রকম মানুষ হে আখতার ! এতো বড়ো দুর্ঘটনাটা হয়ে গেছে তোমার সঙ্গে, তোমার বৌ মারা গেছে তিনদিন আগে, আর তুমি এখানে এসে প্রথমে সে খবরটা দাওনি…আর মিষ্টি নিয়ে এসেছো আমাদের খাওয়াতে…বাড়তি রক্তের দাম হাতে ধরাচ্ছো !’
আখতার মাথা নীচু করে চুপ করে থাকলো । সকলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।
কয়েক সেকেন্ড পরে মাথা তুলে থেমে থেমে ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘আল্লার নামে কসম খেয়েছিলাম যে দাদা, তাই…আর ওই টাকা তো আপনার, আমি নিলে গুনাহ হবে আমার…’
রমেন ঘোষের কণ্ঠস্বরে হতাশা আর ক্ষোভ একসঙ্গে বেরিয়ে এলো,
-‘তারাদা, আমি এসব নিতে পারছি না । তোমরা বসে বসে এই মিষ্টি খাও । আর আখতার, এই টাকাও তুমি রাখো, তোমার আল্লাকে আমি বলবো তোমার গুনাহ মাপ করে দেবার জন্য । আমি চললাম ।’
এই বলে রমেন ঘোষ হাতের সন্দেশটা মিষ্টির বাক্সতে নামিয়ে রেখে বাঁহাতে ধরা টাকাটা আখতারের জামার বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ।
ঘরে সবাই চুপ । কেষ্ট হালদার দুজনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিজের টেবিলে ফিরে গেলো ।
কয়েক মুহূর্ত পরে তারাপদ সাঁতরা বিব্রতমুখে মিষ্টির বাক্সটা টেবিলের কোণায় ঠেলে দিয়ে বললো,
-‘রমেনটা ঠিকই বলে গেলো । কি যে তুমি করলে না আখতার ! তুমি কি একটা নিপাট ভালমানুষ, না কি একটা বেহদ্দ বোকা লোক, তাই-ই আমি বুঝতে পারছি না । দাও, এখন তোমার বাসমালিকের ফোন নাম্বারটা দাও তো আমাকে । তাকেও কিছু বলোনি নিশ্চয়ই, তোমার যা ব্যাপার দেখছি । তোমার জন্য চার পাঁচ দিন অফের কথা বলে দিই, মাইনে যেন না কাটে । বাচ্চাটাকে ঘরে আনার একটা ব্যবস্থা তার মধ্যে করে ফেলো আখতার ।’
৮
বনহুগলির ঝাঁচকচকে এই প্রাইভেট হাসপাতালটায় ডঃ সুমিতাভ হাজরার দুবছরের বেশী হয়ে গেলো ।
ভলানটারি রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার পর বাড়িতে বসেছিলেন কিছুদিন, ক্লিনিকটা চালু রেখেছিলেন ।
নতুন পেশেন্ট দেখা বন্ধ ছিল, পুরনো ডেলিভারি পেশেন্টদের মেডিক্যাল কলেজের সহপাঠী বন্ধুদের কাছে রেফার করে দিয়েছিলেন।
কৌতূহলী বন্ধুদের প্রশ্নের জবাবে সুমিতাভ কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার অজুহাত দিয়েছিলেন ।
তারপর অরুণার কলেজে গরমের ছুটি পড়তেই একমাসের জন্য চলে গেলেন স্কটল্যান্ডে, এডিনবরার চেনা পরিবেশে ।
পরিচিত শহরে ঘুরতে ঘুরতেই এই কৈলাস হাসপাতালের গ্লোবাল বিজ্ঞাপনটা নজরে এসেছিলো তাঁর, গাইনি ইউনিটের সর্বেসর্বা হবে এমন একজন খুঁজছে তারা ।
প্রধানতঃ অরুণার ঐকান্তিক আগ্রহে সেখান থেকেই মেল-এ যাবতীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি ।
অরুণা স্বামীর কর্মহীন অবসাদগ্রস্ত মানসিক অবস্থা ঠিকই বুঝেছিলেন ।
তিনি নিশ্চিত জানতেন মানুষটা কাজের মধ্যে যতো তাড়াতাড়ি ফিরবে ততো কম সময়ে তার সেই দুর্ঘটনার অপরাধবোধের স্মৃতি মলিন হয়ে যাবে ।
আর তাছাড়া এই কৈলাস হাসপাতাল উত্তর কোলকাতার প্রান্তে, তাঁদের চেনা পরিবেশে, তাঁর নিজের কলেজ ও বাসস্থানের থেকে তার দূরত্ব যেকোন মেট্রপলিটান শহরের নিরিখে দুরধিগম্য নয় ।
দেশে ফিরে আসার পর, বনহুগলির এই কর্পোরেট হাসপাতালে সুমিতাভর যোগদান কেবল ঔপচারিকতামাত্র ছিল ।
সারা দেশে ছড়ানো এই কৈলাস হাসপাতাল গ্রুপের পরিচালকমণ্ডলী নির্বোধ নয় ।
তাঁরা সুমিতাভর বিদেশী ডিগ্রী আর সরকারী হাসপাতালে অর্জিত প্রায় দুদশকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবার এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি ।
কথায়-ই আছে পৃথিবী এক ক্ষুদ্র পরিসরের গ্রহ, তার মধ্যে প্রাচীন এই শহরের উত্তরাংশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ।
তাই মাসদুই আগে সুমিতাভর সরকারি হাসপাতালের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাঅবসরের খবর যেমন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই রকম তাঁর এই কর্পোরেট হাসপাতালে যোগদানের খবরও আবার দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো শহরের চিকিৎসকমণ্ডলীতে ।
যথাসময়ে সুমিতাভর পুরনো হাসপাতালেও এ খবর পৌঁছলো ।
ফলত সুমিতাভর যে অল্পসংখ্যক ছিদ্রান্বেষী কলীগ চাকরি ছাড়ার কারণ হিসেবে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁরা হাসপাতালের করিডরে সগৌরবে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ।
#
এক একসময়ে ডঃ সুমিতাভ হাজরার মনে হয় তিনি বেশ ভালো আছেন ।
কৈলাস হাসপাতালে তিনি সমধিক সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারছেন ।
সহযোগী ডাক্তারদের সকলেই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, ইন্টার্নশ্রেণীর কেউ নেই ।
অনেকগুলো মাস কেটে গেছে সেই দুর্ঘটনার পর ।
তবু কখনো কখনো তাঁর মনের গহনে সেই রাতের আইসিইউ-এর দৃশ্য উঁকি দিয়ে যায়, উজ্ঞ্বল আলোয় আলোকিত, সাদা চাদরে ঢাকা রেজিনা আলির নিষ্প্রাণ ঠাণ্ডা দেহ আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিষণ্ণ চেহারায় এক গোপন অপরাধী ।
ধূসর ফটোগ্রাফের মতো তাঁর চোখের তারায় ভাসে সেই প্রাচীন হাসপাতাল বিল্ডিঙগুলোর স্বল্পালোকিত করিডর, ওপিডির উপচে পড়া ভিড়, হাজরা স্যারের টিমের চকচকে উজ্জ্বল চোখের তরুণ ইন্টার্ন সদস্যেরা আর ক্লাসঘরের নিশ্চুপ পরিবেশে তাঁর নিজের স্বরের গমগমে আওয়াজ।
এখানে, এই হাসপাতালে, সবকিছুই কর্পোরেট নিয়মমাফিক, ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য স্টাফ সবাই সময়ে আসেন, আধুনিক বিল্ডিঙের বিভিন্ন স্থানে রাখা টাইম মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করে কাজে লেগে যান ।
যত্রতত্র টাঙ্গানো সাইলেন্স বোর্ডের মান্যতা আছে এখানে ।
প্রথম প্রথম সুমিতাভর বেশ অদ্ভুত লাগত এই পরিবেশ, ভাবতেন কোলকাতার মধ্যেই আছেন তো !
এখানের শান্ত গম্ভীর বাতাবরণের সঙ্গে এডিনবরার মেডিক্যাল স্কুলের হাসপাতালের সাদৃশ্য খুঁজে পান ।
#
ক্যালকাটা ক্লাবে এখন কালেভদ্রে সময় কাটাতে যান সুমিতাভ ।
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ বহাল আছে দূরভাষে আর হোয়াট’স আপ গ্রুপের সাইবার কথোপকথনে ।
সীমাবদ্ধ সে আলাপ, পারস্পরিক কুশলবিনিময়ের আগে আর এগোয় না, সুমিতাভ উৎসাহবোধ করেন না ।
রাজারহাটের নতুন ক্লাবে নব্য পরিচিতদের মধ্যে বরং সুমিতাভ অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছন্দবোধ করেন ।
নতুন প্রজন্মের পতাকাবাহী সদস্যের সংখ্যা সেখানে বেশী, কারুর ব্যক্তিজীবনের ইতিহাসের প্রতি রুচি ও তার জন্য সময় ব্যয় করা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ।
এইসব মানুষের সান্নিধ্যে, তাদের সঙ্গে সাধারণ আলাপচারিতায় এখন সুমিতাভ সময় কাটান, সুখের সন্ধানে না গিয়ে তিনি স্বস্তিতে থাকেন ।
অরুণাও খুশী আছেন, স্বামী ফিরে গেছেন তাঁর ব্যস্ততার পরিমণ্ডলে, নিবিষ্ট রয়েছেন প্রতিদিনের রুটিন কাজের মধ্যে ।
সুমিতাভ আইভিএফ নিয়ে আর জোরাজুরি করেন না অরুণাকে, বোধহয় ভবিতব্যের কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই মেনে নিয়েছেন ।
পুরনো হাসপাতালের সঙ্গে তাঁর ক্ষীণ যোগসূত্র রয়েছে তাঁর প্রিয় ছাত্র অলকের মাধ্যমে ।
অলক সম্প্রতি ফ্যাকাল্টির মেম্বার হয়েছে, মাঝে মাঝেই ফোন করে নানারকম খবর দেয় সে, বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে সুমিতাভ শুনে যান সেসব ।
রিটায়ারমেন্টের নোটিশের শেষদিনে তার সঙ্গে সুমিতাভর দেখা হয়ে গিয়েছিলো প্রায় হঠাৎই ।
সুমিতাভর ইচ্ছা ছিল এসটাব্লিশমেন্টে গিয়ে চুপচাপ দরকারি কাগজপত্রে সইসাবুদ করে ডঃ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়া ।
কলিগদের কৌতুহলী প্রশ্ন এড়ানোর চেষ্টা ছিল তাঁর ।
কিন্তু কারুর কাছে খবর পেয়ে অলক একেবারে হাসপাতালের অ্যাডমিন অফিসে গিয়ে হাজির, সে নিশ্চিত ছিল এখানে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবেই ।
প্রায় দৌড়ে এসেছে সে, একটু হাঁফাচ্ছে ।
সুমিতাভ চেয়ারে বসে কাগজপত্রে সই করছেন, অলক তাঁর পেছন থেকে বলে উঠলো,
-‘স্যার, কেমন আছেন আপনি ?’
সুমিতাভ পেছনে ফিরে অলককে দেখে মনে মনে বেশ খুশী হলেন ।
প্রিয় ছাত্র ও জুনিয়র সহকর্মী অলকের সঙ্গে দেখা না করে বরাবরের মতো এই হাসপাতাল থেকে বিদায় নেওয়ার ভাবনায় তাঁর মনের মধ্যে একটা দ্বিধা ছিল ।
কিন্তু অন্যদের এড়িয়ে কিভাবে তিনি অলকের সাক্ষাৎ পাবেন সেটা ভেবে উঠতে পারছিলেন না ।
শেষমেশ ভাবছিলেন একটা ফোন করে নেবেন ।
এখন সেই কাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ অনায়াসে ঘটে যেতে তিনি যেন নিশ্চিন্ত বোধ করলেন ।
-‘কেমন আছো অলক, বোস এখানে । এগুলো সাইন করে দিই, আর দুতিন মিনিট লাগবে ।’
অলক বসলো না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুমিতাভ সই করা দেখতে দেখতে ভারী গলায় ধীরে ধীরে বললো,
-‘আপনার সিদ্ধান্তটা বদলালেন না স্যার । আমরা, ইউনিটের সবাই, ভেবেছিলাম শেষ অবধি আপনি…’
সুমিতাভ শেষ কাগজটা সই করে উঠে, অলকের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন,
-‘ তোমার সঙ্গে বাই চান্স দেখা হয়ে গেলো, খুব ভালো লাগছে অলক । তুমি কি এখন ফ্রি আছো ? থাকলে চলো না হাসপাতালের বাইরে গিয়ে কোথাও বসে কফি খেতে খেতে কথা বলি ?’
-‘সরি স্যার, এখন তো বেরোতে পারবো না, আইসিইউতে আছি । ওয়ার্ড বয়টা আপনাকে দেখতে পেয়েছে শুনেই আমি তাড়াতাড়ি এখানে এলাম, জানি এখানেই আপনাকে পাবো ।’
একটু থেমে অলক আবার বললো,
-‘ ভাবতে ভাবতে আসছিলাম স্যার, যদি আপনি আপ্লিকেশনটা উইথদ্র করতে এসে থাকেন…’ অলক কথা শেষ করলো না ।
সুমিতাভ ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন,
-‘নাহ । চললাম তাহলে অলক, আবার কবে দেখা হবে জানি না, ফোনে যোগাযোগ রেখো । মন দিয়ে কাজটা করো ।’
-‘ স্যার, একটা কথা আপনাকে জানাই । সেই আখতার আলি, তার বেবি গার্লকে কয়েকদিন আগে নিয়ে গেছে স্যার । একজন বয়স্ক মহিলা, বললো তাঁর বুয়া, সে এসেছিলো সঙ্গে ।’
-‘তাই ! ভালো খবর, কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম । মেনি থ্যাংকস ফর দিস ইনফরমেশন অলক । চলি ।’
হাতটা অলকের দিকে একটু তুলে সুমিতাভ হাসপাতালের অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
৯
এর পরের দুবছর সুমিতাভর ঘটনাবিহীন সাধারণভাবে কেটে গেলো ।
ইউনিটের হেড, তাই কাজের চাপ বেশী নেই ।
কর্পোরেট হাসপাতালের প্রায় সমস্ত পেশেন্টেরই হেলথ ইনস্যুরেন্স করা থাকে ।
অধিকাংশ চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট প্যাকেজ রয়েছে, সেখানে খরচ কমানোর অনুরোধ সামলাবার ব্যাপার নেই ।
আর কর্পোরেট হাসপাতালের অকথিত পেশেন্ট টার্গেট মিট করার ব্যাপারটা তো স্বয়ংসিদ্ধ ।
ডঃ সুমিতাভ হাজরা কৈলাস হাসপাতালে জয়েন করার খবর তো দুতিন মাসেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল ।
তাই হাসপাতালের পরিচালক মণ্ডলীর প্রাথমিক হিসেবমতই প্রসূতি বিভাগের পেশেন্টের সংখ্যাও ছিল ক্রমশ বাড়তির দিকে ।
#
গান্ধী জয়ন্তীর দিনটা সুমিতাভ আর অরুণার শুরু হলো বেশ ঢিলেঢালা ভাবে ।
ন্যাশনাল হলিডে, তাই অরুণার কলেজ বন্ধ ।
কৈলাস হাসপাতালেরও এমারজেন্সি ছাড়া সবরকম নিয়মিত ওপিডি ইউনিট বন্ধ রয়েছে ।
দেরীতে ব্রেকফাস্ট শেষ করে অনেকদিন পরে দুজনে লিভিং রুমে টিভির সামনে বসেছেন, দূরদর্শনে দেখছেন রিচারড অ্যাটেনবরোর গান্ধী ।
অনেক বছর আগে দেখেছিলেন, তাই একেবারে নতুনের মতোই লাগছে ।
টিভির পরদায় এখন চলছে কোলকাতার কুখ্যাত ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-র মর্মান্তিক সেই দাঙ্গার দৃশ্য ।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের একটা বাড়ির ছাদে গান্ধীজীর আমরণ অনশন, সিঁড়ির মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে সুরাবরদী ।
এমন সময় সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা সুমিতাভর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল ।
অরুণার চোখ টিভির স্ক্রিনে, সুমিতাভর দিকে ইশারা করে অন্য ঘরে গিয়ে ফোনটা ধরতে বললেন ।
সোফা থেকে উঠে ফোনটা তুলে নিয়ে ডাইনিং হলে যেতে যেতে সুমিতাভ দেখলেন অলক ফোন করছে ।
-‘হ্যাঁ, অলক, বলো… কেমন আছো ?’
-‘গুড মর্নিং স্যার । ভালো আছি । ব্যস্ত আছেন না কি স্যার ?
-‘ নাহ, এই আর কি । আজ তো এমারজেন্সি ছাড়া হসপিটাল যেতে হবে না ।’
-‘হ্যাঁ, আমিও সেটাই ভাবলাম স্যার । তাই….’
-‘কি, কিছু বলবে…অলক ?’
অলক কয়েক মুহূর্ত থেমে বললো,
-‘স্যার, ভাবলাম আপনাকে একটা খবর দিই । যদিও একেবারেই ভালো খবর নয় স্যার ।’
-‘কি হয়েছে অলক…বলো ?’
অলক একটুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘স্যার, আপনার আখতার আলিকে মনে আছে ? সেই যে…দুবছর আগে…’
এক মুহূর্তে সুমিতাভর চোখের ওপর সেই রাতের দৃশ্য ভেসে উঠলো, সেই সাদা চাদর ঢাকা নিথর দেহ, চারপাশে হেরে যাওয়া ডাক্তারের দল…আর আইসিইউ মনিটরে জ্বলজ্বলে অনেকগুলো সমান্তরাল আলোক রেখা।
সে দৃশ্যে আখতার আলি অনুপস্থিত, কিন্তু সে রাতের ঘটনায় সে-ই তো হয়েছিল সব থেকে বেশী দুঃখার্ত ।
সুমিতাভ থেমে থেমে প্রায় ফিসফিস করে বললেন,
-‘মনে আছে । আখতার আলিকে নিয়ে খবর….কি খবর অলক ?’
-‘স্যার, কাল রাতে রাজাবাজারে ওর বাসের সঙ্গে মুখোমুখি একটা লরির ধাক্কা লাগে, ডিপোয় ফিরছিলো । কাল আমার নাইট ছিল । সিভিয়ার হেড ইনজুরি নিয়ে ওকে বাস ইউনিয়নের লোকজন নিয়ে এসেছিলো। কিছু করা গেলো না স্যার, আজ ভোরে মারা গেলো । ভেরি আনফরচুনেট স্যার ।’
সুমিতাভ স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তাঁর মনে হলো তিনি বধির হয়ে গেছেন ।
অলক দুতিনবার হ্যালো স্যার, স্যার শুনতে পাচ্ছেন, ডাকাডাকি করে ভাবলো লাইনটা কেটে গেছে ।
ও ফোন ছেড়ে দিলো ।
সুমিতাভ ধীরে ধীরে লিভিং রুমে ফিরে আসতেই অরুণা ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন, কার ফোন এসেছিলো ।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুমিতাভ কয়েক মুহূর্ত, সে দৃষ্টি নির্বাক, মন তাঁর অন্যত্র ।
তারপর যেভাবে মাথা নাড়লেন, তার সহজবোধ্য কোন অর্থ হয় না ।
অরুণা সিনেমাতে ডুবে আছেন, স্বামীর আচরণের মধ্যে কোন বৈকল্য খেয়াল করলেন না ।
টিভির পরদায় তখন ওম পুরির ভীষণদর্শন চরিত্র তার প্রতিহিংসা নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা করছে…নিজের কিশোর ছেলেকে চোখের সামনে দাঙ্গায় মরতে দেখার পর কিভাবে সে এক বিধর্মী বাচ্চাকে মাথার ওপরে তুলে আছড়ে মেরে ফেলেছে …গান্ধীজীর অনশনদীর্ণ মুখমণ্ডলে অবর্ণনীয় কষ্টের ছায়া নেমে এলো…বেদনার প্রতিঘাতে এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে গেলো…তারপর নিমীলিত চোখে অতি ধীরে ধীরে অবসন্ন ক্লিষ্ট স্বরে বললেন, সে যেন দাঙ্গায় অনাথ হয়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলেদের মধ্যে একজনকে নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করে, শুধু যেন এইটুকু অবশ্য খেয়াল রাখে সে বাচ্চাটি যেন মুসলমান হয়…।’
সুমিতাভর দৃষ্টি এখন স্থির টিভির পরদায়, তিনি একমনে গান্ধী দেখতে লাগলেন ।
১০
তারাপদ সাঁতরা বাস্তবিক দুঃখের স্বরে বলে যাচ্ছিলো,
-‘আখতার আলি লোকটার ভাগ্যটাই খুব খারাপ স্যার । একটা ভালো মানুষ ছিল । দুবছর আগে বাচ্চা হতে গিয়ে একেবারে অকালে বৌটা মরে গেলো । তারপর ও গ্রামসম্পর্কে এক বুড়িপিসীকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল ছোট বাচ্চাটার দেখাশোনা করার জন্য । তারপর এখন অ্যাকসিডেন্টে তো নিজেই চলে গেলো । বেচারা বাচ্চাটা কিছুই বুঝলো না, অনাথ হয়ে গেলো । সেই পিসিটা তো আখতারকে কবর দেওয়ার পরেই বাড়ি যাই যাই করছিলো । তার দোষ নেই, সে-ই বা কি ভাবে থাকবে । ভাগ্যে আমাদের এই রমেন ছিল, তাই তাড়াতাড়ি দুদিনের মধ্যে বাচ্চাটার একটা হিল্লে হয়ে গেলো, ওই বারাসাতের অনাথ আশ্রমে । ওর স্যার অনেক জানাশোনা ।’
সুমিতাভ টেবিলের এপাশে বসে থাকা রমেন ঘোষের দিকে ফিরে বললেন,
-’আপনি একটা বড়ো কাজ করেছেন ভাই ।’
রমেন ঘোষ বললো,
-‘এইটুকু তো আমাদের করতেই হবে ।’
তারাপদ সাঁতরা একটু গর্বের সুরে বলল,
-‘রমেন আমাদের ইউনিয়নের গর্ব । এইসব কাজের জন্য ওর সময়ের অভাব নেই । আপনি জানেন স্যার, আখতার আলির বউয়ের অপারেশনের জন্য ও-ই রক্ত দিয়েছিল ।’
সুমিতাভ আবার ভালো করে তাকালেন রমেনের দিকে ।
তাঁর মনে হল পরিচিতিহীন এইরকম কিছু মানুষের জন্যই এই শহর এখনও বাসযোগ্য আছে ।
#
সুমিতাভ এই বাস কর্মচারী ইউনিয়ন অফিসে এসে নিজের পুরো পরিচয় দেননি ।
এদের বলেছেন, আখতার আলি পূর্বপরিচিত ছিল, অ্যাকসিডেন্টে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে খোঁজখবর নিতে এসেছেন ।
রমেন ঘোষের কাছে বারাসাতের অনাথ আশ্রমের ঠিকানাটা নিয়ে সুমিতাভ উঠে পড়লেন ।
দরকারি কাজগুলো সারার জন্য তাঁর হাতে সময় বেশী নেই ।
তিন সপ্তাহ বাদেই দুর্গাপুজো, তার আগেই তো প্রায় এক মাসের জন্য কোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে ।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: অঘনাশন, গল্প, সিদ্ধার্থ সান্যাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।