01 Oct

চিত্রাঙ্গদা অ্যাট দি রেট অফ

লিখেছেন:ঋভু চৌধুরী


অনেকদিন হয়ে গেল হ্যাপেনিং কোন সম্পর্কে নেই পার্থ। নতুন কম্পানিতে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে তাকে কয়েক বছরের জন্য কানাডা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বিপুল কাজের ভার সামলে আলাদা করে আর কাউকে ডেট করার মতন সময় কুলিয়ে ওঠা যায়নি। দু একটা ডিস্কের রাতপরী এক রাতের শ্রান্তি হরনকারী হয়ে এলেও তাদের সাথে সম্পর্কে যাওয়ার কথা পার্থ কোনদিন ভাবেনি। রাত ভোর হতেই ঝরা শেফালির মতো সেসব সুবাস মিলিয়ে যেতে দিয়েছে। বরং কাজের ফাঁকে চুটিয়ে দেশ দেখে নিয়েছে সে। কাজে উন্নতি করেছে ক্রমশ। এবারে বর্ষা অন্তে দেশে ফিরে নিজের পরিমন্ডলে কিছুটা থিতু হবার পর কেন যেন একজন নিবিড় প্রেমের জন্য শূন্যতা বোধ গাঢ় হয়েছে তারও। ইন্সটাগ্রামের শরৎসুন্দরীদের মধ্যে তাই অলস মনে কোন একটা যোগ্য ‘ম্যাচ’ সে খুঁজছিল।

ইন্সাটাগ্রামের আকাশ জুড়ে শরতের মেঘ, কাশের দোলা, পদ্মকলি হাতে নেওয়া বালিকাদের মুখ৷ কুমোরটুলির মেটে গন্ধের গা ঘেঁষে হাড়জিরজিরে পোটো আপন মনে কাজ করে চলেছে। রাজ্যের ঝক্কি এখন পটুয়াপাড়ায়। তার পাশেই বড় বড় লেন্সের ক্যামেরা হাতে কতাদুরস্ত ছবি শিকারীদের ভিড়। যুবতী মেয়েরা ভ্রুমধ্যে ত্রিনয়ন এঁকে হাতে কাশের গুচ্ছ, শিউলির বালা আর নকল ত্রিশূল ধরে দুর্গা ঢঙে ছবি তুলতে ব্যস্ত। এরা কেউই মডেল নয়। ক্যামেরামানরাও বেশিরভাগজনই শখের ছবিধরিয়ে। কিন্তু সকলের মধ্যে যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকট তা হল এরা সকলেই চোখ ধাধানো বিনোদনের অংশীদার হতে মরিয়া।

আগেকার দিন হলে এরকম শরতের সময় রাজারা মৃগয়া বের হত, সাধারণ মানুষ যেত তীর্থে। এ যুগের শরৎ ছেলে ছোকরাদের ট্রেকে পাঠায়। বৃদ্ধদের রঙিন শরবত হাতে বসিয়ে রাখে মালদ্বীপের নীল সাগরের বালুচরে। সকলের অভীষ্ট নিজেদের সুন্দর করে সাজিয়ে মুহূর্তগুলোকে মুঠোফোনে বন্দি করে ফেলা। কেউই বিফলে যেতে দিতে চায় না সময়। স্মৃতির সব পাতা রঙিন ছবিতে ভর্তি করে নেওয়ার নেশা বুঝি এরকম। সকলের হাতে ধরা যন্ত্র। ছবির বন্যায় তাদের সোসাল মিডিয়ার দেওয়াল ভেসে যায়। কোথাও কোন দৈন্যতার ছাপ থাকবে না। কোথাও কোন হেরে যাওয়ার রেশ থাকবে না। সকলের মধ্যে সর্বোত্তম হয়ে উঠতে হবে সর্বদা, এই তাদের ব্রত। কখন কী ট্রেন্ড, কোন ভাষার নতুন কী অর্থ গজিয়ে উঠলো,  কোন পোশাকের সাথে কোন পোশাক মিলিয়ে পড়লে তা ফ্যাশন, কোন গানে নাচের কেমন ভঙ্গি,  কিংবা কোন গন্তব্যে পৌঁছে কেমন অনুভব হল তার ধারাবিবরণী পুঙ্খানুপুঙ্খ  বিজ্ঞাপিত না হলে বুঝি এ ভার্চুয়াল জগতে মান থাকে না।

এই হল যুগের খেয়াল। তার ওপর কখন যে কী ঢেউ ছায়া ফ্যালে বোঝা মুশকিল। ভালো খারাপের বিচার মহাকাল করবেন একদিন। কিন্তু কাল বড় নিরুত্তাপ, আধবুড়ো এক পাগল। সে আমাদের মতন সহজে বিচলিত হয় না। সবকিছু নিয়ে অত চুলচেরা বিচারও করতে বসে না। বয়ে যেতে দেয়। এও এক মজা। মানুষ ভাবে প্রাচীন কালের সব বদলে গেল দ্রুত। কিছুই আর আগের মতন নেই। মহাকাল জানেন বাইরের খোলস বদলে যায় কেবল। বদলটাই নিয়ম। কিন্তু বুকের ভেতর একই রকম সুখ শোকের আলোছায়া খেলা করতে থাকে। একই অনুভবে মানুষ বেজে ওঠে, আলোরিত হয়। এখনও মানুষ দিনশেষে একজন মানুষকেই খোঁজে।  যেমন আগে খুঁজত।

কিন্তু এই সোসাল মিডিয়ার মানুষজনকে চট করে চেনা খুব মুশকিল।  যে যেমনটা ঠিক তেমনটা করে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে। কিছুতেই। সকলে নিজেদের ঘিরে জড়িয়ে রেখেছে মায়ার ইন্দ্রজাল। মোহিনী ওড়নার আড়ালে সবার আসল মুখটি চাপা। জীবনের সুখ শোক সবই খুব তীব্র রঙে রাঙানো। আসলে এখানে প্রত্যেকেই আসল সে নয় তার পরিবর্তে নিজের হতে চাওয়া ইচ্ছের স্বরূপমাত্র। মদনের বরে বদলে যাওয়া চিত্রাঙ্গদার দল। সুরূপা চিত্রাঙ্গদা।

স্বাভাবিকের থেকে স্বাভাবতই কিছুটা উচ্চকিত দেখায় এদের সকলকে। দেখনদারির ঝুটো কাজলের আতিশয্য হয়তো সবার মুখগুলোকে ঝলমলে করে রেখেছে কিন্তু বুকগুলো কেমন যেন ফাঁকা। সবকিছু পেয়েও তাদের কেমন খালি খালি বোধ তাড়িয়ে বেড়ায়। সকলেই কী এক সঙ্গোপন ইচ্ছা নিয়ে ছুটে চলেছে প্রাণপণ! এ যুগে ছায়ার আড়াল বলতে অগুনতি মাদকের নেশা। নিজের থেকে পালানো কেবলই। কুরূপ চিত্রাঙ্গদাকে কে আর মনে রাখতে চায়! এমনকি সে নিজেও মনে রাখতে চায় না। সত্যর সম্মুখীন হওয়া হয়তো সত্যিই শক্ত। সহজ হতে পারা তার থেকেও কঠিন।

মেয়ে সঙ্গ জীবনে কম করেনি পার্থ। তার সুপুরুষ চেহারা। জিম করা পেশির পুরুষালী গড়ন। উচ্চপদের চাকরি, যাপনের পারিপাট্য সমস্তই তাকে চিরকাল মহিলামহলে রমনীয় করে রেখেছে। নারীদের কাছে সে একান্তই কাম্য। ইদানীং একটু আলুথালু থাকতে ভালোবাসে পার্থ। কিন্তু সেটাও একধরনের  স্টাইল স্টেটমেন্ট।  তার ক্যাসুয়াল লুকটাও যে বানানো তা বেশ টের পাওয়া যায়। এবং সেটা আকর্ষকও।

কিছুদিন আগে নিম্নচাপ গেল। টানা বৃষ্টি। একঘেয়েমি কাটাতে চিলছাদের কার্ণিশে ভিজতে ভিজতে সবুজ গাছপালার প্রেক্ষাপটে একখানা আবক্ষ ছবি তুলেছিল পার্থ। লম্বা চুলের জল গড়িয়ে নেমেছে রোমহীন সুঠাম শরীরে। সেটা সোসাল মিডিয়ায় দিতে না দিতেই অনেকের বুক ধকধক করে উঠেছিল। সেই ছবির একটা কমেন্টে পার্থ থমকালো ।

চিত্রা নামের একটি মেয়ে লিখেছে ‘ কোলকাতায় এতো সবুজ গাছের মধ্যে আপনি বাসা বুনেছেন, দেখে হিংসে হয়। এ বনে কী মৃগয়া করতে যেতে পারি কখনো? ‘

বেশ কদিন আগে করা কমেন্ট। এতদিন দেখা হয়ে ওঠেনি। পার্থ মেয়েটির প্রোফাইল খুলে দেখল টানা দুটো চোখ পুরু চশমায় ঢাকা, ঝাকড়া চুল ছোট করে ছাঁটা, একটি কমবয়সী মেয়ে।  বালিকাসুলভ। সঠিক বয়স ঠাওর করা যায় না ঠিকমতো। সাজের ঘটা নেই তেমন। কয়েকটা ছবি পাহাড়ের চূড়ায়,  কয়েকটা ছবি রাস্তার কুকুর কোলে নিয়ে, কয়েকটা ছবি কোন মিছিলে হাত নেড়ে গান গাইতে গাইতে। দেখলে চট করে সুন্দরী বলা যায় না যদিও। কিন্তু ব্যক্তিত্বের একটা লাবনী ঘিরে আছে মেয়েটিকে। মন্দও বলা যাবে না তাকে কোনমতে। একটু আলাদা বলেই হয়তো তার ওপর চোখ আটকে থাকে।

পার্থ টেক্স করে রাখল ‘ মৃগয়াইচ্ছু মেয়ে, তোমাকে তো চিনিনে, তবে কতখানি শিকারের পরাক্রম তোমার আছে সে পরিমাণ দেখতে কৌতূহল হচ্ছে। এসো একদিন অরণ্যে। আলাপ করা যাবে। ‘

আলাপ হয়েছে। ক্যাসুয়াল ডেট কখন যে সঘন প্রেম হয়ে ওঠে সেসব হিসেব এখন গোলমেলে। পড়ন্ত বিকেলের কফিশপে গরম কফির কাপ থেকে নৈশ্য বহুতলের ছাদ-রেস্তোরাঁয় ঠান্ডা বিয়ারের উল্লাসে মেতে যেতে কারোরই বেশি সময় লাগে না এখন। চিত্রা যেদিন এসেছিল দুচোখে সুরমা আঁকা ছিল। গলায় একটা লাল মোতির হার। জিন্সের সাথে আলগা একটা টপ। ঘন নীল তার রঙ। পার্থর পরণে ছিল অনেক পকেটওয়ালা মেরুন কার্গো, সবুজ টি-শার্ট। এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের মাঝে এতটুকু মুখে চোখদুটো বুদ্ধিদীপ্ত। প্রথম দিন আলোচনাটা নানা প্রসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে পরস্পরের ভালো লাগা মন্দ লাগা টপকে কখন যে ভালোবাসায় পৌঁছে গিয়েছিল দুজনে টের পায়নি। দুজনেই ফিরতি পথে ভেবেছিল আর একদিন দেখা করলে বেশ হয়।

দেখার পরে দেখা। আঙুলের ডগায় আঙুল। ঠোঁটের ভেতর ঠোঁট। শরীর ছুঁয়ে ফেলা গেল যত সহজে মনের নাগাল তেমন সহজে মিললো কোই!

চিত্রা জানে তার মধ্যেকার উছল মেয়েটাকে ভালো লাগে পার্থের। যে মেয়েটা একা একাই পাহাড়ে বেড়াতে যায়, কলেজ পলিটিক্সে গলা ফাটায়, ত্রাণের জন্য রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে টাকা তোলে। সুন্দরবনে কিংবা আরো প্রত্যন্ত গ্রামে দলবল নিয়ে সে ত্রাণ পৌঁছে দেয়। পথ কুকুরদের খাবার খাওয়ায় টিউশনের টাকা জমিয়ে, যেখানে সেখানে অন্যায় দেখলে গালাগালি দিয়ে ঝগড়ায় নেমে যেতে পারে। ভয়ডর তার চরিত্রে নেই। কিন্তু সেটুকুই তো আর সে নয়। তার মধ্যে একটা ভীতু মানুষও আছে। নরম সরম। যার থেকে থেকে কান্না পায়। মরে যেতে ইচ্ছে করে খালি। পার্থ জানে না চিত্রার বাবা চাকরি খুইয়েছিল কোন একটা সময় অফিসে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে। চিত্রার মা একটা সাধারণ স্কুলের সাধারণ কেরানি। সেই টাকায় সংসার চলে তাদের। অভাব মিটে গেলেও সুখ মেলে না সহজে। রাত্রে বাড়ি ফিরে  প্রায় দেখতে হয় মা বাবার অশান্তি চরমে উঠেছে। আসপাসের বাড়ির জানলায় দাঁড়িয়ে লোকে সেই খিস্তিখেউড়ের সংসার-সার্কাস দেখছে। তখন চিত্রার একটা আড়াল দরকার হয়। কান্না লুকিয়ে লুকিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। নিজেকে লড়াকু, উচ্ছল, লাগামহীন  প্রমাণ করতে করতে নিজের কাছেই সে বড় ক্লান্ত। পার্থ কী এই দুঃখের ভার কোনদিন নেবে? চিত্রা জানে না। চিত্রা জানে না এই উত্তরকলতার গলিঘুঁজির ডাম্প বাড়িটায় কোনদিন যদি এসে দাঁড়ায় পার্থ, তখনও যদি মা বাবা এমন দক্ষযজ্ঞ করে, যদি পার্থ দ্যাখে কী সাধারণ আর ফোঁপরা একটা জীবন বয়ে চলেছে চিত্রা— মিথ্যে অহংকারে ভরা, ঠুনকো যত চাকচিক্য মাখানো— তখনও কী চিত্রাকে একইরকম ভালো লাগবে পার্থর! বিত্ত, পরিবেশ, পরিবার অন্যরকম সংজ্ঞা কি বুনে দেয় না মানুষের চরিত্রকে ঘিরে? সম্পর্ক কি বদলায় না তার প্রভাবে? নাকি এ যুগের সকলেই ভুঁইফোড়। কেবল ‘তুমি’ ‘আমি’ মিলে নিজেদের জগৎ গড়ে নেওয়া যায়? সে দুনিয়া কতদিন টেকে? এসব উত্তর র্খুঁজে দেখতে ভয় পায় চিত্রা। তার থেকে এই ভালো। যেমন চলছে চলুক। যদিন চলছে চালিয়ে নেওয়া যাক। হাতের ওপর হাত, ঠোঁটের ওপর ঠোঁট। সুখের ওপর সুখের ছবি জমে। সোসাল মিডিয়ার দেওয়াল ভরে যায় এই সব মিলনের স্মৃতিতে। বন্ধুরা একসাথে মদের পার্টিতে নতুন কাপেলকে উৎসাহ জোগায়। এই তো বেশ ছবির মতন সব চলছে।

পার্থ টের পাচ্ছে ধীরে ধীরে কেমন যেন শীতল হয়ে যাচ্ছে তার আর চিত্রার সম্পর্কটা। কেমন যেন ছকে বাঁধা। নতুন কিছু আবিষ্কার নেই পরস্পরের থেকে। নতুন কোন আনন্দ নেই। নতুন কোন দুঃখ নেই। তারা কেন জানি একটা বাঁধা ছকের অভিনয় করে যাচ্ছে। চিত্রা একটা সীমার পর সহজ হতে পারে না। পার্থ টের পায় শুধু যেটুকু দেখা যায় তার বাইরেও একটা জীবন থাকে। চিত্রা সুন্দর। কিন্তু বড্ডো ঠিকঠাক। পরিপাটি। কোন টাল খেয়ে যাওয়া নেই। নির্ভরতা নেই। তবে কি পার্থ তার কম্পানিয়ন নয় শুধুই সামাজিক কোন ক্রাইটেরিয়ায় টিক চিহ্ন দিয়ে রাখার মতন ব্যবহার সামগ্রী! পার্থ নিজেকে লেফট আউট মনে করছে আজকাল।

-তুই যা চাস তা না পাওয়া অব্দি তোর শান্তি হয় না না?

-হঠাৎ!

– না তাই বলছি। কেমন যেন মনে হয় তুই যা চাস তার সবটাই তুই পাবি। না পাওয়া অব্দি থামবি না। তোর কোন না পাওয়ার গ্লানি নেই জীবনে। না পাওয়া কিছুই তুই সহ্য করতে, মেনে নিতে পারবি না।

– মানুষ যা চায় তার সবটা পেতেই ভালবসে পার্থ।

– বাসে হয়তো। কিন্তু আমার না পাওয়াদেরও পেতে ইচ্ছে করে।

-মানে?

– মানে এই যে আমি তোকে সবটা বুঝতে পাই না এই না পাওয়াটা আমায় মাঝে মাঝে তোর থেকে যেমন দূরে ঠেলে দেয় তেমনি আবার এই না পাওয়াটাই আমাকে তোর দিকে এমন করে এগিয়ে দিতে থাকে। আঁকড়ে রাখতে চাওয়ার ইচ্ছে বাড়ায়।

-কী খেয়েছিস বলতো আজ? এতো বাজে বকছিস কেন?

– তোর মনে হয়না চিত্রা আমরা আরো বেশি বন্ধু হতে পারতাম? শুধু প্রেমিক, প্রেমিকার বাইরেও খুব ভালো বন্ধু। যেখানে আমাদের না পাওয়াগুলোকে অনায়াসে বলে ফেলা যেত। কুন্ঠাহীন।

– তুই কী জানতে চাস পার্থ?

– কিছু না। ছাড়।

এমনি করেই কথা থেমে গেছে।  এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে, কথারা থমকে আসছে ক্রমশ। ঠোঁটের থেকে ঠোঁট, হাতের থেকে হাত, মনের থেকে মন সরে সরে গেল। চিত্রা বুঝতে পারে আজকাল ‘এ মায়া লাবণ্য… কী অভিসম্পাত।’

কী হয় যদি সব বন্ধন খুলে পড়ে। কী হয় যদি কারো জন্য নিজেকে আর পরিপাটি করে তুলতে না হয়? তার ব্রণের ক্ষতর মতো জীবনের যে সব স্বাভাবিক জমে ওঠা পুঁজ রক্ত তাদেরকে ঠিক তেমনি ভাবে কী গ্রহণ করবে না পার্থ? বিশ্বাস করতে সে আর কবে শিখবে?  শুধু পার্থকেই বিশ্বাস নয়, নিজেকে। ভালোবাসাকে।  একটিবারের জন্য যদি হারিয়ে ফেলার সমস্ত ভয় দূরে ফেলে নিজের সমস্ত নিয়ে দাঁড়ানো যায় পার্থর কাছে তবে গল্পটা কী অন্যরকম হত?

মোবাইল স্ক্রিন জুড়ে কয়েকটা অক্ষর টাইপ করেও মুছে দিয়েছে চিত্রা। খাতার পাতায় বড় বড় করে লিখেছে পার্থের নাম। অনেকদিন কথা হয়নি পার্থের সাথে৷ কতদিন? কতদিন?  এক জীবনের কথা জমে আছে বুঝিবা। আজ সব লিখে ফেলতে হবে। অকপটে। কুন্ঠাহীন।

আজ কোন দায় নেই নিজেকে অলীক উচ্চতায় সাজিয়ে পার্থের কাছে নিবেদন করার। পায়ে লুটিয়ে পড়ার মতন মানুষও চিত্রা নয়। ফলে অনুকম্পা আশা করবে না। আজ সে পার্থকে সঙ্গী ভাবছে কেবল। সব দিক দিয়ে সমান। বন্ধু। যার কাছে সব আলো সব অন্ধকার অনায়াসে বলে ফেলা যায়। আর কোন দ্বিধাবোধ নেই। চিত্রা মনে মনে বললে, ‘ এ মোহ আবরণ খুলে দাও… খুলে দাও….আমাকে ফিরিয়ে দাও আমার ভিতরে… সব রূপ, সমস্ত কালিমা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ হয়ে উঠি। সেই পূর্ণ আমাকে আমি সমর্পণ করলাম। আমাকে তুমি গ্রহণ করো, ভালোবাসা। ‘

চিঠি লিখছে চিত্রা। হাতে লেখা দীর্ঘ চিঠি। সেই প্রথম দিন লাল মোতির যে হারখানা গলায় দুলিয়ে পার্থের সাথে দেখা করতে এসেছিল চিত্রা কেন যেন সেই হারটার কথা বারবার মনে পড়ছে আজ পার্থের। বুক চেরা রক্তবিন্দুর মতো উজ্জ্বল অক্ষরমালা দুলছে নারীর বুকে। সে বুক স্পর্শ করলে আগুন। সে বুকে মুখ ঠেকালে বন্যা। পার্থ কী যোগ্য হয়ে উঠেছে এতো আলো এতো অন্ধকার গ্রহণ করার? তার মুঠো উপচে যায় যদি কী করে সামলাবে সে এতো পাওয়া!

চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে পার্থ। কাকে সে বেশি ভালোবাসে, প্রথম আলাপের উজ্জ্বল মেয়েটাকে নাকি আজকের এই ভেজা চোখের মনটুকু যার! শরৎ ফুরিয়ে গেছে। হেমন্তের হিম ঢেকে ফেলছে নিয়ন আলোর রাস্তাঘাট। পার্থ ভাবে সারাটা জীবন একসাথে পাশাপাশি থেকে যাওয়া সে আদতে বড় শক্ত কাজ। ঠিক যতখানি শক্ত নিজের মুখোমুখি হতে পারা। নিজের কাছে নিজের সবটুকু স্বীকার করে নেওয়া বড্ডো কঠিন। একটা জোর লাগে। প্রেমের মতন ভীষণ কোন জোর। চিত্রার হাতটা বোধহয় শক্ত করে ধরা দরকার।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]    

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ