25 Jan

স্নান

লিখেছেন:দীপ্তিপুত্র কৌস্তভ


এক বালতি গরম জল। ঘড়িতে সময়…ঠিক সকাল আটটা পনেরো। কাঁটায় কাঁটায় বাজলেই শুরু হয়ে যায় চাপান উতোর।

ব্যপারটা প্রায় রোজই হয় অনেকটা এরকম…এই বাড়িতে একটা ইমার্সন হীটার আছে, যা দিয়ে এঁরা স্নানের জন্য জল গরম করে থাকেন। সারাবছরের বাঁধাধরা কাজ। দুজনকেই গরম জলে স্নান করতে হয়। দুজনেরই ভয়ানক ঠাণ্ডার ধাত। সারাবছর ধরে এঁদের কারণে, অকারণে নাকে জল, চোখে জল লেগেই থাকে। দুজনেই দেখেছেন, স্নানের সময়, জলের তাপমাত্রা ইত্যাদিতে সামান্য গোলমাল হয়ে গেলেও ভয়ানক সব শারীরিক কাণ্ডকারখানা আরম্ভ হয়ে যায়। সারাদিন ধরে হাঁচি, নাক দিয়ে বন্যার মত জল বইতে থাকা, মুখচোখ চুলকোতে চুলকোতে লাল হয়ে যাওয়া…সবটাই শুরু হয়ে যায়। দিনকয়েক বাদে সর্দি বুকে বসে গেলে তো আর কথাই নেই! হাঁপ ধরা, শ্বাসকষ্ট, মন্দিরের ঘন্টার ঢং ঢং শব্দের মত ভয়ানক কাশি…এরাও নিয়মমত পেছনে পেছনে চলে আসে। সুতরাং, দুজনকেই জল গরম করে, বলতে গেলে প্রায় একই সময়ে স্নানে ঢুকতে হয়।

এবার প্রশ্ন হল কে আগে ঢুকবেন! গিন্নী সক্কাল সক্কাল বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন।এ আজ তাঁর বছর দশেকের অভ্যাস। প্রায়শই সূর্যও তাঁর সঙ্গেই বিছানা ছেড়ে জেগে ওঠেন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে। চশমার কাচ মুছতে মুছতে কর্তামশাই ঠাট্টা করে গিন্নীকে প্রায়ই বলেন, “তুমি হলে সূর্যের এ্যালার্ম ক্লক। কাঁইকাঁই করতে করতে তোমার কাজ করার শব্দ পেয়েই তিনি হাই তুলতে তুলতে জাগেন। আচ্ছা, মাঝেমধ্যে ঝুঁটিটায় চাঁটি মেরে, থাবড়া দিয়ে বন্ধ করে দিতে পারে না?”

গিন্নী হয়ত তখন লাল ম্যাক্সির কোমরে লাগান দড়িটা শক্ত করে বেঁধে নেন। বাঁধার এমনিতে দরকার লাগে না খুব একটা। কিন্তু নিলে মাথাটা বেশ গনগনে গরম হয়ে ওঠে। মেজাজটা সপ্তমে চড়ে। ঝগড়া করার বেশ একটা মুড আসে। ঝাঁটাটাকে জোরের সঙ্গে ঘষা দিতে দিতে তিনি বলবেন, “থাবড়া মেরে বন্ধ করে দিলে তোমার পেয়ারের ফুলের টবে, সব্জীর টবে জলটা কে দেবে? নিজে তো বুড়োধাড়ি ছেলে হয়ে, পেছন উলটে ঘুমোচ্ছ এত বেলা অব্দি। তার মধ্যে একগাদা গাছ! নিজের শখের যত্ন নিজেকে নিতে হয়। আর ঘরের কাজগুলো? হাঁড়িতে ভাত কে চড়াবে শুনি? ঝাঁটা-ন্যাতা কে করবে? তোমার মা?”

-“আঃ হা! এই তো নয়! মা-কে নিয়ে আবার টানাটানি কেন? পাশের ঘরেই আছে। শুনতে পাবে, আর তোমাদের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে।”

-“হুঁঃ!…আমাদের মধ্যে কি আর শুরু হতে বাকী আছে কিছু? সারা জীবনই তো চলছে। বিয়ে হয়ে আসা ইস্তকই তো! আটটা পনেরো বাজলে আরও হবে। তুমি কিন্তু আজ খবরদার ঢুকে পড়বে না। ঢুকতে হলে এখনই যাও।”

-“আচ্ছা, ঢুকব না…”, বলে কর্তা পাশ ফিরে হলুদের ওপরে নীল ফুলছাপ পাশবালিশ আঁকড়ে, আয়েশ করে শুয়ে পড়েন।

যতই বলুন ঢুকব না, গিন্নী কিন্তু জানেন ঠিক ঢুকবে। ঢুকবেই ঢুকবে। না ঢুকলে তো পেটের ভাত হজম হবে না! বাসী কাপড় কেচে, ঝাঁট দিয়ে, ন্যাতা লেপে, ঘামতে থাকা গিন্নী ঘুরতে থাকা ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে, কপালে লেপ্টে পড়া চুলগুলো ডান হাতের কব্জি দিয়ে সরিয়ে, ম্যাক্সির গলার প্রান্ত খানিকটা তুলে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে, যেই হীটারে বসান গরম জলের বালতিটা নিয়ে, “ওফ! চানটা করতে যাই”, এমন ভাববেন, ঠিক তখনই লাল গামছাটি পরে, নোয়াপাতি ভুঁড়িটিকে গাইডের ভূমিকায় রেখে কর্তাকে দেখা যাবে, অন্য সময়ের চেয়েও বেশী গম্ভীর মুখে ওই বালতিটিই হাতে ধরে টুকটুক করে বাথরুমের দরজার দিকে চলেছেন। পেছন থেকে তাঁর জন্য তখন উড়ে আসছে মধুমাখা সব শব্দ, বাক্য! অবশ্য মাঝেমাঝে এর উল্টোটাও যে হয় না তা নয়। সেদিন আমাদের কত্তামশাই-এর সকালবেলার বেগ, আবেগ থেকে সংবেগে পরিণত হয়। লাল গামছা হলুদ হয়ে আসার মত সিরিয়াস অবস্থা হয়ে আসে। তিনি মাঝেমাঝেই, নীল জলে হাসিমুখ ডলফিন খেলা করা বাথরুমের দরজার সামনে এসে, ডলফিনের মুখে থাবড়াতে থাকেন। প্রবল উদ্বেগের সঙ্গে বলে ওঠেন, “কই গো! হল? আর কতক্ষণ? খুব জোর পেয়েছে যে….”। বাথরুম থেকে তখন জল ঢালার শব্দের সঙ্গে বামাকন্ঠে ভেসে আসে গান, “এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্নমধুর মোহে…..”

এর মধ্যেই কোন কোনদিন দৃশ্যে ঢুকে পড়েন খোকার মা। মানে, আমাদের কর্তামশাই-এর মা। পারেন না আসলে চুপ করে থাকতে। কি করে পারবেন! তাঁর খোকা সরকারী আপিসের বড় চাকুরে। সাড়ে দশটার মধ্যে অফিসে ঢুকতে হয় তাকে। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই…রোজ যাওয়া। খাটাখাটুনি কি কম?! রক্ত জল করে পয়সা রোজগার করে সংসারে আনে। সেই তাকেই কিনা এই দজ্জাল, হিংসুটে, দাপুটে বৌ একটু আরাম করে চানটাও করতে দেয় না! তাঁর নিজের কাজকর্ম অবশ্য এদের আগেই সারা হয়ে যায়। একদিন এই সংসারকে নিজের হাতে গড়ে তোলা, বাষট্টি বছরে পড়া কিন্তু বিয়াল্লিশের মত থেকে যাওয়া তিনি সকালের এইসময়টায় জাগতিক যন্ত্রণা থেকে আত্মার মুক্তির জন্য, হিংস্র আমিত্বের বন্ধনকে আধ্যাত্মিক মিলনের আস্বাদ দেওয়ার জন্য গীতাপাঠ করেন, মালা জপ করেন…এবং তার ফলশ্রুতিতে, সংসার থেকে যেন সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়েন, সে জন্য নাবালক ছেলে ও সেই ছেলের দখল নিয়ে নেওয়া বৌমার কথোপকথনে খানিকটা কান ও মন রাখেন। একসময় তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে সবটা। নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না আর তিনি। তুলসীকাঠের মালা হাতেই চলে আসেন…

-“কি শুরু হয়েছে বৌমা? আমি কি তোমাকে কিছু বলেছি?”, খোকার মা তখন একহাত মুঠো করে থাকেন। সেটি আক্রমণের জন্য যেন প্রস্তুত।অন্য হাত মালা থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণ করছে।

-“আমি আপনাকে তো কিছুই বলিনি। যা বলার আপনার ছেলেকে বলেছি…”, গিন্নীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়।

-“বলেছ তো আমার ব্যাপারেই। তোমাদের কোনকিছুতেই তো থাকি না। তাও তো কথা শোনাতে ছাড়ো না দেখি।”, খোকার মা মালা ঘোরাতে ঘোরাতে বলেন।

গিন্নী, এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা শাড়ি জামা পাট করে আলনায় রাখতে রাখতে, ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক উত্তর দেন -“থাকেন না এটা বলবেন না, মা। দিব্যি তো থাকেন। এই যে এখন চলে এলেন। কি শুনলেন, কি বুঝলেন কে জানে! অথচ বলতে চলে এলেন। এখন নিজের হয়ে বলছেন। খানিকক্ষণ বাদেই ওটা ছেলের জন্য বলা হয়ে যাবে।”

-“তা বলব না? ছেলেটা অফিস বেরোবে সারাটাদিনের জন্য৷ সে আগে স্নান সারবে না? তো কি তুমি সারবে? খালি নিজেরটাই বড় করে দেখতে হবে?”

-“হয়ত করতাম না। হয়ত ও বেরিয়ে গেলেই করতাম। সে না হয় শরীর গোলমাল করলেও, মেনেই নিতাম। নিই নি কি আগে? নিয়েছি তো। কিন্তু ওই যে, আপনারই অদ্ভুত দাবী। স্নান সেরে শুদ্ধ না হয়ে রান্নাঘরে ঢোকা যাবে না! আগুন ছোঁয়া যাবে না। সেটা খেয়াল আছে তো? ছেলে কিন্তু সারাটাদিনের জন্য অফিস বেরোবার আগে দুটি গরম ভাত খেয়ে যেতে পারবে না, মা। চলবে তো?”

-“করে তো দাও শুধু ভাতে ভাত, এক তরকারী আর মাছের ঝোল। তাতেও দেখি কথা শোনাতে ছাড়ো না! রেঁধে খাওয়ালে ছোট হয়ে যায়, এটা মা বুঝি শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছিলেন!”

-“এই তো! ছোটলোকমিতে চলে এলেন। একটু সামলে থাকুন মা। ভাল বলতে না পারুন, আমার মায়ের ব্যাপারে কোন খারাপ কথা বলতে আসবেন না।”

খোকার মা ফাউল করে বসে আছেন। রেফারি থাকলে নির্ঘাত হলুদ কার্ড। রেফারি নেই। সুতরাং, ঘুমের বারোটা বেজে যাওয়া খোকাই যুযুধান দুই খেলোয়াড়ের মাঝে উপস্থিত হয়।

-“আঃ! কি শুরু করলে বলো তো তোমরা! শান্তি নেই জীবনে! তুমি ঘরে যাও না মা। তোমার আবার প্রেশার সুগার বেড়ে যাবে। কথা বাড়াও কেন যে এত, বুঝি না! ”

এইরকমই সব কথাবার্তা চলে। গত দশ বছর ধরে চলছে। গিন্নী এ বাড়ি ছেড়ে কতবার চলে গেছেন বাবা-মায়ের কাছে! উত্তর কোলকাতায় বাবার বাড়ি। বনেদী ঘটি পরিবার। যদিও সে ঘটি তালপুকুরে ডোবে না আর। বাবার আয়পয় তেমন কিছু নেই। জীবনযাত্রাতেও তেমন ভ্যারিয়েশন নেই কোন। কয়েকটা দিন থাকলে কি যে দমবন্ধ লাগে দু পক্ষেরই!

-“কিছু ভাবলে, মুনু?”

-“কি ব্যপারে মা?”

-“ছেলেটা তো ভাল মুনু! তাকে এরকম একা একা গুমরে রাখাটা কি ঠিক হচ্ছে? জীবনে কত কিছুই তো মেনে নিয়ে থাকতে হয়।”

-“তোমাদের কি অসুবিধা হচ্ছে আমি রয়েছি বলে?”

-“না, তা কেন! সে তুই থাক না যতদিন ইচ্ছে। তোরই তো বাড়ি। তবে কি না…জামাই একা রয়েছে৷ কি খাচ্ছে, কি পরছে!”

মা আস্তে আস্তে কয়েকটা কথা বলে চলে যান। মেয়ে বোঝে শো ভাঙ্গার ফার্স্ট বেল বেজে গেল। একদিন বাদেই সেকেণ্ড বেল বাজলে মা তাকে কাঁদতে কাঁদতে সরাসরিই চলে যেতে বলবে।

সুতরাং, সেকেণ্ড বেলের আগেই একদিন চলে আসে মেয়ে। ট্যাক্সিতে আসতে আসতে প্রতিবারের মতই পরিবর্তন হয় তার। কন্যা থেকে গৃহবধূতে। যাওয়ার সময় যেমন হয়েছিল। গৃহবধূ থেকে কন্যায়। পরিবর্তনের পদ্ধতিতে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার কি তবে নির্দ্দিষ্ট রূপ নেই কোনও! আমি কি তবে না মায়ের মেয়ে, না শাশুড়ির বৌমা! আমি কি তবে নই কারুরই?!

আমি কি তবে নই সেই মানুষটারও?!

যার জন্য সমর্পণ করে দেওয়া হয়েছিল একদিন আমাকে?!

সত্যি কথা বলতে কি, আকর্ষণ দুজনেরই একে অপরের জন্য ছিল। গিন্নীর তরফ থেকে এখনও কিছুটা আছেও। কিন্তু সে আর প্রকাশ করবে না। সে আর নীচু হবে না। কর্তারও আছে হয়ত….যার অধিকাংশটাই শারীরিক এবং যান্ত্রিকতা যুক্ত শারীরিক। কামের সম্পূর্ণ শারীরিক প্রক্রিয়াটায় তার কামুক স্বামীর ভূমিকা, খুব ভালভাবে তেল খাওয়ান এক যন্ত্রের। মন সেখানে কোথাও নেই। অথচ মনের ছোঁয়া না পেলে গিন্নী নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন না। কর্তা তখন গিন্নীর শরীর ছিনিয়ে নেন মন থেকে। মানসিকভাবে, বা মানবিকভাবে পাশে লোকটা আজও নেই, কোনদিনই ছিল না।

বিয়ের প্রথমদিকটায় ছোট ছোট পছন্দ মিলে যেত দুজনের। কর্তামশাই গাছ ভালবাসেন। টবে গাছ। বাড়িতে তেমন ফাঁকা জায়গা তো নেই। গিন্নী যদিও এখন কথা শোনান নিজেকেই সবটা করতে হয় বলে, কিন্তু গাছ পছন্দ ছিল তাঁরও। অথচ যেদিন থেকে দায়িত্বটা তাঁর ঘাড়ে পুরোটা পড়ল, মানে কর্তাখোকা টব, মাটি, চারা ইত্যাদি কিনে এনে দেবেন, এবং, প্রতিদিন স্বপ্ন দেখবেন গাছে লেবু হচ্ছে, লঙ্কা হচ্ছে, কড়াইশুঁটি হচ্ছে…সেসব তাঁর খাওয়ার থালায় পড়ছে…অথচ প্রাত্যহিক পরিচর্যা করতে হবে গিন্নিকে….তার কিছুদিন পর থেকে গাছ যেন গিন্নীর বোঝা হয়ে উঠেছে! প্রতিদিন গাছ নিয়ে সমালোচনা চলে তাঁর দিক থেকে। কর্তামশাই কিন্তু নানা বিষয়ে আকাশ পাতাল কল্পনা করেই খালাস। তিনি মনে করেন একদিন এই পৃথিবী গাছে গাছে, সবুজে সবুজে ভরে উঠবে। এ দেশে গরীব মানুষ আর থাকবে না, ভিখারী থাকবে না। এ দেশের সব শিশু একদিন শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে পূর্ণ হয়ে উঠবে…এবং সেসব কাজ প্রায় হয়েই এসেছে। তাই রাস্তাঘাটে শিশুদের ভিক্ষা কর‍তে দেখলে, তারা কর্তার কাছে ভিক্ষা চাইতে এলে তিনি সবেগে, সক্রোধে তাড়া দেন। তাতে গিন্নী রেগে গিয়ে বলেন, “তুমি না বড্ড হিংসুটে! তোমার মন বলে কিছু নেই। সেইজন্যেই তুমি গাছ ভালবাসো, অথচ যত্ন নাও না। বাচ্চা ভালবাসো, অথচ জন্ম দিতে পারো না।” কর্তা তখন বলে ওঠেন, “তোমার মন তো মহান মানুষের। তা হলে তুমিই বা ব্যর্থ কেন?” শুরু হয়ে যায় আবার একপ্রস্ত কথা কাটাকাটির খেলা। বলে রাখি, এই দুটো মানুষ এখনও নিজেদের রক্তের, নিজেদের ডি এন এ, ক্রোমোজমের কোন উত্তরাধিকারী তৈরী করতে পারে নি। পরীক্ষা করান হয়েছিল। সমস্যা সেভাবে দুজনের কারুরই নেই। তবুও সন্তান কেন যে এল না এখনও, সে ভারী অদ্ভুত, ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার!

আর এভাবেই প্রতিদিন নিজেদের বহু খুঁত বার করে ফেলতে ফেলতে দুটো ছেলে-মেয়ে থেকে তারা মাঝবয়সে এসে পড়ল। এখন তাদের একসঙ্গে থাকাটায় ভালবাসা, আকর্ষণ কম…অভ্যাস অনেকটাই বেশী। বন্ধুত্ব? সে কখনও ছিল না। থাকলেও এখন তা সীমারেখাগত। সম্পর্কে কোন তীব্রতা তখনও ছিল না, এখনও নেই। হয়ত কোন একজন যদি বাড়িয়ে দিত হাত, কোন একজন যদি সত্যিই ভালবাসত খুব…..হয়ত কোথাও যেতে পারত সম্পর্কটা। কিন্তু পরস্পরের জন্য এত বছরে ওই কোনরকমে একরকম ধারণা পুষিয়ে ফেলা লোকদুটোর মধ্যে সেই ধৈর্য, বা সৃষ্টিশীলতা আর হয়ত বেঁচেই নেই।

শুরু হয়ে গেছে আজও। মন দিয়ে শুনছে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা কুণ্ডলী পাকানো কুকুর। খণ্ড খণ্ড শুনছে রাস্তায় হেঁটে চলা দুয়েকজন ব্যস্ত মানুষ। আজ একটু তুমুলভাবেই হচ্ছে। শুধুই শাশুড়ি বৌতে যখন হয়, তখন গজগজানির পারাটা একই থাকে সারাদিন ধরে। টুকটাক চলতে থাকে। এ ওকে বলা। ওর উলটে আবার একে শুনিয়ে দেওয়া চিমটি কেটে। আজ ব্যাপারটায় খেপে ওঠা কর্তামশাইও পুরোদমে ঢুকে পড়াতে আরও লাট খেয়ে গেছে। জিনিষপত্র ভাঙচুর হয়েছে বেশ কয়েকটা। ভীষণ চিৎকার!

খোকার মা দু’হাত ঝাঁকিয়ে বললেন-“তুমি কি চাও বৌমা?! সেই যেদিন থেকে এসেছ, এ বাড়ির মানুষগুলোকে একবিন্দু শান্তি তো দাও নি। একটা ছোটলোক ফ্যামিলির মেয়ে! তোমাকে নিয়ে আসাটাই আমাদের ভুল! এই তোমার জন্য আমার খোকার বাবা মরে গেল। আমার খোকাকেও কি এইরকম ঝগড়া করে করে মেরে ফেলতে চাও?!”

-“একজন মানুষ চলে গেছেন, তার সম্বন্ধে বলতে নেই…তবু, এই দোষারোপ বারবার যখন করা হয় আমাকেই, তখন বলি, তিনি মারা গেছেন করোনারি থ্রম্বোসিসে। আর আপনার ছেলেই বা সেদিন ফোন তুলছিল না কেন? কতবার ফোন করেছি সেটা জেনেছিলেন আপনার আদরের খোকা আর তাঁর পেয়ারের তাপসীর কাছ থেকে? পাড়ার লোকজন ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা না করলে শেষবারের জন্য ঠোঁট নাড়ানটুকুও কি চোখে পড়ত আপনার? বারবার ফোন করেছি আপনাকে আর আপনার ছেলেকে। আপনি নিজের দিদির বরের আদর খেতে গিয়ে ফোন তোলার প্রয়োজন মনে করেন না। আর আপনার ছেলে তো তখন তাপসীর গুহায় ঢুকে চুপটি করে নেতিয়ে শুয়ে আছে! কি মনে করেন বলুন তো? কিছু প্রতিবাদ করিনা না বলে যা পারবেন তাই বলবেন না কি?”

আগুনে যেন বড় এক শিশি গাওয়া ঘি পড়ল। আগুন তার শিখা বিস্তার করে জ্বলে উঠল। চারপাশ আরও গরম হয়ে উঠল। চোখ জ্বলল। সেখান থেকে জল ঝরল।

-“কি বললি?! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!! কুত্তি একটা! এই নে!” পুরুষকন্ঠের সিংহগর্জন ভেসে আসে দেওয়ালের কান বেয়ে। বাইরে। হঠাৎ পিঠে কিল মারার আওয়াজ পাওয়া যায়। চুড়ির খনখন আওয়াজ পাওয়া যায়। ধুপধাপ আওয়াজ পাওয়া যায়। পায়ের শব্দ। একটা কাঠের চেয়ার পড়ে গেল।

-“আমাকে মারলে? এত বড় সাহস? বাঃ…ভেরি গুড! অসামান্য!”, ব্যঙ্গ করে হাততালির আওয়াজ ভেসে আসে। “আমার ফ্যামিলি ছোটলোক? আর তোমাদের মত শিক্ষিত পরিবারে বুঝি বৌকে মারধর করা চলে? নিজের জামাইবাবুর সঙ্গে, অফিস কলিগের সঙ্গে আর নিজের ছেলের বৌ-এর সঙ্গে শোয়ার কালচার চলে? মুতে দিই এমন কালচারড ফ্যামিলির মুখে।” আহত, বিষাক্ত, ব্যথিত একটা গলা হিসহিস করে বলে ওঠে।

-“এই শালি! হারামী! মুখ সামলে কথা বলবি! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব!”, আবারও সিংহগর্জন।

-“আচ্ছা?! তাই?! এই না ভদ্রলোকের মত কথা!তাহলে, হে ভদ্র বাড়ির ভদ্র ছেলে! দেখবে তোমার বাবার কীর্তি?! গত দু বছর ধরে আমার মোবাইলে কি কি ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছে, কি কি ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে দেখাব না কি সবাইকে খুলে? আর ওনার মোবাইলটাও তো আছে। আমার তরফ থেকে কোনদিন কিছু গেছে কি না একবার দেখো তো চেক করে। সব কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে দিই বলে এরা ভাবছে যা ইচ্ছে তাই করবে! শুনুন তাহলে…এই যে আপনাকে বলছি, যাকে মা বলি। আপনি যখন সেজেগুজে বোনের বাড়ি যেতেন, তখন আপনার গুণধর স্বামী আমাকে যে কতবার বিছানায় তোলার চেষ্টা করেছে সে যদি আপনারা জানতেন! কাউকে কিচ্ছু বলিনি! কাকে বলব। ওপর দিকে থুতু ছুঁড়লে তো নিজের গায়েই পড়ে। এই বারান্দায় পালিয়ে এসে বসে থেকেছি যাতে লোকের ভয়ে ছুঁতে না পারে। তাও কয়েকবার বোকা বানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেছে। ভয় পাবেন না মা। আপনার মান-সম্মান আপনার বৌমা ধুলোয় লুটোতে দেয় নি। কিন্তু কি জানেন…সেদিনও আমি ভেবেছিলাম ওনার অসুস্থ হয়ে পড়াটা স্রেফ ভান। পালে বাঘ পড়ার গল্পের মত। সেজন্যই প্রথমে কোন রিয়্যাক্ট করিনি। কিছুক্ষণ পরে বুঝি লোকটা মরে যাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই তো আপনাদের ফ্যামিলি। ঘেন্নায় মরে যাই। এ্যাই…তুমি কাছে আসবে না আমার! স্বামী হয়ে বৌ-এর গায়ে হাত তোলো! থুঃ!”

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ! ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা যেন……

ঝপাস করে জল ঢালার মত একটা শব্দ!

মাত্র পনেরো থেকে কুড়ি সেকেণ্ড….

তারপর এই বাড়ির লোকজনের কান্নাকাটিতে পাড়ার আশেপাশের বাড়ির অনেকে চলে এল।

তারপর হৈচৈ! চিৎকার! ডাক্তার! এ্যাম্বুলেন্স! থানা-পুলিশ!

তারপর বেলা গড়ায়…ফিসফিসে গল্পেরা তাদের ময়লা অক্ষর নিয়ে, উন্মুক্ত কৌতূহল নিয়ে জন্মাতে থাকে মোড়ে মোড়ে…গলিতে, চায়ের দোকানে….

-“কি হয়েছিল গো অসিতদা? তুমি তো গেছিলে…”

-“আরে আর বোলো না ভায়া! সকাল থেকেই তো শুনছি! ফাটাফাটি চলছিল! সেই তো সবই জান। এদের চান করার গরম জল দিয়ে গা গরম শুরু হয়…তারপর আস্তে আস্তে মাথা গরম হতে থাকে। তা আজ প্ল্যান করে কিনা কে জানে, মলয়বাবুর বৌ রাগের মাথায়, টগবগে গরম জলভরা বালতিটা তুলে এনে পুরো জলটা…. দিয়েছে ঢেলে পুরো একেবারে! হুঁ হুঁ!!”

-“বলেন কি! সাংঘাতিক ব্যপার তো! খুনের চেষ্টা!”, শিউরে ওঠে শ্রোতারা।

-“সে এখন খুনের নাকি সুইসাইডের, তা তো পুলিশ বলতে পারবে। কিন্তু রাখে হরি তো কে মারবে বলো! বেশীরভাগটাই বালতি থেকে গায়ে মাথায় পড়েছে। থার্ড ডিগ্রি বার্ন রে ভাই! মুখে, চোখে, গলায়…সব ইয়া বড় বড় ফোস্কা! বাঁচবে কি না সন্দেহ!”

-“হ্যাঃ! ওরকম বলবেন না। ইশশ! কি থেকে কি হয়ে গেল বলুন! শিক্ষিত ফ্যামিলি। এরকম কেউ করে?!”

-“আরে ছাড়ো তোমার শিক্ষিত। ভেতরে যা কাহানি আছে না! শোনো, বলি….”

গল্পগুলো পিষতে থাকে, উড়তে থাকে ওদের নিয়ে। আকর্ষণের দৃষ্টিরা সব দূরত্বদের এক করে দেয়। কথায় কথায় অন্ধকারের পাশ থেকে কেউ মুখ বাড়াল। আলতোভাবে জুড়ে থাকা হাতগুলো সব হঠাৎ ছেঁড়া। হড়কা বানে স্রোতের টানে কোথায় বয়ে চলল তারা! অবাক চোখে দেখছ চেয়ে তুমি এবং তোমার মুঠো। এইভাবে কার সময়পাহাড় বাড়তে পারে ক্ষেতখামারে?! জমতে থাকা উত্তাপেরা কেমনভাবে গা পোড়াল! গল্প আসে, গল্প ভাসে, এই পাড়াতে ওদের নিয়ে। অসীম, অপার দূরত্বরা ফিরল আরও একটা ঘরে….

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]  

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ