25 Jan

জন পজারের বাংলো

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সান্যাল


‘সরকারী জীপ-এ করেরাঁচি থেকে এসে প্রথমযেদিন একতলা বাংলোটা দেখতে এলাম তখনই খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল,বুঝলে সুশীল । ব্রিটিশ আমলের আর্কিটেকচার,বড়ো বড়ো পাঁচ-ছটা ঘর,বাংলোর তিনপাশ ঘেরা উঁচুরেলিং দেওয়া বারান্দা,বিরাট কম্পাউনডের সঙ্গে একটা আউটহাউস, বাড়ীর পেছন দিকে গোটাকতক বড়ো বড়ো আম,জাম আরজলেবী গাছ, বাংলোর সামনে গাড়ীবারান্দা থেকে একটা লাল মোরামের রাস্তা গেট অবধি চলে এসেছে । সামনের বাগানটায় কিছুফুলের গাছ, ক্রোটন আর পুটুসের ঝোপ, গেটের দুপাশে লাল হলুদ বোগেনভিলিয়া, সব মিলিয়ে বাস করবার জন্যে একেবারে আদর্শ । বাগানটা অবশ্যদেখেই বুঝলাম যে যত্ন করার কেউ নেই, বিশাল ফলবান গাছগুলোতে পর্যন্ত প্যারাসাইটের ঝাড় লতিয়ে উঠেছে । সঙ্গের কনস্টেবলটাকে জিগ্যেস করতে সে বলল যে আগের ডিএসপি সাহেব তো কোডারমা  শহরে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন, তাই এই কোয়ার্টারে গত দুবছর কেউই থাকেননি। এখন এতো সুন্দর বড়ো ফ্যামিলি কোয়ার্টার থাকতে তিনি যে কেন ভাড়া বাড়িতে থাকতেন সেটা এখন কাকে জিগ্যেস করবো! আমার প্রিডিসেসর শিউশরন সিনহা ছিলেন প্রমোটি, বয়স্ক মানুষ, তিনি তো এখান থেকেই এস পি হওয়ার পর রিটায়ার করে নাকি ছাপরাতে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছেন ।মোটের ওপর কোডারমার ডিএসপি-র এই সরকারি কোয়ার্টার তো আমার বে-এ-শ পছন্দ হয়ে গেলো ।’

রিটায়ার্ড আই পি এস অফিসার রণধীর চৌবে কথা থামিয়ে সামনের হুইস্কির গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিলেন ।

আমরা দুজন বসে চৌবেজির গল্প শুনছি ।

আমি নীরজ কুমার সিং, পাটনা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পাটনা রিজিয়ন টু-র এজিএম, আর আমার সঙ্গের আড্ডাধারী আমার লঙ্গোটিয়া ফ্রেন্ড, পাটনা সেশন কোর্টের সাবজজ সুশীল দ্বিবেদী ।

আমাদের হোসট রণধীর চৌবে ঝাড়খণ্ড সরকারে পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিজির পদ থেকে রিটায়ার করে বছর পাঁচেক হল পালামউএর এজমালি বাড়ি ছেড়ে পাটনায় এসে থিতু হয়েছেন ।

প্রাসাদোপম এই বিশাল বাড়িটা তাঁর বিপত্নীক শ্বশুরমশাইয়ের ছিল, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বিহার সরকারের মন্ত্রীপদ সামলে বছর দশেক আগে পরলোক গমন করেছেন ।

তাঁর একলৌতা কন্যামণিকার নামে উইল করা এই বাড়ীর একমাত্র মালিক এখন জামাই রণধীর চৌবে ।

কারণ মনিকাও চলে গেছেন ক্যান্সারে, বছর তিনেক আগে ।

বিগতদার চৌবেজি এখন দুতিনটি কাজের লোক নিয়ে এই বিরাট বাড়িতে একাই থাকেন ।

চৌবেজির একমাত্র মেধাবী পুত্রটি বর্তমানে আমেরিকায় কর্মরত ।

তার দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম ।

উপরন্তু, ওয়ারক-অ্যালকোহলিক সেই ছেলের দেশী বিদেশী কোনরকম বিবাহেইবিশেষ মন নেই ।

এই নিয়ে রণধীর চৌবের মন প্রায় সর্বদাই ভারাক্রান্ত থাকে ।

মনের দুঃখটা তিনি হুইস্কির গেলাস আর নিয়মিত আড্ডাধারী আমাদের কাছে উগরে দেন ।

#

হ্যাঁ, এখানে প্রায় রোজ সন্ধ্যায় আমাদের জমজমাট আড্ডা হয় ।

কারণ বিবিধ ।

আইনরক্ষকের উচ্চপদে সাঁইতিরিশ বছরের কর্মজীবনে রণধীর চৌবের গল্পের ভাণ্ডার অফুরান।

আমরা তাঁর কাছে বয়সে ও পদমর্যাদায়  অর্বাচীন হলেও ভদ্রলোক বেশ জমিয়ে সেসব গল্প করেন ।

আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, তাঁর সেলারে নানা ব্র্যান্ডের স্কচ হুইস্কির অঢেল জোগান ।

সৎ এবং নিয়মনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার হিসেবে চৌবেজির ঝাড়খণ্ড প্রশাসনে বেশনামডাক ছিল ।

তবে ভদ্রলোকেরএকমাত্র দুর্বলতা যে হুইস্কি,সে ব্যাপারে আমি ও সুশীল একমত ।

অতি সম্প্রতি তাঁর পছন্দ করা মেয়েকে বিবাহে পুত্র অসম্মতি জ্ঞাপন করে আমেরিকায় ফিরেযাওয়ার পর হুইস্কির মাত্রাটা বেড়েছে বলেই আমাদের ধারণা ।

সে যাই হোক, সুশীল বললো,

‘কি হলো তারপর চৌবেজি ? আপনি কি তাহলে ওই বাংলোতেই শিফট করলেন ?’

রণধীর চৌবে গেলাসে আর একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন,

-‘হ্যাঁ, শোনই না ।প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা । ওই বাংলোর আশেপাশে প্রায় আধ মাইলের মধ্যে তখনও কোন ভদ্রগোছের পাকা বাড়ী ছিল না। দূরে দূরে খাপরার চালের কিছু ঘর, মোস্টলি লেবার ক্লাস থাকে, কোডারমা শহরে তারা দিনমজুরি করতে যায় । বাজার দোকান কিছুই প্রায় নেই । সন্ধ্যের পরে বাংলোর সামনের কাঁকরঢালা রাস্তাটায় গাড়িটাড়ি কিছু চলে না । পেছনের কম্পাউন্ড ওয়ালের পরে যতদূর চোখ যায় উঁচুনিচু বাঁজা টাড়। অনেকটা দূরে হাওড়া মোগলসরাই গ্র্যান্ড কর্ড রেললাইন চলে গেছে ।তার ওপারে আবার ঝোপঝাড় জঙ্গুলে জমি । একটু ভেবে শিউশরনজির ব্যাপারটা বুঝলাম আমি । ফ্যামিলি ম্যান ছিলেন, এখানে প্রতিবেশী বলে তো কিছুই নেই । হয়তো কলেজগোইং ছেলেমেয়েও ছিল । কিন্তু আমার তখন যুবক বয়েস, ব্যচিলর জীবন,কাজের জোশও খুব । ভাবলাম, সাব ডিভিশন পুলিশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আমি, অফিসেরপাহারাদার কনস্টেবল, আরদালি, জীপ, সব হামেহাল হাজির থাকবে, অফিস মাত্র পনেরো মিনিটের ড্রাইভ । তাহলে এই জনহীন প্রান্তরে আমার আবার অসুবিধের কি আছে । বরং প্রকৃতির নির্জনতা উপভোগ করার এই একটা সুযোগ । মনে আছে সেদিন শনিবার ছিল । পরের দিন রবিবার রাঁচি থেকে ট্রাকে  মালপত্র আনিয়ে আমি তো জমিয়ে বসলাম ওই বাংলোতে ।’

#

‘সোমবার জয়েন করতে গেলাম এসডিও নরেশ যাদবের অফিসে ।

এই ভদ্রলোকও ছিলেন প্রমোটি, বয়স্ক মানুষ, বেশ ফ্রেন্ডলি হাবভাব ।

কথায় কথায় আমাকে জিগ্যেস করলেন আমি কোথায় বাসা ঠিক করলাম ।

আমি ডিএসপি কোয়ার্টারে উঠেছি শুনে উনি আমার দিকে যেন কিভাবে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ ।

তারপর আবার যেন কনফার্ম করার জন্য বললেন,

-‘জন পজারের বাংলোতে শিফট করেছো ?’

-‘জন পজারের বাংলো?’

-‘ হ্যাঁ । ওই বাংলোটা জন পজারের ছিল । বেওয়ারিশ পড়েছিল বহু বছর। সাপখোপ আর বদমাইশদের আড্ডা হয়ে উঠেছিলো । এই বছর দশেক আগে সরকার ওটা নিয়েনেয় । তারপর ভালোরকম সারিয়ে সুরিয়ে ওটাই এখন কোডারমা সাবডিভিশনেরডিএসপি কোয়ার্টার হয়েছে । জন পজার লোকটা ইংলিশম্যান ছিল । শুনেছি মাইকা মাইন কিনেছিল কয়েকটা । অনেকটা জমি কিনে বাংলোটা বানিয়েছিলো, রাজার মতো থাকতো । তবেবাংলোটা সরকারি কোয়ার্টার হয়ে যাওয়ার পরও ওখানে একটানা বিশেষ কেউ থাকেনি ।’

-‘হ্যাঁ, চারপাশটা অবশ্য বেশ নির্জন । আমার তো বেশ ভালো লাগলো । অন্য কোনও প্রবলেম স্যার ?’

যেন একটু ইতস্তত করে এসডিও যাদব বললেন,

-‘না-আ। তেমন কিছু নয় । তোমার কম বয়েস, রাতে বারান্দায় হঠাৎ বেরিয়ে এসো না, শুনেছি এখনো বুনো শুয়োর ঘুরে বেড়ায় রাতে, উঠে আসে বারান্দায়।

-‘থ্যাঙ্ক উ স্যার । আমি খেয়াল রাখবো ।’

রণধীর চৌবে থামলেন ।

তারপর আমাদের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-‘আরে তোমাদের গ্লাস তো খালি । নাও, নাও, নিজেরা নিয়ে নাও না কেন ?’

এই বলে আমাদের গ্লাসে একটা করে পেগ ঢেলে দিয়ে নিজের গ্লাসটা পুরো ভরে নিলেন, যাকে বলে ডবল পাতিয়ালা পেগ ।

বাইরে ইতিমধ্যে জোরে বৃষ্টি সুরু হয়ে গেছে, অসময়ের বৃষ্টি ।

চৌবেজি আবার শুরু করলেন,

-‘আমি তো জোরকদমে কাজকর্ম শুরু করে দিলাম । সকালে অফিসে নানা ব্যাপারে  মীটিং করি, লাঞ্চের ব্রেকে ঘণ্টাখানেকের জন্য বাংলোয় ফিরে আসি, খেয়েদেয়ে পনেরো বিশ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে অফিসে ফিরে আসি । তারপর একটু ফাইল টাইল দেখেরোজ একটা করে আমার জুরিসডিকশনের পুলিশ স্টেশন ভিজিট করতে শুরু করলাম ।’

‘অস্বাভাবিক ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম, বুঝলে, কয়েকদিন পর থেকে । ব্যাচিলর মানুষ, ওই বয়সে অগোছালো জীবন, বুঝতেই পারছো, শোয়ার ঘরের চারদিকে জামাকাপড়, জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ।

প্রথমে দু তিনদিন অতোটা খেয়াল করিনি ।

একদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ফিরে হঠাৎ মনে হোল, কি ব্যাপার, আমার জামাকাপড় জিনিসপত্র সবকিছু যেন নিপুণভাবে গোছান, সাজানো, আলমারিতে সার্ট প্যান্ট, ঠিক  জিনিসটা ঠিক জায়গায় আছে ! তাজ্জব ব্যাপার !

আমি তো ভীষণ আশ্চর্য হলাম । বাড়িতে মেয়েমানুষ বলতে কিচেনে একটা বয়স্ক দেহাতী বৌবেলায় এসে দুবেলার রান্না করে দিয়ে চলে যায় ।

দুপুরে আমি ঘরে ফিরে লাঞ্চ করে  অফিসে চলে যাওয়ার পর বিকালে সে আবার এসে বাসন মেজে দিয়ে চলে যায় ।ঠিকে কাজের লোক, আমার সঙ্গে তার দেখাইহয় না ।

এর মধ্যে একদিন আমি দেরী করে অফিস যাওয়ার সময় তার গলা-অব্ধি ঘোমটা-টানা চেহারা  দেখেছি, ব্যস ওই পর্যন্তই ।

পুলিশ কর্তার বাড়ি, বিনা অনুমতিতে আমার শোয়ার ঘরে তার ঢোকার প্রশ্নই নেই ।

বাইরে আউট হাউসে একটা আর্মড কনস্টেবল থাকে, সেও একা ।

এমারজেন্সি সিচ্যুয়েশন ছাড়া তার ঘোরাঘুরির অনুমতি বাংলোর চারপাশে, আর কেবল উঁচুতিনদিক ঘেরা বারান্দা পর্যন্ত । পরপর দুদিন দেখার পর তিন দিনের দিন ইচ্ছে করে শোবার ঘরে কিছু জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেলাম ।

ফিরে এসে দেখি সেই একই ব্যাপার, যথাস্থানে জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখা আছে !

ভেবে ভেবে কিছু কূলকিনারা করতে না পেরে আমার চব্বিশ ঘণ্টার আরদালি-কাম-দেহরক্ষী সেই কনস্টেবলকেই ডাকলাম বারান্দায় । জিগ্যেস করলাম,

-‘শোন, রান্নার করার জন্য তুমি যে মেয়েমানুষটাকে ঠিক করে দিয়েছো, সে কি আমার শোয়ার ঘরে ঢোকে, ঝাড়পোঁছ করে ?’

-‘না সাব, ও তো চৌকা ছেড়ে কোথাও যায় না । হ্যাঁ, কভি কভি বারান্দায় জোর হাওয়াতে অনেক শুখা পাতা ধুল এসে গেলে ওকে আমি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে   বলি, কিন্তু আমি তো তখন ওর সাথে সাথেই থাকি সাব ।  কিউ সাব, কুছ খো গিয়া কেয়া সাব ?’

বললাম, ‘না না । আচ্ছা,  তুমি যাও ।’

স্যালুট করে তো সে চলে গেলো, বুঝলে ।

পরের দিন একটু বেলার দিকে আমি সোজা এসডিও যাদবের অফিসে ।

#

গুড মর্নিং টরনিং বলেই আমি আসল কথাটা পাড়লাম,

-‘স্যার, ওই যে জন পজারের বাংলো, মানে আমার কোয়ার্টারের গল্পটা সেদিন বলছিলেন না, সেটা তো সেদিন অধুরা রয়ে গিয়েছিলো ।’

যাদবজি আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

-‘কোই প্রবলেম ?’

আমি কদিনের এক্সপিরিয়েন্স চেপে গিয়ে বললাম,

-‘না না স্যার, এমনিই। কৌতূহল আর কি ! অবশ্য আপনি ব্যস্ত থাকলে, অন্য কোনদিন…’

বলে আমি উঠবার উদ্যোগ করতেই যাদবজি আমাকে হাত নেড়ে বসতে বলে বেল বাজিয়ে আরদালিকে ডেকে দু কাপ চা আর সেও-নিমকি দিতে বললেন ।

চা আর দুটো প্লেটে লোকাল ফেভারিট নমকিন এসে গেলো এক মিনিটেই ।

নরেশজি একমুঠো সেও-নিমকি মুখে পুরে শুরু করলেন,

-‘রণধীর, তুমি তো জানো পলাশীর যুদ্ধের বেশ আগে থেকেই অল্পশিক্ষিত মধ্যমেধার বহু ইংলিশম্যান ভাগ্য বদলাতে আমাদের দেশে এসেছে কয়েক দশক ধরে । কিছু লোক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার হয়েই থেকে গেছে, আর লোকাল মেয়েদের বিয়ে করে অ্যাংলো-ইনডিয়ান কম্যুনিটির জন্ম দিয়েছে । আর তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান, তারা বেশীর ভাগ  আফিম, চা, নীল, লবণ, বরফ, কাপড়  এইসবের ব্যবসা করে আর লোকাল লোকেদের সম্পদ শোষণ করে প্রচুর বড়লোক হয়ে দেশে ফিরে গেছে ।’

-‘ক্লাইভ, হেসটিংস, এরাই তো সব বড়ো বড়ো এগজ্যামপল স্যার ।’ আমি বললাম ।

-‘হ্যাঁ । জন পজার এইরকম একজন ইংলিশম্যান ছিল । নিশ্চয়ই ভালো এনটারপ্রুনার ছিল, কারণ শুনেছি, অনেকগুলো মাইকা খনির মালিক হয়েছিল । মনে করো,  স্বাধীনতার আগে, সেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, আমাদের এই অখ্যাত ঝুমরি তিলাইয়া গ্রামটা তখন দ্রুত ভারতের খনিজ পদার্থের মানচিত্রে উঠে আসছে ।তিলাইয়ার পাশে কোডারমা, ডোমচাঁচ-এমাইকা খনির নতুন  সাহেবী আর দেশী আধা-সাহেবী মালিকদের ভিড় জেঁকে বসছে।ঝুমরি তিলাইয়ার আশেপাশের খনি থেকে তোলা চাপ চাপ মাইকার চাঙ্গড় বস্তা বন্দী হয়ে ডোমচাঁচ কোডারমার নিলামের বাজারে চলে যাচ্ছে।বুঝলে রণধীর, আমি তো এই তিলাইয়ার ই পয়দাইশ, সারা জীবন কেটে গেলো এখানেই । কিশোর বয়সে দেখেছি,মাইকার ব্যবসা জোরদার হওয়ার পর তিলাইয়ার ধূসর ধুলোভরা রাস্তাগুলোর ধারেধারে এক নতুন ধরনের কাজ নিয়ে বসে থাকা দিন-রোজগারী লোকাল মানুষজনের ভিড় । তাদের দুপাশে দুটো করে বাঁশের পাতলা বাঁখারির খচিয়া ঝুড়ি থাকতো,আর হাতে একটা ধারালো ছুরি ! একদিকের ঝুড়ি থেকে অপরিস্কার মাইকার টুকরো তুলছে আর সেই টুকরোর চারপাশের ফাটাফুটো জায়গাগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে পরিষ্কার মাইকার টুকরো ওপাশের ঝুড়িতে ফেলছে ।ঝুড়ি পিছু ওজন করে হাতে হাতে মজুরীরপয়সা!নিজেরচোখেদেখেছি সেই সময়ে মাইকা ব্যবসার কল্যাণে অল্পবিত্ত মজদুর মানুষগুলোর লাইফস্টাইল কেমন ধীরে ধীরে বদলে গেলো । আর দেখেছি সেই মাইকার গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিলাইয়ার ধুলোভরা রাস্তা জ্যোৎস্নারাতে কেমন দিল চস্প হয়ে উঠতে । এখন আর সেসব নেই । খনিগুলোতে মাইকার ভাণ্ডার প্রায় শেষ আর মাইকা খনির ব্যবসাদারেরাও তাইউবে গেছে ।’

এসডিও নরেশ যাদব এতক্ষণ ধরে যেন একটা টাইম মেশিনে ঘুরে এসে থামলেন । আমি চুপচাপ, অপেক্ষা করছি, সিনিয়র অফিসারের তন্ময়তা ভাঙ্গাতে চাইলাম না ।

কয়েকমুহূর্ত পরে একটা বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেলে যাদবজি আবার শুরু করলেন,

-‘হ্যাঁ যা বলছিলাম । শুনেছি এই জন পজার কোডারমার খনি মালিকদের মধ্যমণি হয়ে মাইকার ব্যবসায় বিপুল পয়সা করেছিলো । প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে শহরের বাইরে নির্জন জায়গায় অনেকটা জমি কিনে ওই বাংলোটা বানায় । আর তারপর রাজার মতো থাকতে শুরু করে । এই পর্যন্ত তো ঠিক ছিল, কিন্তু শুনেছি খনির মেয়েমজুরদের নিয়ে ওর ছিল ভীষণ লালসা আর অত্যাচার । ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারতো না, অনেক কুলিকামিন গুমখুনও করেছিল নাকি । সেই পরাধীন সময়ে টাকা দিয়ে ইংরেজ পুলিশকর্তাদের আর তাদের ধামাধরা লোকাল পুলিশকে কিনে রেখে দিয়েছিলো । তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর আগে হঠাৎ একদিন নাকি বাংলো ফেলে রেখে সে দেশে ফিরে যায় । কোডারমায় জন পজারের গল্পটা তো  এখানেই শেষ । তবে ওই বাংলোতে…’

নরেশ যাদব হঠাৎ থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন ।

আমি তো গল্পের এই অংশটাতে ইন্টারেস্টেড ছিলাম বেশী ।

একটু আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, ‘তবে ওই বাংলোতে…কি স্যার ?’

যাদব তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না কিছু না, শিউশরন কীসব বলেছিল, ভুলেও গেছি । ও কে, তাহলে রণধীর ! কোনও সাহায্য লাগলে বোলো, হেজিটেট কোরো না । টেক কেয়ার, গুড ডে ।’

সিনিয়র অফিসারের সিগন্যালটা বুঝলাম, উনি আর কথা বলতে চাইছেন না ।

এসডিও-র সঙ্গে আমার এটা দ্বিতীয় সাক্ষাৎ, তাই আমিও আর কথা বাড়ালাম না ।

তবে বুঝলাম মানুষটা ভালো, মাঝে মাঝে ইমোশনাল কথাবার্তাও বলেন ।

ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে  গুড ডে বলে আমিও উঠে পড়লাম ।’

হুইস্কির গ্লাসে একটা বড়ো চুমুক দিয়ে চৌবেজি আবার শুরু করলেন,

‘এস ডি ও-র সঙ্গে বার্তালাপ করে তো বাংলোর রহস্যটা ভেদ হোল না, বুঝলে।

ভাবলাম, এবার আমার নিজের লাইনেরপুলিশি ইনভেস্টিগেশনের কায়দাটা কাজে লাগাতে হবে । সকালে আমার জীপটা এসে গেলে আমার আরদালি-কাম-কনস্টেবলটাকে ডেকে বললাম, আশেপাশের গ্রামগুলোর মধ্যেঘুরে ঘুরে সবথেকে যে বুঢঢালোককে পাবে তাকে বাংলোয় ডেকে নিয়ে আসতে ।

আধঘণ্টার মধ্যে বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম ।

দেখি মাথা চুল পুরো সাদা, ঘোলাটে চোখ, মুখে অজস্র বলিরেখা, এক দেহাতী বুড়ো আমার আরদালির সঙ্গে বারান্দায় উঠে এসেছে ।

আরদালির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল,

‘সাব, ড্রাইভার পাশের গ্রামে একটু খোঁজাখুঁজি করতে সকলে এই বুড়োর কথা বললো । তারপর এর কাছে যেতেই বুড়ো নিজেই বললো ওকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে ।’

আরদালিকে ইশারা করতে সে স্যালুট করে চলে গেলো ।

আপাতত ওর সামনে আমি আমার ইনভেস্টিগেশন চালাতে চাই না ।

ভেতরের ব্যাপারস্যাপার এখন কেউ যেন জানতে না পারে ।

আমি এবার বুড়োর দিকে চোখ ফেরালাম । নিতান্তই দেহাতী চেহারা, পরনে খাটো ধুতি আর মলিন ফতুয়া। কোনসময় শরীর বলিষ্ঠ ছিল, হাতদুটোর মাংসপেশিগুলো শুকনো কিন্তু প্রকট । দেখে তো আশির কাছাকাছি বয়স বলে মনে হচ্ছে । এ হয়তো জন পজারকে দেখেও থাকতে পারে ।

আমি মুখ খোলবার আগেই সে মাথায় হাতটা ঠেকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললো,

-‘গুড মর্নিং সাহেব, আই অ্যাম ছবিল রাম ।’

আমি ভীষণ অবাক, বললাম, ‘তুমি ইংরেজি বলতে পারো ?’

ছবিল রাম সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে বলল,

-‘কত্তো বরষকে বাদ আমি এই বাংলোর ভেতরে এলাম সাহেব । আগে ছাগল চরাতে এসে কতো সাল তকদূর থেকে দেখতাম আর মনের মধ্যে কতো কিসসা বুড়বুড়ি কাটতো । এখন তো বাইরে বেরোই না ।’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-‘দস বরষ আমি পজার সাহেবের খাস আরদালি হয়ে কাজ করেছি সাহেব, সেসব চালিস বরষ আগেকার কথা । আমি ওই আউটহাউসেই থাকতাম । দেখলাম কদিন আগে,একটা ট্রাক এলো ইধার, বাংলোর দিকে, ঘর কা সামান নিয়ে।’

বুড়ো থেমে গিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললো,

-‘তখনই জানি ঠিক একদিন এখানে আমার ডাক পড়বে ।’

আমি একই সঙ্গে অবাক আর খুশী হলাম…আমার ছানবিন-এর তীর তাহলে ঠিক জায়গায় লেগেছে, এবার বোধহয় রহস্যভেদ হতে পারে ।

মনের ভাব লুকিয়ে রেখে গম্ভীর গলায় বললাম,

-‘তুমি জানো, আমি তোমাকে কেন ডাকিয়ে এনেছি ?’

ঘোলাটে চোখে, ঘড়ঘড়ে গলায় ছবিল বললো,‘জানি সায়েব, আমি ছাড়া আর কে জানবে !’  ওর ঘসে যাওয়া চোখে যেন হাসির আভাস ।

আমার ইন্সটিঙ্কট বললো, লোকটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, একে ব্যাপারটা খুলে বলা যায় । আমি এবার ছদ্ম গাম্ভীর্য সরিয়ে রেখে বললাম,

-‘ছবিল, আমি যখন বাংলোয় থাকিনা তখন কেউ যেন আমার ঘরে আসে, সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে দেয় । একদিন তো আমার চায়ের কাপডিস বেডরুম থেকে সরিয়ে ধুয়ে কিচেনে রাখা ছিল ।’

-‘ও তো যমনা সাহেব, যমনার কাজ !’ ছবিল নিরুত্তাপ গলায় বলে উঠলো ।

-‘যমুনা! এই যমুনা কে ছবিল…কোথায় থাকে, কেন আসে, আমার আরদালিকে লুকিয়ে কেমন করে আসে ?’

পরপর প্রশ্নে আমার উৎকণ্ঠা আমার গলায় চলে এলো,  নিজেরই স্বর আমার কাছে কেমন যেন অচেনা লাগলো ।

আমার একটাও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছবিল যেন এক ঘোরের মধ্যে বারান্দা দিয়ে ধীরপায়ে বাংলোর পিছনের দিকে চলতে লাগলো, পেছনে পেছনে আমি ।

পেছনের দিকের বারান্দায় একটা তালাবন্ধ ঘরের সামনে পৌঁছে ছবিল রাম দাঁড়িয়ে গেলো স্থির । বন্ধ দরজার পাল্লায় একবার যেন গভীর মমতায় হাত বোলাল ।

তারপর মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খুব ধীরে ধীরে, প্রায় ফিসফিস করে বললো,

-‘যমনাএই ঘরে থাকতো সাহেব। এখনও আছে ।’

আমি ওর কথা শুনে স্তব্ধ, যেন কাঠ হয়ে গেলাম ।

বাইরের খটখটে রোদ । কিন্তু বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো । এ কী বলছে !

একবার ছবিলের  মুখের দিকে আর একবার তালাবন্ধ ঘরটার দিকে তাকাচ্ছি । বাংলোর গোটাতিনেক ঘর প্রথম থেকেই তালাবন্ধ পড়ে আছে ।

দরকার নেই বলে খোলার প্রয়োজন মনে করিনি । এ ঘরটা তার মধ্যে একটা । কোনরকমে সামলে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে আমি বললাম,

-‘কি আবোলতাবোল বকছো তুমি ! এখনও আছে…ও-ই কে এক যমুনা…এই বন্ধ ঘরের মধ্যে? এর মানেটা কি ছবিল ?’

ছবিল বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দূরের শুকনো রুক্ষ বন্ধ্যা মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত । তারপর ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায়বললো,

-‘সাহেব, ইউ আর এ গুড ম্যান । ব্রাহমণ আছেন। আপনার আরদালিকে জিগ্যেস করে জেনেছি, আপনি পূজাপাঠ করেন, দারু নেন না, মন্দির মে ভি যান । আপনার কথা শুনে বুঝতে পারছি যমনা আপনাকে পসন্দ করেছে, ও আপনার কোনও ক্ষতি করবে না । আপনি এখানে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারবেন, যমনা আপনার লাইফে কুছু হরকত, ঝামেলা করবে না।’

-‘কিন্তু…’

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ছবিল বলতে লাগলো,

-‘কিন্তু দো সাল আগে যে সাহেব এখানে এসেছিলো, সে ইনসান ভালো ছিল না । এ বাংলোতে বাসা লাগিয়ে পরের দিনই কয়েকজন দেহাতি লোককে ধরে এনে বিনা কসুর কতো পিটাই করলো, পুছিয়ে মাত ।সবকা সামনে বেধড়ক পিটলো, উনকা পরিবার দেখলো, যমনাভি দেখলো । বাস, ওর বহোত গুসসা হয়ে গেলো । এইসা আনসান ঝামেলা শুরু করলো যে  তিনদিনের পর ফ্যামিলি নিয়ে হি লেফট দ্য বাংলো । এর পর এখানে কোই নেহি আয়া। এখন আপনি আসলেন ।’

রণধীর চৌবে বোধহয় দম নেওয়ার জন্য থামলেন ।

তারপর নিজের গেলাসে হুইস্কি  ভরে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন,

-‘বুঝলে নীরজ, ততক্ষণে আমি একটু ধাতস্থ হয়েছি । সন্তর্পণে বললাম,

-‘ছবিল, তুমি আমাকে বলবে এই যমুনাকে, আর জন পজারের সঙ্গেই বা তার কিসের সম্পর্ক ?’

ছবিল আমার দিকে ঘোলাটে চোখ তুলে তাকালো । তারপর ধীরে ধীরে বারান্দার মেঝেতে কষ্ট করে বসে পড়লো । আমি দাঁড়িয়েই রইলাম ওর সামনে ।

ছবিল বলতে লাগলো,

-‘সাহেব, আপনার এই বাংলোতেএক হপ্তাসে জ্যাদা বাস হয়ে গেছে । পজার সায়েবের মেয়েছেলের ওপর জবরদস্তি আর অত্যাচারের কহানি আপনি নিশ্চয়ই এর মধ্যে শুনে ফেলেছেন । রাতের বেলা মাইকা মাইনের কুলিলাইন থেকে ওর পোষা গুন্ডারা মেয়ে তুলে আনতো, প্রতি রাতে নতুন নতুন মেয়ে । পরের দিন সকাল বেলায় দালাল এসে টাকা আর মেয়ে নিয়ে চলে যেতো । এ জায়গা তখন কতো যে নির্জন ছিল সে কি আর বলবো, এক মাইলের মধ্যে কোনও বসতি ছিল না । বাংলোর চারপাশে তখন উঁচু পাঁচিল ছিল, এখনকার মতো বাহারি দিওয়ার নয়, আর ছিল একটা লোহার পাতের শক্তপোক্ত গেট । বাইরে অবাধে ঘুরতো বুনো শূয়োর আর শেয়াল । অভাগী মেয়েগুলোর চিৎকার ওই উঁচু পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে বাইরের হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো, শহরে পৌঁছতো না ।’

আমি বললাম, ‘কিন্তু কেউ কিছু বলতো না ?’

-‘কে কি বলবে সাহেব ! সেকালে সফেদ চামড়ি কা মতলবই অলগ ছিল । হাটটাকাট্টাজোয়ান মর্দ ছিলামআমি,  সব দেখতাম, কিন্তু কোনদিন কিছু বলবার সাহস জোটাতে পারিনি সাহেব । টাকার থলি দিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করে রেখেছিলো পজার সাহেব ।’

#

-‘তারপর, ছবিল ?’

-‘তারপর একরাতে দালাল নিয়ে এলো যমনাকামিনকে । বাদামি রঙের গ্রানিট  পাথরে খোদাই-করা  মেয়েছেলে দেখেছেন সাহেব ? ওইসা জলুস ছিল তার চামড়ায়, মক্ষি যেন পিছলে পড়ে যাবে । আর তেমনি ছিল শরীরের বাঁধুনি, হুরী পরী  জ্যায়সা ।কি যে হলো পজার সাহেবের, নিজের নিয়ম  নিজেই ভেঙ্গে পরের দিন সকালেযমনাকে ছাড়লেন না । পরের দিন না । পরের দিনও না । দিনের বেলায়, সকাল দশটার সময়ওই ঘরটাতে যমনাকে বন্ধ করে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতেন খনিতে, ঘোড়ায় চেপে । আমার ওপর হুকুম ছিল জানলা দিয়ে ওকে খাবার দেওয়ার । দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে যমনার মরদ আসতে লাগলো, জানলার দুপাশে দুজনের সে যে কি রোনাধোনা, কি আর বলবো আপনাকে, আমার খুব কষ্ট হতো । কিন্তু কিছু করার নেই । হাতে রাইফেল নিয়ে রাতে সাহেব তালা খুলে নিজে যমনাকে বার করে আনতেন , আবার সকালে ওই ঘরটাতে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দিতেন।’

চৌবেজি থামতেই আমরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম,

-‘তারপর, কতদিন এভাবে চললো চৌবেজি ?’

রণধীর চৌবেজির চোখ এখন স্কচের প্রভাবে কিছুটা লাল হয়েছে । আমাদের প্রশ্নের উত্তরে ঈষৎ জড়ানো গলায় বললেন,

-‘আমিও ছবিলকে সেই প্রশ্ন করেছিলাম । ছবিল বলতে লাগলো আবার,

-‘সাহেব, চালিস সালের বেশী হয়ে গেছে, আজও সাফ সাফ মনে আছে, সেদিনটা ছিল রবিবার, ছুটির দিন। তখন বিকেলের আলো পড়ে এসেছে, আকাশে একটা কমলা রঙের নরম সূর্য । একটু আগে পজার সাহেব তালা খুলে যমনাকে চানের ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন । নিজে একটা ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতল খুলে বারান্দায় চেয়ারে বসে সিধা সিধা বোতল থেকে চুমুক দিচ্ছেন । পাশের টেবিলে রাইফেলটা রাখা । আমি তখন খাওয়ার টেবিলে কিছু একটা করছিলাম । হঠাৎ বিজলির মতো আমার সামনে দিয়ে হলুদ শাড়ী পড়া একটা মূর্তি  তীরবেগে বেরিয়ে গেলো । আমরা দুজনে কিছু বোঝার আগেই যমনা গেট খুলে একবারে বাইরের রাস্তায় । তারপরেই একটা চিৎকার দিয়ে পজার সাহেব চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন, হাতে রাইফেলটা নিয়ে । আমিও ছুটে বেরিয়ে এলাম । দুজনে গেটের বাইরে এসে দেখি যমনা ছুটে চলে যাচ্ছে শহরের দিকে আর পিছনে ফিরে ফিরে দেখছে। কুলিকামিন মানুষ, হাতে পায়ে শক্তি আছে, ছুটতে পারে ভালো । সাহেব ছাড়বে কেন, সেও বন্দুক উঁচিয়ে ছুট লাগালো, পেছনে পেছনে আমি । দু তিন মিনিটের মধ্যে যমনাআর সাহেবের মধ্যে দুরি কমে আসতে লাগলো । বাংলোর রাস্তায় আসার মাইলখানেক আগে একটা মাঝারি সাইজের ডোবা দেখেছেন তো সাহেব, ওটা সেকালে ছিল একটা বিশাল খাদান দীঘি। রাস্তা তৈরির সময় ওটা  অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে ।যমনা সেই দীঘির পাড় দিয়ে ছুটছে, ছুটছে, এই সময় পজার সাহেব রাইফেল  নিশানা করলেন । প্রচণ্ড শব্দে গুলি ছুটলো । তাকতবার  রাইফেল ছিল সেটা । তার  তাকত আপনাকে কি আর বলবো সাহেব । চোখের সামনে দেখলাম গুলি লাগতেই যমনার শরীরটা শূন্যে লাফিয়ে উঠে জলের ভেতর পড়ে গেলো । যে রাইফেল দিয়ে শনিবার রাতে বুনো শুয়োর মেরে রবিবার বন্ধুদের সাথে ভোজ মানাতেন, সেই রাইফেল দিয়ে পজার সাহেব আমার চোখের সামনে যমনাকে গুলি করে মেরে ফেললেন, আমি কিছু করতে পারলাম না । হাঁফাতে হাঁফাতে আমি যখন দীঘির পাড়ে পৌঁছলাম, তখন খাদান দীঘির জল শান্ত হয়ে গেছে, টলটল করছে, জলের বুকে সূর্যের আলোর ছটা । আর জলের কিনারে একটা হলুদ শাড়ীর আঁচল ভাসছে, তার চারপাশের জলের রঙে লাল আভা ।চারদিক একেবারে সুনসান, কেউ কোথাও নেই । কেবল আশেপাশের জংলী গাছগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরব সাক্ষী হয়ে ।পজার সাহেব দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, বিচ, তারপরে রাইফেলের নলে একটা ফুঁ দিয়ে বাংলোর দিকে ফিরে চলে গেলেন ।’

রণধীর চৌবে কথা থামিয়ে চুপ করে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত ।

আমরা সকলে চুপ । ঘর নিস্তব্ধ, কেবল বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ ।

সুশীল আস্তে আস্তে বলে উঠলো, ‘তারপর কি হলো ?’

চৌবেজি একবার ওর দিকে তাকালেন তারপর বললেন,

-‘এতদিন পরেও মনে আছে, অতোটা একটানা বলে ছবিল চুপ করে বসেছিল বেশ কিছুক্ষণ, যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে । ওর ঘাড় ঝুঁকে পড়ে ছিল মাটির দিকে ।  আমিও চুপ হয়ে গিয়েছিলাম । কিছুক্ষণ পরে আমি নাম ধরে ডাকতে ছবিল ঘাড় তুলে বলতে শুরু করলো আবার,

-‘তারপর পজার সাহেব ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে গেলো শহরের দিকে, ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এলেন । বেশী রাতে দুটো লোক এসে সাহেবের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে টাকা নিয়ে চলে গেলো দেখেছিলাম । যমনার শরীরটা দীঘি থেকে তুলে নিয়ে তারা যে কি করেছিলো তা আর জানতে পারিনি । যমনার মতো পরীর এই ধরতি ছেড়ে  চলে যাওয়ার দুঃখেই বোধহয় পরের দিন আকাশ ভেঙ্গে অসময়ে বারিষ নেমেছিল সাহেব । বৃষ্টি থামতেইপজার সাহেব শহরে বেরিয়ে গেলেন । সাহেবের ঘোড়া চোখের আড়ালে যেতেই আমিও বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলের দিকে, যদি কোথাও পোড়া ছাই দেখতে পাই বা সদ্য খোঁড়াকাঁচামাটির নিশান। কিচ্ছু দেখতে পাইনি । বারিষযমনার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে দিয়েছিলো সাহেব।’

ছবিল একটু থামতেই আমি বলে উঠলাম, তাহলে, ছবিল, তুমি যে বলছো….?’

আমি থেমে গেলাম ।

ছবিল বোধহয় আমার না-বলা কথাটা বুঝতে পারলো ।

একটু হেসে ওঠবার চেষ্টা করতেই আমি পদমর্যাদা ভুলে ওর হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলাম । ছবিল উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো,

-‘থ্যাঙ্ক ইউ সাহেব । আমাকে ধরে তোলার জন্য তো জরুর, ঔরএত্ত বরষ বাদে  একজন গুড ম্যানের কাছে এই কহানি বলে আমাকে হালকা করার জন্য ভি ।’

তারপর বন্ধ দরজাটায় আবার একটু হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসির ভাব করে বললো,

-‘আমার সেদিন ভুল হয়েছিলো সাহেব । আমি যমনার শরীরের নিশান খুঁজছিলাম, লেকিন ওর আতমাটার খেয়াল করিনি । সেটা যে বডি ছোড়নে কা বাদ এই দরজার পেছনে, এই বন্ধ ঘরের মধ্যে ঘর খুঁজে নিয়েছিল সেটা তখন বুঝতে পারিনি ।বুঝতে পারলাম, আমরা দুজনেই,  দুদিন পর থেকেই । পজার সাহেবের জিনা হারাম করে দিলো যমনা। ব্রেকফাস্টের কফিতে নমক, লাঞ্চের মাংসের কারিতে পানি, চানের গরম জল বরফ ঠাণ্ডা । প্রথম প্রথম আমি খুব গালি খেলাম, তারপর সাহেব বুঝতে পারলো কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে বাংলোতে । জ্যাদা সে জ্যাদা আমি যখন রাতে আউটহাউসে থাকি তখন যা কাণ্ড হতে লাগলো, তার জন্য তো আমাকে গালি দেওয়া চলে না । আমার উপর হুকম  হয়ে গেলো রাতে সাহেবের পাশের ঘরে থাকার জন্য । তবু রাতে সাহেবের গায়ের রেজাই উঠে ম্যান্টলপিসের ওপর চলে যেতে লাগলো । বিছানার পাশের টেবিলে  রাখা পানির গ্লাস রোজ উলটে যেতে লাগলো বিছানার ওপর । মাঝ রাতে শোয়ার ঘরের লাইট জ্বলে উঠছে, বেজে উঠছে সাহেবের পেয়ারের গ্রামোফোন ।পজার সাহেব রাতে ঘুমোতে পারেন না, অত বড়ো চেহারাটার মাংস ঝরে গেলো চার পাঁচ দিনের মধ্যেই, লাল চোখের কোণে কালি, পুরো পাগল পাগল অবস্থা । এর মধ্যে মেয়ে সাপ্লাইয়ের দালাল একদিন এসে বন্দুকের গুলির হুমকিতে পালিয়ে বাঁচল । সেদিনই  দুপুরে আবার কি করে যেন সাহেবের ঘোড়াটা শক্ত বাঁধন ছিঁড়ে আর আস্তাবলের বাঁখারির আগড় খুলে ধুধু মাঠে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলো । এইসব প্রতিদিন ঘটছেআর আমি, নিষ্পাপ যমনার ওপর অত্যাচার আর তার খুনের একমাত্র সাক্ষী, সেই আমি তখন অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছি,এক নিষ্ঠুর খুনির ওপর এক বিদেহী আতমার প্রতিশোধ নেওয়ার অনোখা অন্দাজ ।

#

ঘোড়া হারিয়ে যাওয়ার পরদিন সকালে পজার সাহেব ঠিক করলেন হেঁটেই তিন মাইল দূরের কোডারমা শহরে যাবেন । রাইফেল তো আছেই,বাক্স থেকে বড়ো ছাতা বেরোল, আমার জন্য গুপ্তিলাঠি বেরোল, হুকম হলো বাংলো পুরো তালা বন্ধ করে আমাকেও যেতে হবে সঙ্গে । সাহেব চানের ঘরে ঢুকেছেন, অনেকদিন পরে দাড়ি কামিয়ে ফিটফাট হয়ে শহরে যাওয়ার প্ল্যান করেছেন । আমি ব্রেকফাস্টের টেবিল সাজাচ্ছি, এমন সময়ে শুনলাম সাহেবের এক বিকট চিৎকার । দৌড়ে গিয়ে দেখি সাহেব চানের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন, পরনে আন্ডারওয়্যার, হাতের ক্ষুর কাঁপছে আর সাহেবের গাল ভেসে যাচ্ছে রক্তে । ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাহেব যা বললেনতাতে বুঝলাম, দাড়ি কামাবার সময় সাহেবের হাতটা ধরে কে যেন জোর করে ক্ষুরটা গালের ওপরে চেপে বসিয়ে দিয়েছে । বাংলো ছেড়ে পজার সাহেব সেদিনই সোজা ডোমচাঁচের  ক্লাবহাউসে গিয়ে উঠলেন । তার আগে আমার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার কসম খাওয়ালেন গলায় রাইফেল ঠেকিয়ে । দুদিন বাদে ট্রান্সপোর্ট-এর দুটো লরি এসে বাংলোর সব মালপত্র তুলে নিয়ে চলে গেলো । শুনলাম সব জিনিস এককাট্টা সাহেব বেচে দিয়েছেন । বাংলোটা বেচার সময় পাননি কারণ শুনেছিলাম ক্লাবে থাকার সময়েও ওনার কিছু অসুবিধা হয়েছিলো, তাই তাড়াতাড়ি সাহেব কোলকাতায় চলে গিয়েছেন । অনেক দিন পরে শুনেছিলাম তিনি জাহাজে করে দেশে ফিরে গিয়েছেন ।’

ছবিল রাম একটু থেমে বন্ধ দরজার পাল্লায় হাত রেখে আবার বললো,

‘জন পজার সাহেব তো দেশে ফিরে গেলেন আর যমনাবাঈকে রেখে গেলেন এই বন্ধ দরজার পেছনে । কা জানে কতদিনে মুক্তি হবে ওই ভটকতা হুয়া আতমার ।’

আমি একবার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলেই ফেললাম,

‘ছবিল, তোমার মনে হয় সত্যিই যমুনার আত্মা এই বাংলোতে আছে, এই বন্ধ ঘরে ? তুমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করো ?’

ছবিল আমার কথা শুনে কেমন করে হাসলো । তারপর ধীরে ধীরে বাংলোর সামনের দিকে চলতে চলতে বললো,

-‘সাহেব, আপলোগ কতো পঢ়ালিখা করেছেন । কতো দেশ ভি দেখেছেন ।আপনি আমায় বলুন তো কে আপনার ঘরের কাজগুলো করে দিচ্ছে ? আপনার সুবিধা করে দিয়ে কে এই বাংলোতে আপনার বাসকে আসান করছে ?  আপনার আগে ওই যে সাহেব ছিলেন তাকে কে পরেশান করে ভাগালো ?’

আমি চুপ করে থাকলাম।

ওর প্রশ্নেরকোনও যুক্তিগ্রাহ্য জবাব তো নেই আমার কাছে ।

ছবিল আমার দিকে একবার পিছন ফিরে দেখে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললো,

-‘আমি জানি আপনি জবাব দিতে পারবেন না । কাহে কি এর জবাব আমাদের কাছে নেই । আসলে কি জানেন সাহেব,  জিন্দা মানুষের থেকে তার আতমা জ্যাদা তাকত রাখে, সোচতা ভি হ্যায় জ্যাদা । আমি তো ঠিক জানি আপনার কাছে আমি যে এখন ওর কহানি বলে দিয়েছি, এটা দেখেশুনে ও বহোত খুশ হয়েছে, হাঁ !’

আমি তো চমকে উঠলাম, এ বুড়ো বলে কি !

কোনোরকমে বললাম, ‘এটা দেখেশুনে’মানে…কি বলতে চাইছো ছবিল !’

ছবিল বারান্দার সিঁড়ির রেলিং ধরে নামছিল । দাঁড়িয়ে ঘুরে গিয়ে হেসে বললো,

-‘যমনাআমাদের সঙ্গে সবসময়েই ছিল, এখনও আছে । কিন্তু আপনি বেফিকর থাকুন সাহেব, ও আপনার কোন ক্ষতি করবে না, আমার বিশ্বাস, আপনার কোন ক্ষতি ও  হতেও দেবে না ।’

এই বলে ছবিল রাম সেলাম করে ধীরে ধীরে বাংলোর গেটের বাইরে চলে গেলো ।

আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।’

রণধীর চৌবে থামলেন ।

গল্পের ঘটনাক্রমে আমরা নির্বাক হয়ে গেছি ।

কয়েক মুহূর্ত পড়ে আমি প্রশ্ন করলাম,

-‘তারপর চৌবেজি, আপনি কি করলেন ? আপনি কি ওই…’

-‘বাংলোতে থেকে গেলাম…হ্যাঁ, পাক্কা দুবছর । সেই দিন থেকে এক অদৃশ্য আত্মার সঙ্গে সহবাস চললো আমারনীরজ । তাকে তো চর্মচক্ষে দেখিনি কোনদিন ।তবে অনেক পরে তার কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম । আমার সাক্ষাতেসে ছিল লজ্জাবতী,আমার

সামনে সে কখনও তার কোনওচমৎকার দেখায়নি । কিন্তু ওই দুবছরে অণুক্ষণ তার অস্তিত্ব অনুভব করেছি । দেহাতি মেয়েদের বিরাট ঘোমটার মতো নিজেকে সে ঢেকে রেখেছিলো আমার থেকে । অথচ বাংলোয় আমার অনুপস্থিতিতে সর্বত্র তার আনাগোনা, আমার প্রতিটি স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি তার অখণ্ড নজর ।ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠলো আমার ব্যচিলর জীবনের গোপন এক অদৃশ্য কায়াহীন সঙ্গিনী, বাইরের পৃথিবীর কাছে তার অস্তিত্ব আমি অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখে দিলাম ।’

রণধীর চৌবেজি থামলেন ।

আমার মনে চমক আর ধাক্কা একসঙ্গে  দিলো তাঁর একটা বাক্য…’কণ্ঠস্বর শুনেছি’!

এটা কি বললেন চৌবেজি !

আমি ওঁকে জিগ্যেস করতে যাবো এমন সময় সুশীল বলে উঠলো,

‘আর ওই ছবিল রাম ? তার সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি ?’

চৌবেজির ভালো নেশা হয়েছে মনে হল । জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন,

-‘নাহ। সেও বড়ো দুঃখের কথা । মাসখানেক পরেই দেওয়ালীর তেওহার এলো ।  আমি পালামউ-র বাড়িতেছুটিতে চলে যাবো, যাওয়ার আগের দিন কিছু মিষ্টি, একটা ধুতি  আর শখানেক টাকা দিয়ে আরদালিকে পাঠালাম ছবিল রামের  কাছে । কিছুক্ষণ পরে সে জিনিসপত্র নিয়ে  ফিরে এলো, বললো দিন দশেক আগেই নাকি ছবিল রাম মারা গেছে । খবরটা পেয়ে খারাপ লেগেছিল খুব, কে জানে আমাকে যমনার কহানি জানাবার জন্যেই বোধহয় লোকটা বেঁচে ছিল।কিন্তু ওকে আমি ভুলিনি । আমার কাছে যে চব্বিশঘণ্টা কাজের লোক আছে,বিরজু, তোমরা তাকে দেখেছো, সে হচ্ছে ছবিলের নাতি, ছোট্ট শিশু তখন । পরে আমি ওকে ওর বাবা মার কাছ থেকে আনিয়ে নিয়েছিলাম । আমার কাছেই আছে তার পর থেকে।’

চৌবেজি থেমে গেলেন ।

তিনজনেই চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ । রণধীর চৌবে আবার গ্লাস ভরে নিলেন ।

তারপর আমাদের দিকে ইঙ্গিত করলেন । আমাদের আজকের কোটা তো শেষ ।

আমি হাতটা নেড়ে বারণ করে দিয়ে জিগ্যেস করলাম,

-‘চৌবেজি আপনি দুবছরের কথা বললেন । দুবছর বাদে আপনার কি কোডারমা থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেলো ?’

চৌবেজির বেশ নেশা হয়েছে । লাল চোখদুটো তুলে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন, যেন আমার প্রশ্নটা বোঝার চেষ্টা করছেন । তারপর থেমে থেমে,  জড়িয়ে জড়িয়ে, যেন কষ্ট করে শব্দগুলো পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে বার করছেন, বলতে লাগলেন,

-‘ না তো । দুবছর পরে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো । পাটনা থেকে বিয়ে করে বৌকে নিয়েপালামউ চলে এলাম । আমার সুহাগ রাত । রাত বারোটা, নীচের হলঘরের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের ঢং ঢং আওয়াজ আসছে । বউয়ের সঙ্গে ভালো করে ভাবসাব হয়নি তখনও। ঘরের ফোনটা বেজে উঠলো । পুলিশের বাড়ির ফোন, তুলতে তো হবেই । ফোন তুলে দেখি, কোনও আওয়াজ নেই, যেন ডেড লাইন । হ্যান্ডসেটটা নামিয়ে রাখতে যাবো এমন সময় ফোনে একটা হালকা আওয়াজ ভেসে এলো, যেন অনেক দূ-উ-র থেকে আসছে, একটা মেয়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে  কান্নার আওয়াজ ।’

রণধীর চৌবে এক মুহূর্তের জন্য থেমে হুইস্কিতে একটা লম্বা চুমুক দিলেন । তাঁর  চোখ রক্তবর্ণ, গলার আওয়াজ জড়ানো ।

-‘নীরজ, সুশীল, চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, আজও সেই কান্নার আওয়াজ আমার মনের মধ্যে শুনতে পাই…যমুনার অপার্থিব কণ্ঠস্বর, এক বিদেহী আত্মার ডুকরানো কান্না। আমার মনে হোল আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো । থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আমি ফোনটা রেখে স্থান কাল  ভুলে নতুন বউয়ের বিভ্রান্ত চোখের সামনে দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে গেলাম । পুরো বাড়িটা সারাদিনের উৎসবের ক্লান্তিতে নিঝুম হয়ে আছে ।আমার দাদার হুইস্কি কোথায় রাখা থাকে জানতাম আমি । সেই আমার প্রথম হুইস্কির রাত সুশীল, প্রথম আর দীর্ঘতম রাত । বেশ কিছুক্ষণ পরে টলতে টলতে ওপরে ফিরে এসে দেখি নতুন বৌ অপেক্ষায় থেকে থেকে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে । আমার সুহাগ রাত শেষ হয়ে গেছে ।’

চৌবেজি একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে থেমে গেলেন ।

আমি বলে উঠলাম, ‘সে কি !’

রণধীর চৌবে ম্লান হাসলেন । তারপর থেমে থেমে জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন,

-‘সাতদিন পরে ছুটি শেষ করে জন পজারের বাংলোয় ফিরে এলাম একাই । অফিস যাবার আগে বিছানার চাদর অবিন্যস্ত, জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেলাম । অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি সব কিছু একই জায়গায় পড়ে আছে । প্রবল অভিমান করে আমার অদৃশ্য ছায়াসঙ্গিনী আমাকে ছেড়ে, হয়তো বা জন পজারের বাংলো ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে গেছে ।’

চৌবেজি আবার এক মুহূর্ত থেমে ঘড়ঘড়ে স্বরে বললেন,

‘যমুনার  আত্মার মুক্তি হল কিনা জানতে পারলাম না, কিন্তু সেদিনই অফিসে বলে দিলাম শহরে একটা বাড়ি খুঁজতে । দুবছর পরে জন পজারের বাংলো থেকে আমার বাস উঠে গেলো । আর কোনদিন ওদিকে যাইনি ।’

রণধীর চৌবের কথা জড়াতে জড়াতে থেমে গেলো ।

আমরা দুজনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করছি ।

এমন সময় খুব মৃদু নাকডাকার আওয়াজে সচকিত হয়ে দেখি, রণধীর চৌবে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাঁর মাথা  সোফার পিছনের গদির ওপর হেলে পড়েছে ।

বিরজুকে, ছবিল রামের নাতিকে, ডেকে দিয়ে আমরা দুজনে নিঃশব্দে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম ।

#

এখন বৃষ্টি থেমে গেছে ।রাত দশটা প্রায় বাজে ।

বৃষ্টিস্নাত পাটনার রাস্তায় এখন গাড়িঘোড়া প্রায় নেই ।

সুশীল নিঃশব্দে গাড়ি চালাচ্ছে । আমিও চুপ ।

মনে হচ্ছে রণধীর চৌবের গল্পের অভিঘাতে আমার দুজনেই আক্রান্ত ।

আমার বাড়ি এসে গেলো ।

গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে বললাম,

‘সুশীল, আজকের কহানিটা শুনে কি মনে হলো তোমার ? বিদেহী আত্মার জাগতিক কাজকর্ম, তার কণ্ঠস্বর ? তুমি কি এটা বিশ্বাস…’

সুশীল গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে শান্ত গম্ভীর স্বরে বললো,

-‘জ্যাক ড্যানিয়েলস !’

-‘সে আবার কে ! আমি চৌবেজির যমুনার কথা বলছি !’

সুশীল হেসে বললো, ‘এইটা তোমার দোষ নীরজ ! পরস্মৈপদী দুটো পেগ উড়িয়ে দিলে, অথচ বোতল লেবেল কিছুই খেয়াল করলে না ! আজ যেটা আমরা দুজনে খেলাম, চৌবেজি খেলেন, ওটা অত্যন্ত দামী স্কচ, জ্যাক ড্যানিয়েলস…ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ইন মার্কেট ! চৌবেজি কটা পেগ খেয়েছিলেন আর ওনার পেগের সাইজ খেয়াল করেছিলে ? স-অ-ব ছিল ডবল পাতিয়ালা…ওয়ান পয়েন্ট টু লিটারের বোতল তো প্রায় উনিই শেষ করলেন ! তাই বলছিলাম,রণধীর চৌবে নয়, জ্যাক ড্যানিয়েলস-ই হচ্ছে আজ সন্ধ্যের আসল গল্পকার । আর বেশী ভেবো না হে, যাও, ভাবীজি ইন্তেজার মে হ্যায়, ঘরে গিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ো । গুড নাইট !’

সুশীল গাড়ির ইঞ্জিনে স্টার্ট দিলো ।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]   

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ