25 Sep

মুখোশ

লিখেছেন:শুভ্রজিৎ মৈত্র


মেয়ের সামনে মাধ্যমিক। সারাজীবন অন্য বাবাদের গালাগাল করে এসে এখন আমি সেই রকম মেয়ের বাবা যাদের আমি গালাগাল করতাম। এগারোজন প্রাইভেট টিচার। আমার আর তার মায়ের কাছে প্রাইভেট টিচারের রুটিন আছে। বাংলার দুজন টিচার একজন ব্যাকরণ বিশারদ অন্য জন সাহিত্য। সকালে উঠেই আমাদের কাজ মেয়েকে তার রুটিন বুঝিয়ে দেওয়া। বিকেলে পরপর দুটো টিউশন থাকে। বাড়ি আসার পর্যন্ত সুযোগ নেই আমার কাজ টিফিন নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক টিচার থেকে অন্য টিচারে কাছে নিয়ে যাই আবার বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসি। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে বাকি বাবাদের সাথে আলোচনা করে বেশ বুঝতে পারি আমি বাজে বাবা। বাকিদের শেষ দশ বছরের প্রশ্ন মুখস্থ আর আমি সিলেবাস অবধি মুখস্থ করে উঠতে পারিনি।

যাই হোক গুগল আর ইউটিউব দেখে মেয়েকে সাহায্য করার চেষ্টা করি। মেয়ে যদি কোন কাজ আমাকে বা তার মা কে দেয় আমাদের সেটাই প্রথম পায়রিটি। “বাবা, মুখোশ নিয়ে একটা রচনা লিখে দিও তো।” মেয়ের হাতে বেশি সময় নেই শুধু এইটুকু হুকুমই যথেষ্ট।

আমার রিসার্চ শুরু হয়ে গেল। গুগল, ইউটিউব, গুগল ট্রান্সলেটর, কাজ করতে শুরু করলো। প্রথমেই কয়েকটা ভাগ করে নিলাম ভূমিকা, মুখোশের ব্যবহার, দেশ বিদেশের মুখোশ, বিভিন্ন শিল্পে মুখোশের ব্যবহার, মুখোশ নিয়ে ব্যবসা, উপসংহার। পুরুলিয়ার ছৌ থেকে কেরালার কথাকলি, আফ্রিকার আদিবাসীদের নাচ থেকে বিদেশের ভুত কিছুই বাদ রাখলাম না। শেষে অভ্র স্পেল চেকার দিয়ে টেস্ট করে মেয়ের হাতে জমা দিলাম। রচনাটি বারবার পড়ে মনে হয়েছিল ঐ বাবাগুলো এই কোয়ালিটির রচনা লিখতে পারবে না।

সকাল সকাল মনটা বেশ ভালোই আছে। সারা পৃথিবীর মুখোশের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে কৃষ্ণদার ফোন রবিবার বিকেলে কি করছিস? কৃষ্ণদা আমাকে খুব ভালোবাসে। তার সুবাদে শ্রীরামপুরের বুদ্ধিজীবী সমাজে আমার একটা পরিচিতি আছে। লেখক শিল্পী মানুষেরা সারারণতঃ একটু আত্মভোলা হয়। ওনাদের অনুষ্ঠানে একটু খেটেখুটে দিই। ভালোই লাগে। বেশির ভাগই চেনে, যারা চেনে না তারা কিছু হুকুম করে, তা মেনে নিই। সিঙ্গারা, চা, হারমোনিয়াম,  তবলা এগিয়ে দেবার কাজ আমি হাসিমুখেই করি। এই সুবাদে দু একবার মঞ্চে ওঠারও সুযোগ হয়।

কৃষ্ণদাকে জিজ্ঞাসা করলাম- কেন?

– শোন, এবার তোকে একটা কাজ দেবো যেটা একবগ্গা কাজ। এদিক ওদিক করা চলবে না। অনেক কষ্টে কবি বিজয় আচার্যকে রাজি করিয়েছি আমাদের কবি সম্মেলনে আসার জন্য। উনি রাজি হয়েছেন তার থেকেও বড় কথা বেশ কিছু অনামী কবিদের কবিতা শুনবেন বলেছেন। তাই তোর কাজ ওনাকে বেনিটির মোড় থেকে টাউন হল অবধি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে আসার। তোর ছবি ওনাকে পাঠিয়ে দেবো। উনি যেখানে যেখানে যাবেন তুই ওনার সাথে থাকবি। বিজয় আচার্যকে চিনিস তো?

– চিনবো না কেন? মাথার সামনে দিকে টাক, লম্বা চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সম্ভবত এখন জেলের কয়েদীদের খাবার কোয়ালিটি দেখার সরকারী কমিটিতে আছেন।

– ঠিক ধরেছিস, মেজাজি মানুষ, একটু সামলে নিবি। উনি বলেছেন প্রথমেই এসেই মঞ্চে উঠে যাবেন। তাই ঠিক করেছি বেনেটির মোড়ে গাড়িতেই ওনাদের হাতে একটা শুখনো টিফিন ধরিয়ে দেবো। গাড়িতেই খেতে খেতে আসবেন। যদি বাথরুমে যেতে চায় প্রথমেই গ্রিনরুমে নিয়ে যাবি নাহলে মঞ্চে উঠিয়ে দিবি। ওখানেই গলা ভেজাবার কিছু দিয়ে দেবো।

– তারপর?

– তারপর সঞ্চালকের কাজ। যা হয় হবে। উনি যখন মঞ্চ থেকে নামবেন সোজা চেয়ারম্যানের ঘরে নিয়ে যাবি। চেয়ারম্যানকে বলা আছে। কিছু টিফিন করিয়ে দিতে হবে। একটা প্যাকেটও দেবার আছে।

– উনি টাকা নেন?

– নেয় তো বটেই। আসলে বলে গাড়িভাড়া। ক টাকা গাড়ি ভাড়া হয় জানি না। কাউকে বলিস না, এটা তোর আর আমার ব্যাপার।

বাড়িতে বলে দিলাম সামনের রবিবার মানে পরশু আমি নেই। মেয়ের মা চেঁচাতে লাগলো, মেয়ের টিউশনির কি হবে? আমি আরও গম্ভীর ভাবে বললাম, যা হয় হবে।

রবিবার বিকেল বেলায় বেশ সেজে গুজে মোটরবাইকটা নিয়েই চলে গেলাম টাউন হলে। সময় মতো আমি বেনেটির মোড়ে চলে গেলাম। আমাকে কৃষ্ণদা বলে দিয়েছে পাঁচটা বলেছে কিন্তু দেখিস ছটা বাজাবে। ঠিক আছে বেনিটির মোড়ে বসে বসে ফেসবুক করা যাবে। তিন প্যাকেট টিফিন সাথে করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওনাকে আমার গুগল লাইভ লোকেশন দেওয়া আছে। ঠিক খুঁজে পাবেন।

কৃষ্ণদার কাছে শুনলাম এবার উনি কয়েকজনের কবিতা শুনবেন। দাদা ঠিক করেছেন যারা কবিতা বলে বিখ্যাত হয়ে গেছেন তাদের কবিতা ওনাকে শোনাবেন না। নতুন কবিদের কবিতা শোনাবেন। বেশি নয় মাত্র চারজন। হয়তো কারোর ভাগ্য খুলে যেতে পারে যদি ওনার ভালো লাগে। চারজন রেডি, কেন জানিনা আমিও ওদের ঐ উত্তেজনার মধ্যে ঢুকে গেছি।

পাঁচটা থেকে অপেক্ষা করতে করতে ছটা বেজে গেল। কৃষ্ণদাকে ফোন করে বললাম একটু ফোন করে দেখো তো কোথায়। কিছুক্ষণ বাদে কৃষ্ণদা জানালো গাড়ি একটু খারাপ হয়ে গেছে একটু অপেক্ষা করতে হবে। রাস্তার ধারে বসে বসে আবার মনে পড়ল মুখোশ রচনাটার কথা। গুগল ঘাটতে ঘাটতে কতো কিছু জেনেছি। প্রায় চার হাজার বছর আগে মুখোশের প্রচলন ছিল। যা আজও চলছে। কত পূরানো একটি জিনিস এখনও জনপ্রিয়। ভাবতে ভাবতে সাতটা বেজে গেল। হটাত একটা গাড়ির হর্ন। আর ড্রাইভার গলা বাড়িয়ে আমার নাম ধরে ডেকে বলছেন দাদা আপনি কি? হ্যাঁ হ্যাঁ করতে উঠলাম। দেখলাম ঠিক তিনজন গাড়িতে বসে আছেন। তিনটে টিফিন তাদের হাতে ধরিয়ে মোটরসাইকেলে বসে বললাম পিছন পিছন আসুন। রাজ্যধরপুর হয়ে লেভেল ক্রসিং পার করে সোজা টাউন হল।

আমি মোটামুটি লম্বা চওড়া মানুষ। নব্বই কেজি ওজন। বিনা পয়সার বাউন্সারের কাজ করতে লাগলাম। বিজয় আচার্যকে ঠেলেঠুলে সই শিকারিদের হাত থেকে বাঁচিয়ে সোজা মঞ্চে তুলে দিলাম। যাক, এবার আমার কাজ হলের পিছনের দিকে একটা সিটে এসে বসা। আবার উনি যখন নামবেন তখন দৌড়ে যেতে হবে। পিছন থেকে দেখছি ফুলের তোড়া দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হল। কিছু ঠাণ্ডা পানীয় তার সামনে রাখা হল তাতেও তিনি চুমুক দিলেন। সঞ্চালক ওনার কাছে এগিয়ে এসে কিছু চুপিচুপি কথা বলে মাথা নাড়লেন। আমারও ভালো লাগছে নতুন কবিরা কবিতা পড়বেন আর উনি শুনে তার মতামত জানাবেন। কিন্তু সঞ্চালক এসে বললেন কবির গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রোগামের একটু অদল বদল করা হল। উনি নতুন কবিদের হাত থেকে তাদের লেখা কবিতাগুলি সংগ্রহ করবেন। বাড়িতে গিয়ে কবিতাগুলি পড়ে আমাদের কাছে মতামত জানিয়ে দেবেন। আর যদি কোন কবিতা ভালো লাগে তবে সেই কবিতা তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিনে ছাপিয়ে দেবেন। আর আমরা যার জন্য বসে আছি ওনার বক্তব্য শোনার জন্য সেটাই এখন শোনা যাক।

– শ্রীরামপুরের মানুষ, অক্ষর শহরের মানুষ। আমি জানি এই শহরের মানুষের রক্তে কবিতা। যারা বিখ্যাত হয়ে গেছেন আমি তাদের লোক নই। আমি তাদের কাছের মানুষ হতে চাই যারা নতুন কবিতা লিখতে শুরু করেছেন।

বিজয় আচার্য তার বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। একটু আশাভঙ্গ হলেও শুরুটা দারুণ করলেন।

– আমি মনে করি একজন সফল মানুষ তখনই সফল হন যখন তিনি আরও কিছু সফল মানুষ তৈরি করতে পারেন। কবিতা আমাকে অনেক দিয়েছে। সত্যি বলতে গেলে এখন আমার নতুন করে কিছু পাবার নেই। আমার মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা যখন আমি লড়াই শুরু করেছি। যে ধরণের প্রতিবন্ধকতা আমার সামনে এসেছিল তা আজকে অনেকেই কল্পনা করতে পারবে না। কতো কবির বাড়িতে কবিতা পাঠের আসরে নামী কবিরা চেয়ারে বসেছেন আমার জায়গায় হয়েছে সিড়িঁতে। নিজেকে প্রচার করার সুযোগ আজকের দিনের মতন তখন ছিলো না। সামাজিক মিডিয়াতে যে ধরণের কবিতা দেখি পড়ে মনে হয় তারা লিখুক। আরো লিখুক। আমি অন্যদের মতন নই। আমি দোষ ধরি না। আরও কবি চাই, আরও নতুন নতুন কবিতা চাই। সারা বাংলা নিজের গাড়ির তেল পুড়িয়ে ঘুরে বেড়াই নতুন কবিদের জন্য।  ….

শুনতে শুনতে ঘোর এসে গিয়েছিল হাততালি শুনে ঘোর ভাঙলো। মাথা একবার ঝাঁকিয়ে দেখলাম বিজয় আচার্য মাইক থেকে একটু সরে এসে দাঁড়ালেন। সঞ্চালক দৌড়ে এসে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন এবার আমাদের সেই আনন্দের সময়, আমাদের নির্বাচিত চার জন নতুন কবি নিজের হাতে তাদের লেখা কবিতা বিজয় আচার্যর হাতে তুলে দেবেন। সঞ্চালক চারজনকে ডেকে নিলেন। দূর থেকে দেখলাম সন্তানের মতন পরম মমতায় প্রতিটি কবিতা হাতে করে নিলেন। তারপর পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। প্রত্যেককে কথা দিলেন দেখবেন বলে। এবার সবারদিকে জোড়হাত করে ফেরার অনুমতি চাইলেন।

এবার আমার কাজ। তাড়াতাড়ি গিয়ে চেয়ারম্যানের ঘরটি খুললাম। আগেই ভিতরে ঢুকে গেলাম। কৃষ্ণদা এরপর বিজয় আচার্যকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। চেয়ারম্যানের ঘরের দরজা কৃষ্ণদা বন্ধ করে দিলেন। ভিতরে আমরা তিনজন। আমার একটু ভুল হয়ে গেছে চেয়ারগুলি একটু আগে পরিস্কার করে নেওয়া উচিত ছিল। এদিক ওদিক কাপড় খুঁজছি তখনই বিজয় আচার্য পকেট থেকে কবিতাগুলি বার করে সিটগুলি মুছলেন আর বললেন এই এক সমস্যা। কোথাকার কে আমাকে দেখলেই কবিতা বার করে দেয়। আমি যেন সবার ঠিকা নিয়ে বসে আছি। আজকের এই সময় আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তারপর আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন ঘাবড়ে যাচ্ছেন?  ভাবছেন এই কথা যদি আমি বাইরে বলে দিই তাহলে কি হবে? আমাদের কিছু হবে না। একবার নাম করে ফেললে আর কিছু হয়না। সমস্ত কথাই বলে দেবো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। কিছুদিন বাদে তোমার এই দাদার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ আসবে তাতে লেখা থাকবে কবিতা গুলো ভালোই ছিল।  আর হ্যাঁ দাদা ওটা ত্রিরিশ করে দিন। এত কমে হচ্ছে না।

কৃষ্ণদা একটু অবাক হয়ে বলল আপনি পঁচিশ বলেছিলেন। যতদিন বেঁচে আছি সবাই যেন মিতালীকে ভুলে না যায় তাই এই টাকা খরচ করি। এক্ষুনি কোথা থেকে এই পাঁচ হাজার টাকা পাব? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল শোন ওনাকে পাঁচ হাজার টাকা গুগল পে করে দে। আর বেনিটিতে গিয়ে ছেড়ে দে।

যন্ত্রের কোন আবেগ থাকে না। সে শুধু কাজ করে। কেন জানি না নিজেকে যন্ত্র মনে হতে লাগল। বিজয় আচার্যর গাড়ির সামনে মোটর বাইক স্টার্ট দিয়ে আগে আগে চললাম। হটাত মনে হলো ধুর এত করতে নেই। ফিরিঙ্গি ডাঙ্গার মোড়ে এসে বললাম সোজ চলে যান। শুধু “ভাগ” চেঁচিয়ে বলতে পারলাম না। বলতে খুব ইচ্ছা করছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। গাড়িটা আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেল।

পকেট থেকে মোবাইল বার করে মেয়েকে ফোন করে বললাম মুখোশ রচনাটি একটু বদলে দিতে হবে। যা লিখেছি তা আসলে মুখোশ নয়। আসল মুখোশ নিজের চোখে দেখলাম।

[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ