29 Jan

পীরের বেড়

লিখেছেন:পূষন


সে’যাত্রায় সমরের খবরের কাগজের চাকরিটা যখন হয়ে গেছে শুনেছিলাম তখন কেন জানি না খুব অবাক হই নি। আদিদেবের কথা যে ফলে যাবে সেটা যেন আমার মন আগে থেকে-ই জানত। কিন্তু সমর যে আদিদেবের উপর এতটা কৃতজ্ঞ হয়ে পড়বে সেটা ভাবি নি। ওর চাকরি হওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে ছিল জন্মাষ্টমী, আর সেই উপলক্ষ্যে তার বাড়িতে বহুকাল থেকে-ই পুজো হয়ে আসছে। নিতান্ত-ই ঘরোয়া পুজো, ওরা নিজেরাই ভোগ নিবেদন করে এবং তারপরে যথারীতি প্রসাদ-পর্ব। বাইরের লোক বলতে আমি আর ওদের এক-দু’ ঘর প্রতিবেশী উপস্থিত থাকেন, সব মিলিয়ে মেরে-কেটে দশজন। এইবার সেই পুজোয় আমন্ত্রণ পেলেন আদিদেব স্বয়ং; শুনলাম, সমর নাকি বাড়ি বয়ে তাকে নেমন্তন্ন করে এসেছিল। আলাদা-ই ব্যাপার।

জন্মাষ্টমীর দিন, অথচ একটু-ও ঝড়-বৃষ্টি হবে না — এতটা রসাতলে পৃথিবী এখনও যায় নি। তবে যেতে যে প্রায় বসেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। বড় একটা নিম্নচাপ ওই দিন-ই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে হানা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে তার গতি কমে যায় এবং ফলে ‘গ্র্যান্ড রিলিজ’-টা ‘ট্রেলার লঞ্চ’-এ পর্যবসিত হয়। মাঝে-মধ্যে ছিঁটে-ফোঁটা বৃষ্টি, সাথে আকাশে ঘনঘোর উড়ন্ত মেঘের দল আর দমকা জলীয় হাওয়ার দাপট চলছিল একটানা। শেষ রাত্রে না হলেও কাল সকাল থেকে-ই যে কলকাতা আরেকবার একটা নাকানি-চোবানি খাবে তাতে আর কারোর-ই কোন সন্দেহ ছিল না। এ’রকম অবস্থায় এতটা পথ ঠেলে আদিদেব আসবেন কিনা তা নিয়ে কিছু সন্দেহ ছিল, কিন্তু শেষমেশ তিনি এলেন। গল্পও হল।

তখন পুজো সবে শেষ হয়েছে। পাশের ঘরে পাড়ার আমন্ত্রিতজনরা প্রসাদগ্রহণে বসেছেন। আদিদেবকে বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি আগে বসলেন না, সমর আর আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি তোমাদের সাথে-ই পরে বসব। ঝড়-জল যা-ই হোক, আমার তাড়া নেই।”

অগত্যা সে’রকম ব্যবস্থা-ই হল। আমরা চারজন সমরের ঘরে গিয়ে বসলাম। আদিদেব, সমর আর আমি তো ছিলাম-ই; আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল সমরের এক প্রতিবেশী ছোকরা, নাম স্যাম। ছেলেটা যেমন ওভার-স্মার্ট, তেমনি অসহ্য রকমের বেড়ে-পাকা। জগতের সব সে জানে। সমর মুখ হতে আদিদেবের সামান্য পরিচয় পাওয়ার পর থেকে-ই সে যে তাঁকে প্রশ্নের প্যাঁচে ফেলার ধান্দায় রয়েছে এবং সেই জন্য-ই আমাদের আশে-পাশে একটানা ঘুরঘুর করছে এটা আমি অন্তত বেশ আন্দাজ করে ফেলেছি ওর হাবে-ভাবে। এদিকে বাইরে তখন সন্ধ্যে বেশ ঘন হয়ে গেছে, উথাল-পাথাল হাওয়ার গর্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বন্ধ জানালাগুলোর পাল্লায়। মাঝে মাঝে তার সাথে যুক্ত হচ্ছে বৃষ্টির শব্দ। তাছাড়া কাছে-দূরের একটা-দুটো বাড়ি থেকে ঘন্টার টং-টং আওয়াজ আর কীর্তন-টাইপের গানের আবছা সুর ভেসে আসছে কোনো কোনো সময়ে। তাছাড়া পাশের ঘরের প্রসাদগ্রহীতা এবং পরিবেশনকারীদের অস্পষ্ট গুঞ্জন তো আছে-ই।

আড্ডার মেজাজে সময় কাটতে লাগল। আদিদেবের সাথে কথা বলার সময় একটা জিনিস বেশ দেখেছি, সেটা হচ্ছে, আমাদের সাথে ওঁনার বয়সের যে একটা বড় ফারাক আছে সেটা উনি নিজের আচরণ বা বাচনভঙ্গির মধ্যে ফুটে উঠতে দেন না। খুব ঠান্ডা মাথায়, সাধারণভাবে কথা বলেন ভদ্রলোক। এই যেমন আজ।

কথা চলতে চলতে প্রথমে ভগবান আর তার একটু পরেই ভূতের প্রসঙ্গ চলে আসল। আদিদেবের যে এ’লাইনের কিছু অভিজ্ঞতা আছে সেটা উপস্থিত সকলের-ই কম-বেশী জানা। স্যাম আচমকা কথার মাঝখানে ভয়ানক জ্যাঠামি করে একটা প্রশ্নবাণ ছুঁড়ল আদিদেবের উদ্দেশ্যে, “আচ্ছা, আপনি তো শুনলাম বেশ আশ্চর্য লোক! … তা এমন কখনও হয়নি যে আপনার হিসেব মেলেনি? … মানে …”

স্যামের বেয়াড়াপনার মাঝপথে-ই হো-হো করে হেসে উঠলেন আদিদেব। আমরা তাকিয়ে রইলাম ওঁর দিকে। হাসি একটু কমলে তিনি বললেন, “আরে বাবা, জীবনে আজ অবধি কোন হিসেবখানা যে ষোল আনা মিলেছে সেটাই তো ভাববার কথা! … তবে হ্যাঁ, অলৌকিক অভিজ্ঞতার নিরিখে যদি সেই বিষয়টা ভেবে দেখি, তাহলে সেরকম ঘটনা খুব বেশী নেই। যদিও …”

একটা পওজ নিলেন আদিদেব। সমর মাঠে নেমে পড়ল, “যদিও? … যদিও কি বলুন না!”

একটু যেন নিজের মনে-ই একবার মুচকি হাসলেন আদিদেব, তারপর বললেন, “যদিও একটা ঘটনার কথা এখনও মনে পড়লে তাজ্জব হতে হয় … বেশ তো, শোনো তাহলে বলি …

তখনও আমি এইসব লাইনে আসিনি। মানে, আমার ম্যাজিশিয়ান জীবনেরও আগের কথা। বহু দিন পার হয়ে গেছে সেই ঘটনার পরে …  যাই হোক, তখন আমি এক জড়ি-বুটি বিক্রেতার সাথে অংশীদারী কারবারে যুক্ত। পার্টনার ভেবো না, টেনে-টুনে কর্মচারী বলতে পারো। যার সাথে এই কারবার করতাম, সমস্ত মূলধন কিংবা গাছ-গাছড়া বিষয়ক জ্ঞান-গম্যি তার, আমার খালি শ্রমটুকু। ওই লোকের একটা ছোট দোকান ছিল, দিনে সে দোকান চালাত, আর রাত্রে বসতাম আমি। কোনো কোনো সময় সে আমায় কাঁচামাল, মানে ওই গাছপালার ডাল কিংবা শেকড়-বাকড় তুলতেও নিয়ে যেত। আমিও যেতাম; গাছও চেনা হত, উপকারিতাও জানা হত। তখন মনে একটা ধারণা বানিয়েছিলাম যে যদি ম্যাজিকের লাইনে সুবিধা না হয়, তাহলে এই ধান্দাতেই লেগে পড়ব। পেট চলা নিয়ে তো কথা! গ্রামের দিকে এইসবের বেশ ভালো চাহিদা ছিল।

যার অধীনে তখন কাজ করতাম তার নাম ছিল হলধর। হলধরের ব্যাপারে একটা কথা খুব মনে পরে। ডান পা অপেক্ষা তার বাঁ পা-টা ছিল সামান্য ছোট। কেমন যেন সামান্য লাফিয়ে চলতে হত তাকে … যাই হোক, সে’দফা এক মঙ্গলবারে সে আমায় নিয়ে চলল কি-একটা দুষ্প্রাপ্য গাছের মূল যোগাড় করতে। তবে সেই মূল তুলতে হবে সূর্যাস্তের পরে, আলো থাকাকালীন তুললে নাকি তার আর কার্যকারিতা থাকবে না। তখন শীতকাল, এক মাঘের বিকেলে সাইকেলে চেপে দুইজনে রওনা দিলাম। গন্তব্য শাহিনগঞ্জের জঙ্গল, আমার তখনকার আস্তানা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার হবে আন্দাজ।

১০-১৫ কিলোমিটারের পরেই জনবসতি পাতলা হয়ে গেল। শাহিনগঞ্জের বাজার ছেড়ে এসেছি অনেকক্ষণ হল। এখন চারপাশে সবুজের আবরণ, তার মাঝখান দিকে আঁকাবাঁকা রাস্তা। ঘর-বাড়ির ঘনত্ব বেশ কম, রাস্তায় গরু-ছাগল-মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে পাখি ডাকছে বিস্তর। কোথাও ছোট-খাটো দোকান দু-একটা, কোথাও আবার সবুজের বিভিন্ন রকমের শেডস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেতের মধ্যে দিয়ে সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে সোজা আকাশের দিকে। ফাঁকা জায়গা হওয়ায় ঠান্ডা যেন আরও জেঁকে বসেছে। তবে সাইকেল চালাতে বেশ ভালোই লাগছিল। কাজের বাহানায় এরকম ঘুরে বেড়ানো কোনোকালেই নেহাৎ মন্দ লাগে না আমার। আরও চার-পাঁচ কিলোমিটার চলার পরেই লোকালয় সম্পূর্ণ যেন উবে গেল। চারপাশে শুধুই জঙ্গল আর জঙ্গল। রাস্তার হালও ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। বুঝতে পারলাম এই পথে লোকে আসে না। এদিকে আলো তখন প্রায় নেই বললেই চলে, চারপাশটা একপ্রকার আবছা দেখা যাচ্ছে খুব বেশী করে বললে। হঠাৎ একটা বাঁক নেওয়ার সময় একখানা ফলক চোখে পড়ল আমার, প্রায় চার ফুট বাই তিন ফুটের ফলকটা। ফলকটার গায়ে দেখলাম অস্পষ্ট লাল রঙে লেখা রয়েছে —

“আল্লাহ-র জমি আর পীরসাহেবের ঘর।
গোলাম খাঁ-এর আস্তানাতে তিনি-ই হমসফর।”

আমি সাইকেল থামিয়ে চোখ কুঁচকে লাইনগুলো পড়ছি, এমন সময়ে পেছন থেকে হলধর বলল, “এই জায়গাটার নাম হল পীরের বেড়। বাপ-ঠাকুরদার মুখে গল্প শুনেছি, ইংরেজ আমলে এই গোলাম খাঁ নাকি ছিল এক ভয়ঙ্কর ডাকাত। তার দল এই জঙ্গলটা একরকম শাসন করত। শুধু ডাকাতি করা-ই নয়, এদের উদ্দেশ্য ছিল এই জায়গাটার সম্পূর্ণ আধিপত্য নেওয়া। তাই বাইরের কোনো লোক এই পথ দিয়ে গেলে সে আর বেঁচে ফিরত না, সাথে নেওয়া টাকা-কড়ি, জিনিসপত্রের সঙ্গে-সঙ্গে তার প্রাণ-টাও লুঠ করত গোলাম খাঁ-র বাহিনী। শিকারকে ঘিরে ফেলার দারুণ কৌশল জানত গোলামের দল। আসা বা ফেরার সময় জঙ্গলের মাঝে কোথাও একজন প্রথম পিছু নিত শিকারের। শিকারের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে কিছু দূর সে একা-ই ফলো করত, তারপরে পথ চলতে চলতে-ই দু’পাশের জঙ্গলের মধ্যে একজন-দু’জন করে জড়ো হতে থাকত তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। এর ফলে শিকার তিনদিক থেকে-ই ঘেরাও হয়ে পড়ত কিন্তু নিজে কিছুই জানতে পারত না। আরও পরে, যখন জঙ্গল আরও ঘন হয়ে পড়ত বা চারপাশ একেবারে শুনশান হয়ে আসত, তখন তারা শিকারের সাথে ক্রমশ দূরত্ব কমাতে থাকত, আর সব শেষে একেবারে মুখের সামনে এসে দাঁড়াত ডাকাতদের আরেকটা ছোট দল। ফলে শিকারের আর পালাবার পথ থাকত না … তা এরপরে একদিন নাকি এখানে এক পীরসাহেবের আবির্ভাব হয়। তিনি এখানে একটা ঝোপড়া আর ছোট একটা ইটের অস্থায়ী ঘর বানিয়ে সেটাকে দর্গা কল্পনা করে উপাসনা করতে থাকেন। অজ্ঞাত কারণে গোলাম খাঁ এতে বাধা দেয় নি। অনেকে অবশ্য বলে যে সেই পীরসাহেবের অলৌকিক ক্ষমতার কাছে গোলাম খাঁ-র মত দুর্ধর্ষ শয়তানও নাকি হার মেনেছিল। লোকে এ-ও বলে যে সেই পীর নাকি এত ক্ষমতাবান সিদ্ধপুরুষ ছিলেন যে এক-ই সময় একের বেশী জায়গায় তাঁকে দেখতে পাওয়া যেত …… তবে সে’সব অনেককাল আগের কথা। এখন সেই পীরসাহেবও নেই, গোলাম খাঁ আর তার খুনে ডাকাত দলও নেই। খালি সেইসব দিনের স্মৃতি আর পীরসাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা ধরে রাখার জন্য বানানো এই ফলকটা এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।”

ততক্ষণে রাত নেমে পড়েছে জঙ্গলের ভেতর। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। ফলকটাকে ছেড়ে আমরা এগোতে লাগলাম। কিছুটা চলার পরে-ই টের পেলাম, প্রতিটা মুহূর্তে জঙ্গল ঘন থেকে ঘনতর হয়ে আসছে রাস্তার দুইপাশে। দশ-পনের ফুট লম্বা বাঁশঝাড়গুলোর গহ্বরে ফিনফিনে কুয়াশা বিভিন্ন সব মূর্তি ধারণ করতে আরম্ভ করেছে, হট করে দেখলে মনে হয় সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে যেন। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে এগিয়ে চলেছি আমরা। অল্প সময় পরে রাস্তা এতটায় এবড়ো-খেবরো হয়ে পড়ল যে সাইকেল যেন আর চালানো যায় না! বলতে ভুলে গেছি, হলধর শুরু থেকে-ই নিজের সাইকেলে একটা ছোট বস্তা বেঁধে চলছিল। এতক্ষণে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে ওটার ভেতর থেকে বের আনল দুটো কুপি আর দুই গাছা দড়ি। কুপি দুটো জ্বালিয়ে দু’জনের সাইকেলের সামনের অংশের সাথে ভালো করে বাঁধল সে। তারপরে কুপির স্বল্প আলোয় খুব সাবধানে নিজেদের ব্যালেন্স রেখে এগোতে লাগলাম আমরা।

এরপরে উপযুক্ত জায়গায় পৌঁছে প্রয়োজনীয় জড়ি-বুটি সংগ্রহ করতে সময় লাগল আরও ঘন্টাখানেক। তখনও কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি আমাদের। কিন্তু আসল ব্যাপার শুরু হল ফেরার সময়।

ফিরে আসার পথে অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে চেপে বসল। দু’-একটা জোনাকি জ্বলছে বাঁ দিকের সারিবদ্ধ শ্যাওড়া গাছগুলোর নীচের ঝোঁপে। কুপির ক্ষীণ আলোয় পথের বেশী আগে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, তার উপর খানা-খন্দ ভরা এই উঁচু-নীচু কাঁচা রাস্তা! বর্ষায় আসলে যে কি দুর্ভোগ হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে করতে এতক্ষণ চলছিলাম আমরা। আমি আগে, হাত তিনেক দূরে হলধর। মুখে বলছি বটে হলধর, কিন্তু তখন-ই তার বয়স চল্লিশের উপর। তার উপর পায়ের সমস্যার জন্য এরকম রাস্তায় তার সাইকেল চালাতে বেশ কষ্ট-ই হচ্ছিল বোধহয়। চলতে চলতে আমি হয়ত আচমকা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কনকনে হাওয়ার একটা স্রোত ভেসে এল জঙ্গলের ভেতর থেকে আর তৎক্ষণাৎ একটা আবছা শব্দে আমার চমক ভাঙল। ওটা পায়ের শব্দ,না? সাইকেল থামিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে গেলাম। কই, কিচ্ছু তো নেই! ফের সাইকেল চালানো শুরু করতেই আওয়াজটা কানে আসতে লাগল। ফের ঝপ করে দাঁড়ালাম, মন দিয়ে শুনলাম তিন-চার সেকেন্ড। আমি থামার পরের মুহূর্তেই ফের আওয়াজটা বেমালুম থেমে গেছে, কিন্তু যতটুকু শুনেছি তাতে আর কোনো ভুল নেই। খুব মাপা পদক্ষেপে কেউ একটা আমাদের পিছন-পিছন আসছে। খুব দূরে নয়, আবার একদম কাছেও বলা যাবে না। লোকটা যে আমাদের ফলো করছে তাতে সন্দেহ নেই। আমি চললেই সে চলছে, আমি থামলেই থেমে যাচ্ছে। শেষবার অসতর্কতার বশে এক-পা বেশী ফেলে ফেলেছে আর চারপাশের অখণ্ড নৈঃশব্দের কারণে সেই পদধ্বনি আমার কানে এসে পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। কিন্তু কে লোকটা? কি উদ্দেশ্য তার? আর এই অন্ধকার জনবসতিহীন এলাকায় এই সময়ে লোক এল-ই বা কি করে?

বেশ ভয় হল আমার। ব্যাপার কি? হঠাৎ আমার কানের কাছে হলধরের ফিসফিসে গলা শুনতে পেলাম, ‘পিছনে তাকিও না। চুপচাপ চলো আমার সাথে।’ চমকে পাশে চাইতেই দেখলাম হলধর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সাইকেলসমেত। তবে তার সাইকেলের কুপি নিভে গিয়েছে। নিশ্চই আমার ওই থামা-চলার সুযোগে সে ধরে ফেলেছে আমায়। সে না হয় হল, কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। কি আছে পিছনে? হলধর-ও তার মানে শুনেছে ওই পদধ্বনি? আর পেছনে তাকাব না কেন?

চাপা গলায় সেই কথা হলধরকে বলতেই সে উত্তর দিল, ‘পেছনে তাকালে আমাদের আর সামনে এগোতে হবে না। যে বা যারা পেছনে আসছে, তারা চায় যে তুমি পিছনে তাকাও, আর এমন কিছু তোমার চোখে পড়ুক যেটা চোখে না পড়লেই তোমার ভালো … যাক গে, নাও জলদি এসো আমার সাথে … পা চালাও!’ এই বলেই সে বেশ দ্রুত সাইকেলের প্যাডেল ঘোরালো। আমিও নিজের গতি বাড়ালাম।

হলধর-ও যে ভয় পেয়েছে সেটা তার সাইকেলের গতি দেখে-ই টের পেলাম। খুব জোর সাইকেল চালাচ্ছে সে। সত্যি, ভয়ের সামনে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা-ও যে খুব বড় জিনিস নয় সেটা দেখে মৃদু একটা ধাক্কা লেগেছিল … যাই হোক, হলধরের সাথে তাল মেলাতে আমার বেশ কষ্ট হতে লাগল। ওই অসমান রাস্তায় সে যে অত জোরে সাইকেল চালাবার ক্ষমতা রাখে এ আমার জানা ছিল না তো! … এদিকে যত জোরে-ই সাইকেল চালাই না কেন, সেই পায়ের শব্দ কিন্তু আমাদের পিছু ছাড়ল না। আমি যত জোরে এগোই, সে লোক-ও যেন তত জোরে চলে। সাইকেল চালানোর পরিশ্রমে আর ভয়ে আমার ঘাম দিতে লাগল সেই কনকনে শীতের মধ্যেও। আরেকটা জিনিসও আমার মনে হতে লাগল। শুধু পেছনে-ই নয়, আমার যাত্রাপথের দুইপাশেও, জঙ্গলের অন্ধকারের ভেতর দিয়েও কারা যেন সমান তালে আমায় অনুসরণ করে চলেছে। সময় হলেই বেরিয়ে এসে পথ আগলে দাঁড়াবে! … এরা সব কারা? এল কোথা থেকে? কি চায়? হলধর সাইকেল চালাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতবেগে, আর মাঝে-মাঝে গমগমে গলায় আমায় সাবধান করে বলছে, ‘পিছনে তাকাবে না! পিছনে তাকাবে না! আমার সাথে এসো! … তাড়াতাড়ি এসো! পা চালাও চটপট!’

কতক্ষণ যে এইভাবে সাইকেল ছুটিয়েছি তার হিসেব আমার কাছে আজও নেই। হিসেব রাখার সময় তখন ছিল না। আমরা যে ভয়ানক কোনো বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি তখন তা আমার বুঝতে বাকি নেই। ওই হলধর-ই আমার শেষ ভরসা। আমি প্রাণপণে তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় এসে থামল হলধর, আর প্রায় সাথে-সাথেই হঠাৎ করে সেই অনুসরণকারীর দল যেন চুপ করে গেল। কোনো সাড়া-শব্দ নেই কোত্থাও। আমিও থামলাম, কোথায় এলাম দেখার জন্য এদিক-ওদিক ঘাড় ফেরাতেই সে-ই ফলকটা অন্ধকারেও বেশ চোখে পড়ল আমার। ওটার নীচেই দাঁড়িয়ে রয়েছে হলধর। আমি ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই সে বলল, ‘এখানে-ই দাঁড়াও। আমি আসছি এক্ষুনি! দাঁড়াও, যেও না কোথাও যেন!’ এই বলে-ই সে যে পথে আমায় নিয়ে এল এতক্ষণ ধরে সেইদিকেই আবার জোরে সাইকেল চালিয়ে দিল। ফের সেই কনকনে হাওয়াটা উঠল বনের ভেতর, তবে এবার উলটোদিকে। মনে হল, কাদের যেন সেই হাওয়ার তোড়ে তাড়িয়ে নিয়ে গভীরতর কোনো জগতে ফেরত নিয়ে চলল হলধর। আমি হতবুদ্ধির মত শঙ্কিত মনে দাঁড়িয়ে রইলাম সেই ফলকটার গোড়ায়।

কিছুক্ষণ পরেই কিন্তু ফিরে এল হলধর। এইবার দেখি, সে ফের জ্বালিয়ে এনেছে কুপিটা। কোথায় সে গিয়েছিল আর কি করতে-ই বা গিয়েছিল সেই কথা জিজ্ঞেস করতে যাব, এমন সময়ে সে নিজেই হাঁফ-ধরা বিমূঢ় কণ্ঠে আমায় প্রশ্ন করে বসল, ‘আরে, তুমি আগে চলে এলে কি করে? দেখতে পেলাম না তো! আলাদা কোনো চোরাপথ ধরেছিলে নাকি?’

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি হলধর? বললাম, ‘আমি আগে এলাম মানে? … আমায় দাঁড় করিয়ে নিজেই তো ফেরত গেলে! আর নেভা কুপিখানা জ্বালিয়ে ফিরলে এইমাত্র …’

— ‘আমি ফেরত গেলাম? আমি? আর কুপি তো নিভেছিল তোমার!’ বিস্ময় ঝরে পড়ল হলধরের গলায়, ‘আরে সেই যে আমায় না বলেই চুপচাপ তুমি পেচ্ছাপ করার জন্য অন্ধকার শ্যাওড়ার ঝোঁপের কাছটায় আচমকা দাঁড়িয়ে ছিলে … আমি দেখতে পাওয়ায় বললে যে হালকা হওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিলে আর সেই সময় হাওয়ার ঝাপটায় কুপি নিভে গেছে … তারপরে এতটা পথ সাংঘাতিক জোরে সাইকেল চালাতে চালাতে আমায় একরকম তাড়িয়ে আনলে … কাদের যেন পায়ের আওয়াজ শুনলাম … তুমি বারবার পিছনে তাকাতে না করছিলে ……… এই একটু আগেই দুম করে গায়েব হয়ে গেলে, আর আমি খুঁজতে খুঁজতে দেখি এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছ! … আর এর মধ্যেই কিনা ভুলে গেলে সব?! …… আজব লোক বটে তো তুমি!’ কথাগুলো বলে একটু দম নিতে গিয়েই কি যেন ভেবে খাড়া হয়ে দাঁড়াল হলধর। এক সেকেন্ড পরে খুব ফ্যাকাসে একটা গলায় সে বলল, ‘আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। চলো, ফেরা যাক! আর ভয় নেই।’

ভয় যে কিসের নেই সেটা তখন পরিষ্কার না বুঝলেও কথা বাড়িয়ে যে লাভ নেই সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে হ্যাঁ, আর কিছু হয়নি সেদিন।”

আদিদেব কথা থামালেন। আমরা কেউ-ই কিছু বলতে পারলাম না। অনেকগুলো প্রশ্ন আর তাদের সম্ভাব্য উত্তর এলোমেলোভাবে ছোটোবেলার পরীক্ষায় সেই ‘ডানদিক বামদিক মিলিয়ে লেখো’ ধাঁচের কোয়েশ্চেনের মত মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল। একটা মেলে তো আরেকটা মেলে না।

হঠাৎ সমরের মা এসে ‘কিরে, রাত হয়ে যাচ্ছে তো! খাবি কখন তোরা?’ বলে তাড়া না দিলে যে কতক্ষণ যে আমাদের এই অবস্থা বজায় থাকত সেটা ঠিক করে বলতে পারি না।

মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ