জগাদা বলে সে নাকি অদ্যাবধি কত ধরণের যে কাজ করেছে অর্থ রোজগারের জন্য তার কোনো হিসেব নেই।আর তার ফলেই নাকি নানান অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছে সে। জগাদার সঙ্গে দেখা হলে আমি ধরে বসি গল্প শোনার জন্য।আর সেও দারুণ উৎসাহে গল্প শোনায়।সেসব নাকি তার জীবনেরই ঘটনা।ঘোর বাস্তব।মোটেও নয় কল্পনা। আর কি রোমাঞ্চকর সেসব বাস্তব ঘটনা! শুনলে মনে হবে গল্প শুনছি বুঝি।সত্যি সত্যি এমনটা হতেই পারে না।এই তো সেদিনের কথা।জগাদার সঙ্গে দেখা হতেই বললাম,গল্প বলো।কতদিন তোমার গল্প শোনা হয় না।
আবদার শুনে জগাদা সচরাচর যা বলে সেদিনও তাই বলল।
বলল, গল্প! গল্প কোথায় পাব রে! আমার কাছে গল্পটল্প নেই। তবে একান্তই যদি শুনতে চাস তবে আমার একখান বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে পারি তোকে।
জানি জগাদার বাস্তব অভিজ্ঞতা গল্পকেও হার মানায়।আর আমি তো তাই শুনতেই চাই! নেহাত মুখ ফস্কে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে গল্প বলে ফেলেছি। সুতরাং তাড়াতাড়ি নিজের ভুল শুধরে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ জগাদা।তোমার ওই বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনাই তো শুনতে চাইছি।
জগাদা খুশি হয়ে বলল,বেশ তবে চল গুপি হালদারের চায়ের দোকানে। অনেকক্ষণ চা খাই নি।গলাটা শুকিয়ে গেছে।তাছাড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর বেশীক্ষণ কথা বলাও যায় না! সুতরাং গুপির দোকানে হাজির হলাম জগাদাকে নিয়ে। বাটার- টোস্ট আর ডবল ডিমের অমলেট,সঙ্গে চা অর্ডার দিয়ে বসলাম জগাদার মুখোমুখি।
জগাদা বলল সে অনেককাল আগেকার ঘটনা।আমি তখন ইয়ং। বাবা বলল, জগা অনেক হয়েছে লেখাপড়া।এবার রোজগারের পথ দেখো। তো বাবার নোটিশ পেয়ে আমি তো ভাবতে বসলাম কি উপায়ে রোজগার করা যায়।আমার বিদ্যা একটু কম ঠিকই, এইট ফেল, কিন্তু আমার বুদ্ধি! ক’জন বাঙালির আছে আমার মতো খোলতাই বুদ্ধি! ভেবে দেখলাম বুদ্ধি খাটিয়েই রোজগার করব।তা সুযোগও এসে গেল। সেবার আমাদের আমাদের গাঁয়ের ঝিলপাড়ের মাঠে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল।কুস্তি প্রতিযোগিতা। আমাদের গাঁয়ের নিমু পালোয়ান তো আছেই।তাছাড়া আশপাশের পাঁচ-সাতটা গাঁয়ের নামকরা পালোয়ানরাও হাজির। আমাদের গাঁয়ের রকেট ক্লাব এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। পুরস্কার দেওয়া হবে নগদ একশো টাকা।তখন একশো টাকার অনেক দাম।খাসির মাংস আড়াই টাকা সের।তো ফাইনালের দিন শুনলাম নিমুর পেট খারাপ করেছে।সে নাকি কেবল মাঠ আর ঘর করছে।তখন তো আর এখনকার মতো স্বচ্ছ ভারত বলে ধুয়ো তোলেনি কেউ! মাঠঘাটই ছিল আমাদের ল্যাট্রিন। তা সে যাইহোক,মোটকথা আমাদের কেষ্টপুরের নিমু আর রাধাগঞ্জের পটা পালোয়ানের মধ্যে ফাইনাল প্রতিযোগিতা ভেস্তে যেতে বসেছে। আমাদের রকেট ক্লাবের সম্পাদক বিশুদা মুখ কালো করে মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে ভাবছে বিনা প্রতিযোগিতায় পটা পালোয়ান কড়কড়ে একশো টাকা পুরস্কার অর্থ নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। কি দুঃখের ঘটনা। আমাদের গাঁয়ের লোকেদের সাথে আবার রাধাগঞ্জের লোকজনের সাপে- নেউলে সম্পর্ক সেই আমাদের ঠাকুরদাদাদের আমল থেকে। কারণটা কি তা আমরা সঠিক জানি নে। তবে আমাদের বাপ পিতামহের ট্রাডিশন বজায় রেখে আমরাও সেই শত্রুতা পুষে রেখেছিলাম।
যাইহোক, আমাদের কেষ্টপুরের সকলের তো খুব মন খারাপ। আর সব থেকে খারাপ অবস্থা নিমুর।অত যে পালোয়ান নিমু,এক একবারে শতখানেক ডনবৈঠক মারে, মুগুর ভাঁজে রোজ সকালে টানা ঘণ্টা দেড়েক, ভেজানো কাঁচা ছোলা একবাটি কপকপিয়ে খেয়ে হজম করে, সে কিনা আগের রাতে চক্কোত্তিদের বাড়ির সত্যনারায়ণের সিন্নি আধপোয়াটেক উদরে চালান করে ভোররাত্তির থেকে মাঠে ছুটছে।
কি আর করা! ভবিতব্য। নাহলে পটা পালোয়ানকে কুপোকাত করতে নিমুর তো দুই একটা প্যাঁচই যথেষ্ট। কিন্তু ভগবান বোধহয় তেমনটা হোক চাননি। বরং চেয়েছিলেন আমি,এই জগৎ মোহন কুস্তির মঞ্চ কাঁপিয়ে পটাকে পিটিয়ে পাটপাট করে কড়কড়ে একশো টাকার একখানা নোট রোজগার করে জগৎসুদ্ধু লোকের চোখ কপালে তুলে দিই।
তা না হলে ফাইনাল প্রতিযোগিতার দিন আমি সোজা গটগট করে গিয়ে হাজির হব কেন রকেট ক্লাবে! আর মুখ কালো করে বসে থাকা বিশুদাকেই বা বলব কেন, তুমি ভেবো না বিশুদা।প্রতিযোগিতা হচ্ছে। নিমুর বদলে আমি নামবো পটার সঙ্গে লড়তে।
আমার কথায় অবশ্য রকেট ক্লাবে উপস্থিত সকলেই রে রে করে উঠল! বিশুদা বিরক্ত হয়ে বলল, ইয়ার্কি করিস না জগা! দেখছিস এখন জীবন মরণ সমস্যা এসময় এধরণের ইয়ার্কি সহ্য করব না কিন্তু!
কে যেন আবার বলে উঠল জগাটার ঘিলু নড়া চিরকালই।এখন দেখছি মাথার ইস্কুরুপগুলো পর্যন্ত ঢিলে হয়ে গেছে।
আরেকজন কে যেন বললে,গরম পড়লে জগা বোধহয় উন্মাদ হয়ে যাবে।
কে যেন তাই শুনে দুঃখ করতে লাগল খুব, আহারে! মনমোহন কাকার একটা মাত্র ছোটছেলে এই জগা! সে যদি উন্মাদ হয়ে যায় তবে মনমোহন কাকা কি কষ্টটাই না পাবে !
এত প্রতিবন্ধকতা মধ্যেও আমি কিন্তু সিদ্ধান্তে অবিচল রইলাম। গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতার ঢং-এ রকেট ক্লাবের সকলের উদ্দেশ্যে বললাম, রাধাগঞ্জের বিরুদ্ধে কেষ্টপুরের এই প্রতিযোগিতা তো শুধু প্রতিযোগিতা নয়! এ হল যুদ্ধ। শতাব্দীপ্রাচীন শত্রুতা আমাদের গাঁয়ের সাথে রাধাগঞ্জের। সেই শত্রু গাঁয়ের পালোয়ানকে আমরা বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমি, ইয়ে, মানে একখান আধুলি পর্যন্ত নিয়ে যেতে দেবো না রকেট ক্লাবের থেকে। তোমরা বলছো শুরু থেকে আমি এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিইনি। সুতরাং এমন হুট করে আমি ফাইনালের দিন কুস্তির মঞ্চে উপস্থিত হতে পারি না। নিয়ম নেই। কিন্তু আমি বলি, নিয়ম তো মানুষই তৈরি করে ভাঙার জন্য। সুতরাং তোমরা তোমাদের ওই পুরোনো ধ্যাড়ধেড়ে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম তৈরি করো। আর সে নিয়মের নাম দাও ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি। আর তাছাড়া আরও শোনো, পৃথিবীতে যে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে, তাতে দেশের বা মিত্র দেশের জন্য লড়াই করেছে যত সৈন্য, তারা কি সবাই মিলিটারি ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিল? নাকি মিলিটারি স্কুলে পড়াশোনা শিখে সৈনিক হয়েছিল? মোটেও না। দেশের ও দশের প্রয়োজনে চাষী দোকানদার আপিসের কেরানী কলেজের ছাত্র কবি প্রেমিক সবাই বন্দুক হাতে সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছিল। তাহলে! আজকের প্রতিযোগিতা কি আদতে দুই গ্রামের সম্মুখ সমর নয়! আর সেই যুদ্ধে আমি নিজেকে সৈনিক হিসেবে, কি বলে যেন,ও হ্যাঁ, উৎসর্গ করছি।
জগাদার চা টোস্ট অমলেট কখন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গল্প তখনও শেষ হয়নি। অতএব আরেকদফা চা এলো বিস্কুট সহ। জগাদা গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, বুঝলি তো আমার বক্তৃতা শুনে তো সকলে থ। আমার জ্ঞান বুদ্ধির খুব তারিফ করতে করতে সকলে, এমনকি বিশুদা পর্যন্ত বলল,জগা রে! তোর পেটে পেটে এত বুদ্ধি জানতাম না তো !
আমি বললাম, তারপর! তুমি কুস্তি করলে ?
জগাদা বলল, করলাম কি রে? ওই পটা পালোয়ানকে যাকে বলে গো-হারান হারালাম।
শুনে আমি নড়েচড়ে বসে বললাম, তুমি তার মানে কুস্তির প্যাঁচট্যাঁচ….
জগাদা অম্লানবদনে তার বত্রিশ ইঞ্চি ছাতি টানটান করে প্যাকাটির মতো হাতের গুলি ফোলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, হুঁ। জানতাম আমি সবই। আমাদের গাঁয়ের নিমুর আর বুধোর প্যাঁচ কষা দেখে দেখেই শিখেছিলাম। তবে সেদিন আর কুস্তির প্যাঁচে নয়,পটা পালোয়ানকে হারিয়েছিলাম স্রেফ বুদ্ধির জোরে।
আমি উদগ্রীব হয়ে উঠলাম, কোন সে বুদ্ধি যা খাটিয়ে জগাদা রীতিমত এক পালোয়ানকে পরাজিত করেছিল প্রতিযোগিতায়?
জগাদা বলল, দেখ কুস্তি মানে কি? মানে হলো বিপক্ষকে প্যাঁচে ফেলে কুপোকাত করা।তাইতো? তা প্যাঁচে ফেলতে গেলে আগে জাপটে ধরে তবে প্যাঁচ কষতে হবে পটাকে।আমি ভেবে দেখলাম পটা পালোয়ান যদি প্রতিযোগিতার পুরো সময়টা আমাকে জাপটে ধরতেই না পারে তবে তো আর কুস্তি লড়াইয়ের দরকারই নেই।আমাকে জাপটে ধরার জন্য ওকে ছুটিয়ে ছুটিয়ে এমন ক্লান্ত করে দেবো যে ও হাঁপিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়বে।তখন ওকে মাটি থেকে তুলে আচ্ছা করে একবার ধোপার পাটে আছড়ানোর মতো করে আছাড় মারবো।যা ভাবা তাই কাজ।কুস্তির মঞ্চে উঠে আমি সারাক্ষণ ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে গেলাম পটা পালোয়ানের সাথে।পটা পালোয়ান হতে পারে। কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় তো আর ও ওস্তাদ নয়! আর আমি সেই কোন ছোটবেলা থেকে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলছি ইস্কুলের মাস্টার আর বাড়িতে বাবা কাকাদের সঙ্গে। আজ অবধি কেউ একখান চড় থাপ্পড় কষাতে পারেনি আমাকে ওই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার কল্যাণে।
সুতরাং সেবারও যা হওয়ার তাই হলো। আমাকে তাড়া করতে করতে পটা কিছুক্ষণ পরেই ক্লান্ত হয়ে ধড়াস্ করে মাটিতে পড়ে গেল। আমিও সেই সুযোগে ওকে তুলে ধাঁই করে এক আছাড় দিলাম আমাদের গাঁয়ের জাকির ধোপার স্টাইলে।
আর সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে আওয়াজ উঠল, জগৎ মোহন হিপ হিপ হুররে……এ।
কিন্তু পটা পালোয়ান আর উঠে দাঁড়াল না।
জগাদা উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।বলল, ওহ্! দিলি তো দেরি করিয়ে! আজ যাই।কত কাজ আছে আমার! শুধু শুধু তোর সঙ্গে বকবক করে সময় নষ্ট করলাম।
বলেই জগাদা হনহন করে হাঁটা দিল ।
আমি চা টোস্ট অমলেটের দাম মেটাতে মেটাতে প্রতিবারের মতোই ভাবলাম, ওহ্! জগাদা যে কি গুল গপ্পো ফাঁদে একেকটা! হজম করা যায় না।
মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব
Tags: গল্প, জগাদার গুল গপ্পো, মহুয়া রায়
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।