06 Feb

এক সওদাগরের ‘সপ্তডিঙা ও অন্যান্য’

লিখেছেন:মিতালী মিত্র


সদ্য একটা ভালো বই পড়ে উঠলাম। ঠিক গল্প, উপন্যাস কিম্বা প্রবন্ধ নয়, তবে এই বইটিতে সব রসদই মজুত। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শঙ্কর ঘোষ এর লেখার একটি সংকলন- সপ্তডিঙা  ও অন্যান্য। নোয়াখালি মার্চে সাংবাদিক হিসেবে গান্ধীজির সঙ্গী ছিলেন তিনি,  প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রনেতাদের সফর সঙ্গী শঙ্করবাবু প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সাংবাদিকতার চাপ সামলেও  নিয়মিত বই রিভিউ করতেন সওদাগর ছদ্মনামে।  ১৯৬০-৬১ তে আনন্দবাজার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় গ্রন্থ  সমালোচনায়  সওদাগর-এর নতুন কলমের শিরোনাম ছিল ‘সপ্তডিঙা’। সওদাগর ছদ্মনামে শঙ্কর ঘোষের সব গ্রন্থ সমালোচনা এবং তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধ গুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি একত্র করে ‘সপ্তডিঙা ও অন্যান্য’ বইটি প্রকাশ করেছে লালমাটি। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২৪ এর বইমেলাতেই। পড়ার সুযোগ মিলল এখন। বইটি নিয়ে মুগ্ধ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তবে সবার আগে বলি, আমি কিন্তু বইটি রিভিউ করছি না, করার দুঃসাহসও আমার নেই। তবে আমি চাই এই বই সবার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকুক। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন আর এক বিশিষ্টজন আলপনা ঘোষ। তিনি সাংবাদিক, শিক্ষিকা, লেখক এবং শঙ্কর ঘোষের সহধর্মিনী। ছোট দুই পাতার ভূমিকায় তিনি’সপ্তডিঙা ও অন্যান্য’ বইটির প্রেক্ষাপট জানিয়েছেন।

শঙ্কর বাবুর লেখার পাঠকরা নিশ্চই মানেন যে তাঁর শব্দ চয়ণ অসাধারণ। এমনকী জটিল কোনও বিষয় নিয়ে লেখা হলেও, পড়তে গিয়ে কোথাও আটকায় না। সহজ শব্দে, সহজ করে লেখার অভ্যাস তৈরি করা যায় তাঁর রিপোর্টিং গুলি পড়লে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কলমে ব্যক্তি বা দল সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ কী আশ্চর্যভাবে পরবর্তীকালে মিলে যেতে দেখি। এইসবই এই বইটির দ্বিতীয় অংশে পাওয়া যাবে।

বইটির প্রথম পর্বে রয়েছে সওদাগরের গ্রন্থ সমালোচনাগুলি। শঙ্কর ঘোষ সম্ভবত চেয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্যর সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করাতে। যেসব বই তিনি সমালোচনার জন্য নির্বাচন করেছিলেন, তার মধ্যে বেশিরভাগই অনুবাদ সাহিত্য। রাশিয়ান, জার্মান, ফরাসি, চেক ইত্যাদি নানা ভাষায় রচিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ। এইসঙ্গেই ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়েরও তিনি রিভিউ করেছেন।

আনন্দবাজারে ২২ শে জুন ১৯৬০ সালে সপ্তডিঙায় সওদাগর রিভিউ করেছিলেন Kingsli Martin এর Critics London Diary। এই বইটি সেইবছরেরই জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল। কিংসলি মার্টিন প্রথমে নিউ স্টেটসম্যান অ্যান্ড নেশনস এবং পরে নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এই দ্বিতীয় কাগজটিকে জনপ্রিয় করার মূল কাণ্ডারি ছিলেন কিংসলি। ১৯৩১ সাল থেকেই তিনি ক্রিটিক ছদ্মনামে লন্ডন ডায়েরি লিখতে শুরু করেন। এইসব তথ্যই জানিয়েছেন সওদাগর।

বস্তুত তাঁর লেখা না পড়লে ক্রিটিকস লন্ডন ডায়েরির সঙ্গে এই সময়ের পাঠক সংযোগ তৈরি করতে পারবেন না, বইটি যেটিকে আন্তর্জাতিক ইতিহাসের (১৯৩১-১৯৫৬) দলিল বলে উল্লেখ করেছেন শঙ্কর ঘোষ, তা সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে না। সপ্তডিঙাতে সওদাগর এই বইয়ের নানা বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে, একটা জায়গায় চোখ আটকায়, “জেমস জয়েসের সঙ্গে কিংসলি মার্টিনের সাক্ষাৎকারের একটি মজার বিবরণ বইটিতে স্থান পেয়েছে।কিংসলি মার্টিন নিউ স্টেটসম্যানে প্রকাশের জন্য জয়েসকে সুলিভানের উপর একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করলেন। জয়েস কখনও পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন না, তাই স্থির হল সুলিভানের কাছে লেখা তাঁর একটি চিঠি প্রবন্ধের পরিবর্তে নিউ স্টেটসম্যানে প্রকাশিত হবে। যথাসময়ে চিঠি তাঁর হস্তগত হলে কিংসলি মার্টিন দেখলেন, জয়েস তাঁর স্বভাবসুলভ বিকৃত ইংরেজিতে যা লিখেছেন তা স্পষ্টই সুলিভান স্তুতি হলেও তার অর্থ অভিধান মিলিয়ে পাওয়া যাবে না। সেই বোধহয় একবারই কিংসলি মার্টিন অর্থ না বোঝা সত্ত্বেও কোনও লেখা প্রকাশ করতে সম্মত হয়েছিলেন।” এই যে শেষ বাক্যটি- এর জন্যই শঙ্কর ঘোষের লেখা পড়ার আগ্রহ জাগে। ক্রিটিকস ডায়েরিতে যে লণ্ডনের হাইড পার্কের একাধিক বর্ণনার পাশেই কলকাতা ময়দানের ছোট একটি বর্ণনা আছে, সেকথাও জানিয়েছেন সওদাগর।

১৯৬০ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওর রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানের পরে সওদাগর সপ্তডিঙায় LIONEL FIELDEN এর আত্মজীবনী THE NATURAL BELT বইটি নিয়ে লেখা প্রকাশ করেন। কিছুটা সমালোচনার সুরেই শঙ্কর ঘোষ লিখেছেন, “কয়েকদিন আগে সাড়ম্বরে অল ইন্ডিয়া রেডিওর যে রজত জয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হল, তাতে ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক যে ভারতে আকাশবাণীর ইতিহাসেও এইসঙ্গে পঁচিশ বছর পূর্ণ হল কিন্তু তা নয়। ভারতে রেডিওর প্রবর্তন হয় ১৯২৭ সালে কয়েকজন ভারতীয় ব্যবসায়ীর উদ্যোগে।” তারপরে এই প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখে তিনি লিখেছেন, “বিবিসি থেকে যে বিশেষজ্ঞ দিল্লিতে আসেন, তাঁর নাম লায়নেল ফীলডেন। তিনিই অল ইন্ডিয়া রেডিওর প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল। অবশ্য প্রতিষ্ঠানটির নাম তখন অল ইন্ডিয়া রেডিও ছিল না। ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের অল ইন্ডিয়া রেডিও বা সংক্ষেপে এয়ার নামকরণ ফীলডেনই করেছেন। তবে এই নামটি উদ্ভাবনের খ্যাতি তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, সেটি পেয়েছিলেন লর্ড লিনলিথগো, ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয়।” এরপরে প্রায় একপাতা জুড়ে সেই ঘটনাটি ফীলডেনের লেখা থেকে অনুবাদ করে দিয়েছেন সওদাগর। মূল বইটি হাতের কাছে না থাকলেও, সপ্তডিঙা পূর্ণ রয়েছে এমন নানা অজানা খবরে, যা পাঠকের কৌতুহল মেটাবে।

৯ নভেম্বর ১৯৬০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় ‘NEHRU_ THE YEARS OF POWER BY VINCENT SHEEAN বইটির সমালোচনা করেছিলেন সওদাগর। তিনি লিখেছেন, শীয়্যানের মতে নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বকালের আলোচনাই স্বাধীন ভারতের আলোচনা, তিনি মনে করেন যে, নেহরু ইজ ইন্ডিয়া। বইয়ের সর্বত্রই নেহরুর প্রতি শীয়্যানের এই অনুরক্তি প্রকাশ পেয়েছে। শীয়্যান নেহরুর বন্ধুস্থানীয়। এদেশে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে তাঁর প্রায়ই ডাক পড়ে। অবশ্যই এই অন্তরঙ্গতায় অসুবিধাও আছে। নেহরুর যে আগ্নেয় মেজাজের কথা শোনা যায়, তার আঁচে শীয়্যানও কয়েকবার ঝলসেছেন। কিন্তু এই ঘনিষ্টতার জন্য শীয়্যান নেহরুর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কয়েকটি তথ্য পরিবেষণে সক্ষম হয়েছেন যা ভারতবাসী অনেকেরই অজানা।

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের চুপচাপ ফুলে ছাপ বইটির সমালোচনা করেছিলেন সওদাগর, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১ মে, ১৯৯৯ সালে দেশ পত্রিকায় গ্রন্থলোক বিভাগে। সেখানে শঙ্কর ঘোষ একটি আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন, যা সপ্তডিঙা ও অন্যান্য বইটির ১৪৩ পাতায় ছাপা হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, “বর্তমানে ত্রিশঙ্কু লোকসভার দুর্গম মরু পেরিয়ে আমরা কবে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের মরুদ্যানে প্রবেশ করতে পারব, আদৌ পারব, না তার আগেই আমাদের সাধের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটবে তা সকলেরই অজানা।” তাঁর সেই আশঙ্কা অস্বীকার করার আর সুযোগ নেই।

সপ্তডিঙা ও অন্যান্য বইয়ের দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে শঙ্কর ঘোষের কয়েকটি প্রবন্ধ। ইংলন্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভারত সফরে সঙ্গী ছিলেন রিপোর্টার শঙ্কর ঘোষ। বিলেতের রানী ও ট্রাডিশন শিরোনামে রাজকীয় প্রথা ও কেতা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালের ১৮ই মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায়। সফরের বর্ণনা ছাড়াও তাঁর লেখায় যে সুক্ষ্ম পরিহাস ছিল, পাঠকের মনে তা থেকে যাবে। শঙ্কর লিখেছেন,

সেবার রানীর সফর উপলক্ষ্যে ভারত সরকারের প্রচার দফতর রানি যেখানে যেখানে যাবেন, তার ছবি ও পরিচয় দিয়ে আর্ট পেপার বাঁধাই দামি একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। বইটিতে বেলুড় মঠ এবং দক্ষিণেশ্বর কলকাতায় অবস্থিত শুধু যে বলা হয়েছে তাই নয়, কলকাতার প্রসিদ্ধ ভবনগুলির মধ্যে সিনেট হলকেও জুড়ে দেওয়া হয়। সরকারি প্রচার দফতরের কাজকর্ম নিয়ে শঙ্করের সুক্ষ্ম খোঁচা, ‘রানীর না হয় প্রোগ্রামের বাইরে কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না, কিন্তু তাঁর সঙ্গীদের তো ছিল। ভাগ্যে তাঁদের কেউ পুস্তিকাটি পড়ে সিনেট হল দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি।’

আমরা বাঙালি, আমাদের কলকাতা-লেখায় শঙ্কর ঘোষের ঝাঁঝালো মন্তব্য মনে দাগ কাটে,  “চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে বাঙালির যে বসে খাওয়ার অভ্যাস হয়েছিল, তার জের এখনও বাঙালি মানসে রয়ে গেছে। বাঙালি তখন থেকেই শিল্পবিমুখ। জমিদারিই ছিল বাঙালি জীবনের মোক্ষ। জমিদারি আজ নেই কিন্তু আলস্যপ্রিয়তা থেকে গেছে।”

কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অনেক বেশি ভোকাল। এই বঞ্চনার শিকার অবশ্য বাংলা সেই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই। কলকাতার উন্নয়ন নিয়ে শঙ্কর ঘোষের বিশ্লেষণ, দিল্লি কেন্দ্রের শোপিস। তাই দিল্লির জন্য কংগ্রেসি সরকার (তখনও বিজেপি কেন্দ্রের দখল নেয়নি) যে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করবে, কলকাতার জন্য তার এক ভগ্নাংশও করবে না। একথা ঠিক। কলকাতার গর্ব মেট্রো রেল নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা যদি আর একটু কম স্বৈরতন্ত্রী ও সামান্য বেশি গণতন্ত্রী হতেন, তাহলে এই মেট্রো রেলটিও কলকাতায় হত না। বোম্বাইতে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত সেখানেই হত। কেননা বামফ্রন্ট সরকার মেট্রো রেলের ঘোর বিরোধী ছিল। প্রাক্তন মন্ত্রী প্রশান্ত শূর মেট্রো রেল চালু হওয়ার সময় তার বিরোধিতা করে আন্দোলনের হুমকি দেখিয়েছিলেন।” কলকাতার উন্নয়ন নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকার যারা সমালোচনা করেন, তাদের এই লেখাটি পড়া উচিত।

বামফ্রন্ট আমলেই বিশ্বব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ম্যাকনামারাকে কলকাতা বিমানবন্দরে গো ব্যাক ধ্বনি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় কিছুদিন ছিলেন ম্যাকনামারা, তাই বিশ্বব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান হয়েই তিনি কলকাতার উন্নয়নে দরাজ হাতে অর্থ সাহায্য দিতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে যাঁরা বিবেকবান, রাজনীতি সচেতন তাঁরা বললেন ম্যাকনামারা তো মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা সচিবের কাজ করেছেন। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে, কাজেই তিনি ভিয়েতনামের জল্লাদ। শহর উন্নয়নে আলোচনার জন্য তিনি দমদম বিমানবন্দরে নামতেই রাজনীতি সচেতন বাঙালি কালো পতাকা দেখালো। এমনকি তাঁকে গাড়িতে করে রাজভবনে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে পারেনি তৎকালীন প্রশাসন। হেলিকপটারে তাঁকে ময়দানে নামানো হয়। পরে অবশ্য বিশ্বব্যাঙ্কের টাকায় শহরের উন্নয়নে আপত্তি দেখেনি বাম সরকার।” এই বাক্যেই শঙ্কর ঘোষের খোঁচা রয়ে গেল।

শঙ্কর ঘোষ রিপোর্টিং শুরু করেছিলেন ইংরেজি কাগজে। একসময় একইসঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা কাগজে প্রতিবেদন দিয়েছেন। ইংরেজি ও

বাংলা দৈনিকের সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। একই সঙ্গে অনায়াস দক্ষতায় প্রবন্ধ, বই সমালোচনা করেছেন। ১৯৮৭ সালের আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি প্রবন্ধ রয়েছে এই বইয়ের ২১১ পাতায় রয়েছে। সাংবাদিকরা শুধু নয়, যাঁরা এই পেশায় আসতে চান, তাঁদের জন্যই যেন এই লেখা। লেখার শিরোনাম, সাংবাদিকতা বলতে আমি বুঝি রিপোর্টিং। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় কলম, দু একটি প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র ছাড়া আর সব কিছুই রিপোর্ট কোনও না কোনও জায়গা থেকে কেউ না কেউ পাঠিয়েছেন রিপোর্টার সংবাদপত্রের কারিগর। দোকানদার-পসরা সাজিয়ে ক্রেতাকে আকর্ষণ করা হল সাব-এডিটরের কাজ। নতুন প্রযুক্তিতে সাব এডিটরের যত সহায়তা হয়েছে, রিপোর্টারের ততটা নয়। ফলে যত সহজে সংবাদপত্রের চেহারার পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে, তত সহজে পাঠ্যবস্তু বদল সম্ভব হচ্ছে না। তার জন্য অন্বেষণ চলেছে, এবং সম্ভবত উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাবে পুরনো জিনিস নতুন মোড়কে ফেরি করবার একটি প্রবণতা আমাদের দেশের সংবাদপত্রে দেখা দিয়েছে। এই লেখার সময় বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমের এত রমরমা অবশ্যই ছিল না। তবে সেই মাধ্যম সম্পর্কেও বোধহয় এই কথাটি সমান প্রযোজ্য।

সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম সম্পাদক শঙ্কর ঘোষ ২০০৬ সালে ৮ অক্টোবর একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম মেশিন বেড়েছে কিন্তু মাথা তো সেই একটিই কাজ করে। ভাবতেই হয়। প্রবন্ধের শেষ প্যারায় তিনি লিখেছেন, সেই ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিফোন আমার সঙ্গে আছে। তাদের সংখ্যা বেড়েছে। এখন আমার তিনটি টেলিফোন। একটি মোবাইল-আমার স্ত্রীর নামে। একটি কমপিউটার। আমার চোখ ও কানের যা অবস্থা এদের কোনওটাই আমার প্রায় কাজে লাগে না। বাংলা হাতে লিখি। ইংরেজি যদি লিখতে হয় আমার ভিয়েনায় ১৯৫৫ সালে কেনা Kolibri বলে জার্মান টাইপরাইটারটি এখনও চালু রয়েছে। মেশিন বেড়েছে, মাথা তো একটিই কাজ করে।

সংবাদ প্রতিদিনে উত্তর সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর, তাতে তিনি লিখেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দুটি বিষয় নিয়ে। একটি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে সফল করা, অন্যটি তাঁর জরুরি অবস্থা ঘোষণা। ইন্দিরার জরুরি অবস্থা ঘোষণায় সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেননি শঙ্কর। তিনি লিখেছেন, দেশের অধিকাংশ মানুষেরই অন্নসংস্থানের চেষ্টায় দিন কাটে। জরুরি অবস্থার জন্য তাদের কোনও দুর্ভোগ হয়েছিল শোনা যায়নি। যদিও বা কোথাও হয়ে থাকে তাহলে সেটা পুলিশ ও প্রশাসনের অত্যুৎসাহের জন্য। পুলিশের অত্যাচার তো এখনও চলছে। প্রশাসনও তার ক্ষমতার আস্ফালন করতে সর্বদা প্রস্তুত। এ তাদের স্বভাব। জরুরি অবস্থার সময়ও তাই ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মিথ্যা প্রচার। রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা করার অবসর ধনী ও মধ্যবিত্তের আছে, গরীবের নেই। জরুরি অবস্থার সময় ধনী ও মধ্যবিত্ত বঞ্চিত হয়েছিল, গরীব হয়নি।

২০০৪ সালে ৪ এপ্রিল সংবাদ প্রতিদিনের পাতায় শঙ্কর লিখেছেন, পদক চুরিতে বঙ্গ সংস্কৃতি ও রবীন্দ্র উত্তরাধিকার বিপন্ন হয়নি। তাঁর কীর্তি অক্ষয়-অমর, তাঁকে স্মরণের জন্য পদকের প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের নোবেল পদক চুরি যাওয়া নিয়ে সেইসময় যে তোলপাড় শুরু হয়েছিল, সেই নিয়েই তাঁর লেখা। সিবিআইয়ের সমালোচনা তখন তিনি যেভাবে করেছেন, এখনও তা সমান প্রাসঙ্গিক। তবে সেজন্য এই লেখা উল্লেখ করছি না, লেখায় তাঁর একটা মন্তব্যের জন্যই এই উল্লেখ।নোবেল পদক চুরির ঘটনার সময় রাজ্যে বামফ্রন্টের সরকার, রাজ্যে বিরোধীদল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। সেইসময় তিনি লিখেছেন, “সিপিএম ও বামফ্রন্ট মুখে যাই বলুক, তারাও যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরূপ সমালোচনায় নার্ভাস হয়ে পড়ে, তা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শান্তিনিকেতন ঘোষণায় বোঝা গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো একটিই বুলি শিখেছেন, এরাজ্যে কোনও কিছু ঘটলে তিনি সিবিআই তদন্ত চেয়ে বসেন। সিবিআই যেন এই পোড়া দেশের পুলিশ নয়। এমন এক স্বর্গীয় পুলিশ বাহিনী যার প্রত্যেক সদস্য শার্লক হোমস, হারকিউল পোয়ারো, ব্যোমকেশ বক্সি বা ফেলুদার সঙ্গে তুলনীয় মমতার এই আদর্শ পুলিশবাহিনী এ পর্যন্ত কোনও বড় মামলায় সফল হয়েছে বলে মনে পড়েনা, বরং আদালত থেকে অপদার্থতার জন্য তিরস্কৃত হয়ে মুখ চুন করে ঘরে ফিরেছে।” এখন শঙ্কর ঘোষ থাকলে তৃণমূল সুপ্রিমো থেকে সিবিআই, বিজেপি ছাড়তেন না কাউকে।

সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য মেয়র থাকাকালীন কলকাতার রাস্তায় জলজমা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন বৃষ্টি হলেই কলকাতায় জল জমবে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও সেই অভিমত। কিন্তু দুই ভট্টাচার্য বলতে পারছেন না জল কমছে না কেন। ইদানিংকালের একজন সার্থক মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, বিকাশ ভট্টাচার্যর সারাক্ষণের কাজ তো ওকালতি। মেয়রের কাজ তো পার্ট টাইম।

খুব সাধারণ ছোট ছোট কথায় কোনও ব্যক্তি বা ঘটনাকে বিবৃত করার মুন্সিয়ানা ছিল শঙ্কর ঘোষের। হস্তান্তর, বাবুও বিপ্লবী, THE NAXALITE MOVEMENT-A MAOIST EXPERIMENT-প্রতিটি বইতেই তাঁর অসাধারণ সংযত লেখণী, অতি কথন এবং আবেগের বাহুল্য বর্জিত শব্দ চয়ন শেখার মতো। সব বইই আমার ভালো লাগার। এর সঙ্গে যুক্ত হল সপ্তডিঙা ও অন্যান্য।

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2025 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ