।। ১।।
আর বোলো না, কি দিনকাল পড়েছে !
তাই নয় তো কি? কাল রাতে কখন ফিরেছে জানো ?
কখন ?
সাড়ে বারোটা ! ভুতুর বাবা স্মোক করতে উঠেছিল, ব্যালকোনি থেকে দেখেছে। জানোই তো তিন দিন ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তার উপর বিজি সিজন, মাঝে মাঝে রাতভর জাগতে হয় গো লোকটাকে !
হ্যাঁ। পুরুষ মানুষ হলে তাও মানা যায় ! কিন্তু একটা মেয়ে ! অতো রাতে ফিরছে ! সোসাইটির মান সম্মান কিচ্ছু রইলো না আর !
তো আর বলছি কি ? লাস্ট সানডে ইভিনিং এ দেখেছিলে ? কি ড্রেসটা দিয়েছিল ?
হ্যাঁ ওই স্লিভ্লেস, ডীপ-নেক টা তো ? দেখেছি । সত্যি বাবা !
এই মেয়ে গুলো বাইরে থেকে বাবা – মা কে ছেড়ে এসে একা একা থাকবে; আর এসব করে বেড়াবে ! এরকম নোংরামি আর দেখা যায় না মিতালি দি !
দরজাটা খট করে আওয়াজ হয়ে খুলতেই ওপারে এতক্ষণ অবিরত চলতে থাকা কূটকচালি বন্ধ হয়ে গেল। বেরিয়ে এসে সারা দেখল পাশের ফ্ল্যাটের মিতালি বৌদির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার উল্টোদিকের বিল্ডিঙের আরেক প্রতিবেশী অপর্ণা বৌদি।
কিছুক্ষণ একটি অপ্রস্তুত নিস্তব্ধতা ! মিতালি বলে উঠল –
হে হে ! তা, অফিসে চললে নাকি সারা ?
হুম ! – ম্লান হাসিতে উত্তর দিল সারা।
যাই, আমি না রান্না চাপিয়ে এসেছি; এখন চলি; এলাম রে মিতালি। – বলে একরকম চম্পট দিল অপর্ণা।
নেমে এসে অটো করল সারা। ফ্ল্যাটের পড়শিদের এরকম কথোপকথন একরকম গা-সওয়া হয়ে গেছে তার। শুধু কি কথা ? যবে থেকে এ শহরে কাজের দৌলতে এসেছে, তবে থেকে মানুষের কথা, নজর সবকিছু যেন মাঝে মাঝে ছিঁড়ে খায় তাকে !
অটো চলতে লাগলো অফিসের দিকে। ড্রাইভার রিয়ারভিও মিররে যেন একটু বেশিই ঘন ঘন দেখছে বলে মনে হল। অস্বস্তির সাথে ওড়নাটা ঠিক করে নিল সারা।
কাজের অন্ত নেই অফিসে ! মিটিং এর পর মিটিং, ক্লায়েন্ট কল, টিম কল, জুনিয়রদের অ্যালোকেশন, কোয়ারি, হাবি-জাবি সামলাতে সামলাতে হাপিয়ে উঠল সারা। ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা হবে। কফি-মেশিনের কাছে যেতেই কলিগ অনিমেষের সাথে দেখা।
হাই সারা!
ওহ, হাই!
তারপর, পুজোর শপিং ডান ?
ওই আর কি, সামান্য কিছু।
হুম, তা আজ বেরচ্ছ কখন? সাড়ে পাঁচটা তো বাজে! আজ তো ষষ্ঠী, রাস্তাঘাটে জ্যাম এ পড়বে কিন্তু!
হ্যাঁ এই বেরোবো জাস্ট, কিছু কাজ শেষ করে …
কথাটা শেষ করতে দিল না অনিমেষ। বলে উঠল –
একে জ্যাম তার উপর আবার তোমাদের মেয়েদের কিসব ওই মিটিং-মিছিল আছে না, কি সব রাত্রি দখল না কি ? তার জেরে তো আরও সমস্যা!
এক্সকিউজ মি! ‘মিটিং-মিছিল’, ‘সমস্যা’ ; সিরিয়াসলি ?
আরেকটি অপ্রস্তুত নিস্তব্ধতা!
না মানে, ওই মানে, আমাকে না সুব্রত দা একবার ডেকেছিল, চলি হ্যাঁ, পরে কথা হবে। – একরকম দৌড়ে বেরিয়ে গেল অনিমেষ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে চুমুক দিল সারা।
তারপর এক ঘণ্টা মতন হবে, কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়ল সে। ফেরার পথে সমস্যা হল বৈকি, তবে কলিগের সংজ্ঞাত কোনো সমস্যা নয়। বৃষ্টি! মুষলধারে বৃষ্টি! একটাও অটোর পাত্তা নেই। বাসে যাও বা যাবে ভেবেছিল, ভিড় দেখে কুণ্ঠাবোধ করল সে। কোনোমতে মাথা বাঁচিয়ে অফিস বিল্ডিঙটার উল্টোদিকের বাসস্টপ টায় গিয়ে দাঁড়াল।
।। ২।।
স্কুল থেকে ফেরা থেকেই ছেলেটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গিয়েছিল। গা-টা হালকা হালকা গরম দেখেই সন্দেহ হয়েছিল ভার্গবীর। আশঙ্কাটা বাস্তবে পরিণত হল বিকেল পাঁচটার থেকে। ধুম জ্বর! ওষুধ খাইয়ে; মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে সে দেখল ওষুধ তো শেষ!
তখন ঘড়িতে সন্ধ্যে ছটা। ছেলেটা একটু ঘুমিয়েছে। কপালে হাত দিয়ে ভার্গবী দেখল তাপটা নেমেছে। ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ল সে।
ওষুধ কিনে যেই না বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে; চরম ঝড়-জলে ছাতাটা গেল ভেঙে। নিরুপায় হয়ে সামনের বাসস্টপ টায় এসে দাঁড়াল। রনির বাবার তো এতক্ষণে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে! ভাবতে না ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো –
হ্যালো, ফিরেছো ?
হ্যাঁ, কি ব্যাপার কি তোমার? ছেলে জ্বরের ঘোড়ে এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছে, কোথায় তুমি ?
ঘাবড়ে গিয়ে ভার্গবী বলে উঠলো – আমি ওষুধ নিতে বেরিয়েছি। মা-কে তো বলে এসেছিলাম বাবুকে একটু দেখতে, আমি ঝড়-জলে আটকে পরেছি। বাবুর কি হয়েছে? খুব বেশি শরীর খারাপ করছে?
ওপাশের কণ্ঠস্বর যেন আরও রুঢ় হয়ে বলল –
মা কে বলেছি মানে? ছেলেটা তোমার না মায়ের? আর মা তো বলছে তুমি নাকি কিছু বল নি ? একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার? সেই কখন বেরিয়েছ?
এবার খানিকটা ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল ভার্গবীর –
বললাম তো বৃষ্টিতে আটকে গেছি, ছাতা টাও ভেঙে গেছে। আর উনি তো বলবেনই। সন্ধ্যে হলেই তো সিরিয়ালে ডুবে যান। আসে-পাশে কি হচ্ছে কোনও খেয়াল আছে তার? আর আমি বাবুকে ওষুধ খাইয়ে এসেছি।
বাজে কথা রাখো। সিরিয়াল দেখবে না তো কি করবে ? সারা জীবন কষ্ট করে আমাকে মানুষ করেছে। এখন একটু সময় পায় তাই। তুমিও তো একজন হাউসওয়াইফ। তাও মায়ের ব্যাপারে এভাবে বলো কি করে ? সারাদিন ঘরেই তো থাকো। এক পয়সা তো রোজগার করার ক্ষমতা নেই। তাও কখন কোন ওষুধটা ফুরিয়ে গেছে খেয়াল রাখতে পারো না? ইউসলেস ! অসুস্থ ছেলেটাকে ফেলে রেখে বেরিয়ে গেছো? হ্যালো, হ্যালো …
আর শুনতে পারল না ভার্গবী ! ফোনটা কেটে দিল। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল তার।
।। ৩।।
বাসস্টপের একটা কোনার দিকে বসে সবটা লক্ষ্য করছিল সারা। ভার্গবীকে ওভাবে কাঁদতে দেখে নিজের জলের বোতলটা এগিয়ে দিল সে।
খাও।
চোখের জল মুছে খানিকটা জল খেল ভার্গবী।
থ্যাংকস।
হাউসওয়াইফ? – কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসল সারা।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ভার্গবী বলে উঠল –
হ্যাঁ। তুমি তো জব করো তাই না ?
হুম, কিন্তু কথা তো সেখানেও শুনতে হয়। – মৃদু হেসে সারা বলল।
তোমাকেও শুনতে হয়?
হ্যাঁ। কত কি শুনি দিনরাত! “মেয়ের পয়সায় কদ্দিন খাবে? বিয়ে দিয়ে দাও।“; “মেয়েটার ড্রেসটা দেখেছো?”; “কাল রাতে কখন ফিরেছে জানো?” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি !
একটা ব্যাঙ্গের হাসি হাসল সারা। ভার্গবী বলল –
তাও তোমার একটা চাকরি আছে; উঠতে বসতে খোঁটা তো শুনতে হয় না। “এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নেই।“; “ঘরেই তো থাকো, সন্তানের খেয়াল রাখতে পারো না?”; “কি মেয়ে রে বাবা, বাপের বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসে নি দেখছি!” ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি !
এবারের নিস্তব্ধতাটা অপ্রস্তুত বা অস্বাভাবিক নয়। একটি নগ্ন-বাস্তবিকতা। দম বন্ধ করে দেওয়া। দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলে যেমনটা হয়।
এবারের টা সারাই ভাঙল। কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভেবে হঠাৎ সে বলে উঠল –
শোনো।
কি?
এরপর থেকে যদি তোমাকে কেউ বলে – “এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নেই”, তাকে বোলো সে যাতে রোজগার করে বাড়ি এসে খাওয়াটা, জামাকাপড়টা, ঘুমটা ঠিক ঠাক পায়, সেটা দেখার ক্ষমতা তোমার আছে। কেউ যদি বলে – “ঘরেই তো থাকো, সন্তানের খেয়াল রাখতে পারো না?”, তাকে বোলো সন্তান তোমার একার নয়, সমান দায়িত্ব টা তারও। আর যদি কেউ বলে “বাপের বাড়ি থেকে কিছু শিখে আসো নি?”, তাকে বলবে – এতকাল চুপ করে থাকতে শিখেছিলে, এবার বলতে শিখেছ!
মনে যেন এক অদ্ভুত সাহস পেল ভার্গবী। কিছুক্ষণ থেমে সেও এরপর বলে উঠল –
আর তোমাকে যদি শুনতে হয় – “মেয়েটার পোশাকটা দেখেছো?”, তাকে বোলো তোমার পোশাকে তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার লাইসেন্স ছাপা নেই। যদি শুনতে হয় – “রাতে কখন ফিরেছে জানো?” তাকে বোলো প্রতিটা মানুষের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। আর যদি কেউ বলে – “মেয়ের পয়সায় কদ্দিন খাবে? বিয়ে দিয়ে দাও”, তাকে বোলো তুমি না হয় তোমার বাবা-মায়ের ছেলে হয়েই তাদের দায়িত্ব টা নিলে!
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ!
ভার্গবী বলল – কি নাম তোমার ?
সারা! অ্যাকচুয়ালি সরস্বতী । কর্পোরেট ভার্সন “সারা”। ইউ নো রাইট!
হুম।
আর তোমার নাম?
ভার্গবী!
ভার্গবী, অ্যাজ ইন? ভার্গবী মানে কি?
লক্ষ্মী।
তখন বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিস্কার হয়ে এসেছে!
Tags: গল্প, দেবাশিস সাহা, লক্ষ্মী - সরস্বতী
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।