১
বৃষ্টি থেমে গেছে তাতো প্রায় সাত দিন হয়ে গেল। সুমিদের উঠোন থেকে জল নেমে গেছে। গত কয়েকদিন রোদের তেজ ছিল প্রখর। উঠোন মোটামুটি শুকিয়ে গেছে। তবু সুমি সাবধানে উঠোনের ধার ঘেঁষে হাটে। তাঁর মা কাঠ এবং কয়লার উনুনে রাঁধেন। সেই ছাই ফেলে একটা সরু চলার পথ করেছেন তিনি। তাঁদের বাড়ির সীমানায় কলাবতী ফুলের গাছ আছে বেশ কয়েকটা। সেখান থেকে কোলাব্যাঙ এর ডাক শুনতে পেয়েছে এই কদিন। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর কোলাব্যাঙ এর মিলিত শব্দ জানিয়ে দেয় এটা বাংলার এক গ্রাম। সুমি একটা ঝুড়ি আর বটি নিয়ে বের হয়েছে আজ। সোনাপিসিদের বাড়ি যাওয়ার পথে প্রফুল্লকাকাদের বড় পুকুর। ওই পুকুরপাড়ে প্রচুর কচুগাছ আছে। কচুর লতি কেটে নিল সুমি। আজ কচুর লতি রান্না হবে চিংড়ি মাছ দিয়ে। তাঁর বাবার মুদি দোকান আছে বাজারে। মাঝে একটা ফাঁকে সনাতনকাকাকে দিয়ে বাজার করে পাঠায় বাবা। মাছ প্রায় রোজই থাকে আর থাকে মিষ্টি কুমড়ো। এই দুটো জিনিস তিনি আনবেনই। বাকি সুমির ঠাকুমার ফর্দ মতো। গ্রাম ঘরে শাক পাতা কচুর লতি এসব কেউ তেমন কেনে না। সুমির পিসি রেখা থাকে শহরে। পিসি আক্ষেপ করে বলে যে ওখানে নাকি গ্যাদাল পাতাও বাজারে বিক্রি হয়। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফেরে সুমি। হঠাৎ কোলাব্যাঙটাকে দেখতে পায় সে। বেশ বড় মোটাসোটা! কেমন যেন ড্যাব ড্যাব করে তাঁর দিকে তাকায়। তারপর গলা ফুলিয়ে ডেকে উঠল। সুমি মনে মনে ভাবে বোধহয় ওর খিদে পেয়েছে। ব্যাঙ ফড়িং পাখি প্রজাপতি এসব সুমির খুব প্রিয়। ওর বয়স এখন বারো। গতমাসে ও ঋতুমতী হয়েছে। সুমিকে কাছে ডেকে ওর পিসি রেখা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এটা মেয়েদের জীবনের এক স্বাভাবিক ঘটনা। প্রজনন ডিম্বাণু সম্পর্কে অল্প ধারণাও পিসি তাকে দিয়েছেন। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। কিছু শব্দ সে জীবনবিজ্ঞান বইতে পড়েছে। কিন্তু তত বোঝেনি। তার পিসি রেখা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছেন। এখন একটা স্কুলে পড়ায়। সুমি মনে মনে ঠিক করে পিসি এলেই এই ব্যাঙটার কথা জিজ্ঞেস করবে।
রাত এখন প্রায় ১০ টা। সুমি ভাত খেতে বসেছে। ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে যাচ্ছে অদ্ভুত সুরে। সুমি খেয়ে উঠে ঠাকুমার পাশে শুয়ে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি গল্পটা পড়বে। বইটা বন্ধু মিতার কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। দুদিন বাদেই ফেরত দিতে হবে। সুমির আজ খুব ঘুম পাচ্ছে। ও জানে বইটা নিয়ে বসলে হয়ত ঘুম কেটে যাবে। আজকাল রাত হলে সুভাষকাকার মায়ের কান্নার আওয়াজ পায় সুমি। ফুলিপিসি মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি কেঁদেই চলেছেন। আসলে এই মৃত্যুটাকে গ্রামের কেউ মেনে নিতে পারে না। সকলে বলে অস্বাভাবিক। পুলিশ এসেছিল। তদন্ত নাকি হচ্ছে।
পুজোর জামাকাপড় নিয়ে রেখা এসেছে। দুর্গাপুজোর আর ঠিক তেত্রিশ দিন বাকি। সে সুমি ও বাবুর পিসি । সুমি শুনেছে সে নাকি এবার পুজোর ছুটিতে বহরমপুরে যাবে। পুজোর মধ্যে না পরে তা ঠিক সে জানে না। ওখানে সুমির বাবার খোকনকাকু থাকেন। সুমির সম্পর্কে দাদু হন তিনি। তাঁর বাসায় গিয়ে থাকবেন বেশ কটা দিন। সুমির ভারী ইচ্ছে যে সে যায়। কিন্তু তাঁদের পাড়ার পুজো যাত্রাপালা মেলা এসব ছেড়ে তো যাওয়া যায় না। বছরে এই কটা দিন তাঁদের পাড়াটা যেন খুশিতে সেজে ওঠে।
সুমি এক মুঠো ভাত নিয়ে কলাবতী গাছের গোড়ায় রেখে এলো। তার মনে হলো ওই ব্যাঙটার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। তার কাণ্ড দেখে রেখা তো হেসেই অস্থির। সে সুমিকে কাছে ডেকে বললো শোন ব্যাঙ উভচর শ্রেণীর ( Amphibia) মেরুদন্ডী প্রাণী। বর্ষাকাল হল ব্যাঙদের প্রজনন কাল। এই প্রজনন কথাটা সুমি শুনেছে। মানেও খানিকটা বোঝে। আগের বার পিসিই বুঝিয়েছে। পিসির গুণ হলো সব কিছু সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া। সে বললো বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়লে পুকুর, ডোবায় যত পরিণত পুরুষ ব্যাঙ বাস করে তারা স্ত্রী ব্যাঙকে আকৃষ্ট করার জন্য ডাকতে থাকে। ও হ্যাঁ পুরুষ ব্যাঙের গলার কাছে স্বরথলি থাকে কিন্তু স্ত্রী ব্যাঙে তা থাকে না। তুই যে ব্যাঙটাকে খাবার দিয়ে এলি ও তার মানে পুরুষ ব্যাঙ। পুরুষ ব্যাঙের ডাকে স্ত্রী ব্যাঙ আকৃষ্ট হয়ে কাছাকাছি আসে এবং তাদের মধ্যে যৌন মিলন ঘটে। নতুন প্রাণের সৃষ্টি হয়। মানে প্রথমে ব্যাঙাচি ও পরে রূপান্তরের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ হয়ে ওঠে। তার মানে বুঝলি তো ওর খিদে পায় নি। আর খিদে পেলে ও ঠিক পোকামাকড় খুঁজে খেয়ে নেবে।
সুমি ব্যাঙাচি দেখেছে। বিজ্ঞান বইতে ব্যাঙের জীবন চক্র পড়েছে। এটুকু সে জানত। কিন্তু আজ কত কী জানল। রেখা বললো না জানি কত রকম ভাবে সৃষ্টি হচ্ছে প্রাণের। সব কী আর জানি রে!
এই বর্ষার জল যখন ঘাট ছেড়ে মাঠ আর গৃহস্থের উঠোনে দৌড়ায় তখন ছোট ছোট থ্যাপলা জাল দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। রেখা এই একটা সময় বাপের ঘরে এসে বেশ করে মাছ খায়। তাঁর শ্বশুরবাড়িতে মাছ খাওয়া হয় সপ্তাহে মাত্র তিনদিন। বাকি চারদিন নানান নিয়মে নিরামিষ রান্না লেগেই থাকে। রেখার ভালো লাগে না। আসলে এই বিয়েটাই রেখা মন থেকে মানেনি। রেখা ভালবাসত সুভাষকে। সুভাষ তখন বেকার। সারাদিন ছাত্র পড়ায়। খুব ভালো অংক করায় সে। উপার্জন বেশ ভালো কিন্তু সে তো চাকরি নয়। এর মধ্যে সুভাষের বোন ফুলির রহস্যমৃত্যু আরও বিষয়টা ঘেঁটে দিল।
রেখার মা তাড়াহুড়ো করে বিয়ের খোঁজখবর করতে শুরু করল। প্রণবেশ সরকারি চাকরি করে। দেখতে শুনতে খারাপ নয়। বাড়িটাও মাত্র তিন স্টেশন পরে। রেখার চাকরি করতে অসুবিধা হবে না। রেখার বিয়ে হয়ে গেল। সে প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। এখনো সন্তান হয়নি তাঁর। কেন সে জানে না ভাবেও না। প্রণবেশ চাহিদা বা ইচ্ছা অনুযায়ী রাতে শরীর পেতে দেয় রেখা। মাঝে মাঝে ভালই লাগে। সুঠাম চেহারার প্রণবেশ তাঁকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে।
রেখার মন পড়ে থাকে তাঁদের সেই সদগোপ পাড়ার মন্দিরতলার মাঠে। ওই মাঠের এক কোণে ছিল সন্ধ্যাদের বাড়ি। বাড়িটা যেন একটু তফাতে যেন একটু একলা। ওই বাড়িতে সুভাষ ছাত্র পড়াত। ওই বাড়ির একটা ঘর ও ভাড়া নিয়েছিল। সেদিন রেখা সন্ধ্যাদের বাড়িতে এসে আটকে পড়ে। কী ভীষন ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঘন ঘন বাজ পড়ে। সন্ধ্যা সেদিন বাড়িতে একাই ছিল। আর ওই পড়ার ঘরে সুভাষ একা চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পড়ছিল। এই রকম ঝড় হলে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। রেখা সুভাষের ঘরে গেছিল তালের বড়া দিতে। সন্ধ্যাই পাঠিয়েছিল। সেদিন ওই ঘরে কতক্ষণ ছিল , ঠিক মনে নেই। তবে সেই রাতে সে তাঁর সর্বস্ব সুভাষকে দিয়েছিল। বৃষ্টি থামলে মন্দিরতলার মাঠ পার করে দেয় সুভাষ। রেখা বলে কবে আমরা বিয়ে করব রে। আমি তো তোকে ছাড়া পাশে কাউকেই ভাবতে পারি না। সুভাষ কোন কথাই বলে না। রেখা বাড়ি ফেরে।
পরের মাসে নির্দিষ্ট সময়ে ঋতুস্রাব হলে রেখা নিজেকে নিরাপদ মনে করে। তার ঠিক তিনদিন বাদে সুভাষের বোন ফুলির মৃতদেহ পাওয়া যায় কালিপুকুরে। এর তাঁর মুখে খবর ছড়ায় এটা খুন। পুলিশ আসে । লোকে বলে কোন বিশেষ ঘটনা আছে ওদের পরিবারে। ওদের এক আত্মীয় সে বোধহয় দুর সম্পর্কে মামা, সে থাকত ওদের বাড়িতে। এই ঘটনার পর সে নাকি বেপাত্তা। এই সময় রেখার মা তাড়াহুড়ো করে বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। এর মধ্যে রেখা স্কুলে চাকরিটা পেয়ে যায়। সব মিলিয়ে জীবনটা যেন একটা অন্য ধারায় বইতে থাকে।
২
সুরবালার বয়স কম করে পঁচাত্তর হবে । অনেক দেখেছেন এই জীবনে । এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে ভরা সংসারে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ বুঝতে শিখেছেন তিনি। সুভাষের পরিবার তেমন সুবিধার নয় বুঝে মেয়েকে বিয়ে দিলেন অন্যত্র। কেন জানিনা মনে হয় মেয়েটার তেমন মন বসেনি। প্রণবেশ ভালো ছেলে। তবে পরিবারটা বড্ড ধার্মিক। পরিবার মানে ওই তো ওর বাবা আর মা। এরা বড্ড বেশি পুজো উপোস এসব নিয়ে থাকেন। রেখাকে কোন কিছু চাপিয়ে দেননি। কিন্তু ওই প্রায়ই নিরামিষ খেতে মেয়ের ভালো লাগে না। সুরবালা আশা হারিয়ে ফেলার মানুষ নন। তাঁর বিশ্বাস কোনো না কোনো দিন রেখা মানিয়ে নেবে।
এমন অনেক কিছু তিনি মানিয়ে নিয়েছেন আবার অনেক কিছু পারেননি। সব মেয়েদেরই বিয়ের আগে পরে সংসারে অনেক কিছু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়। রেখা অবশ্য তা মানে না। ওর মত ভিন্ন। কিছু বলতে গেলেই বলে কেন , আমিই কেন সব মেনে নেব? সংসার তো তাঁরও।
সুরোবালা এসব ভাবতে ভাবতে ট্যাংরামাছ ধুয়ে তাতে নুন হলুদ মাখাতে থাকেন। তিনি আজ গাটিকচু দিয়ে ট্যাংরা মাছের গা-মাখা ঝোল রাঁধবেন। রেখা যে কাল চলে যাবে। নাতনি সুমির কথা ভেবে দুটো লংকা শিলপাটা থেকে তুলে রাখেন। মেয়েটা একদম ঝাল খেতে পারে না। রাঁধতে রাঁধতে ভাবেন সেদিনও ছিল আশ্বিন মাস। এই সময় তাঁদের দেশের বাড়ির সেই মেঘনা নদীর ধারে, জলাভূমি ও চরাচর জুড়ে শুধু দেখা যেত নানান ফুল।
ভোরবেলা দূর্বা ঘাসের উপর শিশিরের কণা পায়ে আলতো ছোঁয়া লাগিয়ে দিত। সুরো যেত পুকুরে বাসন ধুতে। দিনের বেলা গরম থাকলেও রাতে এবং ভোরে ঠান্ডা বাতাস বইত। পুকুরের মেঘমুক্ত নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেলা নিয়ে সাঁতার কাটত যেন!
এই রকম এক দিনেই তো বড়মামা এসেছিলেন তাঁর শ্বশুরঘরে। কত কী এনেছিলেন! সেদিনও ট্যাংরামাছ রান্না করেছিল সুরো। সঙ্গে ইলিশ । মা মারা যাওয়ার পরে সুরোর ঠিকানা হয় ওই বড়মামার বাড়িতেই। বড্ড আদর যত্নে মামা তাঁকে বড় করে তোলেন। সেই মামা এলে সুরো একটু বেশীই খুশি হন।
এবার মামার মুখ যেন কেমন কেমন। বেশ চিন্তাক্লিষ্ট, কালো ছায়া মুখে। ভাত বেড়ে দিতে দিতে সুরো শুধালে,
– মামা আপনের কি শরীর খারাপ?
– না রে মা। বড্ড চিন্তায় পড়সি।
– কেন মামা! কিছু গোলমাল হইসে নি?
– হ রে মা, এইবার মনসা পূজাখান খুব কষ্ট কইরা করসি। কত যে বাঁধা !
– আমাগো এই গ্রামটা কিন্তু বেশ ভালা।
– তবু সময় থাকতে ইন্ডিয়ায় চইল্যা যাওয়াই ভালো। রাজাকারেগো কোন বিশ্বাস নাই।
– আপনে কি যাইবেন মনস্থ করসেন? অত বড় কাপড়ের দোকান । নারানগঞ্জে অত বড় কারবার!
– সব বিক্রিবাটা কইরা দিমু। আর সোনাকাকায় তো যাইব না জানস। যা গোয়ারগোবিন্দ! বাকি যা থাকে হ্যায় দেখব , সামলাইব।
এরপর মামা খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে সুরোর স্বামীর সঙ্গে কী যে পরামর্শ করলেন! পুজোর পর পরই তাঁরা সকলে চলে এলেন এই দেশে । বড় মামা তারপর মাত্র একটি বছর বেঁচে ছিলেন। নিজের ভিটেমাটি হারানোর শোকে মারাই গেলেন তিনি।
তারপর এক দেশ ছেড়ে আর এক দেশ! কত কী মানিয়ে নেওয়া। শুধু কি মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন! জল হাওয়া মাটি সবার মাঝে খুঁজে নিতে হলো তাঁদের সেই সবুজে সবুজ গ্রামটিকে। যা বা যেটুকু এদেশে এলে পাওয়া গেল, তা যত্ন করে খুঁটে তুলে নিলেন নিজের অন্তরে। জীবন শেষ হতে চলল, শুধু মানিয়ে বা মেনে নেওয়া!
রেখা তো তারই মেয়ে। সে ঠিক পারবে। এসব মনে মনে ভাবেন তিনি।
দুপুরে রেখা খেতে বসলে সুরো জিজ্ঞেস করে,
– তুই খোকন ঠাকুরপোর বাসায় কবে যাবি?
– পূজার আগেই যামু। কেন গো?
– আমি এক বয়াম আচার দিমু লইয়া যাইস।
– দিও। আর যদি কিছু মনে ইচ্ছা করে তো দিও।
– জামাই যাইব তো?
– জানি না। এখনো তাঁকে বলি নি।
– ছুটি থাকলে তাঁরেও নিস লগে।
রেখা আর কোনো কথা না বলে বাকি ভাত কটা খেতে থাকে। সে জানে তেমন সাধাসাধি না করলেও প্রণবেশকে একবার বললেই সঙ্গে চলে যাবে। রেখা এক এক সময় ভাবে একেই কি ভালবাসা বলে? লোকটা খারাপ নয় বরং বেশ ভালোর দিকেই। তবু রেখার মন জুড়ে বসে আছে সুভাষ ।
৩
সন্ধ্যাবেলায় সুমি রেখার কাছে পড়তে বসে। রেখা বলে,
– আজ তোকে চটপট কয়েকটা অংক শিখিয়ে একটু মন্দিরতলায় যাব।
– সন্ধ্যাপিসীদের বাড়ি কি?
– হ্যাঁ রে। কাল তো চলে যাব, তাই একটু দেখে আসি।
– কিন্তু ওদের বাড়িতে তো তালা লাগানো দেখলাম।
– তাই নাকি!
– হ্যাঁ। ওরা তো অনেকদিন হলো নেই গো। বাড়ি তো বুঝি বিক্রি হয়ে গেছে।
– ওমা! শুনিনি তো ! কে কিনল রে?
– মোহনদাদুর ছেলেরা। পিছন দিকটা তো ভেঙ্গে ফেলে ওরা ঘর তুলছে।
– কোথায় গেছে সন্ধ্যারা। জানিস কিছু।
– শুনেছি ওই রানাঘাটে নাকি সন্ধ্যাপিসীদের কে আছে , ওখানেই সন্ধ্যাপিসী আর ওর মা চলে গেছে।
কেমন যেন অদ্ভুত লাগে রেখার। হঠাৎ সন্ধ্যাদের এই চলে যাওয়ার কথা শুনে মনের ভিতরটা খচখচ করে ।
সুভাষের খবর অনেকদিন পায় না রেখা। ভাইঝিকে জিজ্ঞেস করে ,
– সুভাষ তাহলে এখন কোথায় পড়ায় রে?
– পড়ায় না তো আর।
– সেকী! কেন রে।
– চাকরি করতে কোথায় যেন চলে গেছে। ওই যে, বোধহয় দিল্লিতে।
রেখা চুপ করেই ভাবে কী জানি কী হলো! সব কিছু যেন কেমন গোলমেলে লাগছে।
রেখা পরদিন শ্বশুরবাড়ি ফেরে। আর কদিন পরেই বহরমপুরে যাবে। এই কাকার বাড়ি যেতে রেখার খুব ভালো লাগে। প্রায় প্রতি বছর অন্তত একবার রেখা যায়। কাছেই একটা বড় মাঠ। কাকার কাছে শুনেছে এই মাঠটিকে বলা হয় ব্যারাক স্কোয়ার। এটা একটা ঐতিহাসিক ভূমি যার সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ এবং সিপাহী বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।
১৭৬৭ সালে বহরমপুর ক্যান্টনমেন্ট অংশ হিসেবে তৈরি এইখানে একসময় ব্রিটিশ সৈন্য এবং কর্মকর্তাদের থাকার জায়গা ছিল।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সূচনাও হয় এখানে। প্রায় চল্লিশ একর জুড়ে একটা প্রায় বর্গাকার মাঠ। মাঠটির চার কোণে চারটি কামান বসানো রয়েছে। রেখার বড্ড ভালো লাগে এই জায়গাটা। মাঠ ঘিরে কত বড় বড় গাছ। রেখা কাকার সঙ্গে সন্ধ্যাবেলায় কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে যায়।
রেখা একাই ব্যাগ গুছিয়ে কাকার বাড়ি রওনা দেয়। দুদিন ঘুরে বেড়িয়ে ভালোমন্দ খেয়ে কাটিয়ে দিলেও এবার কেন জানিনা মনটা বড্ড কেমন কেমন করতে থাকে। রেখার মনে পড়ে সন্ধ্যা একবার বলেছিল রানাঘাটে ওর এক মাসি থাকেন। মাসির বাড়ির খুব কাছেই নিস্তারিণী কালীবাড়ি। রেখা তাঁর কাকীমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে এই কালীবাড়ি নাকি খুবই বিখ্যাত আর জাগ্রত। কাকিমাও একবার গেছিলেন পুজো দিতে। রেখা ভাবে একটা চান্স সে নেবে। সে ঠিক করল কাল সে একবার রানাঘাট যাবে। সে শুনেছে ওই কালীবাড়ির খুব কাছেই সন্ধ্যার মাসি থাকেন। তাঁর নাম আদুরী। এসব তো সন্ধ্যার মায়ের মুখে গল্পে শোনা। আদুরী মাসির বাড়িতে একটা দুই মাথা তালগাছ আছে। লোকে তালগাছ বাড়ি বলে। সন্ধ্যার মা কোন কারণে রেগে গেলেই বলতেন , যামু গা ওই তালগাছ বাড়িতে।
রেখা নিস্তারিণী কালীবাড়ি এসে প্রথমে পুজো দেয়। দেখে মোটামুটি অনেক লোক এই মন্দিরে পুজো দিতে এসেছে। পুজো দিয়ে সে একটা চায়ের দোকানে এসে এক কাপ চা খায়। তারপর দোকানিকে জিজ্ঞেস করে,
– দাদা এখানে তালগাছ বাড়িটা কোথায় বলুন তো?
– ওই রিক্সা স্ট্যান্ড থেকে ডান দিকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে যান। দেখবেন দুই মাথা তালগাছ। পাকা দু-কামরার বাড়ি।
রেখা চা খেয়ে খান দশেক বেকারির বিস্কুট কেনে। ব্যাগে এক বাক্স সন্দেশ আছে। তারপর সামনে চোখ রেখে হাঁটতে থাকে।
বাড়ি অবধি পৌঁছতে হয় না। তার আগেই সন্ধ্যার মায়ের সঙ্গে দেখা। দেখেই কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায় তাঁর মুখ। রেখা ঢিপ করে প্রণাম করে। বলে কাকার বাড়ি এসেছিলাম । ফেরার পথে রানাঘাটে নামলাম, ভাবলাম একটু পুজো দেই আর তোমাদের সঙ্গেও দেখা করি।
এখন সন্ধ্যার সামনে বসে রেখা। সন্ধ্যা গর্ভবতী। কপালে সিঁদুর, পায়ে আলতা। সন্ধ্যার মা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে চলে, সুভাষ সন্ধ্যাকে ভালবাসার কথা বলে। বিয়ের লোভ দেখিয়ে সহবাস করে। সন্ধ্যা গর্ভবতী হলে সে কাজের অছিলায় দিল্লি না কোথায় কে জানে চলে যায়! গ্রামে আর একটা ফুলি যাতে না হয় তাই তাঁরা এখানে চলে আসেন। সমাজের কথা ভেবে সন্ধ্যা সিঁদুর পরে। সন্ধ্যা মাঝখানে বলে ওঠে, না সুভাষ আমার স্বামী। ও একদিন সিঁদুর পরিয়েছিল আমাকে। রেখা সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে বলে নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁকে তো খুঁজে বের করতে হবে। দায়দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে।
কে খুঁজবে তাঁকে, কেঁদে বলে সন্ধ্যার মা। রেখা বলে তোমরা একটা কাজ করো। একটা ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। ইনি খুব ভালো মানুষ। একজন দিদিমনি। মেয়েদের অসুবিধা হলে সাহায্য করেন। তিনি ঠিক খুঁজে বের করে তোমাদের সাহায্য করবেন। নৈহাটিতে বাড়ি। এক ফাঁকে গিয়ে কথা বলে নিও। আমার নাম করবে।
রেখা বাড়ির পথ ধরে। হঠাৎ ওর খুব প্রণবেশের কথা মনে হয়। স্টেশনে নেমে রেখা একটা শার্ট কেনে। এই প্রথম সে কিছু কিনল। দোকান থেকে বের হয়ে দেখে প্রণবেশ দাঁড়িয়ে। রেখা আজ ফিরবে জানত। বুঝি দেখেছে তাঁকে দোকানে ঢুকতে। রেখা হেসে ফেলে। বলে চলো ওই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে গরম রসগোল্লা কিনি কটা। তুমি তো খুব ভালোবাসো তাই না! রেখা এগিয়ে গিয়ে প্রণবেশের হাতটা শক্ত করে ধরে।
[ বানানবিধি লেখকের নিজস্ব]
Tags: Galper Samay, Rupa Sengupta, গল্প Short story, জীবন, রূপা সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।