অরুণদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৪-১৯৭৫ এ। তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ঢুকেছি। অরুণদা তখন হিন্দমোটরে কাজ করে। ‘শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়া গাছটিকে’ লেখা হয়ে গিয়েছে। আমার শহরের আর এক কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় নিয়ে গিয়েছিল চন্দননগরের শুকসনাতনতলায় অরুণদার বাড়িতে। লিটল্ কার্লমাক্সকে দেখে সেদিন সদ্য যুবক চমকে উঠেছিলাম। সেদিন কয়েকটা কবিতা শোনার পর স্বভাব বাউল অরুণদা আমায় বলেছিল চল বুড়ো তোকে আজ ব্যাপটাইজড করতেই হবে। ব্রহ্মতরল নয় রে গরল আল ভাঙি আয়।
ব্যাপারটা তখন বুঝিনি। একটা রিক্সা করে তিনজনে এসে হাজির হয়েছিলাম জি.টি.রোডে যেখানে ফরাসি আমলে তৈরি চন্দনগরে ঢোকার ঐতিহাসিক গেটটি আছে ঠিক তার পাশে একটা প্রাচীন শুঁড়িখানায়। সেটি আজও আছে। সেখানে ঢুকতেই দেখি অরুণদার একগেলাসের বন্ধুরা আর ভক্তেরদল হৈ হৈ করে তাকে স্বাগত জানাল। সেদিন প্রথম একছিপি র’ হুইস্কি আমার মুখে ঢেলে দিয়ে অরুণদা বলে উঠলো জয়গুরু। তুই আজ যা কবিতা শুনিয়েছিস তাতে তোকে ব্যাপটাইজড না করলে অন্যায় হত। আমি মুগ্ধ রে পাগলা। বলে নিজেও ঢকঢক করে খানিকটা বাংলামদ খেয়ে নিল। তারপর বলে উঠলো আউল বাউল জাত ভিখিরি সবাই নাচো।
জীবনে সেই প্রথম মদ খেলাম। মানে মুখেমদ হল, সঙ্গে মাছভাজা বা ঐ জাতীয় কিছু ছিল যা আজ আর মনে নেই আমার। কিন্তু সেই মুহূর্তে মানুষটিকে আমার মোটেই খুব ভালো লাগেনি। বাড়িতে এসে মায়ের নাক এড়িয়ে যেতে পারিনি। মা কে সব বলার পর মা চুপ করে খানিক্ষণ থেকে বলেছিল আর যেন কোনোদিন না হয়।
এরপর অরুণদা নিজেই একদিন আমার বাড়ি এসে হাজির। মাকে পরিচয় করিয়ে দিতেই মা অরুণদাকে বেশ বকুনির সুরেই বলেছিল তুমি খুবই অন্যায় করেছিলে বাবা। অরুণদা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে হেসে বলেছিল করবে? অন্যায় করেছি কান মুলে দাও। অন্যায় করবো, আবার ক্ষমাও চেয়ে নেবো মাগো।’ বলে হা হা করে হেসে উঠেছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম সেই দিন থেকে মা অরুণদাকে একটু বেশিই স্নেহ করত। অরুণদার স্ত্রী জয়েশ্রীবৌদি শ্রীরামপুরের এক বিখ্যাত মেয়েদের স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন।
সেটা আটদশকের শেষ দিকে একবার দুপুরে আমার বাড়ি এসে সারাদুপুর কবিতার আড্ডা দিয়ে বিকেলে বেরিয়ে গেল। আমিও গেলাম সঙ্গে এগিয়ে দিতে। বটতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে স্কুল ছুটির পর সবাই যখন হৈহৈ করে বাড়ি ফিরছে। অরুণদা যেই দেখেছে বৌদি আসছে ভরাট গলায় চিৎকার করে উঠেছিল জয় জয় আমি অরুণ বলছি তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি একসঙ্গে ফিরবো বলে।’ এক সঙ্গে ফিরবো বলে দাঁড়িয়ে আছি হেতা,’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আমার প্রেম কত গভীর জল মাপবে কে তার’ বল বুড়ো ঠিক বলিনি।
ছাত্রী দিদিমণিরা সবাই দেখছে সেদিকে, আমি অবাক হয়ে দেখলাম বৌদি একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে রাস্তার এদিকে এসে অতি স্বাভাবিক ভাবে আমার সঙ্গে একটু কথা বলে একটা রিক্সায় উঠে স্টেশনের দিকে চলে গেল। সেদিনের সেই ঘটনা আজও আমার কাছে পরম বিস্ময়।
২
অরুণদার সঙ্গে বহু গ্রামে গঞ্জে মেলায় ঘুরেছি বহুবার।স্বভাববাউল কবি অরুণদা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাবে প্রবল প্রভাবিত ছিল। পড়াশোনায় উচ্চমেধার ছাত্র। অসাধারণ রেজাল্ট নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা মানুষটি হিন্দমোটরে উচ্চপদে চাকরি করতে করতেই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ভবঘুরের মতই বাউলজীবন যাপন করতো। নিজের লেখা’ ওই আসে শিবের সকাল দীর্ঘকবিতাটি যখন অরুণদা স্মৃতি থেকে পাঠ করতো অতীতে সে কবিতাপাঠ যাঁরা শুনেছেন নিশ্চিত সেদিন যেভাবে শিহরিত হয়েছিলেন তা আজও ভাবলে শিহরণ জাগাবে।
গত শতকের নয়ের দশকে অরুণদার ডাকে একবার এক কাব্যসভায় চুঁচড়োয় এসেছিলেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত গায়িকা প্রতিমা বড়ুয়া। অরুণদাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। কবিতার আসর জমে গিয়েছিল অরুণদা আর প্রতিমা বড়ুয়ার গানে। কবিতা তখন দূরঅন্ত। হঠাৎ প্রচুর মদ আর বিড়ি খেয়ে আচ্ছন্ন প্রতিমা বড়ুয়া বলে উঠলেন আর গান চলবে না। অরুণ তুই কবিতা পড়। অরুণদা নেচে নেচে গান গেয়ে কবিতা পড়ছে আর প্রতিমা বড়ুয়া অঝোর কাঁদছেন। আমরা ১৫-২০ জন তরুণ দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য।
বাউলেরা অরুণদাকে ভীষণ ভালোবাসতেন।একবার কেন্দুলি জয়দেব মেলায় দুজনে গিয়েছি। অরুণদার জন্যে একটা আলাদা তাঁবু। সেখানেই বসেছে বাউলের আড্ডা। সারারাত ঘুম নেই। ঘুমোলেই অরুণদা বলেছে-বুড়ো জীবনটা বড্ড ছোটো রে। ঘুমিয়ে কাটালে হবে না রে। ‘সুধীর ক্ষ্যাপা আর ক্ষেপীমা গাইছেন মন দিয়ে শোন,’ আহা সে দিন আর ফিরে পাবো না। সেবার বাউলেরা অরুনদাকে বাউল সম্মান দিয়ে ছিলেন। একটা একতারা আর আরও কিছু ছিল।
অরুণদা গীতিকবিতাকেই পছন্দ করত। আমায় বলতো তোরা তেলেকচুয়াল দাম্ভিক কবি। বলেই বলতো তুই বলিনি তোরা বলেছি। মানে তোর কবি বন্ধুরা। গীতগোবিন্দের শ্লোকে অবগাহন কর রে। দেখবি দেহের আর বিভাজন থাকচে না। একাকার হয়ে যাবিরে। তুইই কৃষ্ণ তুইই রাধা। তুইই বাউল তুইই তোর সাধনসঙ্গিনী। জানিস তো অপূর্ব যৌনলীলায় রাধা কিন্তু মা রাধা হলো না, পৃথিবীতে চরকালীন প্রেমিকা রূপেই রয়ে গেল। বলেই বলে উঠলো -‘নিজস্ব তপবনের আলোয় সেজে ওঠো তুমি ছায়ায় ছায়ায়, প্রেম বনিকের হাওয়ায় ভজো গীত গোবিন্দম ভজো গীত গোবিন্দম’। এই অরুণদাই সুন্দরলাল বহুগুণার ‘চিপকো’ আন্দোলনেও যুক্ত ছিল। নিজেকে বলতো ‘আমি সোশ্যাল এক্টিভিস্ট’। বলতো প্রকৃতি না থাকলে বুড়ো তুই আমিও থাকবো নারে। প্রেমের ঝুমুর ঝুমঝুমাবো, পাক ধরেছে কাঁচা বাঁশিতে।
১৯৯৫-১৯৯৮ সালে আমার বাড়িতে একটা কবিতার আড্ডা বসতো প্রতি মাসে। পঞ্চাশটি আড্ডার পর বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অরুণদা প্রত্যেকটি আড্ডায় আসতো। একদিন দুপুরে আড্ডা বসার আগে কবি অরুণ আর ইঞ্জিয়ার অরুণ মিলেমিশে একাকার হয়ে আমায় বোঝাতে শুরু করেছিল স্বভাবিক শক্তি আমাদের জানা শক্তিগুলি আমাদের অজানা শক্তিগুলি (Total Normal Energy, TE Known Energy, KE + Unknown Energy, UKE অর্থাৎ TE KE+ UKE ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার তখন ছেরে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। অরুণদা বুঝতে পেরেই কবিতা বলতে আরম্ভ করে দিলো ‘জলছুরি কাটছে পাথর’, আর ‘পা চলছে পা টলছে…’
আটের দশকে আমি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতাম’ ত্রিবেণী’। অরুণদা বলেছিল’ ধুর ওটা একটা নাম হল? পত্রিকার নাম রাখ ‘মউল’।’ বলে সেদিন আমার বাড়িতে বসেই লিখেছিল প্রচ্ছদ কবিতা ‘মউলবালা’। আর একটি কবিতা ‘বৃষ্টি-পিড়িত ঝুপুর ঝুপুর’ পরে আমার বাড়িতে এক তুমুল বৃষ্টির দুপুরে প্রচুর মদ খেয়ে লিখেছিল। দুটি পান্ডুলিপিই আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে আজও। ২য় কবিতাটি লেখার আগে এক বোতল বৃদ্ধসন্ন্যাসী পান করে অরুণদা বলে উঠলো বুড়ো সারা আকাশ কলকলাচ্ছে, সারা ঘর খলখলাচ্ছে, পা দুটো টলমলাচ্ছে, তোর ভিতর থেকে কে যেন এক আমায় দিয়ে কবিতা লেখাচ্ছে। বলচে বাঁচো রে বুড়ো, সবাই বাঁচো, মদদোকানি, খবরকারি চুন্নুরানী, তাড়িউলি, সবাই বাঁচো, ঝুপুর ঝুপুর বৃষ্টি দিনে সবাই বাঁচো।
তার পরেই একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে লিখে ফেললো ‘বৃষ্টি-পিড়িত ঝুপুর ঝুপুর’। তবে আমার সঙ্গে বেশ কয়েকবছর যোগাযোগ রাখেনি অরুণদা। আমিও রাখতে চাইনি। তার
আরও কত যে অভিজ্ঞতা আছে শেষ করা যাবে না।কারন, ডানলপের গেস্টহাউসে একবার প্রয়াত জগবন্ধু কুন্ডু সম্পাদিত ‘সাহিত্য সেতুর’ বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রচুর মদ্যপান করে মঞ্চে উঠে অরুণদা আর কয়েকজন সাকরেদ খুব আপত্তিজনক কিছু কাজ করেছিল। যা আমার মনে হয়েছিল অরুনদাকে মানায় না। আসলে এগুলো করতে অরুণদার কিছু অকবি মাতাল বন্ধু অরুনদাকে মদত দিত। আমি আর কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলাম এবং কিছু মানুষ অরুণদাকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। সেদিন আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। দীর্ঘদিন অরুণদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি।
হঠাৎ হলদিয়ায় তমালিকা পন্ডা শেঠের অনুষ্ঠানে গিয়ে আবার দেখা, হাতে একটা লজেন্স গুঁজে দিয়ে বলেছিল বুড়ো আমারও সেদিন খুব রাগ হয়েছিল রে, তবে পরে বুঝেছি তুই ঠিকই করেছিলিস। আয়রে বুড়ো আয় আমার অনেক কথা আছে আয় ভাগ করে খাই ভালোবাসা।’
যতদূর মনে পড়ছে সেই ১৯৮২-১৯৮৩ হবে আমি, মাঘ মাসের ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় আমি অরুনদা আর সমরেশদা কেন্দুলি গিয়েছিলাম। সমরেশদা অসাধারণ মানুষ চিলেন। অরুণদা বলতো তাঁকে ‘সাহিত্যের উত্তমকুমার’। কদমখন্ডি শ্মশানে চিতার আগুন দেখতে দেখতে দুই মানুষের সে কি দুরন্ত প্রকাশ। চিতার লাল আগুনে সেদিন দুটো মানুষকে অন্যরকম ভাবে চিনে ছিলাম। তার পরেই অরুণদা সমরেশদাকে নিয়ে ১৯৮৪র ডিসেম্বরের ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেছিল ‘সমরেশ বাউল’, লিখেছিল- পা দুটি তার বাঁধা আছে সুরে গদ্যে গানে।
অরুণদা একটা পত্রিকা সম্পাদনা করত ‘অউম’। এই নাম আর বিষয় নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে। অরুণদা বলত একঘেয়ে জীবনে থেকে অন্য এক জীবনের আস্বাদন’ অউম’।
শেষ দেখা মৃত্যুর কিছুদিন আগে বকখালি উৎসবে আমি আর বন্ধু কবি মৃদুল দাশগুপ্ত সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। অরুণদা সহ আরও কিছু বিশিষ্ট কবি ও লেখক ছিলেন। অরুণদা আমায় জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো বুড়োরে সেই ছোট্টো তুই আজ আমার সঙ্গে এক আসনে। কি আনন্দ রে, এইইই দ্যাখ অউম বাজছে কানে, সাগর জলে ভাসিয়ে দে সব’।
উড়ে গেছে অরুণদা। চলে গিয়েছে স্বর্ণ কৌপীন পড়া এক আন্ত বাউল কবি। গাবগুবাগুপটা একলা পড়ে আছে। লাবডোবাডোব ছন্দে বাজবে না আর। পাখিরে তুয়ার খবর কুথাকে পাই।
Tags: Ramkishore Bhattacharya, গল্পের সময়, গাবগুবি তার একলা আছে, রামকিশোর ভট্টাচার্য
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।