সেক্টর ফাইভ থেকে বাসে করে উল্টোডাঙা নামতেই খিদেটা চাগার দিল অনুষ্টুপের। শেষ খাবারটা খেয়েছে সেই দুপুরবেলা। বাড়ি থেকে দেওয়া টিফিনে আজ ছিল পরোটা, আলুর তরকারি আর মিষ্টি। আজ যেন একটু বেশিই খিদে পাচ্ছে।কী জানি কী হয়েছে।দুপুরের টিফিনটাও আজ টিফিন টাইম হতে না হতেই সাঁটিয়ে দিয়েছে। একটা বাজতে না বাজতেই অনুষ্টুপ টিফিন কৌটো খুলে বসায় কাশ্মীরাদি টোন কেটে বলল, বাব্বা এ যে দেখছি টাইমবাবু।হেড অফিসে রিপোর্টের পর রিপোর্ট পাঠিয়ে শেষ করতে পারছি না, আর তুই খেতে বসে গেলি?
ওদিক থেকে সিঞ্জিনি আওয়াজ দিল, জানোই তো ও বাধ্য ছেলে।বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে টাইমে খেয়ে নেওয়ার জন্য।অফিসে এই এক সমস্যা।সকলে খালি কাজ দেখায়।অফিসে ব্রাঞ্চ হেড উপস্থিত থাকলেই কাজের ধুম পড়ে যায় সকলের।যেন কে বা কত কাজ, করিবেক আজ – তারই লাগি তাড়াতাড়ি।রবীন্দ্রনাথ এসে পড়ে অনুষ্টুপের মাথায়।আরে বাবা একটার সময় লাঞ্চ টাইম।সেই সময় টিফিন খেতে বসলে সমস্য কী? যেন টিফিন টাইমে খাবার খেতে না পারাটাই কাজের প্রতি একনিষ্ঠ হওয়ার উদাহরণ।অনুষ্টুপের ওসব পোষায় না কোনওদিনই।অফিসের আর পাঁচটা কর্মীর থেকে ও একটু যেন অন্যরকম।ওর আবেগ বেশি, ওর খিদে বেশি, বস’কে সন্তুষ্ট রাখতে ছুটির পরেও ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করতে ওর আপত্তিও বেশি। সেক্টর ফাইভে একটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানির অফিসেই এইভাবে বছর তিনেক কাটিয়ে দিল অনুষ্টুপ।যতদিন না নতুন কিছু জুটছে ততদিন সেক্টর ফাইভের এই অফিস টু উল্টোডাঙা টু সোদপুরই ডেলি রুটিন ওর।
কী খাওয়া যায় সেটাই উল্টোডাঙায় নেমে ভাবতে লাগল ও।চতুর্দিকে রোল, চাউমিন, মোমোর দোকান। ইডলি- দোসা, সিঙারা–জিলিপি, তেলেভাজা কিছুরই অভাব নেই। এর সঙ্গে রাস্তাজুড়ে রঙিন পসরার ছড়াছড়ি। কারণ কাল দোল।দেশী পদ্ধতিতে তৈরি ভেষজ আবির, বিদেশী রঙ, হরেক রকমের পিচকারি, মুখোশ, চুল, জামা – যেন চিনাবাজার।অনুষ্টুপ জানে এসবের আশি শতাংশই মেড ইন চায়না।
রঙ খেলার পাঠশালা অনুষ্টুপের কোনওকালেই নেই।ওদের ফ্ল্যাটের নীচে বেসমেন্টে দোলের দিন বেলা বাড়লে একপ্রস্থ রঙ খেলা হয় বটে তবে তাতে অনুষ্টুপ নিজেকে মেলাতে পারে না।একটা অনাগ্রহ কাজ করে।কাল দোল হলে পরের দিন হিন্দুস্থানীদের দোল, দু-দিনের ছুটি। সেইরকমটাই জেনে এসেছে সেই ছোটবেলা থেকে। ফলে দোলের এই দিন দুয়েকের ছুটি বাড়িতে শুয়ে বসে টিভি-মোবাইল দেখেই কাটিয়ে দেয় ও। সেই হিসেবে আজ একটু চাপ মুক্ত লাগছে নিজেকে।প্রতিদিনের বাড়ি ফেরার যে তাড়া থাকে আজ তাতে স্লথ গতি।উল্টোডাঙা স্টেশনের লাগোয়া মোড়ে যেখান দিয়ে ট্রাম রাস্তাটা বেঁকে গেছে ঠিক সেখানেই রোল, পকোড়া, চাউমিনের হাঁকডাক।
অনুষ্টুপের এসব খেতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই এখনও মাইনে হয় নি, তাই বাজেট প্রায় নেই বললেই চলে।তার উপর রোল চাউমিনের এইরকম ম্যারাথন মেকিং দেখে ওর ভক্তি আসে না।তার থেকে একটু ঘুগনি আর সেঁকা পাঁউরুটি খেয়ে নেওয়াই ভাল এমনটা ভেবে রাস্তাটা পার হয়ে নিল অনুষ্টুপ।স্টেশন লাগোয়া দোকানগুলোর মধ্যে এই একটাতেই সন্ধ্যেবেলাতেও ঘুগনি পাঁউরুটি পাওয়া যায়।খিদে পেলে মাঝে মধ্যে এখানে খেয়ে নেয় ও।আজ জিজ্ঞাসা করতেই দোকানদার বলল ঘুগনি শেষ, ডিম-পাউরুটি খেতে হবে। অনুষ্টুপ তাতেই রাজি হয়ে বসে পড়ল দোকান লাগোয়া দুটো বেঞ্চের একটাতে।এখানে এই একটা সুবিধে।উল্টোডাঙার মত শশব্যস্ত জায়গাতেও একটু বসে খাওয়া যায়।অফিস ফেরত অনেকেই এখানে ডিমভাজা, চা বা অন্যকিছু খেয়ে বাড়ি ফেরে।তারাও একটু বসে নিয়ে দশ- কুড়ি মিনিট আয়েস করে খায় টায়।ফলে বসার জায়গার একটা টান থেকেই যায়।আজ লোক কম, তাই ঢোকা মাত্র সুযোগ পেয়ে দোকানদারকে ডিমটোস্ট করতে বলে ব্যাগটা পাশে রেখে বেঞ্চে একটু বসতেই একটা বাচ্চা মেয়ে এসে হাজির হল।সে এসেই অনুষ্টুপের গায়ে টোকা মেরে কিছু খেতে চাইল। অনুষ্টুপ ওকে চেনে। প্রায় প্রতিদিনই উল্টোডাঙা স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে অনেকগুলো বাচ্চার সঙ্গে খেলা করতে দেখে ও।ছেঁড়া জামা, চুল উস্কোখুস্কো, খসখসে গা – যেমনটা হয় আর কি! পুরো টিকিট কাউন্টার এলাকা জুড়ে চলে ওদের হুড়োহুড়ি দাপাদাপি।যেন ওদেরই বাড়ি ঘর।একটু দূরেই ওদের মা-মাসি দিদি- বাবা-কাকা বা ঠিকে নিয়ে রাখা লোকেরা নিজেদের মধ্যে গালাগাল দেয়, গুলতানি করে, গা চুলকোয়, উকুন মারে।এ দৃশ্য অতি পরিচিত।এসব মোটেও ভাল লাগে না অনুষ্টুপের।কোন বাচ্চা কার বা কটা বাচ্চা ওদের নিজের সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ওর। বাচ্চা মেয়েটা খাবার চাইতে প্রথমে সরাসরি ‘না’ ই বলে দিল ও।কিন্তু তাতে কাজ হল না।মেয়েটা ঘ্যান ঘ্যান করতেই লাগল।দোকানদারও দু-এক বার ‘এই যা’ ‘ওই যা’ বলে তাড়া লাগাল। কিন্তু মেয়েটা শুনল না।অনুষ্টুপ জানে এসব ক্ষেত্রে ওদের সঙ্গে দোকানদারের বোঝাপড়া থাকে।খরিদ্দার যদি কিছু কিনে দেয় তাতে তো দোকানদারেরই লাভ।তবে এতদিন সেভাবে ভেবে দেখে নি।আজ ছোট্ট মেয়েটার টলটলে মুখটা দেখে কেমন একটা কষ্ট হল অনুষ্টুপের।ভাবল হতেও তো পারে মেয়েটার সত্যি সত্যি খিদে পেয়েছে।হয়ত সারাদিন কিছু খায় নি।ওর ভাইঝি টুপটুপের বয়সও প্রায় এইরকম।অথচ ওকে যাদবপুরের বিশাল ফ্ল্যাটে কোথায় রাখবে, কি খেতে দেবে, কি কিনে দেবে তা নিয়েই অস্থির দাদা- বৌদি। মেয়েটা পয়সা চাইলেও ওকে কিছু খাবার কিনে দেওয়ার কথা ভাবল অনুষ্টুপ।বলল, খাবার কিনে দিতে পারি – খাবি? তবে এখানে বয়সেই খেতে হবে, চলবে?
অনুষ্টুপ জানে, বাচ্চাদের হাত দিয়ে তুলে আনা এই সব পয়সা আসলে বড়দের ঝুলিতেই যায়।ভিখিরিদের নিয়ে একটা বড় চক্র কাজ করছে এলাকা জুড়ে।অনুষ্টুপের এমন প্রস্তাবে মেয়েটা যেন একটু ঘাবড়েই গেল।ঝামেলা এড়াতে অনেকেই ওকে সামান্য পয়সা দিয়ে বিদেয় করে দেয়।অনেকে খাবার দিলেও কেউ জোর করে খেতে বলে না।তবে খাবারটা ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না এমনটা ভেবে মেয়েটা রাজিই হয়ে গেল।অনুষ্টুপ আর একটা ডিমটোস্টের অর্ডার দিতেই মেয়েটা ম্যাগি খাব বলে বায়না ধরল।
ম্যাগি? এখন ম্যাগি হবে নাকি? অনুষ্টুপ দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল।দোকানদার ঘাড় নাড়ল।অর্থাৎ ম্যাগি পাওয়া যাবে।ভেজ ম্যাগি, এগ ম্যাগি সবই পাওয়া যাবে, কোনটা করে দেবে তা জানতে চেয়ে দোকানদার অনুষ্টুপের দিকে তাকিয়ে রইল।পকেটের কথা ভেবে অনুষ্টুপ ভেজ ম্যাগিই অর্ডার দিল।কিন্তু বাদ সাধল মেয়েটাই।বলল ভেজ নয় এগ ম্যাগিই খাবে সে।
বলে কী এগ ম্যাগি? খেতে পায় না তার আবার ভাল খাওয়ার শখ।মনে মনে এমন কথা ভেবে আবার উল্টোদিকটাও ভাবল অনুষ্টুপ।ভাবল পায় না বলেই না এরকমটা খেতে চাইছে।হয়ত খাওয়ার লোভ হয়, ইচ্ছে হয় কিন্তু সে সাধ পূরণ হয় না।তাই আজ যদি আঙ্কেল এই সাধটা পূরণ করে দেয় তাতে খারাপ কী? এরকম সাত পাঁচ ভেবে মেয়েটার দাবি মত এগ ম্যাগিতেই রাজি হয়ে গেল অনুষ্টুপ।
মুচকি হেসে দোকানদার একটা ওভেনে চায়ের দুধ বসিয়ে অন্যটায় শুরু করে দিল ম্যাগি বসানোর প্রস্তুতি।এসবের মধ্যেই দোকানে চলে এল আর একটি পুঁচকে ছেলে।সে মেয়েটার চেয়েও ছোট।হয়ত ওর খেলার সঙ্গী বা ভাই।অনেকক্ষণ দেখা না পাওয়ায় হয়ত এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছিল।পুঁচকেটা আসতেই তার কানে কানে কিছু একটা বলল মেয়েটা। বোধহয় জয়লাভ সূচক ম্যাগি প্রাপ্তির সংবাদটাই দিয়ে দিল ওকে।মেয়েটার কথা শুনে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে পড়ল ছেলেটার মুখ।কী যেন একটা হারানোর দুঃখ।বসে বসে সবটাই লক্ষ্য করছে অনুষ্টুপ।ভাবছে এবার বোধহয় ছেলেটা এসেও এক প্লেট ম্যাগির বায়না ধরবে। এই সব ভাবনার মধ্যেই সামান্য অন্যমনস্ক হতেই দেখল পুঁচকেটা হাত দিয়ে তাকে ঠেলা মারছে।বলছে আমিও ম্যাগি খাব।
ইতিমধ্যেই ডিমটোস্ট বানিয়ে তা পিস পিস করে কেটে প্লেটে সাজিয়ে গোলমরিচ গুড়ো ছড়িয়ে অনুষ্টুপের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে দোকানদার।প্লেটটা হাতে নিয়ে অনুষ্টুপ ভাবল এ এক অদ্ভূত গ্যাঁড়াকলে পড়া গেল।আজতো ও কম পয়সায় মেকআপ মারতে চেয়েছিল।কিন্তু হয়ে গেল ঠিক উল্টোটা।এখন ছেলেটার দাবি মানলে খরচ আরও বাড়ে।কিন্তু অনুষ্টুপকে যেন মায়ায় পেয়ে বসেছে।ও দোকানদারকে বলল আর একটা এগ ম্যাগি করে দিতে ছোট্ট ছেলেটার জন্যে।
দোকানদার আর একবার মুচকি হাসল।বারবার এই হাসিটা কি কোনও বিশেষ অর্থ বহন করে ? কিছু বুঝতে পারল না অনুষ্টুপ।শুধু ডিমটোস্ট খেতে খেতে ছেলেটাকে বলল- এখানে বসেই খেতে হবে কিন্তু, নিয়ে যাওয়া চলবে না।ছেলেটাও সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে দিব্যি খেলা করতে লাগল মেয়েটার সঙ্গে।ওদের নিজেদের মধ্যে হওয়া কথার সূত্র ধরে অনুষ্টুপ বুঝতে পারল যে মেয়েটার নাম পুলু আর পুঁচকে ছেলেটার নাম টিটো।ওরা নিজেদের মধ্যে তুই-তোকারিই করছিল।
দু-মিনিটের মধ্যে দোকানটা ছেলেটা আর মেয়েটার হট্টগোলের জায়গায় পরিণত হল।এ ওকে ঠেলতে লাগল, ও তাকে।পুঁচকে টিটো কোথা থেকে একটা কঞ্চি এনেছিল।সেটা দিয়েই পুলুকে মারতে গেল।মেয়েটা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে পিছিয়ে গেল।কিন্তু বসার জন্য আড়াআড়ি করে পেতে রাখা বেঞ্চিটা থাকায় বেশিটা যেতে পারল না।কঞ্চির ঘা টা পুলুর পিঠেই এসে পড়ল।আঘাতের হিসেবে ব্যাপারটা খুব হালকা হলেও সেই বা ছাড়বে কেন? এক পা এগিয়ে একটা কিল বসিয়ে দিল টিটোর পিঠে।ওদের এই উৎপাতে বিরক্ত হল দোকানের অন্য কাস্টমারেরা। একজন বয়স্ক লোক অনেকক্ষণ থেকেই বসেছিলেন, অনুষ্টুপ আসার আগে থেকেই।শার্ট-প্যান্ট পরা বেশ ধোপদুরস্ত চেহারা।অনেকটা সময় ধরে ধীরে সুস্থে বাটার টোস্ট-ওমলেট-চা ইত্যাদি খেয়ে চলেছেন।বোধহয় রেগুলার কাস্টমার।বাচ্চাগুলো এরকম করায় তিনি একবার মেপে নিলেন অনুষ্টুপকে। অর্থাৎ ওদেরকে এখানে এন্ট্রি দেওয়াটা ওনার পছন্দ নয়।অবশ্য অনুষ্টুপ এসবে গুরুত্ব দিল না।ও আপন মনে পিস পিস করা ডিম পাঁউরুটির টুকরোগুলো আস্তে আস্তে মুখে তুলতে লাগল যতক্ষণ না বাচ্চাগুলোর খাবারটা তৈরি হয়।
কিন্তু পুঁচকে দুটোর হট্টগোলে দোকানদারও বিরক্ত।বারবার চড় মারব, থাপ্পর মারব ইত্যাদি হুশিয়ারিতে কাজ না হওয়ায় ম্যাগি বানানোর গরম খুন্তিটা নিয়ে ওদের দিকে তেড়ে গেল।এতে ওরা বুঝি কিছুটা বমকে গেল।তাড়া খেয়ে পালিয়ে না গিয়ে ওরা দুজনেই চুপটি করে বসে পড়ল একটুখানি জায়গায়।দোকানদার অন্য কাস্টমারদের দিকে তাকিয়ে বলল এই জন্য শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে এখানে থাকতে দিই না।আমার কাস্টমার নষ্ট করবে।এদের গোটা গুষ্টিকে আমি চিনি।আর যারা বসেছিল বা কিছু খাচ্ছিল তারা চুপ করেই রইল।কথাটা যেন গায়ে লাগল অনুষ্টুপের।বুঝল নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।অর্থাৎ বাচ্চাগুলোকে এখানে খেতে বসানোর ঔদার্য্য দেখিয়ে সে ঠিক কাজ করে নি।
কিন্তু এই নিয়ে যে কী পরিমাণ সঙ্কট তৈরি হতে পারে তার কোনও আন্দাজ তখনও তৈরি হয় নি অনুষ্টুপের মনে।পুচকে দুটো কিছুক্ষণ ভাল হয়ে বসে থাকার পর বেঞ্চ থেকে নেমে পড়ল দুজনেই। অর্থাৎ আর তর সইছে না ওদের।কখন খাবার হবে সেই অপেক্ষাতেই অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে।ওরা কোথায় থাকে কে জানে! হতে পারে উল্টোডাঙা স্টেশনের গা ঘেঁষা যে বস্তিটা আছে সেখানেই থাকে।অথবা হতে পারে টিকিট কাউন্টারের যেখানে ওদের ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি করতে দেখে সেখানেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। হয়ত বা ফুটপাথেরই ছেলেমেয়ে ওরা।এখান থেকে নিজেদের অজান্তেই একদিন ওরা পৌঁছে যায় অন্ধকারের রাজ্যে।মুম্বইয়ের গলি বা দিল্লির ফ্ল্যাট বাড়িতে।কিন্তু এতসব ভেবে অনুষ্টুপের কী কাজ?
পুঁচকে দুটো আবার নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু করেছে।ওরা কি একটুও স্থির হয়ে থাকতে পারে না, অনুষ্টুপ ভাবল। আর দোকানদারই বা করছেটা কী? ওদের খাবারটা দিতে এত দেরী করছে কেন? নিজের খাওয়া শেষ করে প্লেট না নামিয়ে রেখে উঁচু হয়ে রান্নার জায়গাটার দিকে মুখ বাড়াল।দেখল বড় সসপ্যানে ম্যাগি রেডি।কিন্তু অন্য কাস্টমারদের প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে সেটা পড়েই আছে।
অনুষ্টুপকে দোকানদার জানতে চাইল চা দেব ?
বাচ্চাগুলোকে খাবারটা দিয়ে আমায় চা দিন – অনুষ্টুপ যেন কিছুটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ঢঙেই বলল।লোকটা আবার মুচকি হাসল।এর মধ্যেই কাণ্ডটা ঘটে গেল।পুঁচকে দুটোর ঠেলাঠেলিতে একজন কাস্টমারের হাত গেল নড়ে।আর ভাঁড়ের গরম চায়ের অনেকটাই গেল চলকে পড়ে।জামা-প্যান্টে না লাগলেও হাতে গরম চা পড়ায় লোকটার মেজাজ গেল খিঁচড়ে।তিনি উঠে দাড়িয়ে বাচ্চা দুটোকে এই মারেন তো সেই মারেন অবস্থা।
এইরকম একটা ঘটনা ঘটতেই সার্ট প্যান্ট স্যু পরা ভদ্রলোক টোন কাটলেন। কে যে এভাবে এদের খাবার খেতে ডাকে কে জানে ?
ভদ্রলোকের কথাটা খুবই গায়ে লাগল অনুষ্টুপের। কথাটা যে ওকে উদ্দেশ্য করেই বলা তাও বুঝতে পারল সে।পুঁচকে দুটোকে এখানে খাবার কিনে দিতে রাজি হওয়া ইস্তক সমস্যাটা বাড়ছে।ওদের দুজনকে উৎপাতই মনে করছেন এঁরা।এমনকী দোকানদারও। হয়ত এর আগে দোকানদারের নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে।চা পড়ে যাওয়ার পর লোকটা মারতে উদ্যত হওয়ায় পুলু আর টিটো ঠাণ্ডা মেরে এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল।কারণ লোভনীয় ম্যাগি ছেড়ে যাওয়া যায় না।ওরা অনুষ্টুপের দিকে খুব লজ্জিত ভাবে তাকাল – যেন অপরাধ মার্জনা করে দেওয়া হয়।ভারি মায়াভরা চোখ ওদের।
অনুষ্টুপ দোকানদারের দিকে তাকাতেই দেখল দুটো শেষ হয়ে যাওয়া মার্জারিনের কৌটোতে ঢালা হয়েছে তৈরি হওয়া ম্যাগি।সেটাকে একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ওদের হাতে ধরিয়ে দিল দোকানওলা।ম্যাগি পেয়ে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না ছেলেটা আর মেয়েটা।পলিথিনের প্যাকেটটা নিয়েই আলো ঝলমল উল্টোডাঙার মোড়ে যেন ডানা মেলে উড়ে গেল ওরা দুজন।
এরকমটা হওয়ার তো কথা ছিল না – আপত্তি জানাল অনুষ্টুপ। সে দোকানদারকে বলল, আমি বাচ্চাগুলোকে এখানে খাওয়াবো বলে অর্ডার দিয়েছিলাম, আর আপনি ওদের প্যাকেটে দিয়ে দিলেন ? ওগুলো ওরা খেতে পাবে ? অন্য লোকেরাই তো সব খেয়ে নেবে?
এখানে এই ব্যবস্থাই চলে, দোকানদার বলল।
তার মানে ব্যাপারটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। মেজাজটা খিঁচরে গেল ওর।দোকানদারের মাঝে মধ্যে হাসির অর্থ এখন বুঝতে পারল অনুষ্টুপ।এখনও চা খাওয়া হয় নি ওর।সেটা আর এখানে খাবে না বলেই ঠিক করে নিল ও।ডিমটোস্ট আর ম্যাগির দাম মিটিয়ে দিতে দিতে বলল – এটা আপনি ঠিক করলেন না।আমার ইচ্ছে ছিল বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর।দেখলেন না মুখগুলো শুকিয়ে গেছে! সারাদিন খায় নি।
অনুষ্টুপের কথা শুনে কিছু উত্তর না দিয়ে ফের মুচকি হাসল দোকানদার।কিন্তু টোন কাটলেন একটু দূরে বসে থাকা সার্ট-প্যান্ট।এবার সরাসরি অনুষ্টুপকে উদ্দেশ্য করে বললেন – দাদাভাই কি অমর্ত্য সেনের কেউ হন নাকি? এখানে দারিদ্র্য দূরীকরণ করছেন ? আগে তো কখনও দেখিনি।
লোকটাকে আগেই সহ্য হয় নি, এবার মাথাটা গেল আরও গরম হয়ে।অনুষ্টুপ উত্তর দিল, তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?
এসব করতে হলে বাইরে গিয়ে করুন। হাজার হাজার টাকা দিন, ওদের উন্নয়ন করুন কিন্তু এখানে করবেন না।এখানে আমরা খাওয়া দাওয়া করি, আমাদের অসুবিধে হয়।
লোকটার মোচড় মারা কথায় দারুণ অবাক হল অনুষ্টুপ।বাবার বয়সী মানুষটা বলে কী? বাচ্চাগুলোকে এখানে অ্যালাউ করা যাবে না? ফুটপাথের উপর বাঁশ-কাঠ-টালি দিয়ে জবরদখলের দোকান – সেখানেও আমরা ওরা!
অনুষ্টুপ আরও রেগে গিয়ে উত্তর দিল আমার পয়সা আমি কোথায় খরচা করব সে আমি বুঝে নেব।
এবার অনুষ্টুপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল চলকে চা পড়ে যাওয়া লোকটা।বলল বাচ্চাগুলোর জন্য যে আমার চা নষ্ট হল তার দাম কে দেবে, আপনি?
আমি কেন দেব? আপনার আরও সাবধানে থাকা উচিত ছিল।বাচ্চারা তো ছটফট করতেই পারে।ওদের দোষ কোথায়? আপনার বাড়ির বাচ্চা হলে কী করতেন? মেজাজ চড়াল অনুষ্টুপও।
শার্ট প্যান্ট পরা লোকটা বলল আপনি ওদের চেনেন না।আপনাকে তিনবার কিনে চারবার বেচে দেবে।আপনার মত লোকের মাথায় টুপি পরিয়ে রোজ ওরা খাবার জোগাড় করে।একটা বড়সড় র্যাকেট আছে বুঝলেন? আমরা সব জানি।
লোকটার মুখে যেন অনুষ্টুপের প্রতি একটা সহানুভূতির সুর।একটু বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু অযাচিত ভাবে লোকের জ্ঞান শোনা একেবারেই পছন্দ হয় না ওর।মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে ও ফস করে বলেই ফেলল, আমার পয়সা দিয়ে আমি খাওয়াচ্ছি তাতে আপনার বাবার কী?
এই কথাটা শেষ হতেই উল্টোডাঙার ফুটপাথের দোকানটায় যেন বিস্ফোরণ ঘটল। কী আপনি আমার বাবা তুললেন? বলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুষ্টুপের কলারটা ধরে ফেলল ওই লোকটা।ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেল অনুষ্টুপও।দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঠেলাঠেলি, ধস্তাধস্তি।যোগ দিল চলকে চা পড়ে যাওয়া লোকটাও।বলল, সাহাদাকে বাবা তুলে গালাগাল দেওয়া? আপনাকে আজ যেতেই দেব না উল্টোডাঙা থেকে। আমাদের চেনেন তো ?
কোথা থেকে কী হয়ে গেল কে জানে। আরও একজন কোথা থেকে এসে অনুষ্টুপের উপর চড়াও হতে যাবে এমন সময় দোকানদার ওদের থামিয়ে দিল। বলল সামান্য ঘটনা নিয়ে তোমরা এইরকম করছো? আমার ব্যবসাটাই তো মার খাবে আজ।
তবু সার্ট-প্যান্ট পরা লোকটা রাগে গরগর করতে লাগল।যেন কেউ না থামালে দেখে নিত আজ।ওদিকে দোকানদার ইশারায় অনুষ্টুপকে কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ার ইঙ্গিত করল।গোটা ঘটনায় মেজাজটাই চটকে গেল অনুষ্টুপের।পয়সা মিটিয়ে দোকান থেকে বাইরে বেড়িয়ে হাতঘড়িতে দেখল আটটা বেজে পাঁচ।দোকানে খেতে ঢুকে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল আজ।যদিও কাল-পরশু দোলের ছুটি থাকায় দেরিটা অতটা গায়ে মাখল না।উল্টোডাঙা থেকে যেকোনও মেন লাইনের ট্রেন ধরলেই অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় সোদপুরে।আজ না হয় একটু দেরিই হল।ব্যাচেলর অনুষ্টুপের বাড়িতে মা একটু অপেক্ষায় বসে থাকলেও বাবার সে সব তাল নেই।তিনি গ্রুপ থিয়েটারের লোক।অফিস সামলে নাটকের রিহার্সাল দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা।
এতকিছু ভাবতে ভাবতেই স্টেশনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল অনুষ্টুপ।ভাবছিল চায়ের দোকানের ঘটনাটার কথা।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল আর কোনওদিক ওই দোকানে যাবে না।রীতিমত গুন্ডাগিরি।দোকান চত্বর জুড়ে দাড়িয়ে থাকা লোকগুলো ওর হেনস্থা হওয়ার ঘটনাটা দেখেছে।একটা খারাপ লাগা ওকে গ্রাস করল।হয়ত ওই লোকগুলোই ঠিক।বাচ্চাগুলো আসলে ভিখিরি চক্রের টোপ।প্রতিদিন দোকান দোকান ঘুরে ওরা ওইভাবে খাবার,টাকা-পয়সা তোলে।যারা জানে তাদের কাছে এই সহানুভূতির কোনও মূল্য নেই।বাস্তবটা সত্যিই বড় কঠিন।
এতসব ভাবতে ভাবতেই বিধ্বস্থ অবস্থায় দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে উঠেই কোনের দিকটায় চোখ চলে গেল অনুষ্টুপের। চারটে বাচ্চা একসঙ্গে কী যেন খাচ্ছে।আরে ওই তো ওর কিনে দেওয়া মার্জারিনের কৌটোর ম্যাগি।বন্ধুদের জুটিয়ে আনন্দ করে চেটেপুটে ম্যাগি খাচ্ছে পুলু আর টিটো।ওকে দেখেই চিনতে পারল ওরা।চোখে ইশারায় বন্ধুদের জানিয়ে দিল ওই লোকটাই কিনে দিয়েছে ম্যাগিটা।অনুষ্টুপ দেখল মলিন পোশাক আর জট পরা চুলের প্রত্যেকটা হাসিমুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আলোর জ্যোতি।বুকের মধ্যে হঠাৎ তৈরি হওয়া ভাললাগার আনন্দে আকাশের দিকে তাকাল ও।কাল দোল পূর্ণিমা।বস্তির উপরের আকাশ, রেললাইনের তারের আঁকিবুঁকি,গাছের পাতা সর্বত্র যাদু আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সোনার থালার মত চাঁদটা।কিন্তু তাকে ম্লান করে দিয়ে চারটে ছোট্ট অথচ উজ্জ্বল তারা ঝলমল করতে দেখল অনুষ্টুপ।
(বানানবিধি লেখকের নিজস্ব )
[গল্পটি ইতিমধ্যে শ্রীরামপুর কলেজ প্রাক্তনী সাংসদ প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘নস্টালজিয়া’য় প্রকাশিত। অনলাইনে প্রকাশ এই প্রথম]
Tags: Galper Samay, shorts story, Susamir Ghosh, এক চাঁদ চার তারা, গল্প, সুসমীর ঘোষ
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।