পড়তাম আমরা বিল্বেশ্বর উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে। এটি পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহুকুমার অন্তর্গত একটা গ্রাম। অজয় নদীর বাঁধের উপর রাস্তা ধরে যাওয়া আসা আমাদের। আমরা আসতাম কেতুগ্রাম থানার পুরুলিয়া গ্রাম থেকে। জেলার নামের সঙ্গে এক হয়ে গেছে বলে অনেকে গ্রামটিকে পুরুলে বলেই চেনে। স্কুল থেকে এই গ্রামের দূরত্ব চার মাইল প্রায়। আমরা হেঁটে যাওয়া আসা করতাম। তখন রাস্তা ছিল না। আলপথ ধরে যেতাম। তারপর বাঁধের রাস্তা ধরে স্কুল পৌঁছোতাম।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
স্কুল জীবনে রথের দিনে সকাল থেকে খোঁজ করতাম চাকা, রঙীন কাগজ আর কাঠের পাটাতন। পেয়ে যেতাম হারুর বাড়ি মোহিনীর বাড়ি খুঁজে। বন্ধুরা একসাথে বানাতাম রথ। প্লাষ্টিকের জগন্নাথ জোগাড় করতাম দোকানে। পেয়ে যেতাম সবকিছু। তারপর রথ বানানো হয়ে গেলে দড়ি টেনে নিয়ে যেতাম রাস্তায়। রথের ভিতরে ছোট থালায় পয়সা দিত লোকে পুজোর জন্য। আমরা যাহোক অল্প বুদ্ধির ফলে, একটা ছড়া বলতাম। এখনও কিছুটা মনে আছে, জয় গৌড় জয় নিতাই জয় জগন্নাথ, বাসুদেব দয়া কর, আমরা জোড় করি হাত। খুব ভাল লাগত ঘুরতে। তারপর পয়সা জোগাড় হয়ে গেলে পাঁপড় ভাজা খেতাম সব বন্ধু একত্রে ।
একবার ঘোর বর্ষায় বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের দলের কিশোর নেতা বিশু। মাঠে কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
লুকোচুরি খেলতাম মিতুর সঙ্গে ছোটবেলায়। মা আর পিসির শাড়ি শুকোতে দিত উঠোনের তারে। সারাদিন ঝুলত। আর সেই শাড়ির আড়ালে চলত আমাদের লুকোচুরি।
তারপর একদিন মিতুর ভেদবমি হল। ডাক্তার এল। কত চিকিৎসা করলেন তিনি। কিন্তু মিতু লুকোচুরি খেলার মত কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তাকে আর খুঁজে পেলাম না। তখন আমার বয়স আট বছর।
পিসি কোলে করে নিয়ে যেত ষষ্টিতলায়। সেখানে বকুল ফুলের বড় বড় গাছ ছিল। তার ছায়ায় বসে কাটাতাম সারাদিন।
তারপর পিসি দুপুরে বাড়িতে নিয়ে আসত। তারপর স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে দুপুরে মাটির দোতলা বাড়ির ওপরে গিয়ে শুতাম। সেদিন বিকেলবেলা বাবা আর কাকা পুকুরে ছিপ ফেলে বড় রুই মাছ ধরেছিলেন। বেশ সুন্দর করে রান্নাবান্না করে আমাদের খেতে দিয়েছিলেন মা। সেই রাতে দাদু পরলোকে চলে গেলেন। মাছ আর খাওয়া হলো না। সব ফেলে দেওয়া হল পুকুরে। দাদুকে আর দেখতে পেতাম না। তিনিও কোথায় লুকিয়ে পড়লেন কে জানে? তারপর থেকে তাকে আর আমি দেখতে পাইনি।
তারপর বড় হলাম। হাইস্কুলে ভরতি হলাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় কাকাবাবু ম্যানেনজাইটিস রোগে মারা গেলেন। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে দুই মেয়েকে রেখে চলে গেলেন পরপারে। তিনিও লুকিয়ে পড়লেন মেঘের আড়ালে।
ভুবন জুড়ে চলছে এই লুকোচুরির খেলা। আমরা সবাই খেলোয়াড়। কার যে কখন লুকিয়ে পড়ার পালা আসবে কেউ জানে না।
দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , “ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না” ।অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা ।ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,”আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম ” । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো । বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন । অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি । তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে । কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো । এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ । তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী । ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর । আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?
রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে ।
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,
ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।
অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ । পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা । বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা । সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা । শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে । আগে থেকে চোখ দেখতে নেই । আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না ।পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার । সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি । কি যেন বলেছিলো সেই চোখ । আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় । ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে ।
দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে । হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায় ।
ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে
বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ । মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে । এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন । কাছেই একটা পুকুর । রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো । মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন ।
তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে…
স্কুল যাওয়া আসার পথে মাঝখানে ছিল এক সাধুবাবার আস্তানা। সেই ছোট্ট ঘরে আমরা আখ চিবোতাম মনের সুখে। ঘরটা নোংরা হয়ে যেত। সাধুবাবা গালাগালি দিত। একদিন ফেরার পথে প্রচন্ড বৃষ্টি। বাধ্য হয়ে আমরা ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিলাম। সাধুবাবা মাধুকরীতে গেছেন হয়ত। তিনি নেই। পুরো অন্ধকার আকাশ ছেয়ে নেমে এসেছে মেঘের ভেলা। ভয় লাগছে আমাদের। হঠাৎ শুনতে পেলাম পাকুড় তলা থেকে ছোট ছেলের কান্নার শব্দ। তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। আবার কান্নার একঘেয়ে শব্দ। আ্যঁ, আ্যঁ আ্যঁ…..
সবাই শুনেছি সাধুবাবা বলেন, ছোট ছেলে কেউ মরে গেলে তাদের পোড়ায় না। এই পাকুড়তলায় পুঁতে দেয়। আমাদের কচি মনে এই ঘটনা ভীষণ খারাপ একটা প্রভাব ফেলেছিল যা এখনও মনে আছে। তারপর থেকে আমরা আর সাধুবাবাকে ওই ঘরে দেখিনি। তিনিও হয়ত কোনোদিন ভয় পেয়েছেন ওই কান্না শুনে।
ভূত বলে কিছু নেই জানি। তাহলে অই কান্নার আওয়াজ কি করে এল আজও বুঝতে পারি নি আমরা কেউ।
আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন । সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের
মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন ।
আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই । কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন । অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার । মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো । প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি ।
শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো । তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ ।
আমাদের গ্রামে তখন বন্যা এসেছে। আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি। কাকিমা রান্না সেরে নিচ্ছেন। বন্যার ঢেউ মাটির দেওয়ালে ধাক্কা মারছে। মাটির দেওয়াল জলের ধাক্কায় পরে গেলো। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। বললেন,কত কষ্ট করে এই বাড়ি হয়েছে। আর হবে না আমার বাড়ি। কাকু বললেন,চলে এসো পাকা বাড়িতে। বেঁচে থাকলে আবার হবে বাড়ি। আমাদের সবাইকে নিয়ে মা কাকুদের বাড়ি চলে এলেন। দুদিন আমরা অই বাড়িতে ছিলাম। আখের গুড় আর ছোলা ভিজে খেলাম সবাই। গোপালদা গরু মোষ দেখার জন্য নীচে ছিল। সে বলল, আমি দেখ এখানে বসে আছি। বাবু বলল, গোপাল দা তোমার পাশে শাঁখামুটি সাপ। গোপাল দা বলল,ভয় নেই আমার।ওরাও জলে থাকতে পারছে না। থাকুক কিছু করবে না।
সারারাত সে সাপের সঙ্গেই ছিলো। কিছু ক্ষতি হয় নি। বিপদে সবাই মিলেমিশে থাকে।বললেন,গোপাল দা। তারপর বন্যার জল নেমে গেলে বাবা,গোপালদা দুজনে মিলে পাকা ঘরটার
কাদা বালি পরিস্কার করে জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মাটির বাড়িটা পরে গেছে। বড্ড ফাঁকা লাগছে। পাকা ঘর একটা সেখানেই আমরা সবাই একসাথে বাস করতে লাগলাম। আমরা এখন পাঁচজন। তিন ভাই আর বাবা, মা। কাকিমা দুই বোনকে নিয়ে কাটোয়ায় থাকেন। কাকিমা চাকরি পাওয়ার পর কাটোয়া চলে এলেন যাতায়াতের অসুবিধার জন্য। তারপর আবার প্রকৃতির নিয়মে নতুন বছর এলো।
হেমন্ত কাকা ও বড়দা,সিধুকাকা কৃষিকাজে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে গ্রামের অনেকেই পরামর্শ করতে আসতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে।আমি তখন বারো। আমি দেখতাম
সন্ধ্যাবেলা মুনিষরা সকলে কাজের ফাই ফরমাশি শুনে সকালে জমিতে গিয়ে সেইসব কাজ করতো। জমি দেখতে সকালে জলখাবার নিয়ে যেতো বাড়ির ছোটোরা। দুপুরে যখন মুনিষরা ভাত খেতো সে দেখার মতো ব্যাপার হতো। বড়ে বড়ো জামবাটিতে ভরতি ভাত, মোটা তরকারি, ডাল, মাছ, চাটনি, কাঁচালঙ্কা আর পিঁয়াজ। কি সুন্দর শৈল্পিক ছোঁয়া খাওয়ার মধ্যে। কেটিপতিরা খাবার সময় এই আনন্দ পায় কি? আমার মনে হয় পায় না। খাওয়ার আন ন্দ পেতে গেলে খিদে চিনতে হয়। আর খিদের মতো উপহার পেতে গেলে দৈহিক শ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। তা বলে শুধু খিদের জ্বালায় জ্বলতে কার ভালো লাগে। কবে আসবে সেই দিন। সব খিদে পাওয়া মানুষগুলো পেট ভরে খেতে পাবে। আমার বড়দা সব সময় এই কথাগুলি বলে থাকেন।
একটা অজ পাড়াগাঁয়ের কাহিনী বড়দা আমাদের বলতেন। বড়দার বন্ধু সিধুকাকা। বয়সে বড় হলেও তিনি বড়দাকে বন্ধু হিসাবেই দেখেন। আজও বড়দা তার কথায় বলছেন। তিনি বলছেন, গল্প হলেও সত্য কাহিনী। বড়দা বলতে শুরু করলেন তার বন্ধু ও সেই গ্রামের কথা, শরতের শেষ সময়। ধানগাছে দুধ হয়েছে। গ্রামবাসীদের খুব আনন্দ। আর ক’ দিন পরেই সোনার ধান ট্রাকটরে চেপে রাস্তা আলো করে ঘরে ঘরে ঢুকবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ছাড়া জলের বন্যায় ডুবে গেলো গর্ভবতী ধানগাছ। প্রকৃতি বিরূপ হয় না এতটা।
মানুষের মনের কথা প্রকৃতি অনেক ভালো বোঝে। কথাটা বললেন, সহজ সরল মাটির মানুষ বড়োদাদা। তিনি প্রকৃতির ভাষা বোঝেন।
ছোটবেলায় দেখেছি রাধামাধাব ঠাকুর এলে আমাদের গ্রাম বৃন্দাবন হয়ে উঠত। ঘরে ঘরে হরিনাম হত। আমরা নিমন্ত্রন পেতাম সাতদিন ধরে। গোস্বামি বাড়ির পুজোতলায় রাতে বসত কির্তনের আসর। রাধার উজাড় করা প্রেমের কাহিনি শুনে মা, পিসির চোখে জল বাঁধ মানত না।
,আমার মা মহাভারতের অনেক গল্প বলতেন। আমাদের ছোটোবেলাতে অনেক গল্প শুনে মুখস্থ হয়ে গেছিল। রামায়ণের গল্প সুর করে পড়ে শোনাতেন আমার দাদু। দাদু ভাল গান করতেন একতারা বাজিয়ে। তখনকার দিনে যাত্রা শিল্পে মহিলা পাওয়া কঠিন ছিল। আমার দাদু মহিলা সেজে স্টেজে অভিনয় করতেন। কত পুরষ্কার তিনি পেয়েছিলেন তার হিসেব নেই। তাই হয়ত তার ছোটছেলে হেমন্ত যাত্রাশিল্পী হয়েছিলেন বিখ্যাত। হেমন্ত ঘোষালের আমলে দশ রাত যাত্রা হত গ্রামে। তাঁর হঠাৎ মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গেছিল উন্নয়ন। তারপর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। এখন আর যাত্রাপালা পুরুলেতে কম হয়।
বেশ ছিল ছোটোবেলার দিনগুলো। এখন বয়স বেড়েছে। আবেগ এখন পাগলামি বলে মনে হয়। অথচ এই পাগলামি ছিলো বলেই দাদু এত নামকরা শিল্পী হয়েছিলেন।
তারপর বড় হলাম। সংসারী হলাম। তখনও লুকোচুরির পালা চলতেই থাকল। একদিন খবর পেলাম পিসি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কাঁদরের ধারে হঠাৎ আমার কান্না পেয়ে গেল। পিসি ছিল আমার মায়ের মত। আমি প্রথম বুঝলাম মরণ কারো বারণ শোনে না। এরপরে একদিন রাতের বেলায় বাবাকে হারালাম। মা বললেন, তোর বাবাকে আটকানো গেল না। তিনিও লুকিয়ে পড়লেন চিরকালের জন্য।
ভুবন জুড়ে চলছে এই লুকোচুরির খেলা। আমরা সবাই খেলোয়াড়। কার যে কখন লুকিয়ে পড়ার পালা আসবে কেউ জানে না।
একদিন পিসির বাড়ির সামনে কাঁদরের পাড়ে দেখলাম আমার স্বপ্নের সঙ্গিকে। বিশুর সঙ্গে এর বেজায় মিল। একটা সবুজ আলখাল্লা পরে কেমন রহস্যজনকভাবে দেখছে আমাকে। চোখের পলক পড়তেই সে উধাও। একটু পরে দেখি আকাশের খোলা হাওয়ায় সে ডানা মেলেছে। অইরকম ডানা পাওয়ার বাসনায় আমি তাকে ডাকলাম, এস আমাকে ওড়াও আমাকে ভেজাও তোমার আনন্দ রসে। সে একবার হাসল আর হাসতে হাসতে চলে গেল কোথায়, লুকোচুরি খেলার নিয়মে।
Tags: আয়নার প্রতিবিম্বে, গল্প, সুদীপ ঘোষাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।