মায়ের কাছে পড়তে বসতাম। আমার পড়ার সময়ে মায়ের মুখটা আলোয় ভরে যেত।মা বলতেন,ভাল করে পড়ে মানুষ হও।
লিলুয়ার পটুয়াপাড়ায় আমরা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম বাবার চাকরিসূত্রে।ভাড়া বাড়ির সামনে একটা কুলগাছ ছিল। টালির চাল। তখন চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই। কিন্তু বড়দা গ্রামের বাড়িতে কাকাবাবুর কাছে থাকতেন। বাবার কাছে থাকতাম আমরা তিনভাই। বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল।তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড়জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম।
সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য।বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলো কে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।
সৈকত বলল, স্যার তিন’কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন,তাহলে দেখ, এই একশোকিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি?সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়েগেল, অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না!এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল,অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে।স্যার বললেন, হ্যাঁপৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার,সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার।আমরা অবাক হয়ে হাসছি।হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য।তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেড মাষ্টার মশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো।এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা।তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।অমর বললো,স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে।কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি…
পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই।জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া।এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আরবএকটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার।আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশিদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না । ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি,খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায় । দুঃখ শেষে আনন্দ । আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন ।দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসা র নামই জীবন । নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল । তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর । সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয় । তারা যে মায়ের ,মাসির আদরের আঁচল । তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয় ।তারপর যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন কাকাবাবু মরে গেলেন অকালে। বাবা হতাশ হয়ে পড়লেন। ভাই অন্ত প্রাণ। বাবা বললেন, আর লিলুয়ায় থাকব না। গ্রামে গিয়ে জমিজমা দেখভাল করব। চাষ করব। বাবারা দুই ভাই দুই বোন। পিসিদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। তারপর চলে এলাম গ্রামে। গ্রামে এসে নতুন পরিবেশে মিশতে সময় লাগল। কিন্তু টাইম ইস দ্য বেষ্ট হিলার। সময়ের প্রলেপে খাপ খাইয়ে নিলাম নিজেকে। তারপর অজয়ের বন্যায় মাটির বাড়ি ভেঙ্গে গেল। ভেসে যাচ্ছিলাম বন্যার জলে। চিৎকার করলাম, আমাকে বাঁচাও… যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে ।ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে । রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে । জীবনে জ্বর হয় বারে বারে । সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে । বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসা র আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী ।আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী । পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ । সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী । তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ । পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন । তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন । তারা অবশ্যই প্রণম্য । তাদের জীবন সার্থক ।এই পৃথিবী সকলের স্বাধীন ভাবে বিচরণের স্থান হোক । হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক দুর্বল মানসিকতায়।
বিল্বেশ্বর স্কুলের হেড টিচার অম্বুজাক্ষবাবু বলতেন, যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। তারপর বিয়ে হল বন্ধু রমেশের।
প্রায় কুড়িবছর পরে ২০২০ সালে করোনা রোগ এল বিশ্বজুড়ে।রমেশের ছেলের জ্বর হল। কোনমতেই ছাড়ে না। ছেলে চোদ্দদিন পরে বলে, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল বাবা। টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন কর। তোমাকে যেতে হবে না। রমেশ বলল, তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে যদি করোনা ভাইরাস আ্যাটাক করে আমি হাসপাতালে পাঠাব না। আইসোলেশনে রাখার পরে তুই যদি আর ঘরে না ফিরিস।
-তাহলে কি হবে,আমি মরে যাব। আর হাসপাতালে না পাঠালে তুমি আর মাও মরে যাবে। আমার শরীরে অসুবিধা হচ্ছে। তুমি আমাকে হাসপাতালে পাঠাও।
– তা হোক শরীর খারাপ হলে কাউকে বলার দরকার নেই। ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবি।
– না বাবা। তা হয় না। আমি যদি পজিটিভ হই আমাকে হাসপাতালে দেওয়াই ভাল।
বাবা ভাবেন ছেলেটা সমাজের মুখ তাকিয়ে ঠিক বলছে। সমাজে এ রোগ ছড়িয়ে গেলে আরও অনেক লোক মরে যাবে। কিন্তু ছেলেটাতো বাবা হয় নি। ও কি করে জানবে বাবার দৃষ্টিকোণ। আমি কি ওর মায়ের অন্তর দেখতে পাচ্ছি। মেয়েদের বুক ফাটে মুখ ফোটে না। ছেলে হারাবার ভয়ে বা স্বামীকে হারাবার ভয়ে সে করোনা রোগের নাম করে না।
ওর মা বলে, বড্ড অপয়া রোগ। একজনকে গ্রাস করলে সারা বলয় গিলতে চায়।
বাবা ভাবেন, এখনও এই উন্নত যুগে মানুষ কত অসহায়। মিথ্যে ক্ষমতা আর টাকার বড়াই। কোনো কিছুই মৃত্যুকে আটকাতে পারে না।
ছেলে আইসোলেশন ক্যাম্পে চলে গেলো। করোনা পজিটিভ। চিকিৎসায় কোন ফল হলো না।
ছেলেটা চলে গেল…রমেশ আর তার বউ কেমন যেন হয়ে গেল। কারও সাথে আর কথা বলে না। তারপর পৃথিবীর সব রোগ সেরে গেল দুমাস পরে।সংসার সহজভাবে চলতে থাকল। সে ত থামতে জানে না।
আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইন পড়তে ভরতি হলাম। বড়দা বাবার মত ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন চাকরিসূত্রেই।লিলুয়ায় বড়দার বাসায় থাকতাম। ফিরে ফিরে দেখতাম ছোটবেলার পুকুরটাকে। বন্ধুরা সব বড় হয়ে গেছে। কেউ আর পাত্তা দেয় না। সেই পাই স্যার,সৈকত,বিশ্বকর্মা পুজো আমার মনে বিষাদের বাজনা বাজায়। পরাণদার বাড়ির সামনে মিষ্টির দোকানে গেলাম। সেখানে পান্তুয়ার দোকানের বদলে মোমোর দোকান দিয়েছে পরাণদার ছেলে। পরাণদা বুড়ো হয়েছেন এখন। আমাকে দেখে বললেন, কে তুমি চিনতে পারলাম না তো। আমি পরিচয় দিলে তিনি আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন আমাকে, পাই স্যার নেই তো কি হয়েছে, আমি তোমাকে পান্তুয়া খাওয়াব। আমি বললাম, না তুমি এখন বুড়ো হয়েছ। আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। পরাণদাকে প্রাণভরা ভালবাসা জানিয়ে চোখে জল নিয়ে বাইরে এলাম। এখনকার ছেলেরা কেউ আমাকে চেনে না। পরের দিন বিকেলবেলা পরাণদা তার বাড়িতে আমাকে ডাকলেন। থালায় চারটে পান্তুয়া। খেলাাম তৃপ্তি করে। শেষে তিনি কাগজের ঠোঙায় অনেকগুলো পান্তুয়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটা তুমি বাসায় গিয়ে খেও। আমার আনন্দ হবে। ইতস্তত হাতে আমি ঠোঙা ধরে একশ টাকার নোট বের করলাম। পরাণদা বললেন, ভালবাসায় টাকাপয়সার স্থান নেই। আমার এখন টাকার অভাব নেই। তোমাকে পান্তুয়া খাইয়ে আমি যে কতটা আনন্দ পেলাম তা আর কেউ বুঝবে না। পরাণদার এই কথা শুনে আমি আর কথা বলতে পারলাম না। ধরা গলায় বললাম, আসছি। এখনও পটুয়াপাড়ায় আমি সময় পেলেই চলে যাই পুকুরের পাড়ে। বসে থাকি শটিবনের ধারে। জঙ্গলের এক বুনো গন্ধে পরাণদার কথা মনে পড়ে।এই পুকুরে খেলার সঙ্গিদের মনে পড়ে। বুকটা চিন চিন করে ওঠে। মন উদাস হয়। অতিতের এই পুকুর পাড়ে আমার বয়স, আমার স্মৃতি থমকে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিরন্তন খেলায়। আমি পুকুড়ের পাড়ে বসে আমার ছোটবেলার খেলা খেলি আপনমনে,আর স্মৃতিমেঘের চিঠির পাতা পড়ে চোখেরজল ফেলি নীরবে।
[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: গল্প, মেঘের চিঠি, সুদীপ ঘোষাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।