সুবীরবাবুর আজও রাত তিনটের সময় পায়খানা পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে স্ত্রী দয়াময়ী। তিনি বার কতক ঠ্যালা দিলেন। জাগানোর বৃথা চেষ্টা। তবু ডাকলেন, দয়া একবার ওঠো দেহি। হ্যারিকেনটা লইয়া চলো লগে। দয়া পাশ ফিরে ছোট নাতি বাবলুকে জড়িয়ে দিব্বি আবার ঘুম দিলেন।সারাদিন সংসারে অনেক কাজ করেন দয়াময়ী। তাই রাতে বালিশে মাথা দিলেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যান। এ বয়সে কোন প্রেসার, সুগার বা ঘুমের ওষুধ তিনি নেন না। বেশ সুস্থ মজবুত শরীর তাঁর।
ধীরে ধীরে মশারি আলগা করে সুবীরচন্দ্র নামলেন, দরজার পিছনের হুঁক থেকে গামছাখানা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দার এক প্রান্তে পায়খানা, বাথরুম ও কলের যে ব্যবস্থা আছে সেদিকে চললেন। এখন রাত প্রায় তিনটে। আমাশায় ভুগছেন বেশ কদিন হলো। কাজ সেরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সময় স্পষ্ট দেখতে পেলেন কাঁঠাল গাছের পিছনে দাঁড়ানো সাদা ধুতি পরা মনিকাকা যেন হঠাৎ করে আড়াল হয়ে গেলেন। তিনি বেশ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি প্রায় দৌড়ে ঘরে এসে শক্ত করে দরজাটা বন্ধ করলেন।
পাশের বাড়ির নিধুবাবু এখন অবসরে আছেন। তাঁর আবার রাত জাগার অভ্যাস।একটু রাত হলেই ছাদে চলে যান। তাঁর কাছে পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটলেন তিনি। গিয়ে বললেন সব কথা। যে মনিকাকা নকশাল পিরিয়ডে খুন হয়ে গেছিলেন তাঁকে তিনি আজকাল প্রায়ই দেখতে পাচ্ছেন ! এটা কী করে সম্ভব !
নিধুবাবু তো গতকাল রাত বারোটা অবধি ছাদেই ছিলেন। তারপর তিনি নেমেও আসেন। তাই অত রাতে কী ঘটছে তা তো তিনি জানেন না। তবু কেন জানিনা কথাটা শুনে নিধুবাবু বেশ একটু ঘাবড়ে গেলেন।
দয়াময়ী দেবী পরদিন সকালে উঠে শিঙ্গিমাছ, গ্যাদালপাতা আর আদাবাটা দিয়ে ঝোল রান্না করে সুবীরবাবুকে হাঁক দিয়ে ডেকে বললেন,
– কই গ্যালা গো! মাথায় আর প্যাটে ত্যাল-জল মালিশ কইরা তার পরে স্নান কর দেহি।
– বিশ্বাস করো বড় বউ গতকাইল পষ্ট দ্যাখলাম। সেই মনিকাকা ! সেই ধুতি, সেই হাফহাতা পাঞ্জাবি !
– তোমার প্যাট গরম করসে। কাকায় তো কবেই মইরা গ্যাছে।
সুবীরবাবু সর্ষের তেলের বাটিটা নিয়ে নিজের হালকা ভুঁড়িওলা পেটের নাইকুণ্ডলীতে তেল চাপড়ে দিতে লাগলেন। আর ভাবতে লাগলেন তিনি কী করে এতটা ভুল দেখলেন! মনিকাকা ঠিক আগের মতোই ঝট করে সরে গেলেন! লুকিয়ে দেখা করতে আসতেন মায়ের সঙ্গে। মা অন্ত প্রাণ ছিল কাকার। কতদিন মাঝরাতে কুকুরের কান্না শুনে হ্যারিকেনটা নিয়ে কাঁঠাল গাছের তলায় গেছেন তিনি। ওটা সংকেত। কাকা এসেছেন। ঠাকুমা কাকাকে একবার ছুঁয়ে দেখতেন। কপালে চুমু খেতেন। কাকা বলতেন, মা যা আছে দাও, খাই। গবগব করে ভাত খেতেন। তারপর অন্ধকারে ভুতের মতো মিশে যেতেন।
দয়াময়ী দেবী বারান্দায় এসে বললেন আজ তুমি লালুগো পুকুরে স্নান করতে যাও। বেশ কইরা ডুবাইয়া স্নান করবা।
সুবীরবাবু গামছাখানা কাঁধে নিয়ে পুকুরে স্নান করতে চললেন।
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে এসে পড়লেন এক্কেবারে পুকুর পাড়ে। মাঝপুকুরে কয়েকজন ছেলেছোকরা দু’ফাঁক করছে জল।গাঁয়ের মেয়েমরদরা একে একে চান করতে আসছে। কেউ কাপড় কাচছে। সুবীরবাবু ধীরে ধীরে জলে নামলেন। বুক সমান জলে হাত জোড় করে সূর্যের দিকে মুখ করে বললেন,
ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম
ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।
তারপর স্নান সেরে ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরলেন।
বিকেলে শম্ভুর চায়ের দোকানে সুবীরবাবুর বয়সী আরও প্রায় জনা পাঁচেক লুঙ্গি ও ফতুয়া পরা সদ্য রিটায়ার করা বা কদিন বাদেই রিটায়ার করবেন এমন সিনিয়র সিটিজেনের দল জড় হন। এ নিত্যদিনের অভ্যাস। আজ সুবীরবাবু দুধ ছাড়া লিকার চা নিলেন। নিধুবাবু শুধলেন,
– তা ভাই তোমার পেট ঠিক হয় নাই?
– পুরানো আমাশা । ওই যাকে বলে ক্রনিক। চলছে গ্যাদাল পাতা, থানকুনি পাতা আর কাঁচকলা থেরাপি।
– আমি বাপু এসবে ভরসা পাই না। দুটো মেট্রোজি..
কথা শেষ হতে পারে না। দোকানি শম্ভু বলে ওঠে ওই তালপুকুরে কোন বাড়িতে নাকি পাথরের গনেশ দুধ খাচ্ছে। ও বাড়ির গিন্নি যেই না চামচে করে দুধ নিয়ে গণেশের মুখের সামনে ধরছে, অমনি সে দুধ গণেশ বাবাজি চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিচ্ছে। আজ তো রামধন গোয়ালা আমায় এক কিলো দুধ কম দিল!
সে কথা অল্পবিস্তর সবাই শুনেছেন। সুবীরবাবু এসব কথা সাধারণত তেমন বিশ্বাস করেন না। বেশ যুক্তিবাদী। তবু আজ তিনি কোন তর্কে না গিয়ে চুপ করে বসে ভাবতে লাগলেন মনিকাকা কি সত্যি বেঁচে আছেন!
তাঁর দেহ বলে যা পুলিশ দেখিয়েছিল তা দেখে তো চেনার উপায় ছিল না। পুকুরে ভেসে ওঠা ফোলা পচা এক মৃত দেহ। পিঠে তিনটে গুলি !
সহযোদ্ধারা নিয়ে গিয়ে দাহ করেছিল সে দেহ। তখন তাঁদের বাড়ির সবার মনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কেবল সেজপিসিমা তাঁর সরু ধারালো গলায় শেষ মুহূর্তে বলেছিলেন, কমরেড মনি সান্যাল লাল সালাম। কমরেড মনি সান্যাল অমর রহে। তারপরই সেজেপিসীমা অজ্ঞান হয়ে যান ।
সে সময় পাড়ার যুবকের দল কলেজ, বই, পড়াশুনো শিকেয় তুলে রেখে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার মেরে বেড়াতো। আর তাতে লেখা থাকত, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান; ভিয়েতনাম লাল সালাম। এই দলে যে কীভাবে মনিকাকা ঢুকে পড়ল কে জানে! বাড়ির সবচেয়ে ভাল ছেলে। স্কুল ফাইনালে দুর্দান্ত রেজাল্ট! বাবা বলতেন, অরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি করাই কাল হইল। কিশোর সুবীর অত বুঝতে পারত না। তবে মনিকাকা ছিল তার প্রাণাধিক প্রিয়। কাকা যে কত পশুপাখির ডাক নকল করতে পারতেন! বাঁশি বাজাতেন। তখনকার সরকার এই আন্দোলন দমন করতে বহু বিপ্লবী ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি নাকি অনেক নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রীদেরও গ্রেপ্তার করেছিল। আর এনকাউন্টারে মৃত্যু তো ছিলই।
পরদিন রাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। সুবীরবাবু আজ রাত দশটার মধ্যে খুব সামান্য ঝোলভাত খেয়ে শুয়ে পড়লেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন দূরে কোথাও যেন প্যাঁচা ডাকছে। এই রকম প্যাঁচার ডাক অদ্ভুত ভাবে মনিকাকা ডাকতেন। ঠাকুমা কত বকতেন!
প্যাঁচা চেনে না এমন মানুষ নেই বললেই চলে। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষেরা প্যাঁচার ডাকের সঙ্গে বেশি পরিচিত। খানিকটা ভিন্ন রকমের ডাক এবং কুসংস্কার বশত অনেকেই এই ডাক অশুভ বলে মনে করেন। দয়াময়ী দেবীও বেশ ঘাবড়ে গেলেন। এসে সুবীরবাবুর গায়ে হাত রেখে বললেন,
– লোহার শিক আগুনে দিসি। তোমার মায় শিখাইসে।
– মনিকাকা আইসে। একদম মনিকাকার গলা।
– তুমি যে কী ভুলভাল কও। তিনি এখন ওই পারে।
– না বড় বউ। মনিকাকার খিদা লাগসে।
প্রায় অনিদ্রায় রাত কাটে সুবীরবাবু।
প্রতিবেশী নিধুবাবু বয়সে সুবিরবাবুর থেকে অনেকটাই বড়। মনিকাকার বয়সীই হবেন। যে সময় মনিকাকা মারা যান সে সময় নিধুবাবুর বাবা এমএলএ ছিলেন। অনেক খবরাখবর তাই নিধুবাবু জানতেন।
তিনি পরদিন চায়ের দোকানে গিয়ে সবার সামনেই নিধুবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন,
– আচ্ছা গতকাল আপনি এই সাড়ে দশটা নাগাদ প্যাঁচার ডাক শুনসেন ?
– হুঁ। ডাকতাসিল তো। কু কু।
– দয়াময়ীও শুনসে।
– আপনি তো কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। তবে এত ভাবেন ক্যান?
– মনিকাকা অবিকল প্যাঁচার ডাক ডাকতে পারতেন। দুর্দান্ত হরবোলা ছিলেন। পাড়ার দু একজন জানত। আপনারাও বোধহয় জানতেন।
– হুঁ শুনছিলাম মনে হয়। সে কবেকার কথা!
– ওইটাই তো কাল হইল।
– আপনার কী হইল কন দিকি! আপনি কাকার ভুত দেখেন। ডাক শোনেন! শুধাশুধি পুরানো কথা ভাইবা কষ্ট পান।
বয়সে বছর আটেক ছোট হওয়া সত্বেও নিধুবাবু সুবীরবাবুকে আপনি করেই বলতেন। কারণ সুবীরবাবু পেশায় ছিলেন হেডমাস্টার। অত্যন্ত শান্ত ভদ্র ও ছাত্রদরদী । ওই ইস্কুলের নিধুবাবুর ছেলেরা পড়েছেন।
কথাটা চায়ের দোকানের সব বয়স্কদের দলই শুনলেন। সবার স্মৃতিতে মনিকাকার কথা ফিরে এল। সবাই ভাবলেন প্রিয় কাকাকে ভুলতে না পারায় সুবীরবাবুর এই অবস্থা। সকলের কাছেই বিষয়টা একটা সাধারণ স্বাভাবিক দুঃখের বলে মনে হল।
মফস্বল শহরের ছোট একটা গ্রাম্য পাড়া। ধীরে ধীরে মনি স্যানালের ভুতের গল্পটা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। এখন প্রায় সকলেই রাতবিরেতে প্যাঁচার ডাক বা কুকুরের কান্নার শব্দ শুনতে পান। কেউ কেউ আবার বাঁশির শব্দও শুনেছেন।
প্রায় একমাস বিনিদ্র রাত কাটে সুবীরবাবু ও দয়াময়ীর। সামনের অমাবস্যায় কালীমন্দিরে মা-কালীকে একশ-একটা জবার মালা দিয়ে পুজো মানত করে ফেলেন দয়াময়ী। আশা যদি এতে তাঁদের সংসারে স্বস্তি আসে।
এদিকে আর একজনও ঘুমোতে পারেন না । তিনি নিধুবাবু। আজকাল তিনি রাতে আগের মতো ছাদে পায়চারি করতে পারেন না। পাশের বাড়ির কাঁঠালগাছের পাশে এক ছায়ামূর্তি যেন তিনিও দেখতে পান! বুকে একটা চাপ লাগে।
এর মধ্যে অমাবস্যা এসে যায়। পাড়ার তারামা সংঘের ছেলেরা এবার বেশ ধুমধাম করে কালীপুজো করবে বলে স্থির করে। ওদিকে গণেশ বাবাজি দুধ খাচ্ছেন আর এদিকে মৃত বিপ্লবী মনি সান্যাল ভুত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এবার তাই ধুমধাম খুবই বেশি। রাত বারোটার পর জোরে ঢাক বাজিয়ে পুজোয় বসলেন উদয় ঠাকুর। পুজো শেষ হতে মধ্যরাত।
পরদিন অনেক আশা নিয়ে একটু বেলায় অধিকাংশ গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে। কারণ গতকাল অত রাত অবধি পুজোয় সবারই ঘুম আসতে দেরি হয়।
শুধু ভোরবেলা দুধ দিতে বের হয়ে রামধন গোয়ালা আবিষ্কার করে নিধুবাবু উপুড় হয়ে লালুদের পুকুরপাড়ে মরে পড়ে রয়েছেন। মৃতদেহের পাশে নাকি একটা বাঁশিও পড়ে ছিল।
যদিও শোনা যায় তার পর থেকে মনি সান্যালের ভুত বা কোন পশু পাখির ডাক বা বাঁশির আওয়াজ আর কেউ আজ অবধি শোনেন নি।
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের নিজস্ব ]
email:galpersamay@gmail.com
» আষাঢ়ে গল্প on August 8, 2023
[…] এক অমাবস্যা ও আজাইরা গল্প […]
রেজানুল করিম on August 9, 2023
মনি কাকার গল্প আমার খুব ভালো লাগল। বেশ রহস্যময় ভাবে শেষ হল। মনি কাকার মৃত্যুর জন্য হয়তো নিধু বাবুর বাবাই দায়ী, কারণ তিনি ছিলেন এমএলএ, কিন্তু তাতে নিধুবাবুর হাত কতটা ছিল সে বিষয়ে অপ্রকাশ্যে রাখা লেখিকার মুন্সিয়ানা। এই রহস্যটুকুই পাঠককে ভাবাবে।
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।