কোর্ট থেকে বেরিয়ে দুজন দুদিকে হাঁটা লাগালো। আর্য একবার মুখ ঘুরালো , বীথি উঠে যাচ্ছে সাদা বাসে। ও এখন চলে যাবে সলপ । আশা করেছিল আর্য একবার যদি তাকায় বীথি। কিন্তু না, বীথি সোজা উঠে গেল বাসে। ভীড় সাঁতরে বেরিয়ে যাচ্ছে বাসটা দক্ষ সাঁতারের মতো। চকিতে মনে পড়ে গেল কোচিংয়ের দিনগুলোর কথা। দুজনেরই মা জেনে গিয়েছিল তাদের চোরা প্রেমের কথা । কোন অতি উৎসাহী বন্ধু বলে দিয়েছিল হয়তো। তুমুল শাসন জারি হয়েছিল। কিন্তু একেবারে মাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে তাই টিউশন ছাড়ানো হয়নি। দুজনের মা’ই ভেবেছিল ছাড়াতে হলে ও ছাড়াক। আমি ছাড়াবো না । কাজেই দুজনেই রয়ে গেল টিউশনে। সারাক্ষণ কেউ কারো সাথে কথা বলত না কিন্তু ছুটি হলে বাড়ি যাবার সময় রাস্তায় নেমে সাইকেলটা বাঁক নেবার ঠিক আগে একবার তাকাত বীথি। সেই মুহূর্ত টার জন্য আর্য অপেক্ষা করে থাকত উদ্বেগ নিয়ে, চকিত দৃষ্টিপাত তারপর আবার পরের বুধবারের অপেক্ষা। কী যে থাকতো সেই তাকানোতে!হাজার হাজার না বলা কথার সুবাস দুটো যুবক যুবতীকে আনমনা বিহ্বল করে দিত।
হঠাৎ খেয়াল হলো আর্যর সে কোর্টের গেট ছেড়ে এক পাও এগোয় নি। চারপাশে ব্যস্ত ভিড়। হাসপাতাল আর কোর্ট এই দুই জায়গাতে গেলেই কেমন যেন বিষাদের গন্ধ পায় সে। বুকে চাপ ধরে ।
সচরাচর এই সময় বাসে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ বেশ ফাঁকা। জানলার ধারে একটা সিটে বসে, ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলে রাখল বীথি। শীতলপাটির ওপর শান্তিনিকেতনী কাজ করা এই বাহারি ব্যাগটা মামনি দিয়েছিল বিষ্ণুপুর মেলা থেকে কিনে । যেখানেই যেত মামনি তার জন্য কিছু না কিছু আনতো ,এমনকি শিবপুরের কোন শপিং মলে গেলেও তার জন্য এক পাতা টিপ অন্তত আনতো। প্রথমদিকে খুব খুনসুটি হতো আর্যর সাথে এইসব বিষয়ে।
মামনি বলতো–তুই এত হিংসুটে কেন রে? ওর জন্য কিছু আনলে এমন করিস কেন? তুই কি টিপ পড়বি? নাকি ক্লিপ লাগাবি?
অবুঝ অভিমানে সে বলতো,জানি না। তবু কিছু আনবে হাতে করে আমার জন্য। যা হোক কিছু।
প্রথম প্রথম এ সবে মজা পেত বীথি। রাতে মজা করে,আদর করে মুড ঠিক করতে আর্যর। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তার স্বার্থপরতা প্রকট হতে থাকে। মামনির জন্য হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল বীথির। দাঁতে দাঁত চেপে গিলে নিল কষ্টটা। আসবার সময় তাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিলো মামণি। বাপি বসে ছিল চেয়ারে মুখ গুঁজে। খবরের কাগজে জলের ফোঁটা পড়তেই ডাইনিং স্পেস থেকে উঠে ঘরে চলে গেলেন। সেটা খেয়াল করে বীথি ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু আর্য উপর থেকে নেমে বাবার ঘরে গিয়ে গলা তুলে বলে, এসব নাটক করা বন্ধ করবে তোমরা ?
মামনি বলল, তুই সত্যিই চলে যাচ্ছিস রুনু? বীথিকে রুনু বলে ডাকেন তিনি । তারপর সে কি কান্না।
দেখছো তো তোমার ছেলের কাছে এসব নাটক ।ও যে আর চাইছে না আমি এ বাড়িতে থাকি। আমিও আর পারছিনা মামনি।
কোথায় থাকবি রুনু? মায়ের কাছে?
মায়ের কাছে যে থাকার উপায় নেই তা তো জানো মামনি ।আপাতত যাই তারপর খুঁজে নেবো কোনো লেডিস হোস্টেল বা পেইং গেস্ট ।
তোর যে কষ্ট হবে রুনু …
তোমার কাছে এই ক’ বছরেই যা জেনেছি আরাম কাকে বলে। তার আগে তো শব্দটার সাথে পরিচয় হয়নি। এখন অনেক অভ্যাস ছাড়তে হবে আবার । কষ্ট হবে ,তবুও ….
মাঝে মাঝে ফোন করিস মা।
রুনু আর দাঁড়াতে পারেনি। এক ছুটে উঠে পড়েছিল ওলাতে ।পায়ের ব্যথা নিয়ে মামনি সুটকেসটা তুলে দিল গাড়িতে।
পৌঁছে জানাস রুনু–
দু চোখের অবাধ্য জলটা মোছে বীথি। ব্যাগটাতে বড় মমতায় হাত বোলাতে থাকে। ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করতে চায়। থমকে যায় একটু ,কি বলবে মামনি কে?
বলবে,আমরাএইবার আইনত আলাদা হয়ে যাব?চলন্ত বাসের বাইরের চলমান দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে বীথি স্পর্শ করতে চায় তার জীবনের ফেলে আসা মন্দ ভালো মুহূর্তকে।
কোর্টের বাইরে তখনো স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আর্য। জজ সাহেবের ভারী গলা এখনো কানে বাজছে তার। থার্টিন বাই বি হিন্দু ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী আপনাদের ডিভোর্স ফাইল করা হলো। এরপর আপনারা ছ’মাস সেপারেট থাকবেন।তারপর ডেট পড়লে এপিয়ার হবেন।তারপর….
তারপর দুজনার উকিল বেরিয়ে গেল এজলাস থেকে। আর্য তাকিয়ে দেখে দুই উকিল চা খেতে খেতে কিছু একটা আলোচনা করছে বেশ মনোযোগ দিয়ে । সে বুঝতে পারে তাদেরই কথা আলোচনা হচ্ছে যা সবাই আলোচনা করে। এত ভালো মেয়ে বীথি, এত ভালো চাকরি করে ,এত হাসি মুখ তাও কেন থাকতে পারল না আর্য ?বীথির বন্ধুরা প্রশ্ন করে কী লড়াই করলি বিয়েটা করার জন্য,তারপর কী এমন হলো যে বিয়েটা ভেঙে দিতে হলো?
বীথির ঠোঁট নড়ে শুধু । যন্ত্রণাগুলো শব্দদের পিষে মারে, কষ বেয়ে ফেনা ওঠে স্বপ্নদের। মরে যেতে যেতে শেষবার উচ্চারণ করতে চায় বীথির বুকের শব্দরা ,জবানবন্দী দেয় নিজের কাছেই -আমি বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারিনি একটুও। ধরতে পারিনি একটুও ওর মানসিক বিকার। কতদিন হাতে হাত ছুঁয়েছি, নিরালা পার্কে চুপিচুপি আলোয় আঙুল নিয়ে খেলেছি। শরীরের প্রতি কোষে তখন আগুনের গোলা ছুটেছে। আরেকটু ঘনিষ্ঠতা চেয়েছি একটু বেপরোয়া। কিন্তু আর্য যেন মনের কথা বুঝতে পেরে ছিটকে উঠে পড়তো। রাগ হতো , সঙ্গে সঙ্গে অহংকার হতো আর্যর মানসিকতার জন্য। আত্মশ্লাঘা বোধ করত। তার আর সব বন্ধুরা যখন ইউজ এন্ড থ্রো সম্পর্কে ভাসছে তখন নিজের প্রেমের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল আর্য । নিজেকেও সংযত করে নিত বীথি । বাড়ি ফিরে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে নিভিয়ে দিত শরীরের জ্বলে ওঠা শিখাগুলোকে। কিন্তু বিয়ের পর সমস্যা বাড়তে থাকে । বুঝতে পারত না বীথি কেন এত শীতলতা আর্যর! সে যখন অস্থির কামনায় উত্তাপ বিনিময় করতে চেয়েছে মিলতে চেয়েছে প্রতি কোষে কোষে তখন কেন আর্য সবসময় ভিজে যাওয়া পোশাকের মতো ঠান্ডা ! কারণ খুঁজতে চায়তো মরিয়া হয়ে, অসহায় লাগতো বীথির নিজেকে। স্বয়মাগতা হতে চেয়েছে কতবার। কিন্তু বরফ গলে না কিছুতেই। তারপর একদিন রাতে দেখে ফেলে বীথি।
সিনেমা দেখে এসে দুজনেই ক্লান্ত ছিল খুব । কিন্তু তবুও ভেতরে ভেতরে এক অদম্য অভীপ্সা নিয়ে শুতে এলো বিছানায় বীথি। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল আর্য আর দেখছিল বীথি রাত পোশাক পরা শরীরে কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। ক্রিম মেখে চুল বেঁধে বিছানায় যাবার আগে ডাকলো আর্যকে। আর্য বড় অসহায় বোধ করে এই সময়গুলোতে। ধিক্কার দেয় নিজেকে এই কু- অভ্যাসটা ধরার জন্য। সিনেমার গল্পে নানা কেজো অকেজো কথায় নিবৃত্ত করতে চাইল বীথিকে, কিন্তু পারল না । গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে নিল বীথি শরীরের সঙ্গে শরীরকে। তীব্র চুম্বনে সে এক নিঃশ্বাসে পান করতে চাইল সবটুকু। সাড়া দিল আর্য, কিন্তু প্রাণহীন। তীব্র অতৃপ্তি নিয়ে উঠে গেল একটুপরেই আর্য। বীথির ও ক্লান্ত লাগছিল। কান্না আসছিল ,যেমন আসে প্রতিবার । কোথায় সেই তীব্র তৃপ্তির অনুরণন যা এতদিন গল্পে শুনেছে বিবাহিত বান্ধবীদের কাছে ?একটু পরেই সারাদিনের ক্লান্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পড়ে বীথি। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখে আর্য মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখছে। সারা মুখে জ্বলজ্বল করছে এক আলো। যার কিছুটা ফোনের কিছুটা কামের কিছুটা বা বিকৃতির । বীথি উঠে বসে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে। কী করবে এখন? সারা শরীরে যেন চাবুক পড়ছে সপাসপ। আর খুলে যাচ্ছে যন্ত্রণার উৎসমুখ ।গল গল করে বেরিয়ে আসে ধিক্কার অপমান যন্ত্রণার পিণ্ড পাকানো দলা দলা লাভা। তাই, তাই আর্য তাকে সবটা দিতে পারে না। তাই এড়িয়ে যেতে চাই বিছানায়? ঘুমের ক্লান্তির ভান করে । কি করবে এখন সে? কেড়ে নেবে মোবাইলটা ? নাকি অপেক্ষা করবে আর্যর তন্ময়তা ভাঙার । মনে পড়ে যায় মনোবিদ বন্ধু কল্যাণীর কথা। প্রায়ই বলতো -আমরা সম্পর্কের মাঝে ফাঁকটুকু রাখতে ভুলে যায় বলেই একে অন্যের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জগৎ থাকবে তো।
নিশ্চয়ই থাকবে । সেটা বিশ্বাস করে বীথিও। তা বলে সেটা এমন অপমানের লাঞ্ছনার? তার অন্য বন্ধুরা যখন শেয়ার করে তাদের উদ্দাম অভিজ্ঞতা বীথি কুঁকড়ে থাকে। সবাই তাকে পীড়াপীড়ি করে। কী রে, তুই কি সেভ ডিপোজিট ভল্ট থেকে কিছু ছাড়বি না? হাসে বীথি। আর কারণ খোঁজে। ভাবে কি নেই তার যার জন্য আর্য কোন আকর্ষণ খুঁজে পায় না তার শরীরে? অথচ তাকে কী অসম্ভব ভালোবাসে সেটা বোঝা যায়। তবে কী শরীর আর মন দুটো আলাদা আলাদা কায়া? এই মুহূর্তে উত্তরটা জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনে। কোন সাড়া দেয় না বীথি। নিঃশব্দে শুয়ে পড়ে। এসির একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ গ্রাস করে তার সব অভিমান লজ্জার বোবা কান্না কে।
( ২)
বন্ধুদের প্রশ্নটা আর্য কেও ঘুনপোকার মতো একটানা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে গত পাঁচ মাস। জজ সাহেবের দেওয়ার সময় আর মাত্র এক মাস হাতে আছে। এই পাঁচটা মাসের প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সে পূর্ণ মনোযোগে কোন কাজ করতে পারেনি। বুঝতে পেরেছে বীথির যন্ত্রণা কষ্ট। কিন্তু সে বেরিয়ে আসতে পারেনি তার বদ অভ্যাস থেকে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে এর শুরু। হঠাৎ করে মোবাইলে একটা ছবি চলে আসে। ক্লিক করে একটু দেখার পরই থেমে যায় ভিডিওটা। ফুটে ওঠে একটা অ্যাপের নাম, একটা লিংক। নির্দোষ কৌতূহলে সে ক্লিক করে ছবিটি দেখে। সারা শরীরে আগুনের ছোটাছুটি আর মনে তীব্র অপরাধ বোধে জারিত হতে হতে স্নানঘরের নির্জনতায় সে প্রথম পুরুষত্বের উপলব্ধি পায়। তীব্র আনন্দে সে যুবক হয়ে ওঠে। কিন্তু অপরাধবোধে সে পরে কিছুদিন মায়ের দিকে তাকাতে পারতো না। বীথির সাথে কথা বলতে পারতো না চোখে চোখ ফেলে। মা বারবার জেরা করতো, কি হয়েছে তোর বিকি? উত্তর দিত না আর্য। বীথি অভিমান করত আর বুঝি আমাকে ভালো লাগেনা? আর্য কি করে বোঝাবে তখন যে এক গোপন রন্ধ্রপথে সে দেখে ফেলেছে এক রোমাঞ্চকর দুনিয়া। সময় তো আগুনের মত সর্বগ্রাসী। ক্রমে কমে গেল আর্যর অপরাধবোধ। আসক্তি বাড়ল । আগে যে সময়গুলো ভরে থাকতো বীথির রোজনামচার ছন্দে এখন সেখানে জায়গা করে নিল অন্য নারীরা ।
কতবার ভেবেছে আর্য সেসব বীথিকে বলে দিয়ে সে নিজে ভারমুক্ত হবে। কিন্তু পারেনা । এ যে তার একান্ত নিজস্ব আনন্দ।
সাত আট বছরের মেলামেশার পর বিয়ের কথা আসতে প্রথমে আর্য রাজি হয়নি। একটু ভয়ে যে ছিল না তা নয়। বারবার ভেবেছে যদি বীথি বুঝে ফেলে, যদি ধরে ফেলে তার গোপন অভিসার তাহলে ভালো ছেলের যে ইমেজটা বয়ে বেড়াচ্ছে এতকাল সেটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনাটা যে এভাবে মোড় নেবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
সেটা ছিল একটা বন্ধের দিন। বিরোধী পক্ষের বন্ধ, অতএব সরকারি নির্দেশে অফিসে যেতেই হবে বীথিকে। তার দুদিন আগে পায়ে চোট লাগায় আর্য ছুটি নিয়েছিল চার পাঁচ দিন। বীথিও দুদিন ছুটি নিয়ে ডাক্তার প্যাথলজি ল্যাব সব করেছে আর্য কে নিয়ে। কিন্তু সেদিন অফিস না গেলেই নয়। তাই অফিসে হাজিরা দিয়েই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে । সাড়ে তিনটে নাগাদ নিঃশব্দে বাড়ি ঢোকে বীথি। আর্য ঘুমাচ্ছে ভেবে তাকে না ডেকে ঘরে আসে। কিন্তু নীচে তাকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় বীথি। দু-বার ডেকে নিচ থেকে সাড়া পায় না । তারপর ওপরে এসে স্থানূর মত দাঁড়িয়ে পড়ে বীথি । ল্যাপটপের স্ক্রিনে তখন কালো মেয়ের নগ্ন উল্লাসের মোহময় অঙ্গভঙ্গি, ।
আর্য তুমি ! তুমি এত নোংরা! তাই আমাতে তুমি তৃপ্ত নও ?তাই এড়িয়ে যাও আমাকে? ছিঃ ছিঃ আর্য!
চমকে উঠে আর্য, তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়।
তারপর থেকে একটা কথাও বলেনি বীথি, দৈনন্দিন কাজের কথাটুকু ছাড়া। রাতে শুয়েছে ডাইনিং স্পেসে সোফাতে। অনেকবার ডাকতে গেছে আর্য ,আত্মপক্ষ সমর্থন করে আর্য ভাবে এটা তো হতেই পারে। এটা আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা, । বীথি যেমন গান শুনতে ভালোবাসে, ওয়েস্টার্ন গান আমি তেমনি এটা দেখতে ভালোবাসি। আমি তৃপ্তি পাই। এতে এত ছিছিক্কার করার ই বা কি আছে ?এড়িয়ে চলব সেও ভালো। কিন্তু পর্নোগ্রাফি ছাড়বো না ।ওদের হাতেই তো আমার কৌমার্যের সমর্পণ। কিন্তু বীথির স্থির দৃষ্টি আর ব্যক্তিত্ব দেখে সে যেন তাড়াতাড়ি শামুকের শক্ত খোলসের ভেতর ঢুকে গেছে। যে ব্যক্তিত্বকে একদা ভীষণ পছন্দ করত আর্য এখন সেটাই তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
( ৩ )
বীথিকে কাঁদার সময় দিল কল্যাণী ।বীথি যে নেচারের মেয়ে তাতে ও এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে ভাবতেই পারে না কল্যাণী । কোনদিন কোন কারণে
ওর চোখে এমন বন্যা আসেনি। কল্যাণী একবার চেম্বারের বাইরে থাকা মোহনাকে বলে দিল এখন যেন কোন পেশেন্ট না পাঠায়। তারপরে ঘরে এসে বীথির পিঠে হাত রাখতেই বীথি জড়িয়ে ধরল কোমরটা। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে কল্যাণী-
কি হয়েছে? কিসে এত কষ্ট পাচ্ছিস ?
আমি বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারিনি রে একটুও, এমন পারভার্টেড ও।
কল্যাণী ওর মাথায় হাত রাখে।
একটানা কথা বলে বীথি থামলে জিজ্ঞাসা করে কল্যাণী -প্রেম পর্বে কখনো মনে হয়নি ও ব্যতিক্রমী?
ও আমাকে সেভাবে কখনো স্পর্শ করত না। আমি ভাবতাম ওর নৈতিকতা ।
কিন্তু শোন বীথি পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হতেই পারে কেউ। সেটা মানেই পারভার্সন ধরে নিচ্ছিস কেন? নাতো ,সেটা ধরছি না। আমিও জানি হতেই পারে। কিন্তু তা বলে ওর নিজের ক্ষমতা ….
কি হলো থেমে গেলি কেন ?
আমি ঠিকঠাক বলে উঠতে পারছি না রে।
তোদের নৈশ্য সম্পর্কটার কি ব্যাঘাত হচ্ছে কিছু? আসল সমস্যা তো সেখানেই।
চুপ করে যায় কল্যাণী। এই সেদিনই একটা জার্নালে পড়েছে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তির জন্য পুরুষদের জননতন্ত্রের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পুরুষ প্রযোজন স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ও ইউরোলজির অধ্যাপক জোসেফ এ্যলুকাল বলেন ‘স্ক্রিনে দেখা উদ্দীপক দৃশ্য কখনো কখনো নারী পুরুষের যৌন উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয় ঠিকই। কিন্তু কেউ যদি নিয়মিত অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে বাস্তব জীবনে তিনি শারীরিক আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন….
কিরে কি ভাবছিস ?
ভাবছি তুই যদি নিজেকে ,একটু মানে ,আরেকটু খোলামেলা ভাবে ….
তা কি করে হবে ?একটা প্রেমের ফসল আর একটা প্রফেশানালিজম। আর তাছাড়া ও মন থেকে নিতেই পারে না আমাকে। গ্রহণ করে না ওর শরীরও। তাই ব্যর্থতার পর রেগে যায় ,বিরক্ত হয় আমার প্রতি।যা একটু একটু করে ওকে স্বার্থপর তৈরি করেছে ব্যবহারিক জীবনে।
তোরা এক ঘরেই থাকিস তো রাতে ?
না, সেদিনের দুপুরের পর থেকে আমি রাতে ডাইনিং স্পেসে ডিভান শুই ।
আর্য ডাকতে আসে না?
ও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ।সব থেকে কষ্ট হয় মামণির জন্য। রবিবার কুন্তীঘাটের বাড়িতে গেলে কী আদর যত্ন করে ভাবতে পারবি না । মাঝে মাঝেই বলে এবার একটা নাতি নাতনি দে মা, আমার শরীরের ক্ষমতা থাকতে থাকতে মানুষ করে দিই।
তুই আর্য কে বলেছিস সে কথা ?
না বলিনি। কি বলবো ? ওগো আমাকে একটা নতুন প্রাণ দাও। আমাকে একটু দয়া করো। চেয়েই যদি নিতে হয় বরের কাছে কেন? কেন দশ বছরের প্রেমিকের কাছে? আর শরীরের আগুন নেভানোর জন্য জিগালো আছে তো কত এই শহরে।
শোন, বীথি এত অ্যাডামেন্ট হলে চলে না এই সময়ে আর্যর সাথে দূরত্ব তৈরি না করে ওর পাশে দাঁড়া। সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা কর।
বাঃ অপরাধ ওর, বিকৃতি ওর ,আর কথা শুরু করতে হবে আমাকে? ও আমার কাছে স্বীকার করুক ।আমি তারপর ভেবে দেখবো।
কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস এখন তাহলে?
সেপারেশন
কোথাও রিখটার স্কেলে এক চুলও কম্পন ধরা পড়েনি এই বিশাল ভূখণ্ডে। শুধু মনের কারবারি কল্যাণীর ভেতরটা কেঁপে উঠল ভয়ংকর ভাবে। তুমুল লড়াই করে প্রতিষ্ঠা করা সম্পর্ক এভাবে ভেঙে যাবে?
( ৪)
ঘুম থেকে উঠে ক্যালেন্ডারে পাতা উল্টাতে গিয়ে থমকে গেল। আর্য নিশ্চিত জানে পাঁচ মাস শেষ হয়েছে তবু ছোটবেলার মতো কড় গুনে গুনে নিশ্চিত হল । আজ ছ-মাসে পড়ে গেল। সেই গমগমে গলাটা তার পিছু ছাড়েনি। পথেঘাটে চোখ রাঙিয়েছে। কাজের টেবিলে কাজ ভুল করিয়েছে। কুন্তিঘাট যাবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। রাতের ঘুম নিয়ে চলে গেছে। তার জন্য রেখে গেছে অপরাধবোধ আর ধিক্কার । মা ব্যাকুল হয়ে যখন জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে তোদের? কি করেছে রুনু? কি করেছিস তুই? কেন তোরা ডিভোর্স চাইছিস? সে বোবা হয়ে যায়, ঘাড় ঝুলে পড়ে।
তুই হয়তো অন্য মেয়ে বিয়ে করবি আবার কিন্তু আমি রুনুর মত মেয়ে পাব কোথায়? মায়ের প্রশ্ন আর বাবার কঠিন দৃষ্টি সারা শরীরে সপাসপ বেত্রাঘাত করেছে, করেই চলেছে। কতবার বীথির নম্বরটা বের করেও ফোনটা করতে পারছে না। তার নিজের দোষে একটা সংসার ভেঙে যাবে ?একটা সম্পর্কের গায়ে লেগে যাবে ডিভোর্সের তকমা?
মিটিং সেরে বেরিয়ে ফোনটা নরমাল মোডে আনার সময় বীথি দেখলো চার পাঁচটি মিসড কল আর্যর। এই পাঁচ মাস পরে মনে পড়ল ? বিরক্ত বোধ করল সে।নম্বরটা ব্লক করে দেওয়াই তো উচিত ছিল। ছ’ মাস শেষ হলে কোর্ট থেকে ডেট নিয়ে আসবে উকিল।তারপর শান্তি।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একটা ছোট্ট মেসেজ। প্লিজ কাল দেখা করো পাঁচটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির নিচে। প্লিজ বীথি..
কল্যাণীকে ব্যাপারটা বলতেই লুফে নিল। এই সুযোগটা ছাড়িস না। ওর সঙ্গে একটু আলোচনা কর, বোঝা। দরকার হলে আমার কাছে আন। আমরা সেই এক কোচিংয়ের বন্ধু। ও আমার সঙ্গে বেশ খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারবে।
কিন্তু তোর কাছে আনার প্রস্তাবটাও কি আমি দেবো? কল্যাণী বলে দিয়েই দেখ না। প্লিজ বীথি একটু ইগোর খোলসটা ছেড়ে বেরিয়ে আয়, একটু অন্যরকম করে কাটাবার কথা ভাব এবারে দেখা হওয়াটা। ও হয়তো বেরিয়ে আসতে চাইছে। ও তো নিজেও ভালো নেই। আর তোর শাশুড়ির কথাটা একবার ভাব। কিভাবে যত্ন করে তোকে উনি অফিস পাঠাতেন। সত্যি বলতে তোর মাকে সেভাবে কখনো তোকে যত্ন করতে দেখি নি।
এই জোর টুকু বোধ হয় চাইছিল বীথির অন্তঃকরণ। বললো,তাহলে দেখা করি?
হাওড়া ব্রিজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওদের মনে পড়ছে ওরা কতবার প্ল্যান করেছে হেঁটে ব্রিজ পেরবার কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এখন ওদের পাশ দিয়ে জনস্রোত নিচ দিয়ে জলস্রোত । মাঝে টুকটাক কথায় ওরা দ্বিখন্ডিত প্রেম নিয়ে। বড় ঘড়ির তলায় ওকে দেখে বীথি চমকে গেছিল। কি চেহারা হয়েছে! মায়ের কাছে থেকেও এ চেহারা হয় কিভাবে!
তবু সামলে নিয়েই বলে কেমন আছো?
ভালো। তুমি ?
ভালো আছি ,অন্তত সসম্মানে । বলেই সামলে নেয় নিজেকে। কল্যাণী বলেছে সহজ থাকতে।
মামনি কেমন আছে ?বাপি ?মামনি কি এখনো আগের মতো….
হ্যাঁ সব অভ্যাসে এক আছে । শুধু প্রথম প্রথম দুটো টিফিন বক্স রেডি করে ফেলতো অভ্যাসে তারপর কান্নাকাটি। মা কথা বলে না ভালো করে আমার সাথে।
ওরা যে ঠিক করেছিল ব্রিজ ধরে হাঁটবে এমনটা নয়। এমনি টুকটাক কথা ওদের স্টেশনের বাইরে জনস্রোতে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন আপাতত কথা নেই। হাঁটছে চারটে পা একসঙ্গে । গায়ে গা লেগে গেলে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে বীথি, যেন পথ চলতি পুরুষ । আর্য ভাবে কিভাবে সেই নিষ্পাপ কৈশোরের মন্ত্র শেখা যায়? বীথি ভাবে কিভাবে একটা মানুষ পারত শুধু নিজের তৃপ্তির পর এত নিলিপ্ত থাকতে? ভাববে না একটুও যে পাশে শুয়ে থাকা যুবতী মেয়েটিরও কামনা আছে। সেও একটু আদর চায়, নিবিড় সান্নিধ্য চায় স্বামীর আর পাঁচটা মেয়ের মতো । বীথি একথাও ভাবে যে তার মা দিব্যি বাবার সঙ্গে ডিভোর্স নিয়ে বাবার বন্ধু তরুণ কাকুর সঙ্গে লিফট টুগেদারে আছে। বাবা একাকীত্ব সামলাতে না পেরে মানসিক রোগী হয়ে চিকিৎসাধীন। সে কখনো মাকে সাপোর্ট করতে পারেনি। মাকে বোঝাতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে । এখন সে আর মায়ের কাছে যেতেই পারে না । মাকে সে প্রশ্ন করেছিল ,একটা কাগজের সই দিয়েই মুছে দিলে বাবাকে তোমার জীবন থেকে? পারলে? বাবার কী কোন ভালোত্ব তোমাকে বিচ্ছেদ থেকে সরাতে পারত না? তুমি বিকল্প পেয়ে ভুলে গেলে বাবাকে?
আজ সে কি করতে চলেছে? নিজের অপ্রাপ্তিকেই বড় করে দেখেছে সে। অথচ সম্পর্কের প্রথম আটটা বছরে ছায়ার মত তাকে সান্নিধ্য দিয়েছে গাইড করেছে আর্য । তবে কি সেও মায়ের জিন দ্বারা প্রভাবিত? তবে?
পায়ে পায়ে ব্রিজ শেষ হতে চমকে গেল দুজনে একসাথেই । তাদের প্রেম পর্বে অনেক না ফলপ্রসু হওয়া পরিকল্পনার মধ্যে একটা ছিল হাওড়া ব্রিজ হেঁটে পার হওয়া। আজ ভাগ্যচক্রে তা হয়ে যেতে দুজনেই সহসাই যেন অতীতে ডুবে গেল ।
আর্য ভাবতে থাকে, কি বেশি আর ক্ষতি হতো এর চেয়ে যদি সমস্যাটা আড়াল না করে ওর কাছে কনফেস করতাম ।বলতাম ,আমি ডুবে যাচ্ছি রুনু, বাঁচা ।যেভাবে হড়কা বানে ভেসে যাওয়া থেকে আমাকে বাঁচিয়ে ছিলিস নিজের জীবন তুচ্ছ করে। কেন বলিনি, রুনু আয় না দু-জনে একটু পথ খুঁজে নিই..
এরপর কোথায় যাব?
বীথির প্রশ্নে চমকে গেল। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো গঙ্গার বুকে নৌকায় ভাসার শখ বীথির বহুকালের। জীবনে আর সুযোগ আসবে কিনা জানি না। ফোনটা বের করে ওলা ডাকতে গিয়ে আবার ঢুকিয়ে ফেলল আর্য। একটা হলুদ ট্যাক্সি ছিল সামনেই। উঠেই বলল– আউটরাম ঘাট।
আমরা কেউ সাঁতার জানি না। বলেই থমকে যায় বীথি। কি হবে নৌকাডুবি হলে? মরে যাবে এইতো ?এখন কি সত্যিই তারা বেঁচে আছে!
গঙ্গায় ওরা দু-জন শুধু নৌকায় । শীতল হাওয়া এসে লাগছে ক্লান্ত শরীর দুটোতে। বীথির কুর্তির উপর রাখা হাত অনেকদিন পর তুলে নিলো আর্য। এই প্রথম রক্তে রক্তে প্রেমজ কামনার বোধন হচ্ছে বুঝলো সে।
বীথি হাতটা সরিয়ে নিতে গিয়ে আঁকড়ে ধরল আর্যর হাতটা। কার চোখের জল পড়ছে হাতে দেখার জন্য পশ্চিমের রোদ ঝুঁকে এলো একজোড়া হাতের উপর।
-আমাকে কল্যাণীর কাছে নিয়ে যাবে বীথি??
[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]
Tags: short story, গল্প, গল্পের সময়, নন্দিতা সিনহা, শেষের আগে
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।