01 Oct

জামতাড়া গ্যাং

লিখেছেন:শ্রেয়া ঘোষ


গল্পের সময় উৎসব সংখ্যা

(১)

বেশিদিন নয়, এক বছর পুরতে  আরও মাস চারেক বাকি ছিল। এই  ক’মাসের খাপছাড়া সংসার।  চুকিয়ে দিয়ে যখন বেরিয়ে আসে কেউ, টান পড়ে কি কোথাও। পড়লেও সে টান পোক্ত নয়। উপড়ে ফেলতে তেমন কষ্ট কিছু হবার কথা নয়। দুটো ট্রলি, বড় হাতব্যাগটা  আর একটা ল্যাপটপ। বেরিয়ে এসে দরজাটা টেনে দিলেই খচ করে  মসৃণ শব্দে  একটা দরজা বন্ধ শুধু নয়, একটা স্থায়ী সমাপ্তি। দু সেকেণ্ড থমকাল হয়তো – এখনও বদলে দেওয়া যায়। দরজার তলার ফাঁক দিয়ে চাবিটা ভেতরে পাঠিয়ে দিলে সব শেষ।  চার মাস কম এক বছরের স্মৃতিটা সিনেমার দৃশ্যের মতো ভেসে উঠে মিলিয়ে যাবে। শাঁখ বাজছিল। উলু দিচ্ছিল কেউ। এক কুনকে ধাণ হাতে নিয়ে ও থমকেছিল মুহূর্ত। – মাথা ডিঙিয়ে ছুঁড়ে দে পিছনে। আর ফিরে দেখবিনা। নির্দেশ দিচ্ছিল কেউ পাশ থেকে। স্মৃতিগুলো বিপজ্জনক ক্রমশ,ও আর অপেক্ষা করেনি।হৃদপিণ্ডের গতি অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছিল। আর এক মুহূর্ত সময় দেওয়া যাবেনা। লিফটের “জি” বোতাম টিপে সটান নিচে নেমে অপেক্ষমান অ্যাপ ক্যাবে উঠে এয়ারপোর্ট।

সিকিওরিটির মর্নিং শিফটের ছেলেটা বেরিয়ে এসেছিল কিওস্ক ছেড়ে। স্যুটকেসটা গাড়িতে তুলে দেবার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল। ও তাড়াহুড়ো করে নিজেই। আবছা জিগ্যেস করেছিল, কলকাতা? কবে ফিরছেন? স্টেশনে ঢোকার মুখে কি মন্দিরের ফটকের পাশে যেমন লাইন দিয়ে ভিখারি বসে থাকে, এই প্রশ্নগুলো-ও ঠিক সেরকম । এক জনকে একটা দশ টাকার নোট দিয়েছ তো সক্কলে হাত বাড়াবে। তোমার পার্স  খালি হয়ে যাবে তবু বাড়ানো হাতের সংখ্যা কমবেনা। একটা প্রশ্নেরও হাল্কা উত্তর যদি দাও, কি একটু হাসি এমনকি সামান্য ঘাড় হেলানো, ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসবে। ও ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে   ও. টি.পি. খোঁজে। গলায় ব্যস্ততা এনে বলে, থোড়া জলদি চলিয়ে না ভাইসাব। অল্প কদিন যাতায়াত করা পথ ঘাট, দোকানপত্র দ্রুত পিছনে হারিয়ে যায়। একই ভাবে দিনগুলোও।

এসেছিল যেদিন, রাত তখন গভীর। মনটা বেবাক ফাঁকা রেখেছিল। একটা বাক্যাংশই ঘুরে ফিরে নড়াচড়া করছিল – জাস্ট পার্ট অফ আ প্ল্যান। এই ক’মাসে ভোলেনি এক মিনিটের জন্যেও। ভুলতে দেয়নি নিজেকে। হাসেনি। দীর্ঘ অনভ্যাসে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা হয়তো ভুলেই গেছে বরাবরের মতো। ব্যাগটা সাবধানে আঁকড়ে ধরে। ওর অর্জন এই কটা মাসে, যা ও সাফল্য বলে ভাবার চেষ্টা করছে। খুশি হতে চাইছে।

গতকালও, ঠিক এ সময়ে নয়, আরেকটু পরে , যখন ঐ ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় বাসিন্দা অফিস চলে গেছে, ও ঠিক এরকমই অ্যাপ ক্যাব ডেকে বেরিয়েছিল। তখন একটা শুধু স্লিঙ্গ ব্যাগ।একটার পর একটা শপিং মল ঘুরে কেনাকাটা করছিল। গয়না  থেকে মোবাইল, গিফট ভাউচার। কার্ডে দাম মিটোনোর সময়ে প্রত্যেক বার ব্যাংক থেকে ফোন যাচ্ছিল কার্ডের প্রাথমিক স্বত্ত্ব যার, অর্থ্যাৎ এই খেলাটায় ওর প্রতিপক্ষের কাছে। বারবার ফোন আসছিল তাই ওর কাছেও। টিপিকাল বিরক্তি মাখানো গলায়, ওর টিপিকাল অশ্লীল শব্দগুলো উচ্চারণ করে ও জানিয়েছিল কিছু দরকারি কেনাকাটা ও করছে। একটা সময়ে ওকে থামতেই হয়েছিল যখন কার্ডের খরচের শেষ সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল।

ফিরতি পথে টেনশনে ঘামছিল। এমনকি ক্যাব ড্রাইভারকেও ভয় পাচ্ছিল। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর তাগিদটা জরুরি যেন। অনর্থক কথা । ব্যাগ খুলে ওয়েট টিস্যু বার করে মুখ মোছা। ফ্ল্যাটে পৌঁছে  তাড়াহুড়ো করে নেমে এগোতেই একটানা হর্ন বাজিয়েছিল ড্রাইভার ছেলেটি। পথচলতি লোকজন দাঁড়িয়ে পড়েছিল। গুঞ্জনটা ওর চারপাশে চাক বেঁধে উঠতেই , ও সরি বলে ফিরে এসে ভাড়া মিটিয়েছিল।   রাতে কোন কথা আর হয়নি। কথা এড়ানোর জন্যই ও ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল মাথা ধারার চেনা অজুহাতে। যদিও ঘুম আসেনি সে রাতে।

আজ অনেকটা শান্ত। আগে থেকে বুক করে রাখা গাড়ির ভাড়া ব্যাগের সামনের খাপে রাখা। পৌঁছনোর একটু আগেই ব্যাগ থেকে নিয়ে হাতে রাখবে। নামার আগেই ভাড়া মেটাবে। খুচরো ফেরত নেবেনা। বদলে ছেলেটিকে অনুরোধ করবে একটা ট্রলি এনে দিতে। যত অস্থিরতা এই মুহূর্তটার আগে অব্দি-ই। প্রজেক্ট শেষ হয়ে আসার বেলাটায় পৌঁছে ওর মাথা আর মন একদম শান্ত হয়ে আসে। আগের বারের অভিজ্ঞতা ওকে স্মার্ট করেছে।। এয়ারপোর্টে ঢুকে প্রথমেই স্মোকিং জোনে ঢুকবে। বহুদিন যাবৎ টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুগুলো ধীরে ধীরে শিথিল হবে। চেক ইন, সিকিওরিটি শেষ করে বোর্ডিং গেটের সামনে এসে বসবে। কাচের দেওয়ালের ওপারে প্লেনগুলো রাজহাঁসের মতো।

(২)

– ম্যাডাম করীব দশ সাড়ে দশ বাজে চলি গয়ী। বহৎ জলদি মে থী। ফ্লাইট মিস তো নহি হুয়ি…

ও যেন চোরা বালিতে ডুবে যাচ্ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে হবে। একটু হেসে ডান হাতটা তুলে লিফটের দিকে এগিয়েছিল। লিফটের ঐ বদ্ধ কুঠরিটা ওকে স্বস্তি দিয়েছিল। ন ‘তলায় পৌঁছে বেরোতেই হল। নোংরা সিঁড়ির ধাপেই বসে ব্যাগ হাতড়ে চাবিটা পেয়ে একটা যেন পথ খুঁজে পেল। ঘরটা লণ্ডভণ্ড করে রেখে গেছে। এদিক ওদিক দেখে ও গোছানো শুরু করল। বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকা, লণ্ড্রি ব্যাগে জমিয়ে রাখা নোংরা জামাকাপড় সব ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে সুইচ অন করে  দাঁড়িয়েই রইল। আপাতত জল ভরে ওঠার জন্যে অপেক্ষা করাটাই যেন সবচেয়ে জরুরি। সাবান, জল আর কাপড়ের অবিন্যস্ত বাণ্ডিলটা ঘুরে ঘুরে নিজেদের যখন গুছিয়ে ফেলল, ও ঢাকনা বন্ধ করে হোম ডেলিভারিতে  অর্ডার দিল।  খেতে বসে ওর পুরোন কয়েকটা দিনের কথা মনে পড়ছিল। খালি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে ওর এই ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দার কথা ভাবতে গিয়ে দেখল ওর মুখটা কিছুতেই মনে পড়ছেনা। একটা ঝাপসা অবয়ব শুধু। উজ্জ্বল রঙের পোশাকগুলো মনে করতে পারছিল। গাঢ় লাল, সবুজ আর কালো এই রং গুলো ই পছন্দ ছিল। কিন্তু মুখটা ঝাপসা ।

কাজ খুঁজছিল।  যেন অনেক দরকারি কাজ সেরে ফেলতে হবে একটা সীমিত সময়ে। মোবাইলে মেসেজ পাঠানোটাই আপাতত জরুরি কাজের লিস্টের মাথায় । –  চলে গেছে। দুটো শব্দ টাইপ করতে বারবার ভুল হচ্ছিল। তিন চারটে নম্বরে মেসেজটা পাঠিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখল।  বেল বাজতে একটা চেনা প্রতিক্রিয়া শরীরে মনে জেগে উঠেই হারিয়ে গেল। কয়েক মাসের সম্পর্কহীন যাপনেও একটা ছন্দ আছে। কিছু অভ্যেস তৈরি হয়ে যায়। হোম ডেলিভারিতে খাবার নিয়ে স্নান করে শুতে যাবার মুহূর্তে রাগ, স্বস্তি, বিরক্তি, ঘেন্না, ক্লান্তি, দুঃখ সব মিলিয়ে ও অসুস্থ বোধ করছিল। দম আটকে আসছিল। ওষুধ ছাড়া ঘুম অসম্ভব।

অফিসের জমে থাকা কাজ, কাজের পাহাড়, সাইট ভিজিট, ক্লায়েন্ট মীট, টাটা মেডিকালে জেঠুর অপারেশেন, রেডিয়েশন দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ঝড়ের গতিতে। দিনের শেষে দু কামরার ভাড়ার ঘরে এসে  খুঁজে খুঁজে গত কয়েক মাসের  ছোট বড় সব অভিজ্ঞান বাতিল করে জঞ্জালের ঝুড়িতে  ফেলে দেওয়াটা নেশার মতো ক্রমশঃ। মেট্রো স্টেশনে বা ফিরতি পথে রাস্তায় পিছন থেকে কাউকে দেখে চমকে উঠেছে। ফ্ল্যাটে এসে বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করেছে কয়েক সেকেন্ড। এসব কাটাতে গেছে কতগুলো দিন, সপ্তাহ মাস।

শরীরে ক্যান্সার বাসা বাঁধলে যেমন অসহ যন্ত্রণা, ছোটমণিকে দেখেছে , দাঁতে দাঁত চেপে, হাত দুটো মুঠো করে নিঃসাড়ে শুয়ে থাকত, কাছে গেলে বন্ধ দুচোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসত জল। অপারেশনের পর স্বস্তি। কিন্তু সেই প্রাণখোলা হাসি কি ফেরৎ এসেছিল? নিজেকে গুটিয়ে রাখত সারাক্ষণ । লোকজন এড়িয়ে একেবারে একলা মতো। ও -ও কি ছোটমণির মতো ই হয়ে যাচ্ছে? হসপিটালে শুয়ে মণি বলেছিল, শরীরের অংশ কেটে ফেলে দিতে যে কি যন্ত্রণা, পঁয়তাল্লিশ বছরের শরীরটা হঠাৎ পাল্টে গেলে মেনে নেওয়া বড় কঠিন রে বাবলু। মনে মনে ও বলে, পঁয়তাল্লিশ বছর তো অনেক অনেক দিন রে মণি, এক বছরও কাটলোনা,মায়ার শিকড় কি করে  চারিয়ে গেছে অন্দরে,বুঝতেও পারিনি আমি।

(৩)

দুটো প্রজেক্টের ভেলভেট মসৃণ সাফল্য ওকে কি একটু বেশি-ই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল?

– যে কোন কাজেই একটা পদ্ধতি থাকে। ভুল আর সংশোধন, বারবার ভুল হবে, আগের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। এ কাজে হতে হবে বনের হরিণের মতো ক্ষিপ্র আর সদা সতর্ক। বন মানে সত্যিকারের জঙ্গল। রিজার্ভড ফরেস্টের মতো সাজানো খেলাঘরের বনভূমি  নয়। তেষ্টার জলটুকুও নিশ্চিন্তে খেতে পারবেনা। তোমার চোখের দৃষ্টি শুধু সামনেটা দেখাবে। বাকি নটা দিক?

ও হাত তুলেছিল । – আরও চারটে ইন্দ্রিয় তো আছে আমাদের।  চোখে পড়ে গিয়েছিল দশ জনের মধ্যে থেকে আলাদা হয়ে।

– একজ্যাক্টলি। গন্ধ পেতে হবে। বিপদের গন্ধ আছে। রক্তের গন্ধ চেন? রক্ত শুকিয়ে জমাট বাঁধলে যে রকম?  বমির গন্ধ? মড়া পোড়া গন্ধ? আলাদা আলাদা নয়। সব মিলেমিশে গেলে ? চিনতে হবে । আর হাল্কা রাখতে হবে নিজেকে।  লোভের রসে আটকে পড়া চলবেনা  সব ছেড়ে মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারবে? প্রশ্নটা জারি রাখতে হবে মনে, মাথায়। বিপদ ঘনিয়ে এলে একটা ভাপ ওঠে চারদিক থেকে। হাওয়াটা বদলে যাবে। সূক্ষ্মতম বদলটুকুও ধরতে পারে যেন তোমার রাডার। এসকেপ রুটের ম্যাপটা তৈরি রাখতে হবে প্রথম দিন থেকেই।  শিকার চিনিয়ে দেওয়া অব্দি আমাদের দায়িত্ব। তারপর আমাদের আর পাশে পাবেনা। হাত, পা, মাথা , বুক, পেট …. ওয়েল, আর যা কিছু সেটাই মূলধন। আর একটা জরুরি কথা, কাজের শেষে মাথা, মন সব ওয়াশিং মেশিনে ডাম্প করে স্পটলেস ক্লীন করে ফেলতে হবে। কোর্ট কেসের ফয়সালার দায়িত্ব আমাদের। খেলা শুরুর হুইশিল বেজে গেল। অল দ্য বেস্ট।

আড়াই ঘন্টার ফ্লাইটে চোখ বন্ধ করে এই কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া। প্লেনের দরজার মাথায় লাল গ্লোসাইনের  এক্সিট বোর্ডটা  ছাড়া চারপাশের আর সব নেই করে দিল। পরের খেলার হুইশিলের জন্য অপেক্ষা আর প্রস্তুতি। এই মুহূর্তটা থেকেই।

আগের প্রজেক্টের ভাগ বাঁটোয়ারা চুকিয়ে নিয়ম অনুসারে এখন অন্ততঃ মাস ছয়েকের অজ্ঞাতবাস। শরীর আর মনের সম্পূর্ণ বিশ্রাম। ইতিমধ্যে হেয়ার স্টাইল পাল্টানো, হাঁটাচলার ভঙ্গী, চশমার ফ্রেম। রাস্তায় বেরোলে বড় ফ্রেমের রোদচশমা তো বরাবর।আইন কানুনের ব্যাপার সামলানো কোম্পানির দায়িত্ব। মোবাইলের নতুন নম্বর এসে যায় একদিন। কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে হোক বা অন্য কোন যোগাযোগের সূত্রে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট আসে।

– নিজের কাজ নিয়ে মনে যদি দ্বিধা থাকে, তাহলে ধরা পড়ে যাবে। এক প্রকারে কিন্তু আমরা মানুষকে সাহায্যই করছি। সিনেমার অভিনেত্রী ভাবতে পার নিজেদের। ক্যানভাসটা রিয়েল। অপরাধবোধের কোন হেতু নেই। একটা হোঁচট খেয়ে পার্টির জীবন আরও মসৃণ এগিয়ে যাবে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের মক টেস্ট হয় যেমন। আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এ কাজ তোমার জন্য নয়। প্রজেক্ট  শুরু করলে মাঝপথে বেরিয়ে আসা চলবেনা। বিয়েটাকে সত্যি ভাবলে বিপদে পড়বে। পার্ট অফ প্ল্যান।

– আমাদের কাজটা কি অপরাধের মধ্যে পড়ে? এত অব্দি বলে স্যার ঘরের আটজনের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন। ও সব চেয়ে আগে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিল , নট অ্যাট অল। আমার কাছে জীবনটা একটা যুদ্ধ। আমার বাঁচার রসদ নেই। কারও কাছে উদ্বৃত্ত। আমাকে লড়ে জিততে হবে। আমি খুন করছিনা –  পেটের খিদেটা উল্টে খুন করে ফেলবে আমাকে। উপযুক্ত একটা রণকৌশলের পরিকল্পনা মতো কাজ করে শত্রুকে নিকেশ করা তো জীবজগতের ধর্ম। কেউ শিকার ধরে খিদে মেটায়। আমি নাহয় তাদের দলেই নাম লেখালাম। চাকরি করে কি করে নিপাট ভদ্রলোকেরা? – জীবিকা নির্বাহ। আমার কাজটাও ঠিক সে কারণেই।

সকলে চুপ করে গিয়েছিল। শেষ সারিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রোগা মেয়েটা। স্যার ওকে আলাদা জিজ্ঞাসা করলেন, তপতী? -বাঁ হাত দিয়ে কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে, আড়াআড়ি গভীর কাটা দাগটা ছুঁয়ে বলেছিল  হিংসা, প্রতিহিংসা।

থানার ঘরটা অনেকটা সেদিনের মিটিং রুমের মতই। সেদিনের মতই আজও ওরা চার পাঁচ জন আর অফিসারের দৃষ্টি মূলতঃ ওর ওপর। কিন্তু ও সেদিনের মত নয় আজ। চোখের তলায় কালি। মাথা নিচু।

– বিয়ের খেলা ছেড়ে এবার লিভ টুগেদার কেন ম্যাডাম? দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল টেবিলের ওধারের লোকটা।

– একটু জল। আর একটু সময় দরকার । ওর সামনে সকালের কাগজের খোলা পাতা। কাল রাতের নাটক থেকে নেওয়া একটা ছবি।

(8)

খবরটা কাগজে বেরিয়েছিল গত সপ্তাহে আর ও বিয়ে ভাঙার সরকারি কাগজ হাতে পেয়েছে তারিখ মিলিয়ে ঠিক এক মাস আগে। আনন্দ হওয়া কি স্বাভাবিক ছিল? অথবা স্বস্তি? যেমন ওর কাছের লোকজন, আত্মীয়,স্বজন সকলে বলছিল, কানের পাশ দিয়ে বিপদটা কেটে গেছে ওর। যেমন ঘূর্ণির তাণ্ডব থেকে মাঝে মাঝে উদ্ধার পায় ওর শহরটা যখন সেই বিধ্বংসী ঝোড়ো দানব আছড়ে পড়ে প্রতিবেশী রাজ্যে। গত এপ্রিলে ওর চলে যাওয়ার দিন থেকেই যে মুখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল, কাগজে সেই মুখ দেখে ও চাইছিল গোলাপি টি শার্ট আর হাল্কা নীল জিন্সের এই মেয়েটা অন্য কেউ হোক। ভয় করছিল ওর। খুব ভয় করছিল। গোটা কলকাতা যেন ওকে প্রশ্ন করতে শুরু করবে এই মুহূর্তে – এই টপটাই তো কিনে দিয়েছিলিস ব্যাঙ্ককে হানিমুনে গিয়ে?  – শুনলাম  গয়নাগুলো সবই নাকি নিয়ে গেছে। আর একটু খোঁজ খবর নেওয়া উচিত ছিল। – ঠগিনী বলে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, সন্ধ্যা রায় – অনুপ কুমার। – আগে আগে নাকি  আরও দুটো বিয়ে করেছিল। একটা ছেলে তো শুনলাম হাসপাতালে, ঘুমের ওষুধ ….

–  একটা ছেলে ঘুমের ওষুধ, আরেকটা ছেলে মেন্টাল অ্যাসাইলামে, সেই খবরটা পাওনি? কাগজটা রোজ পড়বে এই কদিন। আরও দুটো তিনটে কাগজ দিতে বলে দিও হকারকে। অনেক খবর পাবে। রোজ আরও নতুন নতুন। অফিসে ছুটি নিয়ে ফোনটা বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।

খবরগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে ও নিজেও। বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে সব কটা কাগজের নেট সংস্করণ। কাগজের খবর কোথায় পাবে? হকারকে কি বলবে, দাদা কাল থেকে আমাকে পাঁচটা বাংলা আর তিনটে ইংরেজী কাগজ দেবেন? তখনই তো বলবে সে, হ্যাঁ ঐ মেয়েটা ধরা পড়েছে তো? এ পাড়ায় তো সব বাড়িতেই কাল থেকে চার পাঁচটা করে কাগজ নিচ্ছে। সকলেই তো বলছে ….

ঘুমের ওষুধ আর মানসিক হাসপাতালের মাঝখানে ছিল ও। আরও দুটো লিভ ইন সম্পর্ক, এস্কর্ট সার্ভিস। একটা ছেলে, বছর খানেক প্রায় একসঙ্গে ছিল বারুইপুরে ঘর ভাড়া করে, অত দূর থেকে ওর ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করেছিল। অনেক প্রশ্ন করেছিল ওকে। ও এড়িয়ে গিয়েছিল। ছেলেটা বলেছিল, আমি ছেড়ে দেবনা। আপনাদের মতো ফালতু ভদ্দরলোকের হেল্প আমার চাইনা। ছ ফুটের ওপর হাইট, পেটানো চেহারা, ডান হাতটা মুঠো করে বলেছিল, ও জানেনা আমাকে ঠকানোর দাম কত। সেই ছেলেটাই পুলিশে গিয়েছিল। ছবি টবি … ।

ছবি, বিয়ের সার্টিফিকেটের কপি, বিচ্ছেদের কাগজ নিয়ে ওকেও যেতে হয়েছে থানায়। তখনই দেখেছে ওদের গ্যাং লিডারকে। পাঁচটা বাংলা আর তিনটে ইংরেজী কাগজে ছবি দেখে এখন সারা দেশ চিনে গেছে এই গ্যাং এর মাথা আর অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গদের। হাইলাইট করা ঘাড় ছাপানো চুল পনিটেল করা, কপালের বাঁ দিকে গভীর কাটা দাগ। চলে যাবার কিছুদিন আগে থেকেই ও বলত, স্যার বোধহয় নেক্সট মান্থেই আমাকে অন্য একটা প্রজেক্ট টীমে নেবে। মুভ করতে হবে শিগ্গির। একটু থেমে বলত, ইন ফ্যাক্ট আমিই আউট স্টেশন প্রজেক্ট অপ্ট করেছি। একটা বড় জাম্প পাব। মোর ওভার এই খুপরি ফ্ল্যাটে আমার সাফোকেটিং লাগছে। অন লাইনে একটা হাই লাইটার আর একটা হেয়ার ব্যান্ড আনিয়েছিল। বলেছিল নেক্স্ট উইকে স্যারের বার্থডে। এখন থানায় অফিসারের সামনে বসে থাকা লোকটাকে হাবার মতো লাগছিল।

– সিনেমার অভিনেত্রী ভাবতে পার নিজেদের। ক্যানভাসটা রিয়েল। অপরাধবোধের কোন হেতু নেই। একটা হোঁচট খেয়ে পার্টির জীবন আরও মসৃণ এগিয়ে যাবে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের মক টেস্ট হয় যেমন। মোবাইলে অডিও ক্লিপিংটা এই অব্দি চালিয়ে বন্ধ করে দিলেন অফিসার। চেয়ার ঠেলে উঠে আচমকা পনিটেলটা ধরে টান দিতে যন্ত্রণায় মুখ কুঁচকে গেল লোকটার।  – তো সমাজ সেবা ভালই চলছিল, ফাঁসাল কে? দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল শয়তানটা। এই লোকটার সঙ্গেও হয়তো ও…  আর বসে থাকতে পারেনি। কোন রকমে থানার অফিসারকে বলে বেরিয়ে এসেছিল। সারা শরীর মুচড়ে বমির দমক উঠে আসছিল।

(৫)

শহরটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। খবরগুলো কাগজের পাতায় পিছিয়ে যেতে যেতে, আর ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল একদিন। যেমন হয়।

যেমন হয় আর কি। ফের ঘুরে আসে খবরগুলো। ছোট থেকে বড়। তোলপাড় চলে কিছুদিন। মাঝে কেটে যায় দিন, মাস, বছর।শহরে গঞ্জে, অফিসে রাস্তায় লোকগুলো, যাদের দেখছ, দু ভাগে ভাগ হয়ে আছে তারা। প্রতারিত আর প্রতারক। অনিয়ন্ত্রিত বিধ্বংসী পারমাণবিক বিক্রিয়ার মতো জ্যামিতিক ক্রমে প্রতিদ্বন্দী দুটো দলই বেড়ে চলছে। বাইরে থেকে বুঝবেনা। দুটো দলের একটাতে যদি ঢুকে পড় ঘটনাচক্রে তখন শুধু। অদৃশ্য এক দেওয়াল শরীর পাবে তোমার চোখের সামনে। লোভ হোক বা খিদে, প্রতিশোধের তাগিদ বা বেমক্কা খানিকটা মজা লুটে নেওয়া, কেন আর কারা বোঝা সহজ নয়। জটিল এক জৈব শৃঙ্খলের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জাল বিছিয়ে যাচ্ছে অবিরত। কেউ হারিয়ে যায় বাসি খবরের মতই। ফাঁকটুকু ভরাট করতে চলে আসে নতুন  ঘটনা, নতুনতর ধান্দাবাজি। পারিপার্শ্বিক বদলে যায়। লিঙ্গ, ধর্ম, সমাজের তল ভিন্ন । প্রতারণা আর ভাঙচুর অভিন্ন। ভূকম্পের মতো ঝুরঝুর করে একটার পর একটা নির্মাণের ধ্বংস, হাহাকার, ক্রোধ, হতাশা, ঘৃণা শুধু পাক খেয়ে চলে অতলান্ত ঘূর্ণীর মতো।

দেখতে পাচ্ছ, পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ঐ যে ওরা। এক্ষুণি শুনতে পাবে নতুন একটা খেলা শুরুর বাঁশি। আগের খেলাটা শেষ করে দেখ ফিরে যাচ্ছে আরও কেউ, ঝুঁকে ঝুঁকে। তার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে ছায়ার মতো আরও কেউ। হাতটা ধরছে আর সেই মুহূর্তে নতুন একটা দান ফেলে থমকে যাওয়া ঘুটিগুলো চলতে শুরু করছে, দেখ ধীরে,সন্তর্পণে।…. ক্রমশ বাড়িয়ে নিচ্ছে গতি,ভরবেগ, শক্তি।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ