01 Oct

নিশিযাপন

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সিংহ


গল্পের সময় উৎসব সংখ্যা

চোস্তা আর হাফ হাতা পাঞ্জাবি গায়ে গলাতে গলাতে কৌশিকের হঠাৎ চোখে পড়ল, এ দেয়াল সে দেয়ালে বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো একের পর এক ছবি। ফ্রেমগুলোর ফাঁকফোকর থেকে চুন সুরকি খসে খসে দাঁত-মুখ বেরিয়ে আসা দেখে তার মনে হল, এগুলো ঢাকার জন্যই বুঝি এই ফ্রেমগুলো এখানে টাঙানো হয়েছে।

কিন্তু ছবিগুলো এ রকম কেন! ছবিতে গাছ আছে। কিন্তু পুরো গাছটা নেই। কাণ্ডের পরেই সামান্য একটু ডালপালা। মনে হচ্ছে, যিনি এটা এঁকেছিলেন, তিনি পুরোটাই এঁকেছিলেন। কিন্তু কেউ বুঝি কাঁচি দিয়ে ছবির উপরের অংশটা কেটে নিয়ে গেছে।

এ কী! পাশেরটা ও রকম কেন! ফ্রেমের বাঁ দিক থেকে ডান দিক পর্যন্ত শুধু সাপের মাঝখানের শরীরটাই দেখা যাচ্ছে। লেজ আর মাথাটা কোথায় গেল!

ওমা, এটাও তো তাই! জিরাফের দেহটা দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু গলা থেকে উপরের অংশটা কোথায়! ভারী অদ্ভুত ছবি তো! তার থেকেও বড় কথা, এই ধরনের ছবি কেউ আঁকতেই পারেন, তা বলে সেটা কেউ এত দামি ফ্রেমে বাঁধায়!

রাজেন্দ্রবাবু এসে যখন বললেন, দাদাবাবু, আপনার খাবার বেড়েছি। চলুন, খাবেন চলুন। কৌশক তখন নীচে নামতে নামতে এই ছবির প্রসঙ্গ তুলেছিল। রাজেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, ও, তার মানে ওরা বড় হয়ে গেছে। তাই ফ্রেমে আর ধরছে‌ না।

— মানে? কোনও কিছু আঁকার পর, যেটা আঁকা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটারও বয়স বাড়ে নাকি?

রাজেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, বাড়ে বাড়ে… আমি তো গত বছরেও ওই ঘরটা খুলেছিলাম। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলাম। তখন মাথা আর লেজ পুরো ফ্রেম জুড়ে ছুঁই ছুঁই করছিল। আগে‌ তো এইটুকুনি ছিল।

— কী বলছেন?

— সেই জন্যই তো বাকি ঘরগুলো খুলি না।

কৌশিক ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?

রাজেন্দ্রবাবু বললেন, এখন থাক। খাওয়া-দাওয়া করুন। রেস্ট নিন। পরে শুনবেনখ’ন।

পড়ে কেন! নিশ্চয়ই কোনও একটা গণ্ডগোল আছে! রাজেন্দ্রবাবুর কথা শুনে কৌশিকের কেমন যেন একটা খটকা লাগল। তবু বলল, ঠিক আছে।

সেই কোন সকালে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান থেকে রওনা হয়েছে সে। তার পর ট্রেনে করে ক্যানিং। ক্যানিং থেকে অটো করে সোজা জ্যোতিষপুরের‌ ধলার মোড়। এটা সুন্দরবনের মধ্যে হলেও, এটাকে ঠিক সুন্দরবন বলা যাবে না। বলতে হবে— গেটওয়ে অফ সুন্দরবন।

পেছনের সিটে দু’জনের মাঝখানে কোনও রকমে চাপাচাপি করে বসেছিল ও। প্রায় চল্লিশ মিনিট জার্নি করার পর অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চারপাশে তাকাতেই কৌশিক একেবারে থ’। ধারে বসলে নিশ্চয়ই এগুলো দেখতে দেখতে আসা যেত! এই রকম নৈসর্গিক দৃশ্য সে বহু দিন দেখেনি। চারিদিকে খাঁ খাঁ করছে খোলা মাঠ। দু’হাত দূরে দূরে বিশাল বড় বড় গাছ। কী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া। মাটির সরু‌ রাস্তা। এটাকেই বলে আদর্শ গ্রাম।

ডাক্তার তাকে বলেছিলেন, সকালে একটু হাঁটাহাঁটি করবেন। পারলে মাটির উপরে। তা, নর্থ ক্যালকাটায় মাটির রাস্তা কোথায় পাবে!‌ পার্কও তো‌ এখন সিমেন্টে বাঁধানো। তাই মাটির এমন রাস্তা দেখে খালি পায়ে হাঁটার লোভ আর সামলাতে পারল না কৌশিক। পায়ের চটিটা খুলে হাতে নিয়ে নিল।

এখানে সে এসেছে তার এক বাল্যবন্ধু রতনের খোঁজে। বন্ধুটি দিন সাতেক আগে নাকি এখানে বেড়াতে এসেছিল। লোকমুখে শুনেছিল, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই অদ্ভুত বাড়িটার কথা। বাড়িটা প্রায় দুশো বছরেরও বেশি‌ পুরনো। দেখলেই বোঝা যায়, এখন আর কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।

ক্যানিং সাহেব যখন এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শিয়ালদা টু ডায়মন্ড হারবার ট্রেন লাইনটাকে সোনারপুর থেকে ক্যানিং অবধি টেনে নিয়ে এলেন, তখন নাকি স্বয়ং ক্যানিং সাহেব এই বাড়িতেই কয়েক দিন কাটিয়ে‌ছিলেন। সুন্দরবনের অনেক জলদস্যুরাও মাঝে মাঝে এখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকত। বারোভূঁইয়ারাও অনেক গোপন মিটিং করত এখানে। কত স্বাধীনতা সংগ্রামী যে লালমুখো পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এখানে রাতের পর রাত কাটিয়েছে তার হিসেব নেই!

এই বাড়িটির প্রতিটি ইটের খাঁজে খাঁজে নাকি ইতিহাস লুকোনো আছে। সেই ইতিহাসের খোঁজ করতেই এসেছিল রতন। থাকার কথা ছিল তিন দিন। কিন্তু তিন দিন কেন, আজ সাত দিন হতে‌ চলল সে ফেরেনি। তার বাবা-মা দিদি জামাইবাবুরা নাকি তার সঙ্গে মোবাইলে বহু বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। প্রথম প্রথম রিং হত। এখন যত বার ওঁরা ফোন করছেন, বলছে সুইচ অফ।

তাই তার মা-বাবা তাকে এখানে পাঠিয়েছে ছেলের খোঁজ নিতে।

খোঁজ করে করে সে যখন এখানে এসে পৌঁছল, তখন তিনটে বেজে গেছে। বাড়িটা দেখে সে একদম অবাক। কয়েক বিঘে জমির ওপরে এই বাড়ি। চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে, পুরনো আমলের জমিদার বাড়ি। একেবারেই ভগ্নদশা। কত যুগ যে এর গায়ে সিমেন্ট-বালি পড়েনি, রং হয়নি, কে জানে! পলেস্তারা খসে খসে ইটগুলো বেরিয়ে পড়েছে। দেয়াল ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে কত বট-অশ্বত্থ।

এটাই সেই বাড়ি তো! মূল ফটক দিয়ে ঢোকার সময় দেখল, ডান দিকের দেয়ালে হাতখানেক চওড়া একটা শ্বেতপাথরে খোদাই করে কী যেন একটা লেখা। কিন্তু কী লেখা, সেটা আর পড়া যাচ্ছে না। অক্ষরের চলটাগুলো উঠে‌ উঠে গেছে। তার ওপরে বছরের পর বছর ধরে জমেছে ধুলোবালির পারত… এটায় নিশ্চয়ই এই বাড়িটার নাম লেখা আছে! তাই ও হাত দিয়ে ঘষে ঘষে ময়লা পরিষ্কার করে পড়ার চেষ্টা করল। অতিকষ্টে উদ্ধার করল নকশা করে লেখা একটা শব্দ— নিশিযাপন।

আর এটা দেখেই ও লাফিয়ে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ,‌ এই তো সেই বাড়ি।

রতন যখন দূরে কোথাও যায়, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়, ও কোথায় যাচ্ছে সেখানকার নাম-ঠিকানা, সব ওর মায়ের কাছে দিয়ে‌ যায়। সঙ্গে কেউ গেলে তার ফোন নাম্বারটাও দিয়ে দেয়, কোনও কারণে তাকে না পেলে, যাতে ওর কাছে ফোন করে খবর নিতে পারেন।

এ বারও একটা চিরকুট দিয়ে এসেছিল। তাতে এখানকার নাম, ঠিকানা ছাড়াও লেখা ছিল একজনের নাম— রাজেন্দ্র শর্মা।

ও সেই ঠিকানা খুঁজে খুঁজেই এখানে এসেছে।

কৌশিক যখন চিরকুটে লেখা ‘নিশিযাপন’ নামটি প্রথম দেখেছিল, তখনই ওর মনে হয়েছিল, থাকার জন্য নয়, এই বাড়িটা বোধহয় তৈরিই হয়েছিল বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মাঝেমধ্যে ফুর্তি করার জন্য। তাই এই বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছিল— নিশিযাপন।

বাড়ি তো‌ পাওয়া গেল, এ বার এই চিরকুটে লেখা রাজেন্দ্র শর্মাকে খুঁজে পেলে হয়!

না, তাকে আর খোঁজ করতে হল‌ না। ফটকের ভেতরে পা রাখা মাত্রই, কেউ কোত্থাও নেই, হঠাৎ কোত্থেকে যেন‌ তার সামনে উদয় হল থুত্থুড়ে বুড়ো লোকটা লোক। তাঁকে ওই নামটা বলা মাত্রই তিনি বললেন, বলুন, আমার নামই রাজেন্দ্র শর্মা।

কৌশিক তাঁকে রতনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, খোঁজ করতে এসেছেন? খুব ভাল কথা। কিন্তু বড্ড বেলা করে ফেলেছেন তো… কলকাতা থেকে আসছেন বুঝি? নিশ্চয়ই অনেক সকালে বেরিয়েছেন। স্নানটান করে এসেছেন কি? না হলে, আগে ওটা সেরে নিন। তার পর ঘরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিন। খাওয়া দাওয়া করুন। তার পর কথা হবেখ’ন।

সত্যিই কৌশিকের খুব খিদে পেয়েছিল। তাই বুড়োর কথা শুনে কৌশিকও মাথা কাত করল।

কুয়ো থেকে বালতি বালতি জল তুলে ঝপঝপ স্নান করে কৌশিক যখন দালানে উঠে এল, তখন তার ছোট্ট লাগেজটা নিয়ে তার আগে আগে তরতর করে চওড়া কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলেন সেই বুড়ো।

কৌশিক বলল, আরে করছেন কী, দাঁড়ান দাঁড়ান, ওটা ভারী আছে, আপনি পারবেন না। আমাকে দিন, আমাকে দিন।

উনি বললেন, পারব না কেন? আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি নাকি? আসুন, আপনি আমার পেছন পেছন আসুন।

দোতালায় উঠে কৌশিক দেখল, সামনে লম্বা একটা করিডোর। মাথার ওপরে পর পর বেশ কয়েকটা ঝাড়বাতি। এগুলোর যা চেহারা, আদৌ জলে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ডান হাতে কোমর অবধি নকশা করা ঝাঝরি পাঁচিল। আর ক’পা দূরে দূরেই মোটা মোটা থাম্বা। ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেলেও বোঝা যাচ্ছে, দারুন কারুকাজ করা ছিল এক সময়।

আর বাঁ দিকে পর পর অনেকগুলো দরজা। দরজাগুলো এতটাই লম্বা যে, হাত যাবে না বলেই হয়তো ওপরে ছিটকিনি লাগানো হয়নি। দরজার পেটের কাছে ইয়া বড় বড় বেশ ভারী-জাতীয় হ্যাসবোল্ট লাগানো। কিন্তু এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও দরজাতেই তালা লাগানো নেই।

প্রথম ঘরটাই খুলে দিলেন রাজেন্দ্রবাবু। ঘরের ভেতরে লাগেজটা রেখে বললেন, আপনি ততক্ষণ রেডি হয়ে নিন, আমি আসছি।

রাজেন্দ্রবাবু চলে যেতেই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। কৌশিক মনে মনে বলল, ও বাবা, কী আওয়াজ… সিসট্রনটা নিশ্চয়ই নষ্ট হয়ে গেছে! কিন্তু এই সাবেকি দরজাতেও‌ সিসট্রন! বাব্বা, এগুলো তো সাধারণত অফিস-কাছারিতে লাগানো থাকে! এরা বাড়িতে লাগিয়েছেন!

খেয়েদেয়ে দোতলায় উঠে নিজের ঘরে না ঢুকে সোজা করিডোর ধরে পায়ে পায়ে ও একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হ্যাঁ, ও ঠিকই দেখেছিল, কোনও দরজাতেই তালা দেওয়া নেই। হ্যাসবোল্টগুলো খুব পুরনো। মনে হয় বহু যুগ ধরেই এই ভাবে আটকানো রয়েছে। হ্যাসবোল্টগুলোতে‌ ধুলোর পুরু স্তর জমে আছে।

ও নিজের ঘরে যাবার জন্য পিছনে ফিরতেই মনে হল, কে যেন ঝট করে সরে গেল। কে! রাজেন্দ্রবাবু নাকি! তাকে কি উনি ফলো করছেন! কিন্তু তাকে ফলো করতে যাবেন কেন! তবে কি… তখন যে কথায় কথায় তিনি তাকে ‘সেই জন্যই তো বাকি ঘরগুলো খুলি না’ বলে‌ ফেলেছিলেন, তার জন্যই কি‌ তাঁর‌ মনে হচ্ছে কৌতূহলবশত আমি ওই ঘরগুলো খুলতে পারি! সত্যিই খুলি কি না, সেটা দেখার জন্যই কি তিনি ফলো করছেন! হতে পারে!

ঘরে ঢোকার জন্য দরজা ঠেলতেই ও দেখল, পাপোষের উপরে কী যেন একটা চকচক করছে। মনে হচ্ছে, হিরে-চুনি-পান্নাখচিত কোনও অলংকার।‌ এখানে এটা এ ভাবে পড়ে আছে!‌‌ কোথায়, তখন তো চোখে পড়েনি! নিচু হয়ে তুলতে গিয়ে দেখল, না,‌ ওটা নড়ছে। তার মানে এটা অলংকার নয়। তা হলে এটা কী!‌ না, কেন্নো নয়, কেন্নোর মতো দেখতে ঠিকই, কিন্তু কেন্নো কখনও এ রকম হয় না। ও যখন আরও একটু ভাল করে দেখার জন্য ঝুকেছে, ঠিক তখনই সে ডানা মেলে হুশ করে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়ে নিমেষে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

ভারী অদ্ভুত পোকা তো! দারুন কালারফুল। এটা অবশ্য খুব স্বাভাবিক। সুন্দরবন বলে কথা! এ রকম আরও কত সুন্দর সুন্দর পোকামাকড়-জীবজন্তু যে এখানে আছে, কে জানে!‌ এ রকম কয়েকটা চিড়িয়াখানায় রাখতে পারলে বাচ্চারা একেবারে চোখ ফেরাতে পারবে না।

বিশাল বড় ঘর। ঘর তো নয়, একেবারে হলঘর।ঘরটার মধ্যে পর পর বেশ কয়েকটি দরজার সমান বিশাল বিশাল আদ্যিকালের জানালা। খড়খড়িওয়ালা। জানালাগুলো খোলা। খোলা মানে, আটকানো যায় না বলেই হয়তো খোলা। সামনের জানালার তিনটে কব্জার ওপরের দুটোই খুলে গেছে দেখে একটা পাল্লা কাত হয়ে ঝুলছে। কব্জাটা নিশ্চয়ই খুব মজবুত। তা না হলে অত ভারী জানালার পাল্লাটাকে ধরে রাখতে পারত না। তবু তার মনে হল, যে কোনও সময় সামান্য দমকা বাতাসের তোড়ে খুলে পড়তে পারে। বাকিগুলোরও ওই একই দশা। বোঝা যাচ্ছে, এগুলো‌ দেখাশোনা করার কেউ নেই। সেই জানালাগুলো থেকে পড়ন্ত বেলার যথেষ্ট আলো ঢুকছে ঠিকই, তবুও লাইট জ্বালাল কৌশিক।

আর লাইট জ্বালাতেই ও চমকে উঠল। দেখল, সামনের মতো দেওয়ালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত খালি ফ্রেম, ফ্রেম আর ফ্রেম। এ ঘরে তো ছবি টাঙানোর মতো আর কোনও জায়গাই নেই! তা হলে ওই খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে পর পর‌ অতগুলো ফ্রেম রাখা কেন!

ও যখন এগুলো ভাবছে, হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, বাবু, এই যে আপনার পান।

— পান? কী পান?

ছেলেটা বলল, খয়ের ছাড়া মিঠা পাতা, কুঁচো সুপারি, এলাচ দানা, চারশো বিশ জর্দা।

চমকে উঠল কৌশিক। বলল, আমি যে এই পানই খাই তুমি জানলে কী করে?

ছেলেটা বলল, জানি।

— তুমি কি রাজেন্দ্রবাবুর নাতি নাকি?

ছেলেটা বলল, না।

— তবে?

ছেলেটা বলল, আমি রাজেন্দ্র।

— ও, তোমার নামও রাজেন্দ্র? বাঃ বাঃ বাঃ, খুব ভাল। বড় রাজেন্দ্র পাঠালেন বুঝি?

ছেলেটা কোনও উত্তর দিল না। কৌশিককে পানটা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।‌ ও বেরোতেই দরজাটা আবার দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। আর সেই শব্দটা শুনেই কৌশিকের একটু খটকা লাগল। সে যখন জামাকাপড় পরে খাবার জন্য দরজা ঠেলে বের হয়েছিল কিংবা ফিরে এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেছিল, কই, তখন তো এ রকম দড়াম করে দরজা বন্ধ হয়নি! তা হলে কি বেরোনোর সময় ওরা দরজাটা টেনে বন্ধ করে যাচ্ছে। হতে পারে! না হলে এ রকম আওয়াজ হবে কেন!

কৌশিক সারা ঘর পায়চারি করে করে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখতে লাগল। আর সামনে কোনও জানালা পড়লেই খড়খড়িতে চোখ রেখে দেখতে‌ লাগল বাইরের দৃশ্য।

হঠাৎ দেখে, এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই একটা লোক কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। মাটি কোপাতে কোপাতে কাঁধের‌ গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে। ঘাম মুছতে মুছতে এ দিকে তাকাতেই কৌশিক একেবারে‌ থ’। অবিকল রাজেন্দ্রবাবুর মতো‌ দেখতে একটা লোক। একদম ইয়ং। মনে হয়, রাজেন্দ্রবাবুর ছেলেটেলে হবে। তাই জোরে চিৎকার করে বলল, ও ভাই, এই যে… এই যে… এ দিকে… রাজেন্দ্রবাবুকে একটু বলবেন আমার ঘরে এক জগ খাবার জল দিয়ে যেতে…

সে নীচ থেকেই চিৎকার করে বলল, যাচ্ছি।

না, দু’মিনিটও লাগল না। কৌশিক দেখল, সেই লোকটাই এক জগ জল নিয়ে দরজা ঠেলে তার ঘরে ঢুকছে। তাকে দেখে কৌশিক বলল, রাজেন্দ্রবাবু কোথায়?

লোকটি বলল, আমিই তো রাজেন্দ্র।

কৌশিক একেবারে অবাক। এ কী রে বাবা! এ বাড়ির সবার নামই কি রাজেন্দ্র নাকি? তাই বলল, তার মানে আপনি হলেন মেজো রাজেন্দ্র, তাই তো? আচ্ছা, এখানে যারা থাকে, তাদের সবার নামই কি রাজেন্দ্র? আপনাদের বাবা-মায়েরা বুঝি‌ রাজেন্দ্র ছাড়া আর কোনও নাম খুঁজে পাননি, না?

লোকটা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর সে বেরোতেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।

কৌশিকের মনে হল, জায়গাটা বেশ অদ্ভুত। আর যারা এখানে থাকে, তারাও কোনও অংশে কম অদ্ভুত নয়। অদ্ভুত এই বাড়িটাও। এতগুলো ঘর, সব ক’টা দরজাতেই হ্যাসবোল্ট দেওয়া। কী আছে ওই ঘরগুলোতে? একবার দেখলে‌ হয়!

ও এক-একটা ফ্রেমের সামনে যাচ্ছে আর খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখছে। সব ক’টা ছবিই কেমন যেন! কোনটাও পরিপূর্ণ নয়। অর্ধেক অর্ধেক। আধখ্যাচড়া।

ও যখন ছবি দেখায় মগ্ন, ঠিক তখনই কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল, রাতে কী খাবেন, বলুন। আমি বাজারে যাচ্ছি। নিয়ে আসব।

কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে দ্যাখে, একেও একেবারে রাজেন্দ্রবাবুর‌ মতো দেখতে। তবে এ অত বুড়ো‌ নয়। খুব বেশি হলে প্রৌঢ় বলা যেতে পারে। তাই কৌশিক বলল, আপনি কি রাজেন্দ্রবাবুর ভাই নাকি?

লোকটা বলল, না না, আমিই রাজেন্দ্র। বাজারের দিকে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম… আমি বরং মুরগির মাংস নিয়ে আসি, কেমন?

কৌশিক হতচকিত। না,‌ পাঁঠার মাংস ও ছোঁয় না। ও মাংস খেলে, একমাত্র চিকেনের প্রিপারেশনই খায়। কিন্তু এই লোকটি সে কথা জানল কী করে! আন্দাজে? নাকি যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ লোকই চিকেন পছন্দ করেন বলে!

কৌশিক যখন এ‌ সব ভাবছে, লোকটা ততক্ষণে দরজা ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে সচকিত হল কৌশিক।

পায়চারি করতে করতে ও একটা জানালার খড়খড়ি দিয়ে দেখল, একটু আগে যে লোকটা তার কাছে জানতে এসেছিল, রাতে সে কী খাবে, সেই লোকটা বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে মূল ফটক পেরিয়ে মাটির রাস্তায় উঠে গেল।

কৌশিক আগেই শুনেছিল, এই বাড়িতে যাঁরা আসেন, তাঁদের খাওয়া-থাকার সমস্ত ব্যবস্থা নাকি এই বাড়ির লোকেরাই করে। সেই কোন যুগ‌‌ থেকে এটা চলে আসছে। কিন্তু তাদের অবস্থা পড়ে যাওয়ার পরেও যে সেই রীতি এখনও অক্ষরে অক্ষরে‌ পালন করা হচ্ছে, এটা দেখে একটু তাজ্জব হয়ে গেল কৌশিক।

কৌশিক ভাবল, আচ্ছা, লোকটা তো বাজারে যাচ্ছে। তার সঙ্গে গেলে কেমন হয়! হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু জোরে পা চালালেই লোকটাকে ঠিক ধরে ফেলা যাবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। পার্সটা হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, দেখে দরজাটা বন্ধ। অনেক টানাটানি করল। ধাক্কাধাক্কি করল। কিন্তু না, কিছুতেই খুলল না। তা হলে কি উনি বাইরে থেকে হ্যাসবোল্ট টেনে দিয়ে গেছেন! ভারী অদ্ভুত লোক তো! এ ভাবে কেউ হ্যাসবোল্ট দিয়ে যায়! এলে জিজ্ঞেস করতে হবে তো, উনি এটা কেন করলেন? ঠিক আছে, আগে আসুক তো… বাজারে গেছে মানে নিশ্চয়ই অনেক্ষণ সময় লাগবে। ততক্ষণ আমি কী করব! কী করব! কী করব!

এ দেয়াল, ও দেয়াল, সে দেয়ালে যত ছবি ছিল, সবই তো দেখা হয়ে গেছে!‌ তা হলে কি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখব!

এমন সময় হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ওদিককার পালঙ্কের পায়ায় পর পর হেলান দিয়ে রাখা ফ্রেমগুলোর দিকে। আচ্ছা, ওই ফ্রেমগুলোতেও কি দেয়ালে টাঙানো অর্ধেক-অর্ধেক ছবির মতোই অসমাপ্ত ছবি বাঁধানো? নাকি… দেখি তো…

ফ্রেমগুলোর কাছে গিয়ে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একদম প্রথম ফ্রেমটা হাতে তুলে নিয়ে কৌশিক দেখল, খাওয়ার পরে যে ছেলেটা তাকে পান দিতে এসেছিল, এটা সেই ছেলেটার ছবি। ছবির নীচে বড় বড় অক্ষরে লেখা ক্যাপশন— রাজেন্দ্র শর্মা, বয়স ১২ বছর।

কৌশিক সেটা মেঝেয় নামিয়ে রেখে পরের ছবিটা তুলে নিল। দেখল, যে লোকটা তাকে জলের জগ দিতে এসেছিল, এটা তার ছবি। ছবির নীচে লেখা— রাজেন্দ্র শর্মা, বয়স ৩৪ বছর।

তার পরের ছবিটা তুলে দেখে, যে খানিক আগে এসে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, রাতে কী খাবেন, এটা তার ছবি। নীচে লেখা— রাজেন্দ্র শর্মা, ৫২ বছর।

তার পরের ছবিটা সামনে মেলে‌ ধরতেই কৌশিক দেখল, এ বাড়িতে ঢোকামাত্র যে থুত্থুড়ে বুড়ো লোকটা তাকে বলেছিলেন, বড্ড বেলা করে ফেলেছেন তো… স্নানটান করে এসেছেন কি? না হলে, আগে ওটা সেরে নিন… এটা সেই রাজেন্দ্রবাবুর ছবি। নীচে লেখা— রাজেন্দ্র শর্মা, বয়স ৭৯ বছর।

কৌশিক ভাবল, যে ক’টা রাজেন্দ্রকে সে দেখেছিল, তাদের সব ক’টা‌ ছবিই তো তার দেখা হয়ে গেল। তা হলে এর পরের ফ্রেমগুলোয় কার ছবি!

পরের ফ্রেমটা তুলতেই দেখে, ছবি নয়, তুলি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে বিভিন্ন রঙে লেখা—

‘কিছু দিন আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কুন্নাই পাখির রোম আর যে গাছ এখন আর কোত্থাও দেখা যায় না, সেই কারিনি গাছের বাট দিয়ে আমি একটা তুলি বানিয়েছিলাম। এই তুলি দিয়ে কিছু আঁকলেই কেল্লাফতে। শেষ আঁচড় দেওয়া মাত্রই জীবন্ত হয়ে ওঠে সব।’

তার পর একদম নীচের দিকে লাল রঙের একটা ছোট্ট খুলি চিহ্নের পাশে ছোট্ট ছোট্ট হরপে লেখা— ‘পরের ফ্রেমটা দেখুন।’

কৌশিক নড়েচড়ে বসল। মানেটা কী? পরের ফ্রেমটা তুলে দেখল তাতে লেখা রয়েছে—

‘এখানকার ছবিগুলো দেয়ালে টাঙানো যাবে না। কেউ ভুল করে টাঙালেও, এই ফ্রেমের কাঠ আর এই দেওয়ালের সংমিশ্রণে মিরাকেল ঘটে যাবে।এই ছবিগুলোতে যারা রয়েছে, তাদের বয়স বাড়তে শুরু করবে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চেহারাও বাড়তে বাড়তে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাবে।’

তার পর ওই আগের ফ্রেমটার মতোই এই ফ্রেমটারও নীচের দিকে লেখা রয়েছে— ‘পরের ফ্রেমটা দেখুন।’

এগুলো কি হেঁয়ালি না কী! চটপট পরের ফ্রেমটাও তুলে নিল কৌশিক। তাতে লেখা—

‘আমার এই ছবিগুলোকে ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছি বলেই, আমি ওই-ওই বয়সেই স্থির হয়ে আছি।’

তার নীচে আবার‌ যথারীতি লেখা— ‘পরের ফ্রেমটা দেখুন।’

ঝট করে পরের ফ্রেমটা হাতে নিয়ে কৌশিক‌ দেখল, তাতে লেখা—

‘যে একবার এই বাড়িতে ঢোকে, সে আর কোনও দিনই ‘নিশিযাপন’ থেকে বেরোতে পারে না। আপনার বন্ধুও পারেনি। আপনিও পারবেন না।’

আর‌ একদম নীচে ছোট্ট খুলি চিহ্নের পাশে গুড়ি গুড়ি অক্ষরে লেখা সেই একই কথা। তবে ‘পরের’ জায়গায় এখানে লেখা রয়েছে ‘শেষ’। ও ভুল দেখল না তো! তাই আরও একবার চোখ বোলাল কৌশিক। দেখল, না, সে ভুল দেখিনি। এখানে স্পষ্ট লেখা রয়েছে— ‘শেষ ফ্রেমটা দেখুন।’

— সে তো দেখবই। কিন্তু ওপরে ওটা কী লেখা! আমি নিশিযাপন থেকে বেরোতে পারব না! হুঃ, আমি বেরোতে পারব না! সে রকম হলে দরজা ভেঙে বেরোব। যত্তসব… নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে শেষ ফ্রেমটাও হাতে তুলে নিল কৌশিক। দেখল, একটা থুত্থুড়ে বুড়ো খাটে শুয়ে আছেন।‌ তাঁর পা থেকে গলা অবধি নামাবলি দিয়ে ঢাকা। বুকে গীতা। চোখে তুলসী পাতা। নীচে লেখা— রাজেন্দ্র শর্মা, তিরোধান ১২ জুলাই, ১৯২০।

তার মানে? এটা তো দু’হাজার কুড়ি! আর এখানে তো দেখছি উনিশশো কুড়ি লেখা! তার মানে একশো বছর আগে! লাফ দিয়ে উঠল কৌশিক। এই প্রথম যেন সে একটু ভয় পেল। তাকে এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু সে পালাবে কী করে! দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ। তা হলে! এ কোথায় এলাম আমি! ও ধপাস করে পালঙ্কের উপরে বসে পড়ল।

না, এতক্ষণ টের পায়নি। এই প্রথম ও টের পেল, কেমন যেন একটা পচা-পচা আঁশটে গন্ধ। কোত্থেকে আসছে এটা! এতক্ষণ তো ঘরের মধ্যেই ঘুরছিলাম। কই, কোথাও কিছু চোখে পড়েনি তো! তা হলে কি এই খাটের নীচ থেকে…

ঝপ করে পালঙ্ক থেকে নেমে ঝুলে‌ থাকা বিছানার বাড়তি চাদরটা এক হাত দিয়ে তুলে‌ খাটের তলায় তাকাতেই ও দেখল— একটা লোক টানটান হয়ে শুয়ে আছে।‌ এত‌ দুর্গন্ধ, নাক রাখা যাচ্ছে না। লোকটার গায়ে সাদা সাদা ওগুলো কী কিলবিল করছে! মনে হচ্ছে পোকা ধরে গেছে। কিন্তু কার বডি এটা? কার? তার যে বন্ধুটা তিন ‌দিনের‌ জন্য এখানে বেড়াতে এসেছিল, সেই রতনের কি? হতে পারে! হতে পারে! হতে পারে! ওকে মেরে হয়তো ওর বডিটা এখানে গুম করে রেখেছে। কিন্তু মুখ না দেখলে বুঝব কী করে!

ঝট করে উঠে পকেট থেকে মোবাইলটা বের‌ করল কৌশিক। তার পর মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে লোকটার মুখের উপড়ে আলোটা ফেলতেই আঁতকে উঠল সে। দেখল, লোকটা আর কেউ‌ নয়, সে নিজেই।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ