01 Oct

রুই মাছের কালিয়া

লিখেছেন:সাগর কুমার পাঠক


গল্পের সময় উৎসব সংখ্যা

নিতাই জ্যাঠা সন্ধ্যাবেলা যখন হাঁক পাড়লো “কইগো সব গেলে কোথায়?”, আমরা যত কচিকাঁচার দল ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলাম। তার ঠিক একটু আগেই ঝপ করে লোডশেডিং হয়ে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, যা সেইসময়ের নিত্য ঘটনা ছিল । মা তখন একহাতে মাথার ঘোমটা আরেকহাতে হ্যারিকেন সামলাতে সামলাতে বেরিয়ে এসেছে, পেছন পেছনে আমরা। দেখি নিতাইজ্যাঠা মাথায় বিরাট ছাতা আর হাতে একটা প্রমাণ সাইজের রুইমাছ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। মাছটার কানকোর দুপাশ থেকে একটা দড়ি ফাঁসের মত  জ্যাঠার বাম হাতে ঝুলছে, অন্য হাতে একটা বিরাট ছাতা। হলুদ হ্যারিকেনের আলোয় মাছের গা টা চকচক করছে। “এসব আবার কেন? ” মায়ের কথা শেষ হতে না দিয়ে জ্যাঠার হুঙ্কার “তুমি থামো তো বৌমা! আসছিলাম, দেখি এক ব্যাটা এই মাছটা ছিপ দিয়ে ধরে বিক্রির জন্য বসে আছে। কি মনে হল কিনে নিলাম , জমিয়ে রাঁধো তো আজ, রুই মাছের কালিয়া। বহুদিন খাইনি। তা আমার বানর সেনা কই গেল? সব ভদ্দরলোক হয়ে গেল নাকি? কোনো সাড়া শব্দ পাচ্ছি না। ” “এই তো আমরা”, বুড়ি মানে আমার জ্যাঠার মেয়ে, আমাদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট আর পাকা, রিনরিনে গলায় উত্তর দিলো। এমন সময় বাবা বেরিয়ে এলেন, ধমক দিয়ে বললেন “আরে মানুষটাকে ভেতরে ঢুকতে দিবি তো নাকি? বলতেই আমরা সরে দাঁড়ালাম, নিতাইজ্যাঠাও বৈঠকখানায় ঢুকে পড়লেন। জেঠিমা মাছ নিয়ে ভেতরে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে জ্যাঠা বৈঠকখানায় যখন বসলেন আমরা চারজন ছেলেমেয়ে ততক্ষণে বইপত্র গুটিয়ে মাদুর পেতে জ্যাঠার মুখে গল্প শুনবো বলে রেডি। নিতাই জ্যাঠা বাবার নিজের দাদা নন। বাবার কিরকম দূরসম্পর্কের মাসতুতো দাদা হন। অকৃতদার মানুষ, সারাজীবন কোনো নির্দিষ্ট চাকরি করেননি। প্রায় সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেরিয়েছেন, কিন্তু কোনো জায়গাতেই থিতু হয়ে থাকেননি। আজ এই যে এলেন হয়তো দুদিন বাদেই অন্য জায়গায় চলে যাবেন। ওনার সঙ্গে সবসময়ই একটা ছোট ঝোলা থাকে, তাতে দরকারি কিছু জিনিসপত্র আর দুএকটা জামাকাপড় আর একটা খাতা ছাড়া কিছুই থাকেনা। এই খাতায় ওনার পরিচিত সব আত্মীয়দের নাম ঠিকানা আর বংশলতিকা লেখা আছে। আমার বাবা একদিন সেখান থেকে আমাদের আটপুরুষের নাম জেনে লিখে রেখেছেন। আমার নিজের জ্যাঠা বাইরে চাকরি করেন, তাই এই পরিবারে আমার গুরু গম্ভীর বাবার কথাই শেষ কথা, এমনকি আমার নিজের জ্যাঠাও বাবাকে বিশেষ ঘাঁটাননা। তবে নিতাইজ্যাঠা আমাদের এখানে আসলে কেসটা পুরো উল্টে যায়। তখন বাবাও কেমন মিইয়ে যায়। আর আমাদের মানে নিতাইজ্যাঠার বানরসেনাদের কাছে পুরো বাড়িটা তখন অভয়ারণ্য! জ্যাঠার ছেলে বুড়ো ক্লাস নাইনে পড়ে, আমি টোটন ক্লাস সেভেন, আমার ভাই ছোটন থ্রি আর জ্যাঠার মেয়ে বুড়ি পাঁচবছর, এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি, তবে হাবভাব যেন কলেজে পড়ে।

ইতিমধ্যেই মা জ্যাঠাকে এককাপ চা দিয়ে বলে গেছে যে রান্নাঘরে তেলেভাজা বানানো হচ্ছে, মুড়ি দিয়ে খাওয়া হবে। তখন আরেকবার চা দেবে। জ্যাঠা চা নিয়ে ডিসে ঢেলে সশব্দে চুমুক দিলেন, তারপর  বললেন “ফাসটোকেলাস!” আমরা বুঝলাম জ্যাঠা আজ খোশমেজাজে আছে। এতক্ষণ বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিলো এবার ঝমঝমিয়ে নামলো। জানলা দিয়ে আসা  দমকা হাওয়ায় হ্যারিকেনটা দপদপ করছিলো, মা ছুটে এসে জানলা বন্ধ করে দিলো। আমরা জানি আজ আর আমাদের পড়তে বসতে হবেনা। এরপর জ্যাঠা আমাদের খবরাখবর নিতে লাগলেন। তার একটাই প্রশ্ন সবার কাছে, গত ছমাসে কে নতুন কি করেছে। আমি আর ভাই নতুন সাইকেল শেখার কথা বললাম, যদিও আমি ফুলপ্যাটেল শিখলেও ভাই উচ্চতা জনিত টেকনিক্যাল  কারণে হাফ প্যাটেলের আটকে আছে, তবু আমি বিশেষ প্রতিবাদ করলাম না। বুড়ি তার নতুন রান্নাবাটির রান্না করা থেকে পুতুলের জামা বানানোর লম্বা ফর্দ হাজির করলো। জ্যাঠা সব শুনছিলেন আর মিটিমিটি হাসছিলেন। খালি বুড়োদা যুতসই কিছু বলার মত খুঁজে পাচ্ছিলো না। এমন সময় জেঠিমা মুড়ি আর গরমাগরম তেলেভাজা নিয়ে হাজির। বেগুনি, পেঁয়াজি আর আলুরবড়া। আমাদের একটা থালায় সব তেলেভাজা  আর জ্যাঠার আলাদা বাটিতে। আর দুই জায়গায় মুড়ি। একটা বড় বাটিতে  জ্যাঠার জন্য আর গামলায় আমাদের জন্য।

জ্যাঠা একটা বেগুনী কামড়ে একমুঠো মুড়ি চিবোতে চিবোতে চোখটা বন্ধ করে আবারও বললেন “ফাসটোকেলাস “জেঠিমা ” আরও তেলেভাজা আনছি” বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আমরাও ততক্ষণে হাত চালাতে শুরু করে দিয়েছি, বুড়োদা বাদে। হঠাৎ বুড়োদা “আমি ছিপ দিয়ে মাছ ধরেছি “বলে চিৎকার করে উঠলো এমনভাবে যেন ও এভারেস্ট চূড়ায় তেনজিং নোরগের সাথে উঠেছে।“ জ্যাঠা প্রশ্ন করেন “কত বড় মাছ?” বুড়োদা সততার সাথে যে সাইজটা দেখালো তার মাপ চার পাঁচ ইঞ্চির বেশি হবেনা। আসলে নিতাইজ্যাঠার কাছে আমরা কেউ মিথ্যা বড়াই করার কথা ভাবতেও পারতাম না।

“হুম! টোপ কি ছিলো? “জ্যাঠার প্রশ্ন।

“কেঁচো আর আটার গুলি ” বুড়োদার উত্তর শুনে জ্যাঠা মুচকি হাসলেন। জ্যাঠা আবারও ডিশে চা ঢেলে শোঁ শোঁ শব্দে খেতে লাগলেন। আমরাও সবাই হাত আর মুখ চালাচ্ছিলাম। গরম গরম তেলেভাজা আর মুড়ি তখন অমৃত মনে হচ্ছিল। হঠাৎই বুড়ি বেমক্কা প্রশ্ন করলো “আচ্ছা জ্যাঠা তুমি কোনোদিন মাছ ধরেছো?”

“আমি? বলে জ্যাঠা হঠাৎ উদাস হয়ে গেলেন। তারপর বিষন্ন গলায় বললেন, একসময় আমি অনেক মাছ ধরেছি। তারপর বুড়োকর্তার বয়সে এসে একটা ঘটনার পর আর মাছ ধরিনা। বুড়োদাকে উনি মাঝে মাঝে বুড়োকর্তা বলেন, আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বলে। আমি বললাম “কোন ঘটনা জ্যাঠা? বলোনা”

“বলবো, তবে তোরা ভয় পাবি না তো?”

না না, ভয় পাবো কেন? ছোটন বেশ বীরদর্পে কথাটা বললেও বুড়ি আমার গা ঘেঁষে বসলো।

“শোন তাহলে বলি, আমি তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি, এই বুড়োকর্তার বয়েসী বা তার চেয়ে একটু ছোটই হবে। তখন আমার খুব মাছ ধরার নেশা ছিলো। অনেক কষ্ট করে পয়সা জমিয়ে দামী হুইল, ছিপ আর সুতো কিনেছিলাম। আমার এক বন্ধু ছিলো, বিশু, আমার সবচেয়ে ক্লোজ, ওই তোরা যাকে বেস্টফ্রেন্ড বলিস, ওই আর কি! বিশু আমার পাশের গ্রামে থাকতো। ওই আমায় মাছ ধরা শিখিয়েছিল । তা বিশু একদিন খবর দিলো ওদের গ্রামে নাকি টিকিট কেটে মাছ ধরার কম্পিটিশন হচ্ছে, পাঁচটাকা টিকিট। তখন পাঁচটাকার অনেকদাম, পাঁচপয়সাই কেউ দেয়না তো পাঁচটাকা। ওর কাকা নাকি টিকিট কিনেছে। আমাদের তো খুব মনখারাপ। ইস যদি একটা টিকিট যদি পেতাম! শনিবার বিকেলটা মনখারাপ নিয়েই কাটলো। রবিবার মাছধরার কম্পিটিশন। রবিবার ভোরবেলা বিশু আমার বাড়ি এসে হাজির, ওর কাকার নাকি শনিবার রাত থেকে খুব জ্বর, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। তাই কাকা টিকিটটা আমাদের দিয়ে দিয়েছে। আমরা তো লাফাতে লাফাতে বাসি রুটি আর গুড় টিফিন কৌটোয় বেঁধে, আমার বাবার সাইকেলটা কাকুতি মিনতি করে চেয়ে নিয়ে কম্পিটিশনের জায়গায় হাজির। প্রথমে তো ঢুকতেই দিতে চাইছিলো না, শেষে কড়কড়ে পাঁচটাকার টিকিট দেখিয়ে ঢোকার অনুমতি পেলাম। দেখি ইতিমধ্যেই বেশ কিছু লোক তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির। বিরাট বড় পুকুর, প্রায় ছোটখাটো দিঘীও বলা যেতে পারে। সেখানে পাড় ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় দশ বারোজন লোক হাজির। আমরাই সেখানে বয়সে সবচেয়ে ছোট। আমরাও গম্ভীর মুখে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বটগাছের তলায় পুকুর পাড়ের একটা ছায়ায় বসলাম। যেহেতু আগে থেকে কিছু জানা ছিলোনা তাই মাছের চারও কিছু রেডি করিনি, খালি কিছু আটার গুলি আর কেঁচো নিয়ে চলে এসেছি। সেগুলোই টোপে গেঁথে ছিপ ফেললাম “।

“চার কী জ্যাঠা?” বুড়ি প্রশ্ন করলো।

মাছ ধরার আগে জলে কিছু ভালো ভালো খাবার ফেলে মাছেদের কাছে ডাকতে হয়। একে বলে চার ” বলে জ্যাঠা মিষ্টি করে হাসলেন। এমন সময় মা আরেককাপ চা এনে হাজির করলেন। সঙ্গে ধমক দিলেন, কিরে তোরা জ্যাঠাকে একটু বিশ্রাম করতে দিবিনা নাকি?

বুড়ি এবার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো “আমরা এখন চারের গল্প শুনছি!”

ছোটন সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞর মত উত্তর দিলো “চার নয় মা, মাছ ধরার গল্প শুনছি, তাই না রে দাদা “। মা তখন একটা প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ঘর থেকে বিদায় নিলেন।

“তারপর কী হলো জ্যাঠা?” বুড়োদা জিজ্ঞাসা করলো।

“তারপর আর কী? অনেকক্ষণ কেটে গেল ফাৎনায় কোনো টান পড়লো না। শুধু আমরা নয়, সবাই দেখি বসে আছে, কারোরই ছিপে কিছু ধরা পড়ছে না। এরপর বেলা বাড়লো, ইতিমধ্যে  খিদে পেয়ে গেছে।সকালে বিশেষ কিছু খেয়ে আসিনি। বিশুর প্রস্তাব মত ছিপ রেখে রুটি গুড় খেয়ে নিলাম। ও একজনের কাছ থেকে গ্লাসে করে জল নিয়ে এল। ভদ্রলোক কলকাতা থেকে গাড়ি করে এখানে মাছ ধরতে এসেছেন। সঙ্গে বেতের ঝুড়িতে অনেক খাবার, ফ্লাস্কে চা আর বোতলে জল এনেছেন। আমাদেরও উনি খাবার দিতে চাইলেন, আমরা রাজী হলাম না, শেষে কমলালেবু দিলেন দুটো, নিলাম। তখন সবে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে, আমাদের বাজারে তখনও কমলালেবু ঢোকেনি। যাইহোক খাওয়া দাওয়া সেরে আবারও ছিপ নিয়ে বসলাম, এভাবে অনেকটা সময়  কেটে গেল। চারদিকের আলো বেশ কিছুটা কমে গেছে। ভদ্রলোক দেখি সব গোটাতে শুরু করেছেন। আমরা ছিপ ফেলে এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে, বিশু জিজ্ঞাসা করলো, ” কি, আর মাছ ধরবেন না? ”

“ধুর! এখানেও সেই একই চিটিংবাজী কারবার, এখানে কারো মাছ উঠবে না।”

“কেন?” দুজনেই একসাথে প্রশ্ন করলাম।

“ওসব আমার জানা আছে, তোমরা বুঝবে না”

“কেন? কি হয়েছে কাকু? শুনেছি এই পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ আছে, রুই, কাতলা, মৃগেল…” বিশু বললো।

“আরে এরা আগের রাতেই মাছেদের প্রচুর খাবার দিয়ে দিয়েছে, সেই সব খেয়ে মাছেদের পেট ভর্তি, আর টোপ গেলে?” বলে গজগজ করে ভদ্রলোক হুইলের সুতোর চাকা ঘোরাতে লাগলেন। এরপর সব গুটিয়ে ভদ্রলোক গজগজ করতে করতে চলে গেলে। একটু বাদে দেখি প্রায় সব লোকই তাদের জিনিসপত্র গুটিয়ে চলে যাচ্ছে। একটু বাদেই বেরোবার মুখে একটা ঝামেলা শুরু হলো। পুকুর মালিক আর তার লোকজনের সাথে যারা টিকিট কেটে মাছ ধরতে এসেছে তাদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে গেলো। বিশু বললো “দাঁড়া এখন বেরোবো না, ঝামেলা কাটুক তারপর বেরোবো, সেই ফাঁকে চল আরেকবার চেষ্টা করি। কেউ নেই শুধু আমরা আছি, এই সুযোগে যদি মাছ টোপ গেলে। ” কথাটা আমার পছন্দ হলো। আমি আবারও নতুন টোপ গেঁথে পুকুরে যত দূরে সম্ভব ফেলা যায়, ছিপ ফেললাম। একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে এল। একটা কুয়াশার স্তর পুকুরের জলের ওপর ভাসছে, ওপারটা দেখাই যাচ্ছে না প্রায়। এমন সময় দেখে কালো চাদরে মুখ ঢাকা একটা লোক আমাদের পাশে হাজির! আমরা প্রথমে চমকে উঠে ভয় পেলেও দেখি লোকটা শালপাতায় মোড়া একটা ঠোঙা আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। শালপাতার মোড়কটা খুলতেই সুন্দর একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল আমাদের নাকে। বিশু বললো “মহুয়া আর পিঁপড়ের ডিমের টোপ। আরো অনেক কিছু আছে কিন্তু সেগুলো চিনতে পারছিনা। এই দুটো চিনি কারণ কাকা অনেক দাম দিয়ে এগুলো কিনে আনে।“ তাড়াতাড়ি টোপ গেঁথে পুকুরে ফেললাম। প্রায় অন্ধকারে নিশাচরের মত ফাতনার দিকে তাকিয়ে রইলাম দুজনে!হঠাৎ শিবু চেঁচিয়ে উঠলো, “ফাতনা ঢুবেছে, নিতাই সুতো ছাড়”, আমি ওর কথা মতো সুতো ছাড়তে লাগলাম। এরপর শিবু আমার হাত থেকে ছিপটা নিয়ে নিলো। মাছ ধরায় ওই আমার গুরু, তাই আমি আর আপত্তি করলাম না। এরপর শিবু মাছটাকে খেলাতে লাগলো, কখনো সুতো ছাড়ে কখনো হুইল গোটায়। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন চললো, এদিকে চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আমার তখন শীত শীত করছে, বিশু দেখছি ঘামছে। অনেক কসরত করে বিশু মাছটাকে ডাঙায় তুললো। প্রায় তিনসের মানে আজকালকার তিন কেজির রুই  , গায়ে শ্যাওলা ধরে গেছে। বিশু বললো পাকা রুই। এরপর ছটপট করতে থাকা মাছটাকে থলেয় ভরে ফেললো ও কায়দা করে। আমায় সব গুটিয়ে নিতে ইশারা করলো। সব গুটিয়ে দুজনে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম কেউ নেই। ওই ঝামেলার মধ্যে আমাদের কথা সবাই ভুলেই গেছিলো বোধহয়। চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটাকেও আর দেখতে পেলাম না আশেপাশে। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে সাইকেলের পেছনে বিশুকে বসিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলাম। বিশুর বাড়ির সামনে এসে বিশুকে নামিয়ে দিলাম। ও বললো “ভাই, মাছটা তুই বাড়ি নিয়ে যা ” আমি আপত্তি করলাম, কিন্তু ও শুনলো না। বললো “কাল স্কুল থেকে ফিরে তোর বাড়িতে তোর মায়ের হাতে রুই মাছের কালিয়া খাবো। আমার তো মা নেই, এত রাতে আমি এই মাছ নিয়ে কি করবো, পারলে তোর মা কে বলিস মাছ ভাজা কয়েকপিস আমায় দিয়ে দিতে। বাবাকে দেবো “। মা মরা ছেলেটার কথায় আমি আর আপত্তি করলাম না। ওর মা কয়েকবছর হল মারা গেছে, ওর বাবা খুব রাগী আর কিপটে।  প্রায়ই আমার মা ওকে আমার সাথে বসিয়ে খাওয়ায়। আমি আর কিছু না বলে সাইকেল স্টার্ট দিলাম।“ বলে জ্যাঠা একটু থামলেন। এমন সময় জ্যেঠিমা সেকেন্ড রাউন্ড তেলেভাজা নিয়ে ঢুকলেন, “বললেন খেতে আজ একটু দেরি হবে, তাই আরেকটু তেলেভাজা দিয়ে এলাম”, বলে একটা বড় থালায় গরম তেলেভাজা নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ছোটন একটা গরম আলুর বড়ায় কামড় দিয়ে মুখ থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফেলে দিলো।

“উফ কি গরম! মুখ পুড়ে গেল!” আমরা ওর দুর্দশা দেখে হেসে ফেললাম। বুড়ি বললো, “তারপর জেঠু তোমরা খেলে সেই রুই মাছ?”

“সে আর হলো কই?” জেঠু হতাশ গলায় উত্তর দিলো।

আমি প্রশ্ন করলাম, “কেন, সেই মাছ তুমি খাওনি?”

জেঠু সাবধানে একটা আলুর বড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, “এইবার তো সেই আসল গল্প!” তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন, এরপর যেন কোন সুদূর অতীতে চলে গিয়ে বললেন, “আমি বিশুকে নামিয়ে দিয়ে জোরে সাইকেল চালাচ্ছি। তখন রাস্তায় আলো বিশেষ ছিলোনা, তারওপরে গ্রামের রাস্তা। সেদিন কুয়াশাও পড়েছিল অনেক। ফাঁকা রাস্তা, লোকজন বিশেষ নেই গ্রামে। এই সময় অধিকাংশ লোকজনই ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। রাস্তার দুপাশে প্রচুর গাছপালা, তাই অন্ধকারটাও বেশ ঘন। ঝোপঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে মিটমিট করে।  এমন সময় দেখি রাস্তায় একটা লোক হঠাৎই আমার সাইকেলের সামনে চলে এসেছে। আচমকা ব্রেক কষে আমি সাইকেল সমেত হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কোনো রকমে টাল সামলে সোজা হয়ে দেখি সেই লোকটা! সর্বাঙ্গে কালো চাদর মুড়ি দেওয়া। লোকটা হঠাৎ চাদর থেকে তার হাতটা বার করে হাত পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভঙ্গীটা এমন যেন কিছু চাইছে! আমি থলে থেকে শালপাতায় মোড়া বাকি টোপটা ওর হাতে দিলাম। আমার একটু খানিই লেগেছিলো। বাকিটা রয়ে গিয়েছিল। লোকটার হাতে শালপাতার মোড়কটা দিতেই সে হাতের তালুটা কাত করে মোড়কটা ফেলে দিলো। বুঝলাম ও অন্য কিছু চায়। আমার প্যান্টের পকেটে একটা সিকি আর একটা কাঁচা টাকা ছিলো। পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি লাটাই কিনবো বলে অনেক কষ্টে জমিয়ে ছিলাম। প্রথমে সিকিটা দিলাম ওর হাতে, ও ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটা। বুঝলাম ওর পছন্দ হয় নি। এরপর অনিচ্ছা সত্বেও এক টাকার কয়েনটা ওর দিকে বাড়িয়ে  দিলাম। ও কিছু না বলে আমার মাছের থলির দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করলো! তার মানে ও মাছটা চায়। সে কি করে হয়, আমার ধরা প্রথম এতবড় মাছ আমি ওকে কিছুতেই দেবো না। চট করে কয়েনটা পকেটে ঢুকিয়ে লোকটাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সাইকেলে লাফিয়ে উঠলাম। প্রাণপণে প্যাডেলে চাপ দিলাম। সাইকেলে জোর প্যাডেল করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, রাস্তার মাঝখানে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। এই অন্ধকারেও ওর জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি আমি লক্ষ্য করলাম। আমার মেরুদন্ড দিয়ে তখন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাতাস রীতিমতো ঠান্ডা হলেও আমি দরদর করে ঘামছি, জোরে প্যাডেল করলাম কিছুক্ষণ। পথ যেন শেষই হচ্ছে না। সাইকেলটা যেন ভারী হয়ে গেছে, হঠাৎ টের পেলাম আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারে কে যেন বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস হচ্ছে না অথচ বেশ বুঝতে পারছি ক্যারিয়ারে কেউ বসে আছে। তার গায়ে যে একটা চাদর আছে সেটাও টের পাচ্ছি। এদিকে ভয়ে সাইকেল থামাতেও পারছি না! এমন সময় মাথায় একটা বুদ্ধি এল।”

“কি বুদ্ধি?” আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম।

“আমি বামহাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে অন্য হাতটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে মাছটা বার করে পেছন দিকে ছুঁড়ে দিলাম। পরিস্কার টের পেলাম সাইকেলের পেছনে বসে থাকা লোকটার ওজন হালকা হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম সাইকেলের ক্যারিয়ারে আর কেউ বসে নেই। কোনো রকমে বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সেই রাতে আমার ধূম জ্বর এলো। তিনদিন জ্বরের ঘোরে ছিলাম। চারদিনের দিন একটু সুস্থ হলাম। সেদিন বিকেলে বিছানায় শুয়ে আছি, বিশু এলো। সব বললাম। বিশু কিছু বললো না, মা কটা নারকেল নাড়ু দিলো, সেগুলো  না খেয়ে পকেটে ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। পরদিন সকালে আবার এসে হাজির। আমার ঘরে সোজা ঢুকে ছিটকিনি তুলে আমার বিছানায় বসলো, তারপর ফিসফিস করে বললো “তুই মেছুয়া ভুতের পাল্লায় পড়েছিলি। ওর নাম মেছো জগা, আমাদের গ্রামেই থাকতো, মাছ ধরার পাকা শিকারী বলতে পারিস। এমন টোপ বানাতো, মাছ না গিলে পারতো না। ও বছর দুয়েক হলো মারা গেছে। এই পুকুরে বরাবর চ্যাম্পিয়ন হতো মাছ ধরার কম্পিটিশনে”। মরে গিয়েও ও সেই নেশা ছাড়তে পারেনি। সবাই বলে মেছো জগা নাকি মরে গিয়ে মেছো ভুত হয়ে গেছে। এই পুকুরে গত দুবছর থেকে আর কারোর ছিপে মাছ ওঠেনা। গতবছর একজন আমাদের মতই একটা বড় রুই মাছ পেয়েছিল সন্ধ্যাবেলা, কিন্তু সে সেই মাছ নিয়ে বাড়ি যেতে পারেনি। রাস্তায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। সবচেয়ে অবাক কথা লোকটা মারা যাওয়ার পর মাছটাও তার কাছে পাওয়া যায়নি। ভাগ্যিস তুই মাছটা ফেলে দিয়েছিলি না হলে ….. বলে চুপ করে যায় বিশু। ভয়ে আমার দেহ কাঠ হয়ে যায়। এমন সময় মা দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। বিশু গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দেখি মা লুচি তরকারি নিয়ে হাজির।“বলে নিতাই জ্যাঠা চুপ করলেন। এমন সময় বুড়োদা হঠাৎ বলে ওঠে ‘ আমি হলে কিছুতেই মাছটা দিতাম না। মরে গেলেও না”। জ্যাঠার মুখটা কথাটা শুনে কালো হয়ে যায়, কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। বুড়ি তখন বলে ওঠে, “তুই বেশি বড় বড় কথা বলিস না, বদ্দা। সেদিন তো রাতে বাথরুম যাওয়ার সময় আমায় দরজার কাছে দাঁড়াতে বললি, এমন সাহসী তুই”। কথাটা শুনে বুড়োদা ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।  এমন সময় হঠাৎ সারাঘর আলোয় ভরে গেল, কারেন্ট চলে এসেছে। জেঠিমা ঘরে ঢুকে ঘোষণা করলেন, রান্না প্রায় শেষের দিকে। তারপর বললেন, “দাদা আপনার কথা মত রুই মাছের কালিয়া করেছি, আপনি খাবেন চলুন। সবাইকে একসাথে খেতে দেব। খেয়ে আপনি বিশ্রাম নিন।“ এরপর রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম। আমাদের বৈঠকখানাতেই জ্যাঠা শুলেন। অতিথি আসলে ওই ঘরেই তাকে শুতে দেওয়া হয়। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়ের দাপট আর তারসাথে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরাও এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

একটু বাদে হঠাৎ বাইরের দরজায় ধাক্কার আওয়াজে বাড়ির সবাই জেগে উঠল। বাবা পাড়ার চেনা লোকের গলার আওয়াজে দরজা খুললেন। আমরা দেখলাম খাকি পোশাক পরা দুজন পুলিশ আর পাড়ার কিছু লোক দরজায় দাঁড়িয়ে। পাশের বাড়ির হারাধনকাকু বাবার কাছে এসে চাপা গলায় কি যেন বলল, বাবা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন, তারপর বললেন “বুড়ো, নিতাইদাকে একটু ডাকতো?” আমি আর বুড়োদা জ্যাঠার ঘরের দিকে ছুটলাম। গিয়ে দেখি দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কেউ নেই। কেউ যে এই ঘরে ছিল তার কোন চিহ্নই নেই। এসে বাবাকে সেকথা জানাতে বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর একটা ছাতা নিয়ে পুলিশ আর পাড়ার লোকজনদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। মা জেঠিমাদের কোন প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। বাবা বেরিয়ে যাবার পর আমি আর বুড়োদা আরেকটা ছাতা নিয়ে বাবাদের দলটার পেছু নিলাম। বলতে গেলে কি আমার মা আর জেঠিমাই পাঠালেন আমাদের। আমাদের যে ভয় করছিল না তা নয়, তবে তার থেকে কৌতূহল ছিল বেশি। গ্রামের এই রাস্তাটা কিছুটা যাবার পর দুভাগ হয়ে গেছে। একদিকটা বাসস্ট্যান্ডের দিকে আরেকটা দিক অন্য গ্রামে যাওয়ার রাস্তা। বাসস্ট্যান্ডের দিকের রাস্তার ধারে একটা বড় বট গাছ আছে। সবাই সেখানে দাঁড়িয়েই বাসের জন্য অপেক্ষা করে। সেখান থেকে একটু এগিয়ে একটা জায়গার দিকে এক জন পুলিশ অফিসার দিক নির্দেশ করলেন। সবাই সেখানে গিয়ে হাজির হল। আমরাও তাদের পেছন পেছন পা চালিয়ে সেখানে হাজির হলাম। দেখি নিতাইজ্যাঠা রাস্তায় পড়ে আছে, ওনার চোখ দুটো ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, যেন কোনও কিছু দেখে খুব ভয় পেয়েছেন। বামদিকের হাতটা বুকের কাছে জড়ো করা। হাতের থেকে একটা দড়ি বেরিয়ে আছে ,দড়ির নিচে একটা রুইমাছের মাথা। মাছটার বাকি অংশটা নেই, কে যেন  ছিঁড়ে নিয়েছে বাকি অংশটা। বোঝাই যাচ্ছে উনি এই মাছটা নেওয়ার সময় প্রবল বাধা দিয়েছিলেন।  পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক বললেন লোডশেডিং এর পর আজ সন্ধ্যা থেকেই এই রাস্তায় বিশেষ কেউ আসেনি। কিছুক্ষন আগে একজন এই রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে ওনাকে পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দেয়। আমরা এসে খোঁজ খবর শুরু করি। প্রথমে কেউই ওনাকে চিনতে পারছিল না , শেষে আপনার পাশের বাড়ির হারাধনবাবু ওনাকে চিনতে পারেন আপনাদের আত্মীয় বলে। উনি নাকি মাঝে মাঝে আপনাদের বাড়িতে আসেন। এরপর আমরা গ্রামের লোকদের নিয়ে আপনার বাড়িতে যাই। বাকি সব ঘটনা তো আপনি জানেন। এমন সময় আমাদের দেখতে পেয়ে বাবা আমাদের ধমকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আমরা পাড়ার একজনকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে আসি। আসতে আসতে ভাবতে থাকি, নিতাইজ্যাঠা যদি সন্ধ্যেবেলায় মারা গিয়ে থাকে তবে আমাদের বাড়ি কে এসেছিল ?

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • Subhrendu Gangopadhyay on October 2, 2023

    বেশ সুস্বাদু ও ভয়বহুল হয়েছে তোর রান্না করা রুই মাছের কালিয়া….বহুৎ খুব। লাগে রহো…

    মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ