01 Oct

সরলাবালা হোম ডেলিভারি

লিখেছেন:সিদ্ধার্থ সান্যাল


গল্পের সময় উৎসব সংখ্যা

নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড বোধহয় এসে গেছে ।

লোক্যাল বাসের কন্ডাক্টর আর ক্লিনারদের শোরগোল আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে প্যাসেঞ্জার জোগাড় করার আওয়াজ হিরণ্ময় গাড়ির ভেতর থেকেই শুনতে পেলেন ।

এখানে ভলভো বাসের স্ট্যান্ডটা চালু লোকাল বাসের লেনগুলো ছাড়িয়ে সামান্য দূরে, বড়ো শেডটার শেষ প্রান্তে ।

যেন নীচুজাতের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে আলগা, দূরে দূরে থাকা !

ইউনিভারসিটির ড্রাইভার ছেলেটা লোকজন আর হকারের ভিড়ের মাঝখান দিয়ে সাবধানে গাড়িটা প্রায় শূন্যগতিতে চালিয়ে ভলভো স্ট্যান্ডের ফাঁকা লেনের মধ্যে ঢুকিয়ে দাঁড় করালো।

তারপর বেশ তৎপরতার সঙ্গে ড্রাইভার সীট থেকে নেমে বাইরে এসে হিরণ্ময়ের দিকের দরজাটা খুলে ধরে বললো, এসে গেছি, নেমে আসুন স্যার ।

পাশে রাখা মাঝারি সাইজের ডাফল ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধুতি সামলে নেমে এলেন হিরণ্ময়।

এই একটা ব্যাপার !

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের সম্মানীয় বক্তা, তাই হিরণ্ময়ের পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি !

কাল দুপুরের কথা মনে পড়ে যেতেই হিরণ্ময়ের ঠোঁটের কোণে হাসির ভাব এলো ।

আলমারি থেকে ভালো একজোড়া সার্ট প্যান্ট বার করে ব্যাগের ভেতরে রাখতে যাবেন, দেখতে পেয়ে নন্দিতা প্রায় চোখ কপালে তুলে ফেলেছিল, এই সার্টপ্যান্ট পড়ে তুমি ইউনিভারসিটিতে সমাবর্তন ভাষণ দেবে !

হিরণ্ময় মৃদু প্রতিবাদ করতে যাবেন, নন্দিতা ঝট করে পোশাকদুটো আবার আলমারিতে তুলে রেখে একটা সুন্দর সুতোর ডিজাইন করা হালকা বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি আর একটা মাড় দিয়ে ইস্ত্রিকরা কোরা রঙের ধাক্কাপাড় ধুতি বার করে দিয়ে বললো, তোমাকে নিয়ে পারা যায় না, সব কিছুর একটা নিয়ম আছে তো । নাও, এগুলো এবার সাবধানে ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও, ভাঁজ নষ্ট কোর না যেন।

হিরণ্ময় মৃদু হেসে স্ত্রীর নির্দেশ পালন করতে করতে মুখটা তুলে বললেন, তোমরা যখন ভাষণ শুনতে যাও তখন বক্তার পোশাক দ্যাখো, না কী তাঁর বক্তব্য শোন ?

নন্দিতা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, মেয়েরা তো দুটোই করে মশাই। উপন্যাসে এতো চরিত্র তৈরি করো, এটা বোঝো না তা তো নয়। তাছাড়া ধুতি পাঞ্জাবি আর তোমার ওই কালো মোটা ফ্রেমের চশমাতে তোমাকে বেশ রাশভারি দেখায়, বেশ সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাব হয় ! তা না, তোমার কেবল কুঁড়েমি। ওই যে, আলমারি থেকে খুঁজে বার করতে হবে !

#

ড্রাইভার কখন ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে হিরণ্ময় খেয়াল করেননি।

তার স্যার ডাকে হিরণ্ময়ের ভাবনার সুতোটা কেটে গেলো ।

সামনের ঝকঝকে গ্রানাইট পাথর-লাগানো বেঞ্চের ওপর ব্যাগটা রেখে ছেলেটা বললো, আপনি বসুন স্যার, আমি টিকিটটা নিয়ে এক্ষুনি আসছি। বোলপুর তো স্যার ? সামনের দিকে সিট থাকলে নিয়ে নেবো ?

হিরণ্ময় মনে মনে একটু খুশী হয়ে ভাবলেন, ড্রাইভারকে তো দেখছি পুরো ব্রিফ করা আছে।

তিনি হ্যাঁ বলতেই তাড়াতাড়ি সে টিকিটঘরের দিকে চলে গেলো ।

হিরণ্ময় অবশ্য বোলপুরের দু কিলোমিটার আগেই নামবেন। বাসে গেলে ওটাই সুবিধে, বাসস্ট্যান্ড থেকে ওঁর বাড়ি দুমিনিটের হাঁটাপথ।

বেঞ্চে বসার আগে হিরণ্ময় চারদিকটা দেখলেন।

বছর দেড়েক আগে বাসেই এসেছিলেন দুদিনের জন্য, রাজ কলেজে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হয়ে।

এখন বাসস্ট্যান্ডটা আগের থেকে বেশ ছিমছাম হয়েছে, ঝকঝকে রঙ করা ছাউনি, প্যাসেঞ্জারদের জন্য গ্রানাইট পাথর-ছাওয়া বেঞ্চ, লোহার ব্র্যাকেটে ঝোলানো বিভিন্ন গন্তব্যস্থানের দূরত্ব লেখা বিলবোর্ড।

পাশেই একটা স্টেট ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ, সঙ্গে এটিএম-এর গুমটি ।

একটু দূরে লোহার খাঁচার মধ্যে বিশাল একটা ওয়াটার কুলার, তার সঙ্গে একটা স্টেনলেস স্টিলের গ্লাস, চেন দিয়ে আটকানো।

হিরণ্ময় বেঞ্চে বসতে না বসতেই টিকিট নিয়ে ড্রাইভার ফিরে এলো।

টিকিটটা তাঁর হাতে দিয়ে বললো, বাস আসতে আধঘণ্টার মতো দেরি আছে স্যার। দেখুন দিকি, আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। আগে জানলে মিনিট পনেরো পরে বেরুতে পারতাম।

হিরণ্ময় পাঞ্জাবির হাতাটা সরিয়ে হাতঘড়িতে  দেখলেন, প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে।

এও নন্দিতার এক নাছোড় ব্যবস্থা ! হিরণ্ময় হাতঘড়ি বিশেষ পরতে চান না। মোবাইলে সময় দেখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি।

দামি র‍্যাডো ঘড়িটা আমেরিকা-প্রবাসী ছেলে সৈকত বাবাকে দিয়ে গেছে বছর তিনেক আগে।

সেই থেকে হিরণ্ময়ের কোন অনুষ্ঠানে যাওয়ার থাকলে ওই ঘড়ি জোর করে পরিয়ে দেয় নন্দিতা ।

বলে, আছে যখন, পরবে না কেন।

এর পরে তার আরও একটা অকাট্য যুক্তি, আর তাছাড়া তোমাদের পুরুষদের তো ওই একটাই গয়না। পড়ে পড়ে নষ্ট হতে দেওয়ার কোন মানে হয় !

নন্দিতার বলা কথাটা মনে আসতেই হিরণ্ময় নিঃশব্দে হেসে উঠলেন।

#

লোকজনে জমজমাট বাসস্ট্যান্ডে আধঘণ্টা সময় তো পলকপাতে কেটে যাবে, ভাবলেন হিরণ্ময়।

লন্ডন প্রবাসী সোশিয়োলজির অধ্যাপক বন্ধু জানকী তাঁকে শিখিয়েছিল, হিরু, পাবলিক প্লেসে এথোনোগ্রাফিক স্টাডি করবি, রেলস্টেশনে, এয়ারপোর্টে লোকেদের চালচলন হাবভাব লক্ষ্য করবি, সময় কেটে যাবে। এটা আবার তোর উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণেও কাজ দেবে।

সুযোগ পেলেই জানকীর দেওয়া উপদেশ কাজে লাগান হিরণ্ময়।

বেঞ্চিতে বসার আগে চারপাশটা একবার দেখলেন।

এই সময়টা তো বাসস্ট্যান্ডের জন্যে যাকে বলে পিক আওয়ার। লোকাল বাসের ওদিকটায় স্থানীয় লোকজনের বেশ ভিড় ।

ড্রাইভারকে পঞ্চাশটা টাকা দিলেন তিনি, দুদিন সার্ভিস দিয়েছে তাঁকে।

চটপটে ছেলেটা হাত তুলে একটা নমস্কার করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো ।

হালকা শীতের দুপুর।

ব্যাগ থেকে শালটা বার করতে গিয়ে কি মনে করে আজকের খবরের কাগজটা বার করে নিলেন। সকালে গেস্ট হাউসের রুমে দিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু নটার আগে সভায় পৌঁছনোর তাড়ায় পড়া হয়নি। বাসযাত্রায় পড়বেন ভেবে তুলে রেখেছিলেন ব্যাগে।

হিরণ্ময় খবরের কাগজটা খুলতে যাবেন এমন সময় তাঁর চোখ পড়ে গেলো সামনের ব্যাঙ্কের কাঁচের দরজাটার দিকে।

দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসছে এক তরুণী, ফরসা চেহারায় পরনে হলুদ রঙের  শাড়ী, হালকা প্রসাধনে সুশ্রী উজ্জ্বল মুখ।

পথচলতি তরুণী মেয়েদের দিকে লক্ষ্য করার বয়স হিরণ্ময় অনেক কাল আগে পেরিয়ে এসেছেন। তবু এই মেয়েটির মুখে কি যেন আছে, হিরণ্ময় তাকে লক্ষ্য  করতে লাগলেন।

কিন্তু সে সুযোগ বেশীক্ষণের জন্য পেলেন না তিনি।

হিরণ্ময় দেখলেন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছাউনিতে ঢুকে  মেয়েটি সোজা এই ভলভো বাস লেনের দিকে এগিয়ে আসছে।

আর তাকিয়ে থাকাটা অশোভন হবে ভেবে তিনি  নিউজপেপারের দিকে নজর দিলেন।

কয়েক মুহূর্ত পরে কাগজের ওপর হালকা ছায়া পড়াতে মুখ তুলে দেখলেন মেয়েটি হাসি হাসি মুখে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

হিরণ্ময় মুখ তুলতেই মেয়েটি বললো, কাকু, এইখানটায় বসবো ?

ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখলেন হিরণ্ময়, ইতিমধ্যে বাকি বেঞ্চগুলোতে অনেক যাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেছে। ছাউনির এক প্রান্তে রয়েছে বলেই বোধহয় এই বেঞ্চটা একটু ব্রাত্য হয়ে আছে ।

তিনি একটু সরে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বসো না।

এই বলে তিনি আবার খবরের কাগজে মন দিলেন।

কিন্তু মনের মধ্যে কিছুটা কৌতূহল।  আড়চোখে দেখলেন মেয়েটি বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর হালকা হালকা পা  দোলাচ্ছে।

তারপরেই হঠাৎ পা দোলানো থামিয়ে হিরণ্ময়ের দিকে ফিরে বলে উঠলো, কাকু, আপনি কি বর্ধমানেই থাকেন ? এইখানে বাসের জন্যেই বসে আছেন নিশ্চয়ই ? তারাপীঠে যাবেন ?

একসঙ্গে তিন তিনটি প্রশ্নের ধাক্কায় হিরণ্ময় একটু মজা পেলেন, ‘মেয়েটা সপ্রতিভ আছে’ !

হাতের কাগজটা আধমোড়া করে একটু হেসে বললেন, না, এখানে থাকি না। বাসের জন্য অপেক্ষা করছি । বোলপুর যাবো। আমার বাড়ি বোলপুরের কাছে।

বলে তিনি আবার কাগজ পড়ার উদ্যোগ করতে লাগলেন।

মেয়েটি আবার বললো, আমি বর্ধমানেই থাকি কাকু, অন্তরা, আমার নাম অন্তরা হালদার। আমি কিন্তু বাসে করে কোথাও যাবো না। আপনি বর্ধমানে কাজে এসেছিলেন ?

হিরণ্ময় একটু হেসে কাগজটা মুড়ে ব্যাগের মধ্যে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, বাঃ বেশ নাম তোমার। হ্যাঁ, কাজেই এসেছিলাম।

অন্তরা লক্ষ্য করছিলো। তারপর বললো, আপনাকে বোধহয় বিরক্ত করছি। আমার ঠাকুমাও বলতো, তুই বাবা মানুষকে বড়ো বিরক্ত করিস অনু। কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন।

ক্লিক করুন এখানে  https://khoshkhobor.blogspot.com/

হিরণ্ময়ের কাগজ রাখা হয়ে গিয়েছিলো।

তাঁর ঝটিতি মনে পড়ে গেলো বিমল মিত্রের শঙ্করকে বলা আপ্তবাক্য…’কথা বলবে সকলের সঙ্গে, রাস্তাঘাটে যখন যেখানে যার সঙ্গে সুযোগ পাবে কথা বলবে, সবাই তোমার এক একটা কাহিনীর মালিক হয়ে উঠবে, একেকটা চরিত্র ভায়া…’

ব্যাগের চেনটা বন্ধ করে তিনি হাসিমুখে বললেন, না না, বিরক্ত হইনি। আমার নাম হিরণ্ময় চৌধুরী । তুমি কথা বলো। আমার ভালো লাগছে শুনতে । তাছাড়া আমার হাতে আধঘণ্টার মতো সময়ও আছে।

অন্তরা কিশোরীর মতো মাথা দুলিয়ে হেসে উঠলো, ব্যস, তাহলে তো হয়েই গেলো। আসলে আমাকেও কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকে হবে তো। আমার গাড়িটাকে এই ভলভো স্ট্যান্ডে আসতে বলেছি। কাজ সেরে সে-ও আধঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে গল্প করে সময়টা কাটিয়ে দেবো। আমি আবার কথা না বলে বেশীক্ষণ থাকতে পারি না।

অন্তরা হাসতে লাগলো।

হিরণ্ময় মনে মনে বললেন, সেতো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে । আরও লক্ষ্য  করলেন সুশ্রী মুখে এই অন্তরা মেয়েটির হাসিটাও সুন্দর।

তিনি বললেন, আমি বিশ্বভারতীতে সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলাম । এখন রিটায়ার্ড। বিশ্বভারতী মানে বুঝলে তো…শান্তিনিকেতন ?

অন্তরা ঘাড় নেড়ে বোঝাল সে বুঝতে পেরেছে।

তারপর বললো, আমি হোম সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, বর্ধমান ইউনিভারসিটি থেকে। সে প্রায় দশ বছর আগে।

এই কথা থেকে মেয়েটির বয়সের একটা আন্দাজ পেলেন হিরণ্ময়। হ্যাঁ, তিনিও ভাবছিলেন ত্রিশ  একত্রিশ হবে নিশ্চয়ই।

হিরণ্ময় এবার বোঝার চেষ্টা করলেন, এই অন্তরা হালদারের বিয়ে হয়েছে কি না…’পাশ করে আঁচড়ানো সিঁথি তো ধবধবে সাদা। আজকাল আবার বিয়ে হয়ে গেছে বোঝাতে অনেকেই কপালের মাঝখানে চুলের ঠিক নীচে একটা ছোট কুমকুমের একটা চিহ্ন দেয়।  সেটা তো নেই। হাতে শাঁখা নেই । সে অবশ্য অনেকেই পরে না…’

সরাসরি প্রশ্ন করা অশোভন হবে ভেবে হিরণ্ময় একটু ঘুরিয়ে বললেন, তোমার বাড়িতে কে কে আছেন অন্তরা ?

– কেউ নেই, আমি একা থাকি কাকু। অবশ্য ঠিক একা নয়, একজন চব্বিশ ঘণ্টা কাজের লোক আছে, মিনতিদি, ঠাকুমার আমলের লোক, আমার বড়ো দিদির মতো, একেবারে লোকাল গার্জেনের হাবভাব তার।

অন্তরা হাসতে হাসতে আবার বললো, আর আছে দুজন দুবেলার ঠিকে রাঁধুনি মেয়ে, তার সঙ্গে জোগাড় দেওয়ার জন্য আরও দুটি মেয়ে।

হিরণ্ময় বেশ অবাক হয়ে গেলেন…’এই মেয়েটা একলা থাকে ! বোঝাই যাচ্ছে নিজের বলতে কেউ নেই। বিয়ে হয়নি তাহলে। তাইতো, গুরুজন আত্মীয় কেউ সঙ্গে বাস না করলে বাইরের কেই বা বিয়ের উদ্যোগ নেবে ! কিন্তু থাকা খাওয়ার তো দুজন লোক ! দুজনের রান্নাবান্না, জোগাড় দেওয়ার  জন্য চারজন মানুষ !’

হিরণ্ময়ের মনে যখন এইসব ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, অন্তরা যেন তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরে হাসতে লাগলো, আপনি বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছেন তো কাকু ! ভাবছেন, মেয়েটা একা থাকে…মনে হচ্ছে বাবা মা নেই। বিয়েও হয়নি ! পুরনো কাজের লোককে নিয়ে দুজনে থাকে…কিন্তু এতো রান্নার ব্যবস্থা ! অবাক হওয়ারই কথা তো ! বলছি সব এক এক করে । আপনার মনে হবে যেন গল্প শুনছেন !  সত্যি !

হিরণ্ময় এবার কিছুটা উৎসাহিত হলেন, সময়টা এমনভাবে কাটবে তিনি ভাবেননি।

হাসিমুখে বললেন, অন্তরা, তোমাকে বলা হয়নি…মানে এ পর্যন্ত বলার সুযোগ পাইনি…মানে তুমিই দাওনি আর কি…

হিরণ্ময়ের কথার মাঝখানেই অন্তরা হাসতে হাসতে বলে উঠলো, কাকু, আপনি তো এক্কেবারে আমার ঠাকুমার মতো কথা বলছেন ! ঠাকুমাও বলতো, তুই তো কাউকে কথা বলার সুযোগ দিস না অনু, কেবল নিজেই কথা বলে যাবি, আর তোর কথা সবাইকে শুনতে হবে। না, না, আপনি বলুন কাকু, এই আমার মুখ বন্ধ করলাম।

হিরণ্ময় বুঝলেন এই মেয়েটি তার ঠাকুমাকে খুব ভালবাসে। এই অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকবারই উল্লেখ করেছে। মুখে বললেন, তোমার ঠাকুমাকে তুমি খুব ভালোবাসো…না অন্তরা ?

– সে বুড়ি মানুষটা তো সব ভালবাসাবাসির বাইরে চলে গেছে অনেকদিন কাকু । আমাকে একা ফেলে রেখে…ওই আমার বিয়েটা দিয়ে যাওয়ার চিন্তা করে করেই বোধহয় বেঁচে থাকতো। তারপর তো…

কথা শেষ না করে অন্তরা চুপ করে গেলো ।

তার  ধীরে ধীরে বলা কথাগুলো আর গলার আওয়াজটা একটু ভিজে শোনাতে হিরণ্ময় অন্তরার  দিকে তাকালেন ভালো করে।

হঠাৎ মেয়েটির ভাবান্তর দেখে আর তার একটা কথায় তিনি বেশ অবাক হয়ে গেলেন।

‘বিয়ে ! এই অন্তরা বিবাহিতা না কি ! কিন্তু কোথাও তো তার কোন চিহ্ন দেখছি না ! হাতও খালি । বাঁহাতে এয়োতির চিহ্ন লোহার বদলে একটা ব্ল্যাক ডায়ালের সুন্দর হাতঘড়ি। অবশ্য আজকাল কে আর এসব মানামানি করে ।’

অন্তরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলো। হিরণ্ময়ের মনের ভাবটা তাঁর চোখেমুখে ভেসে উঠে থাকবে।

ধীরে ধীরে সে বললো, হ্যাঁ কাকু, আমার বিয়ে হয়েছিলো। তবে সেসব চুকেবুকে গেছে অনেকদিন।

তারপর এক মুহূর্তের মধ্যেই গলার স্বরে হালকা ছটফটে ভাবটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে বললো, এখন তো ওসব মনেও পড়ে না। সেও একটা গল্প। আপনার সময় আর ইচ্ছে থাকলে শোনাব আপনাকে।

তারপর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঘাড় মুছে বললো, তার আগে আপনি বলুন তো কি কথা আপনার আমাকে বলা হয়নি।

– অন্তরা, আমি যে রিটায়ার্ড প্রফেসর সেটা বলেছি তোমাকে, কিন্তু যেটা বলা হয়নি…আমি একজন লেখকও বটে । গল্প উপন্যাস লিখছি, গত তিরিশ বছর ধরে। কিছু পুরস্কার-টুরস্কারও পেয়েছি।

হিরণ্ময় দেখলেন কথাগুলো শুনতে শুনতে অন্তরা বিস্ফারিত চোখে একভাবে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপরে চকচকে চোখে বললো, তাই আমি কখন থেকে ভাবছি, আপনার মুখটা কেন আমার চেনা চেনা লাগছে ! নামটা শুনেই আগে খেয়াল করা উচিত ছিল আমার !

এক মুহূর্ত থেমেই সে উচ্ছল স্বরে বলে উঠলো, হিরণ্ময় চৌধুরী নাম আর আপনার এই মুখ, দুই-ই তো আমার আগে দেখা কাকু।

অবাক হবার পালা এবার হিরণ্ময়ের।

বিস্ময়ের সুরে তিনি বললেন, কি বলছো ! তোমার সঙ্গে আমার আগে দেখা হয়েছিলো ? কবে  ? কোথায় ? কই, আমার তো কিছু মনে পড়ছে না !

অন্তরা হিরণ্ময়ের প্রশ্নগুলোর জবাব না দিয়ে হুড়মুড় করে বলতে থাকলো, ‘মনময়ূরী’ তো আপনার লেখা কাকু ? কি ভালো লেগেছিল গল্পটা ! কবে পড়েছি, এখনও পুরোটা, সব চরিত্রগুলো মনে আছে ! সিনেমা হয়েছিলো তো ! সেটাও দেখেছি ! বইটার জ্যাকেটের পেছনে আপনার ছবি ছিল তো ! অবশ্য চুলগুলো তখন বেশ কালো ছিল ! ইসস, আপনার সঙ্গে কোনোদিন এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি ! কি ভালো যে লাগছে !

হিরণ্ময় বেশ অবাক হলেন, খুশীও হলেন।

বছর বারো আগে প্রকাশিত এই উপন্যাসটা সত্যিই পাঠকমহলে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।

এই বইটার জন্য পরে তিনি বঙ্কিম পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

এতদিন পর এই বাসস্ট্যান্ডে যদি জানতে পারা যায় সেই কাহিনী কোন তরুণীর মনে ভালোলাগার ঝড় তুলেছিলো তাহলে লেখক খুশী হয় বইকি !

স্মিতমুখে তিনি  বললেন, হ্যাঁ, ‘মনময়ূরী’ তো অনেক বছর আগে লেখা। তবে আমার খুব জনপ্রিয় বই। অনেকগুলো এডিশন হয়েছে । উপন্যাসটা পড়ে তোমার  খুব ভালো লেগেছিল বলছো ?

– আমার বিয়েতে কেউ উপহার দিয়েছিলো কাকু। কয়েকবার পড়েছি ‘মনময়ূরী’ । তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে তো, কম বয়েস ! তাই আমার নিজেকে তখন গল্পের সুপর্ণার মতো মনে হতো ! কতোবার ভেবেছি, এবার সুপর্ণার মতো আমার জীবনেও যদি কোন অরিত্র আসে…সুপর্ণার মতো আমাকেও  ভাসিয়ে নিয়ে যায় ! তা…সে তো আর হওয়ার ছিল না…তা-ই হয়নি ।

অন্তরা থেমে গিয়ে একটু ম্লান হাসলো । তারপর চেয়ে রইলো দূরে, লোকজনের ভিড়ের দিকে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার এই ভাবান্তর হিরণ্ময় লক্ষ্য করলেন…দু-দুবার বিয়ের কথাপ্রসঙ্গে অন্তরা  বিমর্ষ হয়ে পড়েছে ।

’বিয়ে যে ভেঙে গেছে সেটা তো নিশ্চিত। কিন্তু কারণটা কি ! এত সপ্রতিভ হাসিখুশি একটা মেয়ে…’

এই ঘটনার পেছনের কাহিনী জানার জন্য হিরণ্ময়ের লেখক মন উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি, তোমার বিয়েটা সার্থকতা পায়নি সেটা বুঝতে পারছি অন্তরা। কিন্তু কারণটা কি ? অবশ্য…

হিরণ্ময়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্তরা মুখ ফিরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল তাঁর দিকে ।

চোখে চোখ পড়তে একটু থেমে গিয়ে হিরণ্ময় তাঁর কথা শেষ করলেন, অবশ্য…বলতে তোমার যদি আপত্তি না থাকে ।

অন্তরা আবার তাকালো মানুষের ভিড়ের দিকে ।

তারপর যেন মনের মধ্যের  কোন একটা দ্বিধা সরিয়ে দিয়ে একটু জোরগলায় বললো, বলবো কাকু । আপনি লেখক, আমার তো কথা বুঝবেন । হয়তো একটা বইও লিখে ফেলতে পারেন।

তারপর আবার তার সেই উচ্ছল স্বরে বললো, তাহলে কিন্তু বেশ মজা হয়। লিখবেন তো ?

হিরণ্ময় বললেন, বই লিখবো কী না সেটা তো এক্ষুনি বলতে পারছি না । তবে তুমি বলো, আমি শুনবো ।

– কিন্তু আপনার বাস যদি এসে যায়, তাহলে আমার গল্প কিন্তু শেষ হবে না। ইনকমপ্লিট থেকে যাবে।

হিরণ্ময় ঘড়ির দিকে তাকালেন । তারপর বললেন, টাইম অফিসের নিদান অনুযায়ী এখনও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় আছে। তোমার কথা তার মধ্যে শেষ করো। আর যদি শেষ না-ই হয়…এই যে তুমি বই লেখার কথা বলছো না, লেখক আছে কি করতে ! তার সব লেখার মধ্যে হয়তো  কিছুটা সত্যি থাকে, বাকি সবটাই কল্পনা !

কথা শেষ করে তিনি হালকা হাসলেন ।

– আমার জন্মের পর শুনেছি কুড়িদিনের মাথায় মা মারা যায় । একটা শক্ত অসুখ হয়েছিলো, তাতে নাকি কেউ বাঁচে না । মা-ও বাঁচেনি। বাবা কোলকাতার বড়ো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো বলে শুনেছিলাম ঠাকুমার কাছে। কোন লাভ হয়নি । আমি জন্মেই মা-হারা হয়েছিলাম কাকু। মা কী জিনিস আমি জানি না । আপনাদের গল্পের ভাষায় আমি একটা দুর্ভাগা মেয়ে ।

– ওহ। হিরণ্ময় প্রায় অস্ফুটস্বরে বললেন।

– আপনি ঠাকুমাকে ভালোবাসার কথা বলছিলেন না কাকু। আমার নামটা ওই ঠাকুমারই দেওয়া।

ওই ঠাকুমা-ই আমার মা হয়ে ছিলো আমার জন্মের পরে একুশটা বছর। আর আমার সাত বছর বয়েস থেকে বাবা হয়েও।

হিরণ্ময়ের মুখ থেকে প্রায় অজান্তে বেরিয়ে এলো, তার মানে ?

অন্তরা ম্লান হেসে বললো, বাবাও আমাকে ছেড়ে অকালে চলে গিয়েছিলো কাকু। সাত বছর বয়েস তখন আমার । ভালো করে কিছু বোঝার আগেই আমি মা বাবা দুজনকেই হারালাম। একেবারে অনাথ অবশ্য হলাম না। আমার শক্ত মনের ঠাকুমা আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখলো।

অন্তরা থেমে গেলো । কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপ। তারপর হিরণ্ময় ধীরস্বরে বললেন, তোমার বাবার কি করে…মানে ঠিক কি হয়েছিলো ? কোনো অসুখ ?

– না। আমাদের একটা ফ্যাক্টরি ছিল। আয়রন কাস্টিঙের নানারকম কাজ হতো বলে শুনেছি । সেখানে একটা বড়ো অ্যাকসিডেনট হয়েছিলো। আমার বাবা আর একজন ফ্যাক্টরির লেবার সেই দুর্ঘটনায়  মারা যায়। আমি তো তখন অনেক ছোট। সবকিছু ভালো করে মনেও নেই । কেবল মনে আছে ঠাকুমা কিছুতেই আমাকে শ্মশানে যেতে দেবেনা, বাবার মুখাগ্নি করতে দেবে না । আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঠাকুমার সেই হাউহাউ করে কান্নাটা আমি এখনও চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই। সেই ঠাকুমাও চলে গেছে দশ বছর হলো।  সেই তখন থেকে আমি একাই আছি কাকু ।

অন্তরা একটু মুখে ক্লিষ্ট হাসির ভাব করে থেমে গেলো। দুজনেই চুপ ।

কয়েক মুহূর্ত পরে হিরণ্ময় নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আর…তোমার বিয়ে ?

অন্তরা এবার হেসে উঠলো, সেও এক গল্প ! সত্যি বলতে কি, এক মজার গল্প ! শুনবেন ? আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে ! তবে বিয়ের গল্পটা বলতে গেলে অবশ্য একটু পিছিয়ে গিয়ে বলতে হবে ।

একটু থেমে অন্তরা বলতে থাকলো, ঠাকুমার কাছে তো বড়ো হতে থাকলাম । পৈত্রিক ফ্যাক্টরিটা ঠাকুমা বিক্রি করে দিয়েছিলো । ভালো করে জ্ঞান হবার পর ঠাকুমার মুখে তো ওই ফ্যাক্টরির কথা আর বিশেষ শুনিনি। অনেকদিন পরে শুনেছিলাম ওখানে যে লেবার সুপারভাইজার ছিল সে-ই নাকি জলের দামে ওটা কিনে নিয়েছিল। এতোদিন পরে এখন আমার মনে হয় বাবার ওই অ্যাকসিডেনটটাও হয়তো তৈরি করা হয়েছিলো । যা হয়েছিলো হয়তো তা ছিল একটা পরিকল্পিত দুর্ঘটনা, মানুষটাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে তার ব্যবসাটা  আত্মসাৎ করার প্রথম ধাপ ।

অন্তরা থামতেই হিরণ্ময় সম্মতির ভাবে মাথা নাড়লেন।

তারপর বললেন, হতেই পারে । এরকম আকছার হয় । কেবল বিভিন্ন অথরিটির সঙ্গে একটু দহরম মহরম থাকাটা জরুরী।

অন্তরা বললো, সেই-ই। মাঝে পঁচিশটা বছর কেটে গেছে । এখন তো আর কিছু করার নেই। যে কিনেছিল সে-ও বেঁচে নেই । এখন তার ছেলেরা নাকি মালিক । সে যাক,  ঠাকুমার কাছে তো বড়ো হতে লাগলাম । বাদামতলায় বড়ো রাস্তার ওপর আমাদের নিজেদের দোতলা বাড়ি, পুরনো, ঠাকুরদার বাবার আমলের। একতলায় নীচে বাইরের দিকে তিনটে দোকানঘর আর ভেতরের দিকে দুঘর ভাড়াটে । ফ্যাক্টরি বিক্রির টাকার ওপরে ব্যাঙ্কের সুদ আর ভাড়ার টাকা, এই দুইয়ের ওপর নির্ভর করে আমার পঞ্চান্ন বছর বয়সের ঠাকুমা সংসারে তার দ্বিতীয় ইনিংস সুরু করে দিলো। কাকু, আপনি জি বাংলার ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ শো-টা কখনো দেখেছেন ? দশ বছর ধরে রোজ বিকেল পাঁচটায় চলছে ! তখন তো ওই শো-টা ছিল না । থাকলে আমার ঠাকুমা ওখানে হতো সুপার দিদি নাম্বার ওয়ান, হ্যাঁ !

চকচকে চোখে বলে থামলো অন্তরা। হিরণ্ময় শো-টা দেখেননি কোনদিন । তিনি মাথা নাড়লেন। ও  আবার বলতে শুরু করলো, ঠাকুমা অসাধারণ রান্না করতো। ওই কথায় আছে না ‘রান্নায় দ্রৌপদী’…সেই রকম ! ছোটবেলা থেকে দেখেছি পাড়ার মধ্যে কোন বাড়িতে ঘরোয়া অনুষ্ঠান, পাকা দেখা, অন্নপ্রাশন, এসবে বাইরের লোকের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার থাকলে, সে বাড়ির গিন্নীরা  ঠাকুমাকে ডেকে নিয়ে যেতো । রান্না হয়তো সে-বাড়ির বৌ-রাই করতো, ঠাকুমা পাশে মোড়ার ওপর বসে সবকিছু বলে বলে দিতো। যেখানে যেতো আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতো। পাশে বসিয়ে বলতো, ভালো করে দ্যাখ অনু, কিভাবে, কি রকম করে কি হচ্ছে । বাড়িতে হাতে ধরে শেখাতো, কতো পুরোন দিনের হারিয়ে যাওয়া রান্না। ঠাকুমা বলতো, যে বাড়িতে-ই যাবি বাড়ির বৌকে রান্না তো করতেই হবে, সে খুব কম হলেও ঠিকে রাঁধুনির ওপরে খবরদারি তো করতে হবে। অনু মা, ভগবান মেয়েদের জোরের জায়গাগুলো কম দিয়েছেন, তবে তার মধ্যে একটা বড়ো জায়গা দিয়েছেন, সেটা   হচ্ছে এই রান্না ! ভালো করে রান্না জানলে সে মেয়ের কদর হবেই। ঠিক করে শেখ, যতোদিন আছি শিখে নে। ঠাকুমার কথা মেনে কতোরকম রান্নার কতো আটঘাট শিখে গেলাম কাকু।

হিরণ্ময় একমনে শুনে যাচ্ছেন, এই সহজ সরল গল্পটা বেশ লাগছে তাঁর ।

অন্তরা আবার শুরু করলো, কলেজে ঢুকে গেলাম, হোম সায়েন্স নিলাম। পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না। বেশ ভালোই চলছিলো। কিন্তু এক নতুন ঝামেলা দেখা দিলো বাড়িতেই । কলেজের দ্বিতীয় বছর থেকেই ঠাকুমার অষ্টপ্রহর গুনগুনানি শুরু হয়ে গেলো, আমার বয়েস হচ্ছে। আমি চলে গেলে কি হবে তোর। একা একা এই বাড়িতে কি করে থাকবি ! পাশ করে গেলেই তোর বিয়ে দেবো। একা একা মেয়েদের এই সমাজে থাকা ভীষণ কষ্টের, ভীষণ বিপদের রে অনু। বুঝুন কাকু, যে মানুষটা চল্লিশ বছরে বিধবা হয়ে পরের তিরিশ বছর একা একা কাটিয়ে দিলো, বিধবা অবস্থায় পুত্রশোক সামলে একমাত্র নাতনিকে সবরকম ঝড়ঝাপটা এড়িয়ে বড়ো করে তুললো, সে কিনা এখন এইসব কথা বলতে শুরু করেছে ! আমি ঠাকুমার নিজের  উদাহরণ দিতে গেলেই বলতো, আমাদের সময়টা ছিল আলাদা। দিনকাল এখন অনেক বদলে গেছে রে অনু। উত্তরে আমি তো সেই একই কথা বলতাম, ওই-ই তো ! দিনকাল, সমাজ এখন অনেক পালটে গেছে ঠাকুমা। আজকের দিনে একটা মেয়ের পক্ষে একা একা থাকা, চেষ্টা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো আগের থেকে অনেকটাই সহজ হয়েছে। আমার ভাবনাও সেই রাস্তায় ছিল কাকু। পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা করে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। তারপরে না হয় বিয়ের কথা ভাবা যাবে। মিথ্যে বলবো না কাকু, এমন কি এটাও ভাবছিলাম, পড়াশোনা শেষ করে যদি একটা লোকাল চাকরি করতে পারি আর কয়েক বছর পরে যদি এমন জীবনসাথী পাওয়া যায় যে আমাদের বাড়িতে এসে থাকতে রাজি হবে ! আমার বুড়ো ঠাকুমাটাকে নইলে কে দেখবে ? কিন্তু মানুষকে তো তার নিয়তি চালায়, সেটা কে খণ্ডন করবে ! আমার এই সব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই আমার অজান্তে বুড়ি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলো !

– কিসের ? তোমার বিয়ের ?

– হ্যাঁ ! ঠাকুমার পিসতুতো ভাইয়ের নাতি ! তাদের বাড়ি শক্তিগড়ে । নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে কুল্লে পৌনে এক ঘণ্টার রাস্তা । ছেলে সম্পন্ন ঘরের, নিজেদের বাড়ি, পোস্ট-অফিসের পাকা চাকরি । সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আমি আপত্তি জানাতেই বুড়ি অন্নজল ত্যাগ করলো । তার সেই একই কথা…আমি চলে গেলে তুই কি করে থাকবি…আমার মরার পরে তোরা দুজনে তো এবাড়িতেই এসে থাকবি…এ বাড়ি তো তোরই…সজল রাজি হলে প্রথম থেকেই তো এসে থাকতে পারিস…উপোসী পেট নিয়ে তার  এইসব যুক্তি চললো দিন দুয়েক । বিধবা মানুষ, বচ্ছরকার নীল-এর নির্জলা উপোস দেওয়া শক্ত শরীর। তবুও দিন দুয়েকের পর ঠাকুমা দুর্বল হয়ে পড়লো, গলার আওয়াজ ক্ষীণ, মুখে সেই এক কথা…অনু, রাজী হয়ে যা মা। এমন পাত্র কোথায় পাবো…আমার যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়…। আর অন্য কোন উপায় না দেখে আমি হাত তুলে দিলাম কাকু।

– তুমি বিয়েতে মত দিয়ে দিলে ?

– হ্যাঁ, সবদিক ভেবে দেখলাম ঠাকুমা যেটা বলছে সেটাই বোধহয় ঠিক । এর থেকে ভালো ব্যবস্থা কি আর হতে পারে ! কিন্তু বিধাতাপুরুষ বোধহয় সেদিন অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। আমার বিয়ে তো হয়ে গেলো সুপুরুষ চেহারার সজল দে-র সঙ্গে। বর্ধমানের বাদামতলা এরিয়ার আমরা পুরনো বাসিন্দা। খুব আড়ম্বর না হলেও আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, আমার কলেজের বন্ধুরা, বিয়েতে লোকজন এসেছিল ভালোই। ঠাকুমার সে উৎসাহ দেখে কে ! ক্যাটারারের রাঁধুনি লোকেদেরও রান্নার টিপস দিয়ে দিয়ে জেরবার করে দিয়েছিলো ! বলে অন্তরা হেসে উঠলো।

হিরণ্ময়ও হাসলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তারপর ?

অন্তরা নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো।

তারপর বললো, আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমার গল্পটা শেষ করতে হবে কাকু। আপনার জন্যেই ! আমার গাড়ি তো এসে দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু আপনার বাস মিনিট পাঁচেকের বেশী দাঁড়াবে না । সিট রিজার্ভ করেছেন তো ? এখানে কিন্তু বোলপুরের কোটা আছে ।

হিরণ্ময় মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, করেছি। তুমি বলে যাও ।

মনে মনে বললেন, দরকার হলে পরের বাসে যাবো অন্তরা। কিন্তু শারদীয়া উপন্যাসের এই প্লটের শেষটা না শুনে আমি উঠছি না !

– বিয়ে তো হয়ে গেলো ! শ্বশুরবাড়ি এলাম, দোতলা বাড়ি, লোকজন কম । ছেলের বাবা মা আর  এক বুড়ি বিধবা পিসী নীচের তলায় থাকেন। দুই বোন বয়েসে বড়ো, অনেকদিন বিয়ে হয়ে গিয়েছে । দোতলায় আমাদের ঘর। সময় কম, তাই একেবারে প্রথম রাতের কথায় যাই । দশ বছর প্রায় হয়ে গেছে, এখনও সব ছবির মতো চোখে ভাসে। ফুলশয্যার রাতে, সব লোকজন চলে যাওয়ার পর আমার বর দোতলার ঘরে এলো । ঘরে ঢুকে আমার সঙ্গে কোন কথা নেই । গলার মালা-টালা খুলে খাটের ওপর রেখে ফুল দিয়ে সাজানো সেই খাটের তলা থেকে ভাঁজ-করা একজোড়া শতরঞ্জি চাদর বের করে ঘর থেকে বেরুতে যাবে, আমি লাজলজ্জা ভুলে বলে উঠলাম, কি ব্যাপার, কোথায় যাচ্ছো ? তুমি এঘরে থাকবে না…মানে থাকতে চাও না ? আমার বিয়ে-করা নতুন বর ঘুরে দাঁড়িয়ে নীচের ঠোঁটটা কামড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে বললো, আমি বাইরের বারান্দায় শুতে যাচ্ছি । যদি মনে করো, দরজাটা বন্ধ করে দিতে পারো । আমার কেমন যেন জেদ চেপে গেলো, অপমানও লাগছিলো। বললাম, আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি ? তাহলে বাড়িতে আগেই বলতে পারতে। কি যেন মনে হল তার, দাঁড়িয়ে গেলো। এক মুহূর্ত আমার দিকে ভালো করে তাকালো, তারপর বললো, সেরকম কিছু নয়, তোমার অন্য কোথাও ভালো বিয়ে হতেই পারতো। আমি বললাম, কিন্তু বিয়ে তো তোমার সঙ্গে হয়েছে । আমি তো নিজে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইনি। তোমার ঠাকুরদার বোন, মানে আমার ঠাকুমা, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে উপোস দিয়ে জোর করে এই বিয়েতে আমার মত করিয়েছে। সজল  বললো, কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া কোনদিন সম্ভব নয় । আমি বললাম, তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন । ও বললো, আমিও আপত্তি করেছিলাম। কেউ শোনেনি। আমি…আমি  অন্য একজনকে ভালোবাসি। কিন্তু বাড়িতে বলিনি, কিছুতেই বলতে পারিনি ।

এটুকু শুনেই হিরণ্ময় প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন, দ্যাট ইটারনাল সিনড্রোম…রঙ্গমঞ্চে একজন তৃতীয় মানুষ…এক নারীর আবির্ভাব  !

অন্তরা  থেমে গিয়ে হিরণ্ময়ের দিকে তাকিয়েছিল। তাঁর কথা শেষ হতেই হঠাৎ মুখে আঁচল দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো । হিরণ্ময় তো হতবাক…’এমন একটা সেনসিটিভ বিষয়, যা ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, সে ব্যাপার নিয়ে কেউ এরকমভাবে হেসে উঠতে পারে !’

হিরণ্ময়ের মুখে নিশ্চয়ই তাঁর মনের ভাব ফুটে উঠেছিলো ।

অন্তরা যেমন হঠাৎ হেসে উঠেছিলো সেরকম হঠাৎই হাসিটা সামলে নিয়ে বললো, সরি, সরি কাকু ! মনময়ূরী-র মতো একটা দারুণ গল্পের  সৃষ্টিকর্তার এমন একটা ভুল আন্দাজ শুনে হঠাৎই হাসি পেয়ে গিয়েছিলো। সরি । কাকু, তৃতীয় মানুষটি কোন মেয়ে নয়, একটি জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ ! হ্যাঁ-আ !

বলে আবার অস্ফুটে হেসে উঠলো অন্তরা।

শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন হিরণ্ময়। প্রথমত, এমন একটা ব্যাপার এই আপাতসাধারণ গল্পের মধ্যে এসে পড়বে এটা তাঁর ভাবনার অতীত ছিল। আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক ভাবে অগ্রাহ্য আর স্পর্শকাতর এই বিষয়টাকে কি সহজ ভাবে উপস্থাপন করছে এই মেয়েটা !

হতভম্ব হিরণ্ময় কিছু বলার আগেই অন্তরা এবার সিরিয়াস গলায় বলে উঠলো, হ্যাঁ কাকু ! সজল দে-র ভালোবাসার মানুষ ছিল একটি পুরুষ। আমার বিয়ে-করা বর, ওই যাকে বলে সমকামী, তাই ছিল। কথাটা শুনে সেই রাতে, আমার ফুলশয্যার রাতে, আমি কিন্তু আজকের মতো হেসে উঠিনি, উঠতে পারিনি কাকু। কিছুক্ষণের জন্যে আমার বোধবুদ্ধি বোধহয় লোপ পেয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমি কেঁদে উঠবো, না কি সামনের লোকটাকে, যার সঙ্গে আমার মাত্র দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে, যাকে ঘিরে সব মেয়ের মতোই আমার স্বপ্ন দেখার তেমন করে শুরুটাও হয়নি, তাকে ঘেন্না করবো, সেসব কিছুই মাথায় ছিল না । শুধু মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়েছিলাম খাটের ওপর সেটা মনে আছে । সজল আমার সামনে দরজার কাছে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে তার শতরঞ্চি আর চাদর। দিনভর কোলাহলের পর সারা বাড়ি নিঝুম হয়ে আছে । যেন বহুযুগ পরে আমার গলায় স্বর ফুটলো, বললাম, তাহলে আমি এখন কি করবো ? সে খাটের ওপর থেকে একটা নতুন বালিশ তুলে নিয়ে বলল, তুমি মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে নিও । আমি বাধা দেবো না। অষ্টমঙ্গলায় গিয়ে আমি তোমাকে রেখে আসবো তোমার বাড়িতে। এখন শুয়ে পড়ো । বলে ও দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেলো। কতক্ষণ ওইভাবে বসে ছিলাম জানি না। যখন সম্বিত ফিরলো, তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন খাটের ছতরি থেকে ঝোলানো রজনীগন্ধার ছড়াগুলো টেনে টেনে ছিঁড়লাম, গলার মালাটা, গায়ের ফুলের গয়না সব কুচিকুচি করলাম, আর তারপর ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

হিরণ্ময় স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন ।

তাঁর মনে হচ্ছিলো, কি অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী এই মেয়েটি, অন্তরা।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ । তারপর হিরণ্ময় বললেন, বুঝতেই পারছি, এরপর তোমার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো। আর এটাও বুঝতে পারছি, তুমি পরে আর বিয়ে করোনি ।

– নাহ । সেই যে বিয়ের আটদিনের মাথায় শক্তিগড় থেকে চলে এসেছিলাম আর ওখানে ফিরে যাইনি। আইন মতো ছমাস আলাদা থাকার পর সহজেই মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেলো। গয়নাগাঁটি সব আমার সঙ্গেই নিয়ে এসেছিলাম। একদিন একটা ছোট লরি এসে ঠাকুমার দেওয়া ফার্নিচার, ফ্রিজ, আলমারি দিয়ে গেলো। নিজের বাড়িতে সজল কী বলেছিল আমি জানি না। আমার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে বা প্রবৃত্তি কোনটাই হয়নি। আমার বাড়িতে কি হয়েছিলো, ঠাকুমার কি নিদারুণ অবস্থা হয়েছিলো, পাড়া-প্রতিবেশীর কৌতূহল আর নিন্দেকে কিভাবে মোকাবিলা করেছিলাম, সেসব  আর বিস্তারিত বললাম না কাকু। শুধু এইটুকু বলি, যেদিন কোর্টে ডিভোর্সের ডিক্রিটা হলো সেদিনই আমার ঠাকুমা শয্যা নিলো। সে বিছানা ছেড়ে ঠাকুমা বিশেষ আর ওঠেনি । আমার দুর্ভাগ্যের সব অপরাধ গ্লানি মনের মধ্যে নিয়ে আমার বিয়ে দেওয়ার ঠিক একবছরের মাথায় ঠাকুমাও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম কাকু।

অন্তরা চুপ করে গেলো, চোখ তার লোকজনের ভিড়ের দিকে ।

হিরণ্ময় দেখলেন তার চোখ ছলছল করছে। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখদুটো মুছে নিয়ে মুখে একটু হাসির ভাব এনে  হিরণ্ময়ের দিকে তাকালো ।

তারপর বললো, অনেক অনেক দিন পরে এইসব কথা মনে করে করে বললাম তো,  তাই একটু মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এখন কিন্তু আমি ভালো আছি কাকু। খুব ভালো আছি। আপনি আবার বিয়ের কথা বলছিলেন । হ্যাঁ, বিয়ের কথা ভাবি তো ! এখন করতেও পারি ! পারি কী না বলুন ?

এতক্ষণে হিরণ্ময় জোর দিয়ে বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই পারো। আমি তো বলবো তোমার বিয়ে করা উচিত । কেন সারা জীবন তুমি একা থাকবে !

– হ্যাঁ । বিয়ে যদি করি, এখন আমি আমার নিজের শর্তে করবো ।

– কি রকম  ?

– ওই যে ! বিয়ের পরে  আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে থাকতে হবে। শুধু জীবনের সাথী হলে চলবে না,  আমার ব্যবসার কাজে আমার সাথী হতে হবে, আমাকে পুরোদস্তুর সাহায্য করতে হবে !

– তোমার ব্যবসা ! হিরণ্ময় কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ।

অন্তরার কাহিনী শুনতে শুনতে ভাবনাটা অবশ্য তাঁর মাথায় এসেছে…’মেয়েটার এখন সংসার চলে কিসে ! ওই ভাড়ার টাকায় ? না কি চাকরি করে ? এদিকে গাড়ি আসবে বলছে…’

অন্তরা হাসিমুখে বললো, আমার একটা ছোট ব্যবসা আছে কাকু। সেটা বাড়াবার প্ল্যান করছি । সেই লোনের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার জন্যেই আজ ব্যাঙ্কে এসেছিলাম ।

– আচ্ছা ! খুব ভালো ! কিসের ব্যবসা তোমার অন্তরা ?

– ওই সেই যে ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ ! আর তার সঙ্গে আমার ঠাকুমা !

– কি রকম…বুঝলাম না তো ! একটু বুঝিয়ে বলো।

– ওই রিয়ালিটি শো-টায় মেয়েরা এসে তাদের বাঁচার গল্প শোনায়, কারুর কম বয়েসে স্বামী মারা গেছে, কারুর স্বামী থেকেও নেই, বৌকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আবার কাউকে ঘটনাচক্রে বাড়িঘর ছেড়ে আসতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে, সেই স্বপ্ন পূরণ করে কিভাবে নিজের পায়ে, পরিবারের পাশে, দাঁড়াতে পেরেছে শো-তে সেই সব গল্প শোনায়। ঠাকুমা চলে যাওয়ার পরে, কিছুদিন কেমন যেন জড়ভরত হয়ে গিয়েছিলাম । বাড়িতেই থাকতাম আর মনের কষ্টকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য  টিভি দেখতাম। তারপর ওই ‘দিদি নাম্বার ওয়ান’ শো-টা থেকে, শো-এর মানুষগুলোর গল্প শুনে শুনে আমি নিজের থেকে কিছু করার ভরসা পেলাম। যে ঠাকুমার অযথা চাপে আমার জীবনটা এসে একজায়গায় স্থির হয়ে ছিলো, সামনের দিকে এগোনর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলো না, সেই ঠাকুমাই আমাকে আবার দিশা দেখালো কাকু। আমি ঠাকুমার শেখানো রান্নার ওপরে ভর করে হোমকুকড ফুড ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করলাম, ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি, মাছ, চাটনি, স্পেশাল অর্ডারে চিকেন, মাটন । প্রথমে কয়েকটা পরিবার দিয়ে শুরু হলো।  সময়ের সাথে সাথে বছরে বছরে আস্তে আস্তে বাড়ছিল সেই ঘরোয়া ব্যবসা, দশ ঘর থেকে বিশ ঘর, বিশ  থেকে তিরিশ। তারপর হঠাৎই করোনা-র প্যানডেমিক এসে পড়লো । ওই যে কথায় বলে না, কারও সর্বনাশ, তো কারও পৌষমাস ! কোভিডের সময়টা আমার জন্যে পৌষমাস হলো কাকু…ছোট ব্যবসাটা প্রায় রাতারাতি দারুণ ভাবে বেড়ে গেলো। বর্ধমান শহরের চারদিকে, দূর দূর মহল্লায় এতো অর্ডার, এতো ডেলিভারি বাড়তে লাগলো ! সামলাতে গিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টাটার ছোট হাতি কিনে ওটাকে ডেলিভারি ভ্যানগাড়ি করে ফেললাম। একটা ড্রাইভার আর তার হেল্পার। আজ আমার কাছে একটা কলেজ হস্টেল, দুটো গেস্ট হাউস, একটা পুলিশ লাইন, আর প্রায় চল্লিশটা ঘর। বেলা বারোটার পর থেকে ডেলিভারি শুরু, চলে প্রায় দুটো অবধি। ছ-সাতটা লোকের মাইনে দিই আমি কাকু, রোজ কমসে কম একশো জনের রান্না হয়, বড়ো তিনটে গ্যাসের উনুনে। আমার গ্রাহকরা নাকি আমার রান্নার খুব প্রশংসা করে, আমি শুনতে পাই, আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে।

অন্তরা  থামতেই হিরণ্ময় বললেন, চমৎকার ! কিভাবে তোমার প্রশংসা করবো অন্তরা ! আমি তো তোমার ওই রিয়ালিটি শো-টা দেখিনি কোনদিন, কিন্তু তুমি তো আমার সামনে জলজ্যান্ত দিদি নাম্বার ওয়ান, উইথ হানড্রেড এন্ড ফিফটি স্কোর আউট অফ হানড্রেড !

অন্তরা চকচকে চোখে বললো, ভালো একটা গল্প হবে বলুন ! লিখবেন তো কাকু ?

– এখন তো আমি সিরিয়াসলি তোমার গল্পটা লেখার কথা ভাবছি অন্তরা। তবে নাম-টাম, জায়গা এসব একটু পালটে দিতে হবে।

– সে আপনি পালটে দিন। আপনার বই বেরোলেই সিনেমা হয়ে যাবে সেটা, আমি ঠিক জানি । আচ্ছা কাকু, যদি সিনেমা হয়, তাহলে কি ডাইরেক্টর বা ওরা সবাই  আপনাকে জিজ্ঞেস করবে নায়িকার রোলে আপনার কাকে পছন্দ ?

হিরণ্ময় মজা পেলেন প্রশ্নটা শুনে । হাসিমুখে বললেন, নাহ, সিনেমার কাহিনীকারকে সেসব জিজ্ঞেস করার চল আছে বলে তো আমার জানা নেই। কিন্তু কেন বলতো, এই প্রশ্ন করছো ?

– না, মানে, আমার ইচ্ছে, ইন্দ্রাণী হালদার যদি অন্তরার রোলটা করে বেশ ভালো হবে। খুব মানাবে ওকে। তাই না ?  বলুন কাকু ?

হিরণ্ময় হেসে ফেললেন ।

হাসতে হাসতেই কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই অন্তরা পিছনের দিকে হাত দেখিয়ে বলে উঠলো, ওই যে বিকাশ আমার গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছে ! আপনার বাস তো এখনও এলো না কাকু ! সময় তো হয়ে গেছে !

হিরণ্ময় অন্তরার  দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটা চারচাকার ছোট ভ্যান ঠিক স্ট্যান্ডের ওপাশে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালো।

ভ্যানের দেওয়ালের মাঝখানে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘সরলাবালা হোম ডেলিভারি’, বাদামতলা, বর্ধমান । বাঙলায় লেখা , তার নীচে ইংরেজিতে, বড়ো বড়ো করে ফোন নাম্বার দেওয়া আছে । লেখার ওপরের খালি জায়গাটায় একটা বিরাট থালার ছবি, থালায় ভাত, বোধহয় কিছু ভাজাভুজির ছবি আর থালার চারপাশ ঘিরে অনেকগুলো বাটি, সেগুলোতে নানারকম ব্যঞ্জন।

ভ্যানটা দেখে চমৎকৃত হিরণ্ময় অন্তরার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অন্তরা হাসিমুখে বললো, সরলাবালা…আমার ঠাকুমার নাম। এবার ব্যাঙ্কের লোনটা পেয়ে গেলেই বাড়ির একতলাটা ঠিকঠাক করে ওখানে একটা ভাতের হোটেল খুলবো।  ঠিক করেছি, নাম দেবো ‘সরলাবালা ভাতের হোটেল’ ! বাদামতলার কাছেই কোর্ট, রেজিস্ত্রার অফিস, আমাদের মহল্লায় আছে দু-তিনটে ডাক্তারের ক্লিনিক, নার্সিংহোম। সেখানে সারাদিনভর লোকজনের ভিড়। ভাতের হোটেল শুরু করলেই জমে যাবে কাকু।

– ওহ, তোমার হোটেলের নাম দেবে শুনে মনে পড়লো অন্তরা। কিছুদিন আগে একটা বই দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে জানো…বইটার নাম ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ !

– জানি তো ! বইটা পড়িনি, কিন্তু সিরিজটা দেখেছি টিভিতে। দারুণ, খুব ভালো লেগেছিলো। আমি এবার যাই কাকু ? আপনাকে এখন একা একা আরও কিছুটা সময় কাটাতে হবে ।

অন্তরা উঠে পড়লো । হিরণ্ময় উঠে পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে এখানে দেওয়া নাম্বারে একটা ফোন কোর, তাহলে আমি তোমার নাম্বারটা সেভ করে নেবো। তোমার কাহিনীর বই বেরোলে তোমাকে পাঠাতে হবে তো ! বলে হিরণ্ময় হাসলেন।

অন্তরা একটু ভুরুটা কুঁচকে হাসিমুখে বললো, আহা, আপনাকে সেভ করতে হবে কেন ! আমারও কার্ড আছে ! এই যে, ‘সরলাবালা হোম ডেলিভারি । ক্যাটারারস এন্ড হোম ফুড সাপ্লায়ারস। সবরকমের অর্ডার নেওয়া হয়। প্রোপ্রাইটার অন্তরা হালদার’। এটা রাখুন কাকু । দুটো ফোন নাম্বার দেওয়া আছে । মোবাইলটায় করবেন। পরেরবার বর্ধমান এলে কিন্তু অবশ্যই লাঞ্চ আমার ওখানে। আমি তো বাড়িতেই থাকি। মনে থাকে যেন। আসি কাকু। সাবধানে যাবেন ।

অন্তরা গাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো ।

কিছুটা গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে প্রায় দৌড়ে ফিরে এসে তড়বড় করে বললো, বইটা আপনি লিখবেন যে সেটা তো আমি জানি। তবে কাকু আমাকে, মানে আপনার নায়িকাকে ওইরকম বুড়ি করবেন না যেন, প্লিজ। আর তাছাড়া, ইন্দ্রাণী হালদারকে বুড়ি একদম মানাবে না । আসি, কাকু ?

হিরণ্ময় কিছু বলার আগেই ডানহাতটা নেড়ে দিয়ে অন্তরা দৌড়ে তার গাড়ির দিকে চলে গেলো ।

হিরণ্ময় তাকিয়ে দেখতে দেখতে পেছনে একটা মৃদু ঘর্ঘর আওয়াজ শুনলেন।

কোলকাতা-বোলপুর-তারাপীঠ যাওয়ার ভলভো বাসটা ধীরে ধীরে চ্যানেলে ঢুকে দাঁড়িয়ে গেলো ।

[বানানবিধি ও মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ