12 Jun

ভেবলির নতুন বছর

লিখেছেন:রূপা সেনগুপ্ত


ভেবলির নতুন বছর রূপা সেনগুপ্ত

আকাশে তামাটে হলুদ চাঁদ। তিনমাথার মোড়ে পুবদিকে একফালি গোল মেঠো জমি।   পাড়ার বাচ্চামেয়েরা কিৎ কিৎ খেলে সেখানে। আজ ন্যাড়াপোড়া হবে। দোলপূর্ণিমার আগের দিন রাতে শুকনো ডালপালা জোগাড় করে ন্যাড়াবুড়ি বানিয়েছে ভূদেব। কোলে ছোটভাই হরিকে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ভেবলি। সবিতা ভেবলির দিকে তাকিয়ে বলে, যা ঘর থেকে আলু আর বেগুন নিয়ে আয়। পুড়িয়ে নিবি এখানেই। ভেবলি নিজের মনে ভাবে, ঘরে আলু বেগুন থাকলে তো! বাবার শরীর খারাপ।বাবা দুদিন কাজে বের হতে পারেনি।ভেবলি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।শৈলদাদা না এলে ন্যাড়াবুড়িতে আগুন দেওয়া হবে না। ঠিক এই সময় কোলের ভাইটা কেঁদে ওঠে। ঘরে ফেরে সে এবার। মায়ের কাছে গিয়ে বলে – নাও, ওরে দুধ দাও। কানতাসে।
সরলা ছেলে কোলে নিয়ে আঁচলে মাথা ঢেকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বলে,
– চইলা আইলি!
– কী করমু, এমন কানতে লাগল। মা ঝুড়িতে আলু বেগুন কিছু আছে?
– না রে। ফুলজেঠির ঘরে গিয়া দেখ।
– যামু? যাই তাইলে।একটা আলু আর একটা বেগুন হইলেই হইব।
ভেবলি দৌড়ে যায়।

হোলিকার সঙ্গে পাড়ার বাচ্চাদের আলু বেগুন পোড়ান হয়ে যায়। দূরে দাঁড়িয়ে দেখে ভেবলি। খিদে পায় তাঁর। আগুন নিভে এলে কঞ্চি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা হয় ওই সবজিপোড়াগুলো। একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে আলু আর বেগুন নিয়ে বাড়ির পথ ধরতে গিয়েও ধরে না ভেবলি। সবাই চলে গেলে নিভন্ত ন্যাড়াপোড়ার কাছে গিয়ে কঞ্চিটা নিয়ে আরো একটু খোঁচাখুঁচি করতেই বের হয় একটা পোড়া টমেটো ও একটা আলু। খুশিতে মন ভরে ওঠে। রাত হয়ে যাওয়ায় সবার বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। তাই এটুকু বাড়তি প্রাপ্তি তার হল!
বাড়ি ফিরে ওগুলো মায়ের কাছে দিলে বেশ করে লংকা ডলে মাখে মা।ভেবলি ভাইকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে দেখে তার মা থালায় ভাত নিয়ে একটু একটু করে ওই পোড়া আলু বেগুন টমেটো মাখা দিয়ে থালা সাজায়। তারপর হ্যারিকেনটা এক হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে মাঝের ছোটঘরের মেঝেতে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে আগে খেতে দেয়। এরপর ওষুধের দোকান থেকে কিনে আনা জ্বর কমার ওষুধ খাবে বাবা। বাবার খাওয়া শেষ হলে সে আর মা খাবে। আজকের মতো একটা দিন যেন শেষ হল। ভেবলি ভাবে এভাবে টেনেটুনে তাঁরা কবে থেকে যেন চলছে কে জানে! আর কত দিন এভাবে চলবে তাই বা কে জানে!

পুকুরটার অন্য কোনও নাম থাকতেও পারে কিন্তু লোকে বলে পদ্মপুকুর। দুগ্গাপুজোর সময় অনেক পদ্মফুল ফোটে। দুনি, আলো, সাধনা মানে ভেবলির বন্ধুরা সাঁতরে ফুল তোলে। ভেবলি জলে নামতে ভয় পায়। ও সাঁতার জানে না। শুধু বলে, আমারে একটা পাতা ছিড়া দিবি? বেশি বড় লাগবো না।
পদ্মপুকুরের লাগোয়া জমিতে করিমচাচার ঘর। চাচার বুড়ি-খালামা ডাক দেয়।
– তুই পাতা নিয়ে কী করিস রে?
– ভাত খাই।
– তাই বল। ফুল নিস না কেন?
– আমার ফুলের দরকার নাই গো দিদা।
পুকুরঘাট থেকে উঠে ঠিক বা-দিকে হাঁটলে একটা ছোট আমবাগান। তার পাশেই কিছুটা বুনো, নাম না জানা গাছের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা তাল আর নারকেল গাছ। সব মিলিয়ে একটা হালকা জঙ্গল। ওই জঙ্গলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির একচালা দুটো ঘর। ওই ঘরে বাস করে বুড়ি ননিবালা দাসী। তিনি নাকি ফরিদপুরের কোন গ্রাম থেকে ভাশুরপোর হাত ধরে এপারে এসেছিলেন। তাকে এ পাড়ার সবাই বড়মা বলে ডাকে।
ভেবলি ভাবে একবার বড়মায়ের খোঁজ করে বাড়ি ফিরবে।
বড়মার ঘরের সামনে বনতুলসীর বেড়া দেওয়া একফালি উঠোন। এক কোণে হাতচাপা জলের কল। পাশে দুটো গাই বাঁধা।
ভেবলিকে দেখে একগাল হেসে ওঠেন ননিবালা। দাওয়ায় বসতে বলে হাতে দুটো নাড়ু দেন। ভেবলিকে উনি ডাকেন স্বপ্না নামে। তাঁর এই নাম অবৈতনিক প্রাইমারি ইস্কুলের খাতায় লেখা আছে। লাবণী দিদিমণি খাতা খুলে নাম ডেকে দেখেন কে কে উপস্থিত। তখন উনি কেমন একটা উঁচু গলায় ডাকেন রোল নম্বর চার, স্বপ্না দাস। ভেবলি উঠে দাঁড়িয়ে বলে, উপস্থিত। বাড়িতে এই নামে কেউই ডাকে না। একটু বেশি শান্ত স্বভাব আর মুখচোরা হওয়ায় মেজপিসি আহ্লাদ করে সেই যে কবে ভেবলি বলে ডেকেছিল সেই নামই পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে গেল! ওর হাতে একটা নারকেল ধরিয়ে দিয়ে বড়মা বললেন, বাড়ি নিয়া যা। পথে কুড়িয়ে পাওয়া দুটো কাঁচা আম বড়মার হাতে তুলে দেয় সে। তারপর বড়মার উঠোন থেকে কয়েকটা গিমাশাক তুলে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
পদ্মপাতা হাতে ঘরে ফিরে  ওই পাতায় ভাত খায় ও। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত , শুকনা মরিচ ভাজা দিয়ে আলুসিদ্ধ মাখা আর বেগুন দিয়ে গিমাশাক ভাজা।
আজকাল খাওয়া শুরুর আগে ঝাল ছাড়া অল্প ভাত ভাই হরির মুখে দেয় ভেবলি। ভারী সুন্দর দেখতে ওর ভাইটা। বড় বড় চোখ, কোচকানো কোচকানো চুল, বড্ড মায়া লাগে ভেবলির। আদর করে বেশ খানিকটা ভাত খাইয়ে দেয় সে।
মা অনেক নিশ্চিন্ত বোধ করে। পেট ভরা ভাত খেয়েছে ছেলেটা। দুধের জন্য আর কাঁদে না। খানিক বাদে ঘুমিয়ে পড়ে।

বাবা অনেকটাই সেরে উঠেছেন। আজকাল কাজে বের হচ্ছেন। এবার দোলপূর্ণিমা চৈত্র মাসে পড়েছে। মা বলে বেশিরভাগ সময় ফাল্গুন মাসেই দোল উৎসব পড়ে। ওদের বাড়িতে এইদিন নিরামিষ রান্না হয়। আসলে অনটনের কারণে এখন প্রায়ই নিরামিষ খেতে হয়। একসময় নাকি বাবার বাবা মানে ঠাকুর্দা একদম মাছ ছাড়া ভাত খেতে পারতেন না। সেসময় তাঁদের গ্রামের বিলে নাকি অনেক মাছ পাওয়া যেত। ঠাকুর্দা মাছ ধরে আনতেন। আর এই রকম যে সব দিনে মাছ খাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল সেসব দিনে ঠাকুর্দার নাকি ভাত খাওয়া কমে যেত।
এখন মাছ খুবই কম খায় ওরা। ভেবলি মায়ের মুখে শোনে, যে কোনও মানুষের কাছে ভিটার টান বড় টান। তাঁর ঠাকুর্দা  ফাঁকা গুড়ের  ডিব্বায় ভরে এনেছিলেন ভিটাবাড়ির এক খাবলা মাটি। ভারতের মাটি ছোঁয়া অব্দি আগলে আগলেই রেখেছিলেন সেসব। ভারতে এসে তাঁরা আতান্তরে পড়লেন। ঠাকুরদা আর বাবা সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তেন বাইরে কাজ খুঁজতে। এইভাবেই একদিন বাবার সঙ্গে তাঁর নরেশ কাকার দেখা হয়ে যায়। তিনিই বাবাকে এই কাপড়ের দোকানের কাজটুকু জুটিয়ে দেন।
এবার বড্ড গরম পড়েছে। মা ঘর বাড়ি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। তারই মাঝে চলছে সেলাইয়ের কাজ। ওদের নতুন জামাও তৈরি হবে। গরমের হাত থেকে বাঁচতে আগে নাকি দেশগ্রামের বাড়িতে খাওয়া হতো গমের ছাতু, দই ও পাকা বেল দিয়ে বানানো এক বিশেষ শরবত। এই শরবতেই প্রাণ জুড়িয়ে নিতো  ছোট বড় সবাই। কেবল তাই নয়, সংক্রান্তির দিন গ্রামের হাটে কোনও কোনও দোকানে বিক্রেতারা ক্রেতাদের এই শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।
ওদের এই বাসায় একটা বেলগাছ আছে। সকালে মাঝে মাঝে জুটে যায় বেলপানা। তাঁর মা বেলের সরবত বলে না, বলে বেলপানা।
মাঝে মাঝে দুয়েকদিন হাল্কা ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। আর কয়েক দিন পরেই চড়কের মেলা বসবে তাঁদের বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাসে করে যেতে হয়।
সংক্রান্তির আগের দিন নীল পূজা। তাঁর মা নীলের উপোস করে। শিবেরই পূজা। সমুদ্রমন্থনকালে উত্থিত বিষ কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ, তাই নীল পূজা। মায়েরা নীলের উপোস করে সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
ভেবলি এবার মেলায় গিয়ে পুতুল কিনবে। মাটির ভাঁড়ে খুচরো যে পয়সা ও জমায়, তা নিয়ে সে মেলায় যাবে।এখন শুধু দিন গোনা কবে সংক্রান্তির দিনটা আসবে!

সন্ধ্যাবেলায় গা ধুয়ে কালো কার দিয়ে চুলে বিনুনি করে কপালের টিপটা পরে মা। ভেবলি সহজপাঠ বইটা খুলে বসল। চুপচাপ মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে।কী সুন্দর দেখতে তাঁর মাকে।সাধারণ সুতির ছাপা শাড়িতেও তিনি যেন অপূর্বা! মা সেলাই মেশিনটা নিয়ে বসে। আর কদিন পর পয়লা বৈশাখ। মেজপিসি সবাইকে টাকা দিয়েছিলেন, তা জমিয়ে চৈত্রসেলে  ছিটকাপড় কেনা হয়েছে। নিজের হাতে ছেলে মেয়ের জন্যে জামা তৈরি করবে ভেবলির মা সরলা। এছাড়া তারা-মা বস্ত্রালয়ে ছোটদের যে টেপজামা আর ইজের বিক্রি হয় তা সেলাই করে তার মা। মাঝে বেশ কিছুদিন সেলাইয়ের কাজ বন্ধ ছিল। ভাইয়ের জন্মের তিনমাস পরে আবার কাজ শুরু হয়। মা এসময় প্রায়ই ফুলজেঠিকে বলত, দিদি সেলাইয়ের কাজটা বন্ধ হইয়া গেলে খামু কী! আমার আর পোলাপানের দরকার ছিল না। আপনার দেওর কয় এক সন্তানে ভরসা কী! আমার মাইয়াটা বড্ড ভাল।মানুষের মতো মানুষ হইলে কি পোলা আর মাইয়ায় কোন ফারাক থাকে?
এপাড়ায় পয়লা বৈশাখের আকাশে সূর্য ওঠে ঝলমল করে।আমবাগান থেকে ছিড়ে আনা পাঁচ পাতার আমের পল্লব। সেই পল্লবের কাঁচা মিঠে সুবাসে শিশুমন নেচে ওঠে চড়াই পাখির মতো। সব বছর তো সমান যায় না। কখনও বিকেলে  হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় নেমে আসলে মন ভারী হয় সকলেরই। মাঠ আর রাস্তার ধুলোয় ঝাপসা হয়ে যায় দিগন্তিকা। টুপটাপ আম পড়ে মাটির পরে। এবার বুঝি বৃষ্টি হবে। কচি হাতে আম ধরে রাখা মুখ বুক ভিজিয়ে কখনও নামে বারিধারা।
প্রতিবার নতুন বছরে বাবার হাত ধরে যায় শ্যামলকাকুর দোকানে। হালখাতার নেমন্তন্ন। দোকানের সামনে  দরজায় আম্রপল্লব দিয়ে সাজানো, সিঁদুর লাগানো। দুয়ারে মঙ্গলঘট। নজরটা থাকত এবারে প্যাকেটে কী থাকবে? শ্যামলকাকুর দোকানের পর অর্জুনকাকুর দোকান। বৈশাখ শুরু মানেই শুরু রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল। হাসি পিসিদের বাড়িতে। ভেবলি খুব সুন্দর নাচ করে। রান্নাবান্না শেষ করে ওর মা নাচ শেখায়। মা নাকি দেশের বাড়িতে এসব শিখেছে। তাঁর কোন মাসির কাছে। এদেশে এসেছে এগারো বছর বয়েসে। মা বলে, যে বছর দেশ স্বাধীন হয় সেবছর আশ্বিন মাসে নাকি তাঁর জন্ম। তারপর তো ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু দেখেছেন। ছেড়ে এসেছেন নিজেদের প্রিয় ভিটে মাটি ও প্রতিবেশী। কী আর করা!
এবার পয়লা বৈশাখ যেন একটু অন্য রকম। মা সাত সকালে উঠে স্নান করে নতুন কাপড় পরে তৈরি। হাতে অনেক কিছু, পুজোর বাসন ফুল ফল বেলপাতা! কোথায় যাচ্ছে মা! মেজ পিসিও ভোর ভোর এসে হাজির। কোলে ভেবলির ভাইকে নিয়ে আর ব্যাগ ভর্তি টুকিটাকি জিনিস নিয়ে প্রস্তুত সেও। মা বাবা পিসি মুচকি মুচকি হাসছে।
একটু পরে ওরা বাজারে পৌঁছয়। দেখে একটা দোকান ঘর। সামনে দুয়ারে দুই পাশে দুটো কলাগাছ ফুল আর আমার পল্লব দিয়ে সাজানো দুয়ার। ঘরের ভিতর তাক ভর্তি সাজানো নতুন নতুন জামা ইজের প্যান্ট।এ নাকি তাদের! শ্যামলকাকু, অর্জুনকাকু সবাই হাজির। প্রতিবেশী কাকুদের কে যেন দোকানের সাইন বোর্ডটা এনে সোজা করে ধরল। হারানকাকু এল মই নিয়ে।ওটা দোকানের মাথায় লাগিয়ে দাওয়া হবে। ভেবলি তাকিয়ে দেখে তাতে বড় করে লেখা ‘স্বপ্না স্টোর্স।’ আরে এত তারই নাম। নিচে  আবার একটু ছোট হরফে লেখা এখানে বাচ্চাদের রেডিমেড সব রকম জামা পাওয়া যায়, মাপ নিয়ে সেলাই করার ব্যবস্থাও আছে।
মা আর বাবা ভেবলিকে কাছে ডেকে বলল, কী রে আয়।
ভেবলি একদম ভ্যাবলার মতো আনন্দে কেঁদে ফেলল।

 

Tags: , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ