গ্রামে গঞ্জে শহরের আনাচে-কানাচে কত যে ঘটনা ঘটে যায় তার খবর আমরা কি রাখি। কতটুকু রাখতে পারি।নদীর ধারে সাজানো-গোছানো গাছ গাছালি ঘেরা সেরান্দি গ্রাম।
এই গ্রামে একটা হাই স্কুল ছিল।
রুনু নামে, একটা মেয়ে পড়ত এই স্কুলে। যখন অঙ্কের ক্লাস হতো, তখন দিদিমণি দেখলেন অংক না করে রুনু ছবি আঁকছে। আবার বাংলার ক্লাসে মাস্টারমশাই গেলেন তখন ও দেখলেন বাংলা না লিখে সে ছবি আঁকছে। রুনু খুব বকা খায় মাস্টার দিদিমণিদের কাছে। তবু সে ছবি আঁকা ছাড়তে পারে না।বাড়িতে বাবা মা বারবার বলে ছবি আঁকা বাদ দিয়ে তুই পড়াশোনা কর।পড়াশোনা না করলে তোর ভবিষ্যৎ মাটি হয়ে যাবে।
কি করে পাশ করবি মাধ্যমিক। তারপর রুনু মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলো। পাশ করল কোনরকমে। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করল। কিন্তু কলেজে পড়ে আর গ্রাজুয়েট হতে পারল না। এখন তার বয়স একুশ বছর। তারপর আর পড়াশোনার চাপ নেই।অখন্ড অবকাশে শুধু ছবি আঁকে সে।
এক মাসে ঘুরে বেড়ালো মা-বাবার সাথে দিঘার ও কলকাতার আনাচে-কানাচে। কত রকমের ছবি যাদুঘরের দেয়ালে দেখল সে।
সেগুলোর উন্মুক্ত ছবি আঁকল সে। দিঘার সমুদ্রের ধারে বসত সে অনেকক্ষণ।বসে বসে ছবি আঁকত সাগরের। ঝাউবনে হারিয়ে যেত তার মন।
তার সুন্দর ছবি দেখে দর্শকরা বাহাদুরি দিত।
বাবা বলতেন, তুই এখানে এসে ঘুরবি না শুধু ছবি এঁকে যাবি।
রুনুর মাত্র একুশ বছর বয়সে বিয়ের যোগাযোগ করতে শুরু করল কারণ তার বাবা গরীব চাষী।
কম টাকায় ব্যবস্থা হল ঘোরার। তাই রুনু ঘুরতে পেল।না হলে কোনদিন সে বাইরে যেতে পারিনি ঘুরতে সুযোগ পায়নি। কলকাতায় এসে মামার কাছে ছিল। ওখান থেকেই ঘোরাঘুরির ব্যবস্থা হয়েছিল রুনুর। এখানে এসে রুনুর সঙ্গে পরিচয় হল একটি ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি খুব মিশুকে নয়। একা থাকতেই পছন্দ করে বেশি।সে রুনুকে তার জীবনের কাহিনী শুনিয়েছিল সাগরপাড়ে। ছেলেটির বয়স আটাশ বছর। সে বলেছিল, একমাত্র মা ছাড়া আমি কারো কাছে প্রিয় ছিলাম না। তবুও নীল আকাশ সমুদ্রের জল হাতছানিতে বারবার ছুটে আসি সমুদ্রের ধারে।
প্রথমবার বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম সমুদ্রে যাব। কলকাতা থেকে ট্রেন ধরে কয়েক ঘন্টা পর চলে এলাম একদম দিঘা। প্রথম সমুদ্র দর্শনে এসে সমুদ্র দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি আকাশের নীল সমুদ্রের নীল একাকার হয়ে গেছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই বৃহৎ সমুদ্র দেখে।
কত ছোট আমরাই সাগরের কাছে। তারপর লজ ভাড়া করে আমরা সব বন্ধুরা চলে গেলাম সেখানে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা লজের মালিক করতেন। প্রত্যেকদিন সামুদ্রিক মাছ ভেজে খেতাম আবার দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় পেতাম। লজের মালিক বললেন এখানে এলে শুধু মাছ খাবেন বিভিন্ন রকমের মাছ খেতে ভালো লাগবে।
সমুদ্রস্নান মনে রাখার মত এই সমুদ্র স্নান করতে বারবার ভালো লাগতো বারবার ছুটে চলে যেতাম সমুদ্রের ধারে সেখানে পাথরে বসে থাকতাম আর দেখতাম ঢেউয়ের পর ঢেউ।
পুলিশ মানা করত এ পাথরের ফাঁকে বিষধর সাপ ও থাকে তাই তারা বলত অন্য জায়গায় বসবেন এসব জায়গায় সাধারণত কেউ বসেনা।
সন্ধ্যাবেলায় সমুদ্রের ধারে বসে ঢেউ গুনতে আর বন্ধুরা আনন্দে মউজ করতো আমি একা এক পাশে ঝাউবনের মধ্যে গিয়ে ঘুরতাম সেখানে আমার আরো ভালো লাগতো।
আমার এক বন্ধুর নাম ছিল গৌতম। গৌতম এর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে যেতাম সমুদ্রের ধারে ধারে। ছবি তুলতাম কত সেইসব ছবি এখনো মনের মনিকোঠায় চির অমর হয়ে আছে। এখনো ভুলতে পারিনি সেই সব দিনের কথা।সকলের সাথে আমি সহজভাবে মিশতে পারি না। কিছু কিছু বন্ধু আমার খুব প্রিয় ছিল। তারা বুঝতো আমার অন্তরে কথা। আমার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল তাই তাদের সঙ্গে আমার বেশি ভালো লাগত।
আমি দেখতে খুব স্মার্ট নই কালো দোহারা চেহারার এক অসুন্দর যুবক। আজ অব্দি আমাকে দেখে কেউ প্রেমে পড়েনি। আমি কারো প্রেমে পড়িনি। আজ কিন্তু আমি প্রকৃতির এই সমুদ্রের প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রেম যে কত মধুর একমাত্র যার হয়েছে সেই জানে।
সেখানে পরিচয় হলো এক মেয়ের সাথে তার নাম সোমা। সোমা খুব সুন্দর দেখতে কি করে আমার মত একটা কালো ছেলে প্রেমে পড়ে গেল। সোমা এতটাই ভালবেসে ফেলল যে আমার সঙ্গে লজে যেতেও কুণ্ঠাবোধ করল না।
পরেরদিন সকালে এসো সোমা আমাকে বললো চলো সমুদ্রসৈকতে ঘুরে আসি। বলল হাতটা দাও হাত ধরে আমরা দুজনে একসাথে হাঁটবো দেখবে কত লোক দেখবে। আমরা খুব মজা পাবো। তারপর আমি তার হাত ধরলাম আঙ্গুলে আঙ্গুলে সাথে ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে গেল তারপর হৃদয় শিহরিত হতে লাগল আমি বললাম তোমার কি অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে হচ্ছে। সোমা বলল হ্যাঁ হৃদয় খুলে যাচ্ছে। আমি বললাম আমার হৃদয় ভিজে যাচ্ছে ভালোবাসায়।
কোনোদিন ভাবতে পারিনি এত সুন্দরী এক মেয়ে আমাকে ভালোবেসে ফেলবে। আন্তরিক ভালোবাসা।
তার বাবা-মায়ের সঙ্গে তারা অন্য জায়গায় ঘোরে। কিন্তু সে চলে আসে আপন মনে আপন খেয়ালে সমুদ্রের ধারে। সেও সমুদ্র ভালোবাসে। আর এই সমুদ্র যেন আমাদের মিলন ঘটিয়েছিল।
সোমা বালি নিয়ে সমুদ্রসৈকতে কি সুন্দর এক দেবী প্রতিমা তৈরি করেছিল। যেটা ঢেউয়ে সে আবার ভেসে চলে গেল।।
আমি বললাম আমাদের প্রেম এরকম হবে নাতো। বালির ঘরের মতো। সোমা বলল জীবনে তো তাই জীবনে তো বালির ঘরের মতো একদিন ভেসে যাবে সব ঘর। সোমা আরও বলল তবে যতদিন বাঁচবো আনন্দ করে বাঁচবো এসব চিন্তা করে লাভ নেই এস এখন আনন্দ করি। সোমা আমাকে মানুষ করে ধরেছিল আমি মানুষ ছিলাম না আমি কারো সাথে মিশতে পারতাম না ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতাম না কিন্তু তোমার প্রেমে পড়ার পর আমি বুঝতে পারলাম জীবন কি।
সোমা বলল জীবন অদ্ভুত শিল্প যে শিল্পী এই শিল্প ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই তো সার্থক জীবনে দুঃখ কষ্ট আছে তাকে বড় করে দেখলে হয়না তাকে ভুলে গিয়ে সব সময় আনন্দে থাকতে হয় সেই আনন্দের খোঁজে থাকতে হয় শুধু আনন্দ শুধু আনন্দ এই আনন্দের অপর নাম দেবতা বা ঈশ্বর।
সোমা বলল আমরা শুধু টাকা পয়সার পিছনে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু এই আনন্দের পিছনে যদি আমরা ঘুরে বেড়াতে পারতাম তাহলে জীবনে এত সুন্দর অনুভব হত যে জীবনকে ভালবাসতে ইচ্ছে করত কিন্তু আমরা পারি না আমরা শুধু টাকা পয়সার পিছনে ছুটে বেরিয়ে আমাদের জীবনের মূল্যবান সময়টা নষ্ট করি।
সোমা বলেছিল তুই কোন জাত পাত নয় মানুষই একমাত্র ধর্ম মানবতা একমাত্র ধর্ম মানুষকে ভালোবাসায় একমাত্র ধর্ম এসো আমরা ভালোবেসে মানুষকে ভালবাসতে শিখো। এস জগতকে ভালবাসতে শিখি।
তারপর আমরা বিয়ে করেছিলাম এক মন্দিরে।সোমার মত অনুযায়ী হিন্দুমতেই আমরা বিয়ে করেছিলাম।
আমি বাড়ি নিয়ে গেছিলাম তাকে। আমার বাবা-মা কিন্তু কোন অমত করেননি তাকে গ্রহণ করেছিল সুন্দরভাবে। আর তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিল বাড়ির সকলে।
সোমা আমার বাড়ি পরিবেশ পাল্টে তুলেছিল সবাই তাকে ভালোবাসতো সবাইকে থেকে এসে ভালোবাসার কথাই বলতো।
কিন্তু ভাল লোকেরই তো কষ্ট বেশি। সোমার এক কঠিন অসুখ হল। সমস্ত মায়া ছেড়ে সে একদিন চলে গেল অজানা দেশে।
নিজের জীবনের গল্প বলার পরে ছেলেটি রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিল রুনুকে। রুনুর খুব ভাল লেগেছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি বলল আমাদের গ্রামও তোমাদের গ্রামের পাশে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব ফিরে গিয়ে।
রুনু কলেজে পাশ করতে পারেনি।
তাই গ্রামের পাশেই নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকলো মন খারাপ করে। সে দেখল নদী বয়ে চলেছে কুলুকুলু স্বরে আর চারিদিকে গাছগাছালি। এখানে পাশ ফেলের সংজ্ঞা আলাদা।
বালিতে পা ঢুকিয়ে এসে বসে থাকল।রুনু দেখল ধীরে ধীরে সেই গো পায়ের গর্তটা জল জমে যাচ্ছে একদম বিশুদ্ধ জল। হাত দিয়ে পাশে আরো বড় বড় গর্ত করল মুহূর্তে গর্ত জলে ভরে গেল। সেই জলের কত রকম রং-বেরংয়ের মাছ। দাঁড়কে, তেচোখো,খলসে মাছ খেলা করতে লাগলো।
ভিজে বালি থেকে পা বের করল। একটা ঘরের মতো হয়ে গেল বালির গর্তটা।তার মন ভাল হয়ে গেল। রুনু ছেলেটিকে ভালবেসে ফেলেছে।বালির ঘর আর জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
বাড়ি গেলেই রুনুকে বকা খেতে হয় বাবা-মা বলেন তুই শুধু নদীর ধারে যাবি জলে পা ভিজিয়ে বসে থাকবি ঠান্ডা হাওয়া লেগে তোর কঠিন অসুখ হবে একদিন দেখবি তোকে আর ভালই করা যাবে না। কিন্তু রুনু যে নদীর ধারে না এসে পারেনা বটগাছের সঙ্গে কথা না বলে তার মন তো ভালো থাকে না সে কি করে ঘরে থাকবে তাই সে লুকিয়ে পালিয়ে আসে নদীর ধারে। নদীর ধারে এসে সেই বট গাছের তলায় এসে বসলো বসে বট গাছের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। বটগাছের কাছে রুনু বলল, একবার সাগরপাড়ের ছেলেটাকে ডেকে দাও।
ও মা, ঠিক পরের দিন ছেলেটা নদীর ধারে হাজির। বাটুবাবা তার কথা রেখেছে। বটগাছটার রুনু নাম দিয়েছিল বাটুবাবা। নদীর ছলছলে জলে পা ডুবিয়ে রুনু ছেলেটাকে এবার নিজের কথা শোনালো।তার গ্রাম তার জীবনের কথা। রুনু বলল,আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু ।দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে । কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে । রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি , শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু।.চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর । ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা । এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে । তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন , দুর্গা তলার নাটমন্দির । এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা । গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা । এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম । সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না ।
কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড় । তারপর বাজারে পাড়া ,শিব তলা,পেরিয়ে নাপিত পাড়া । এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে । সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা ,তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা । কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা ।এখন সব কিছুই যান্ত্রিক । মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই । বেশ জেঠু জেঠু ভাব ।সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি । আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া , কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া । সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা , কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই ।শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।
এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান ।
রুনু ছেলেটাকে আবার বলল,ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল । তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর । পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত । একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব । তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না । মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না ।তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ ।
ছেলেটিও বলল, মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি । হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে ।
রুনু বলল, শোন না। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে । পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে । মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না । শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না । পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই । জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন । মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে । তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম । প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে ।আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম । সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম । পরের দিন দধিকর্মা । খই আর দই । পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল । তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।
ছেলেটা বলল, তোমার গ্রাম খুব সুন্দর। বটগাছটার তলায় বসি চল। রুনু বলল, এই বটগাছ আমার পিতৃসম। আমার বাটুবাবা। ছেলেটি বলল, আমি কথা বলব। সে বলল, রুনুকে আমার করে দাও বাটুবাবা।রুনু ভাবে, আমি দূরে চলে গেলে বাটুবাবার মন খারাপ হবে তো।
ছেলেটি বলল,গাছের মন খারাপের কোন ব্যাপারই নেই।হয়ত আছে। মানুষ বোঝে না সেই ব্যাথা।
রুনু তার প্রিয় বাটুূবাবাকে মনের কথা বলে। সে বল, বাটুবাবা সবুর করার কথা বলতে চায়।
একমাত্র রুনু বোঝে সেই কথা।
তারপর সন্ধ্যাবেলা বাড়ি এলো। দাদু ঠাকুমা দিদি দাদা বাবা-মা সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। বাবা বললেন তোর আর পড়ে কাজ নেই তোর বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো।
তার দাদা বলে,গ্রামে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রথা এখনো বন্ধ করা যায়নি। সমাজের লোক এবার সচেতন হচ্ছে।
রুনুর দাদা বাবাকে বাধা দিয়ে বলল না বাবা এই অবস্থায় রুনুর বিয়ে দিও না। এখনো কিছু বোঝেনা। ও এখন ছবি এঁকে দেখবে একদিন বড় শিল্পী হবে।
সংসারেও সামলাতে পারবে না ও। সবসময় ছবি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দাদু ঠাকুমা মা দিদি সবাই বাধা দিল এই বিয়ের বিরুদ্ধে সকলে। তখন বাধ্য হয়ে তার বাবা মত পাল্টালেন।
রুনু এখন ছাদে বসে থাকে।আর্ট কাগজ আর রঙ পেন্সিল নিয়ে।আর ছবি আঁকে সেই পরিচিত ছেলেটির অবয়বে দুঃখের কঙ্কাল কোলাজ।
তার পেন্সিল বক্স নিয়ে শেষ বিকেলে নদীর ধারে তার পাশের প্রকৃতির বৈচিত্রের ছবি আঁকল আজ।
ছবি আঁকলেই রুনু মনটা ভালো হয়ে যায়। অজানা দেশে যেন মন হারিয়ে যায়।
সে খুঁজে পায় কত রঙ বে রঙের পাখি।
কত রং বে রঙের পৃথিবীর আলো।
সমস্ত না পাওয়ার দুঃখ গুলো সে ভুলে যায় যখন সে ছবি আঁকে।
তার এক বান্ধবী ছিল রমা। সে বলল তুই তো খুব সুন্দর ছবি আঁকিস।তুই এই ছবি নিয়ে থাকতে পারিস।এই ছবিই তোকে জীবনের পথ দেখাবে।
রুনু নদীর ধারে বসে থাকে আর ছবি আঁকে। তারপর ছবিতে রং বসায়। জলরং বসিয়ে সে একদম ছবিকে বাস্তব করে তোলে।
একটা বট গাছের তলায় নদীর ধারে এসে বসে থাকে একা। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বেশি মেশে না। একা একা থাকতেই সে পছন্দ করে বেশি।
বটগাছটার সঙ্গে সে কথা বলে।
কথা বলে মজা পায়।
কথা বললেই সে ছবি আঁকে আরো ভালো। আপন মনে বলে যায় তার না পাওয়া কথা, পিতৃসম বটগাছটাকে।
গাছটা তার কথা শোনে।
কিন্তু সে তো উত্তর দিতে পারেনা।
শুধু ডালপালা নাড়িয়ে তার গায়ের ওপর দু-চারটে পাতা ফেলে দেয়। যেন মায়ের পরশ।
সেই মায়ের পরশে তার মন ভালো হয়ে যায়।
বাড়িতে যখন ঢোকে তখন সে একা হয়ে যায়। বটগাছ নেই।নদী নেই।দিদি পড়াশোনায় ব্যস্ত।দাদা খুব পড়াশোনায় ভালো।দাদু মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। বাবা-মা ঠাকুমা নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে।
রুনু নানা রকম ছবি আঁকে আর তার নিজের ঘরে।নানা রকমের ছবি তার সেই বটগাছ নদীর ধারে বসে থাকা। তার পর সমুদ্রে ছেলেটির সঙ্গে গল্প করার মুহূর্ত সবসময় মনে রাখে।
শিল্পীর মনের সাধনা বাসনা তাই ছবির আকারে প্রস্ফুটিত হয়। সেসব ছবি সংগ্রহ করে নিয়ে রাখে দেয়ালে। কোন যশ-খ্যাতি টাকা পয়সার জন্য নয় সে তার ভাল লাগার জন্যই সাজিয়ে রাখে এই ছবিগুলি। কিন্তু কস্তুরীর গন্ধের মতো প্রতিভা ও একদিন প্রস্ফুটিত হয়ে যায় সবার মাঝে তাকে লুকিয়ে রাখা বড় কঠিন।
সব ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে। এরকম টাঙ্গাতে টাঙ্গাতে একদিন ঘরের দেওয়াল ভর্তি হয়ে যায়।
দাদার বন্ধু অরিন্দমদা একদিন বেড়াতে আসেন ওদের বাড়িতে।সেখানে এসে সে গেছে রুনু ঘরে।
একবার ঘরে ঢুকেই অবাক অরিন্দমদা।
বিখ্যাত শিল্পী দাদা। সেই ছবি দেখে বুঝে যায় খুব সুন্দর শিল্পীর হাত এর ভবিষ্যৎ খুব ভালো।
সে তার ছবির দায়িত্ব নেয় ।
অরিন্দম তার বন্ধুকে বলে, তুই বোন রুনুকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। আমি ওকে আরো ভালো করে ছবি আঁকা শেখাবো।এরপর শুরু হল রুনুর পরবর্তী পর্যায়ের জীবনের লড়াই।
আরও আঁকাতে পরিণত হতে লাগলো রুনু।
শুধু লেখাপড়া না হলেই যে জীবন স্তব্ধ হয়ে যাবে তার কোন মানে নেই। সে বিকাশ ঘটাতে পারে অন্য ক্ষেত্রে। ছবি হোক বা কোন শিল্প হোক বা কম্পিউটার হোক যে কোনো একটা দিকে তার প্রতিভা বিকশিত হতে পারে।
প্রায় দুই বছর পরে দাদা আর দাদার বন্ধু অরিন্দমদা একটা চিত্রপ্রদর্শনী করলন সব রুনুর আঁকা ছবি।
সেই ছবি প্রদর্শনীতে বহু টাকার ছবি বিক্রি হলো সেই টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ি এলো রুনু। বাবার হাতে দিল জীবনের প্রথম আয়। বাড়িতে এখন খুব আনন্দ।
যে কলেজে ফেল করেছে সে আজ এত লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছে।এইটা শুনে তার গরীব বাবা খুব খুশী।
বাবা বললেন তুই কি করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলি। আমি তোর কাছে লজ্জিত। আমি তোর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু তোর প্রতিভা চাপা পড়ে যেত। এই ভুল কোনো বাবা,যেন আর না করে।
আর রুনুকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
সে তার ছবি আঁকত মনমত।
আপনাআপনি বিক্রি হয়ে যেত লোকের পছন্দে। সে এত জনপ্রিয় হয়ে গেল যে তার আঁকা ছবি শুনলেই সকলে কিনে নিত মোটা মূল্যে।
রুনু তারা ছবির দিকে যখনই তাকায় তখন সে স্বপ্নে বিভোর হয়ে যেত।
আকাশে ভাসতে ভাসতে উড়ে চলে যেত অনেক দূরে।
তার মন চলে যেতো বিদেশে। সে স্বপ্ন দেখত সে আরো বড় হবে।
সে আরো বড় হবে আরো ছবি আঁকবে।
আজ রুনু দাদুর ঘরে ঢুকেছে। সে বলল দাদু বয়স্ক লোকদের আজকাল আর কেউ সম্মান দিতে চায় না এখন ওয়াইফাই নেট আর ফোরজির যুগ।
রুনু বলল, এখনার ছেলেমেয়েরা তাদের ব্যাকডেটেড বলে।
দাদু ঠাকুমা পুরোপুরি এক্সসপার্ট সকলেই।
কিন্তু ওরা জানেনা একদিন এক্সপার্ট ছিলেন এরা নিজের নিজের কাজে।
রুনু ঘরে ঢুকলেই দাদুর মনটা ভালো হয়ে যায় সে রুনুর কথা শুনে বলল, জানিস আমি সাঁতার কেটে গঙ্গা পার হতাম।
একটানা 24 ঘন্টা সাইকেল চালাতাম।
20 পিস রসগোল্লা, দু’কেজি মাংস খেতাম কবজি ডুবিয়ে।
লাঠি খেলা কুস্তি সবকিছুতেই দাদু বাহাদুর ছিল। রেডিও ছিল সে যুগে বিনোদনের মাধ্যম। অতি আধুনিতায় শেষ হয়ে গেছে সব।
বুঝলি বড় বাইক চালানো বাহাদুরী।
ডোন্ট কেয়ার ভাব।
একদিন দেখবি, ফোর জি তেও ঝুল জমবে।
রুনুর একদিন ভাইরাস আক্রমণে খুব অসুখ হল। ভীষণ জ্বর এল।
ডাক্তারবাবু তাকে বাইরে যেতে মানা করলেন। জানলা বন্ধ।নদীর ধারে বসতে মানা করলেন।হাওয়া লাগলে নাকি অসুখ বেড়ে যায়।তিনি
বললেন, যে হাওয়া লেগে জ্বর আরো বেড়ে যেতে পারে। এমনকি ডাক এসে যেতে পারে অন্ধকারের। রুনুর বাড়ির সকলে ভয় পেল ডাক্তারবাবুর কথায়।
রুনু কয়েকদিন ধরে ঘর থেকে বেরোতে পারল না। প্রায় মাসখানেক। তবু বেআক্কেল জ্বর জড়িয়ে থাকে শরীরময়। মন স্পর্শ করতে পারে না জ্বর।
রুনু ওষুধ নিয়ম করে খায় কিন্তু কিছুতেই মন ভালো হয় না তার। মন ভারাক্রান্ত হয়ে রইলো কি করে সে যাবে নদীর ধারে,হাওয়ার কাছে, বাটুদার কাছে। রুনু বটগাছটাকে বাটুদা বলে ডাকত,কথা বলত মনের জানলা খুলে।
ডাক্তারবাবু আসেন আর মুখ গম্ভীর করে বলেন অবস্থা ভালো নয়।
আমার বেশ ভালো লাগছে না।
একে হয়তো বাঁচানো খুব কঠিন হবে।
রোগীর সামনে না বললেও তার বাবা-মাকে ডাক্তার বলেন এবং তা বলে বেরিয়ে যান উদাস মনে।
তার বাবা-মা দাদা-দাদু ঠাকুমা সবারই মন খারাপ হয়।
কি হবে আর ভালো হবে না রুনু। বাড়ির সকলের মন খারাপ হয়ে যায়। রুনু ভাবে সোমার মত সেও হয়ত মায়া ছেড়ে চলে যাবে অজানা জগতে।
বটগাছটার সে নাম দিয়েছিল বাটুদা। তাকে সে মনের কথা বলতো। সাগরপাড়ের ছেলেটার কথাও বলত।
এখন সে যেতে পারছেনা।কথা না বলতে পেরে পেট ফুলে যায়। বমি পায়।
সে ঠিক করল চুপিচুপি বাটুদার কাছে যাবে।কষ্ট করে, সে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হলো ঠিক বিকেল বেলায়।
সে চলে গেল বাটুদার কাছে।
নদীর ধারে গিয়ে বসে বলল, বাটুবাবা আমার খুব জ্বর হয়েছে। তোমার কাছে আসতে পারিনি প্রায় একমাস।তুমি কেমন আছো?উত্তরে শুধু শন শন হাওয়া বয়। রুনু বলে, আমার মন খুব ছটফট করছিল, সেই সাগরপাড়ের ছেলেটা জন্য। ওকে আমার কাছে এনে দাও আর একবার। আমি ওকে নিয়ে জীবনের ছবি আঁকব। ওর দুঃখ ঘুচিয়ে দেব। আমি ডাক্তারবাবু কথা না শুনে চলে এসেছি।নদীর কাছ থেকে হাওয়ার জলীয় স্নিগ্ধতায় রুনুর মন ভাল হল।
বাটুবাবা কি করবে। সে কথা বলতে পারেনা।ঝড়ে গাছের ডাল নামিয়ে তার পিঠে স্নেহস্পর্শ দিল।
রুনুর শরীর একদম ভালো হয়ে গেল।ডাক্তারবাবুর ওষুধে যে রোগ ভাল হয় নি, আজ খোলা হাওয়ায়, বাটুবাবা আর নদীর আদরে সে সুস্থ হয়ে উঠল। রুনু বলছে, আমার লাফাতে ইচ্ছে করছে বাটুবাবা। ভারি ফুরফুরে মন এখন আমার।আমার জ্বর কমে গেল। পেটফোলা কমে গেল। বমি বমি ভাবটা চলে গেল। নদী আর বটগাছের আদরে আমি গাছকন্যা হয়ে উঠেছি । সে চিৎকার করে বটগাছকে এসব বলল।সে বটগাছের ঝুরি ধরে মায়ের কোলের মত আদর পেল। সে দুলতে থাকল আদরে।
বটগাছ আর নদী তাকে নবজন্ম দিল।
এদিকে চিন্তায় শোচনীয় হয়ে উঠলো বাড়ির অবস্থা। তারা রুনুকে খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় গেল রোগীটা ।
সকলে দেখল রুনু হাওয়ায় উড়তে উড়তে আসছে আনন্দে। তার আনন্দের সীমা নেই।
আবার পরের দিন বাটুবাবারর কাছে চলে এলো রুনু। বাড়ির আর কেউ বাধা দেয় না। বাড়ির লোকেরা জেনে গেল বটগাছ আর নদী ওর জীয়ন কাঠি।
সেই নদীর ধারে বসে বটগাছের ছবি আঁকতে শুরু করল রুনু আর বটগাছের মাঝে ঈশ্বর দর্শন করল সে। সে দেখল বাঁশি নিয়ে হাসছেন পরম ধন। সে ছবি আঁকে বটগাছের।গাছের মধ্যে ঈশ্বরের বাস,আল্লার বাস। রুনুর সেই সাগর পারে ছেলেটির কথা মনে পড়ছে। সে নাকি মসজিদে আজান দেয়। এখন তার শুধু মনে পড়ছে সেই আজানের সুর, আল্লাহু আকবার…
এই আজানের সুর সে শুনিয়েছিল বারবার রুনুকে। গাছের মধ্যে খুঁজে পেল সেই ঈশ্বর ও আল্লাহর সমন্বয়।
তার সেই গাছের স্পর্শ যেন পরম প্রেমময়ের স্পর্শ। একদিন রুনুর আঁকা ছবি বড় পুরস্কার পেল।
রুনুর কোন হেলদোল নেই। সে বাটুবাবার কোলে দুলছে খুশিতে…
[মতামত ও বানানবিধি লেখকের ব্যক্তিগত]
Tags: গল্প, গাছ কন্যা, সুদীপ ঘোষাল
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।