সুরবালার বয়স এখন প্রায় পঁচাশি। মোটামুটি নিজের সব কাজ সে নিজে করতে পারে। শুধু চুল আঁচড়াতে গেলে বড্ড হাত ব্যথা করে। হাতটা উঁচু করতে গেলেই যত বেদনা। ছেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ওষুধ মালিশ এসব করলে একটু উপশম হয় । সুরবালা বুঝে গেছেন যে এই বয়েসে এর বেশি কোন কিছু আশা করা ঠিক নয়। তিনি ভাবেন বড্ড দীর্ঘ জীবন পেলেন তিনি! তাঁর স্বামী তো সেই কবেই পরপারে যাত্রা করেছেন। ছেলে মেয়ে দুটিকে লেখাপড়া শেখানো বিয়ে দেওয়া এই সব তিনি একা হাতে সামলেছেন। এখন তেমন কিছুই রোগ তাঁর নেই শুধু এই রোগা হার ঝিরঝিরে শরীরটায় প্রবল ব্যথা। সব কলকব্জা যেন ঢিলে হয়ে গেছে!
খুব ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। তারপর কী হলো কে জানে ! দোর গোড়ায় পড়ে গেলেন! কাপড়ে চোপরে পেচ্ছাপ করে ফেললেন। অনেক চেষ্টা করেও আর উঠতে পারলেন না। অবশেষে ছেলে বৌমা এসে তুললো। ততক্ষণে পায়ের পাতা গোড়ালি ফুলে কালশিটে পড়ে একাকার।
ডাক্তার বললেন ভাঙে নি। কিন্তু একদম রেস্টে থাকতে হবে। মাস দুই বিছানায় থাকতে হবে ভেবে তিনি যারপরনাই দুঃখিত হলেন।
মিতালী ভেবেছিল কোন আয়া বা কাজের মেয়ে রাখতে হবে না। শাশুড়িমায়ের যেটুকু কাজ তা তাঁরা স্বামী স্ত্রী মিলে করে ফেলবে। স্নান করার সময় সৌভিক সাহায্য করবে বাকি বাথরুমে যাওয়ার সময় সে নিজে ধরে নিয়ে গেলেই হবে। কিন্তু কাজটা যতটা সহজ ভেবেছিল ততটা সহজ নয়। মিতালী যখন রান্না করে তখন সুরবালার পায়খানা পেলেই বিপদ। মিতলীকে রান্না বন্ধ রেখে যেতে হয়। মিতালী বুঝল একজন লোক রাখা দরকার।
…………
খোঁজ করতে করতে আনুকে পেলো মিতালী। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি থাকে সে। ভারী ভালো মেয়ে । রাতে সুরবালা বিশেষ ঘুম থেকে ওঠেন না। আর যেহেতু বুবাই প্রায় ভোর অবধি অফিসের কাজ করে তাই মিতালী এই একটি বেলার লোক দিয়েই কাজ চালাবে ঠিক করে নিল। আনু একদম ঘড়ি ধরে আসে। মায়ের যে যে কাজগুলো তাঁর করার কথা তা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে করে। মিতালীর ঘর সংসারের কাজও টুকটাক করে দেয়। আনু সধবা। হাতে একটা সরু লোহা পরে। কিন্তু সিঁদুর পরে না। মিতালীর বরাবরই কৌতুহল খুব কম। তাই এই সব ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন প্রশ্ন সে করে না। কিন্তু শাশুড়িমা একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন ,
– তোমার সোয়ামী কী করে গো আনু।
– তাঁর একটা মুদি দোকান আছে গো। বলে মন দিয়ে সুরবালার বা-পায়ে বাতের তেল মাখতে শুরু করে।
– আর ছেলে মেয়ে?
– নেই। মানে তাঁর আগের পক্ষের একটা মেয়ে আছে। বিয়ে হয়ে গেছে।
– ও। তুমি বুঝি দ্বিতীয় পক্ষ।
– না গো মা। তৃতীয় পক্ষ। দু নম্বর বউটা পাশের বাড়ির হারুর সঙ্গে পালিয়ে গেছে। আমার বাবা তো খুব গরীব । ভাবল দুবেলা খেতে পরতে পারব। তাই বিয়ে দিয়ে দিল। আমি তখন নাইনে পড়তাম গো। তবে আমার সোয়ামী মানুষটা বেশ ভালো। বড্ড সোজা সরল ।
– তবে তোমাকে এই কাজে নামতে হলো কেন?
– আজকাল মুদি দোকান তেমন চলে না। ওই যে প্রথম পক্ষের মেয়ে বুড়ি। ওর বর খুন হয়ে গেল তো। কী সব পার্টি করত। ও দুই মেয়ে কোলে বাপের ঘরে ফিরে এল । সৎ মা হলেও আমি মা। এক সংসারেই রয়ে গেলাম। মেয়েটাও আয়ার কাজ করে। এভাবেই চলে যাচ্ছে গো মা। তাছাড়া আমার বর বয়েসে আমার থেকে অনেক বড়। এখন সে ভাবে কাজ করতেও পারে না।
মিতালী চা নিয়ে এসে এই কথাবার্তাটুকু শুনে ফেলল। এরপর ফিরে যেতে যেতে শুনল আনু আর মা গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। মিতালী আন্দাজ করে যেটুকু বুঝেছে তাতে মনে হয় পঞ্চাশ বাহান্ন হবে আনুর বয়স। ওর বরের তো তাহলে সত্যি বেশ বয়স হয়েছে।
রাতে এই আটটা নাগাদ দুধ রুটি বা দুধ খই খায় সুরবালা। মিতালী খাবারটা টেবিলে এনে রাখল। এই তিনমাসে সুরবালা বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এখন হেঁটে এসে খেতে বসতে পারছেন।
আনুর কাজ অনেকটা হালকা হয়েগেছে। কিন্তু মেয়েটা বসে থাকতে পারে না। ঘুরে ঘুরে এটা সেটা করে। কখনও কলতলার শ্যাওলা ঝামা ঘষে পরিষ্কার করে আবার কখনও বা উঠোনের কোণে যে আগাছা হয়েছে তা পরিষ্কার করে রাখে। মিতালী খেয়াল করে দেখল আনু বেশ কয়েকটা শাক সবজির গাছ লাগিয়েছে। গিমাশাক, ব্রাহ্মীশাক তো আছেই সঙ্গে পুঁইশাক আর কুমড়োশাকও। হাতের গুণে মিতালীদের উঠোনের একটা দিক বেশ খানিকটা সবুজ হয়ে গেছে। মিতালীর ভালো লাগে। একটা মায়া জন্মায় আনুর উপর। দুপুরে আনু মিতালীর কাছ থেকে খবরের কাগজ চেয়ে নিয়ে পড়ে। ও ক্লাস নাইন অবধি পড়েছে। টুকটাক গল্প করে। বলে সেই সেবার পূর্ব পাকিস্তানে এক ভয়ংকর দাঙ্গা লাগল। তখন ওরা এদেশে পালিয়ে আসে। কোন একটা ক্যাম্পে বুঝি উঠেছিল ওরা। সে এক ভয়াবহ ঘটনা! ক্যাম্পে নাকি কলেরায় ওর মা মারা যান। ওর বাবা তারপর কোন চেনা লোকের সাহায্যে রানাঘাটে চলে আসেন। ওদের ঠাকুমা ওদের চার বোনকে মানুষ করেন। না , ওর বাবা আবার একটা বিয়ে করেন নি। এই যা রক্ষে। নইলে আনুর ভাষায় পেট বাড়ত আর অভাব বাড়ত। আনু এদেশে এসে ইস্কুলে ভর্তি হয়।
মিতালীর খারাপ লাগে। ভাবে আনু হয়ত পড়াশুনা করলে অন্য কোন কাজ করে স্বামীকে আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারত!
——–
একদিন হঠাৎ আনু আসে না। পাশের বাসায় কাজ করে ললিতা সে এসে খবর দিল আনুর বর মারা গেছে। গতকাল রাতে হঠাৎ বুকে ব্যথা ওঠে , হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ঘণ্টা খানেক পরেই সে চলে যায়। মিতালীর খুব মন খারাপ লাগে। ভাবে দিন দুই বাদে আনুর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে কিছু টাকা দিয়ে আসবে। এই সময় নিশ্চয়ই ওর টাকার দরকার।
দিন তিনেক পরে মিতালী একদিন সময় বের করে বিকেল নাগাদ আনুর বাড়িতে যায়। একটা রিক্সা ভাড়া করে নেয় সে। গিয়ে দেখে উঠোনের এক ধারে আনুর মেয়ে বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ কর্ম সেরে জনা কুড়ি অতিথিকে খাবার দিচ্ছে। মিতালীর মনে পড়ল আনুর তো কোন পুত্র সন্তান নেই! নিয়ম মতো আজ মেয়েটি কাজকম্ম সারছে। মিতালীকে দেখে সাদা থান পরা মলিন চেহারার আনুর মুখে একটু হাসি ফুটলো যেন। বুড়ি দৌড়ে এসে একটা চেয়ার টেনে মায়ের পাশে বসতে দিল। একটু যেন ব্যস্ত হয়ে উঠল মেয়েটি। মিতালী ব্যাগ খুলে টাকা বের করে আনুর হাতে দিল। বললো রাখো আর কদিন পরে একটু সামলে নিয়ে যেও। তুমি কী ঠিক করলে তখনই নাহয় শুনব। আজ থাক।
এরপর মিতালী ঘাড় ঘুরিয়ে একটা টেবিলে রাখা আনুর বরের ছবির দিকে তাকিয়ে কেমন চমকে উঠল! এই মুখ তো বড্ড চেনা! অনেকগুলো পুরোনো ছবির সঙ্গে একটা ছবি আছে সৌভিকের বাবা আর এক তরুণের। সেগুলো রাখা আছে মায়ের টিনের ছোট বাক্সটিতে। সেখানে এই মানুষটাকে দেখিয়েই তো মা বলতেন আমাদের অবনী ভাই। তোমার শ্বশুরের চেম্বারে তিনি ছিলেন কম্পাউন্ডার। কী সুন্দর জ্বর পেট খারাপের মিক্সচার ওষুধ বানাতেন। সেই গোলাপী রঙের মিক্সচার! ওষুধের শিশির গায়ে বরফির মতো দেখতে কাগজ কেটে লাগানো। দু দাগ ওষুধ খেলেই রোগ পালাই পালাই করত। অবশ্য তোমার শ্বশুরবাবার হাত যশ ছিল খুব। তারপর তো কী গোলমাল লেগে গেল দেশে। অবনীদের গ্রামের সবাই দেশ ছাড়ল। দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু কেমন স্বাধীন তাতো ঠিক বুঝলাম না। আসলে সে তোমার বাবার কাছে কাজ শিখতে এসেছিল। খুব ভালো মানুষ ছিল সে। ওদিকে আমার শ্বশুরমশাই চারদিকে যোগাযোগ করতে লাগলেন। তারপর স্বাধীনতার প্রায় দেড় বছর বাদে আমরা দেশ ছাড়লাম। অবনীর কোন খোঁজ পেলাম না। তোমার বাবার বড্ড প্রিয় ছিল সে।
মিতালী দেখল ছবির ওই তরুণ অবনীর সরল মুখটি এই বৃদ্ধ বয়েসেও তেমন বদলায় নি। মিতালী ছবির দিকে তাকিয়ে বলল আনু তোমার বরের নাম কি অবনী ? উনি কি ফরিদপুরে ছিলেন ?
আনু ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
অবাক হয়ে বলে,
– বৌমনি তুমি জানলে কী করে?
– উনি দেশের বাড়িতে তোমার দাদার বাবার চেম্বারে কম্পাউন্ডার ছিলেন । আমাদের বাড়ীতে একটা ছবি আছে । গেলে দেখো।
– হ্যাঁ গো উনি তো বলতেন উনি নাকি দেশে থাকতে ডাক্তারের চেম্বারে কাজ করেছেন। আর বলতেন এদেশে এসে যদি ডাক্তার দাদার দেখা পেতাম তবে জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেত! কত খুঁজেছেন তাঁর ডাক্তার দাদাকে।
– বাবাতো আসলে এদেশে আসার কয়েক বছর বাদেই মারা যান।
– ইস! তাই হয়ত দেখা হয় নি।
মিতালী বাড়ি ফিরে আসে। রাতে মিতালীর স্বামী সৌভিক ফিরলে সে আনুর বাড়ি গিয়ে কী কী ঘটল তা খুলে বলে। সৌভিক খুব অবাক হয়। কত খুঁজেছে তাঁরা! বলে জানো এদেশে এসে বাবার তেমন পসার হয় নি। বাবা ভাবতেন অবনী কাকা থাকলে এমনটা হয়ত হতো না। এই পাড়ায় ওরা এসেছে বছর পনের আগে। তার আগে ওরা নৈহাটিতে থাকত। হয়ত এই পাড়ায় আগে এলে অবনী কাকার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত!
রাত গভীর হয়। মিতালীর ঘুম আসে না। সে ঠিক করে কাল সকালে ওই ছবিটা বের করবে। তারপর শাশুড়ি মাকে জানাবে। বয়স্ক মানুষের রাতে কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ। সে উঠে জল খায়। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবে এই ভাগাভাগি জাত ধর্মের লড়াইয়ে মানুষ যে শুধু ভিটে মাটি স্বজন খুইয়েছে তাতো নয়। প্রায় ষাট বছর ধরে বয়ে চলছে কত যন্ত্রণা অভাব অনটন। আর কী জানি কী কী দেখতে হবে ওই মানুষগুলোকে। অল্প চাঁদের আলোয় মিতালী দেখে আকাশে ভেসে যাচ্ছে হালকা সাদা মেঘ।ভেসেই যাচ্ছে !
Tags: গল্প, ছবি, রূপা সেনগুপ্ত
email:galpersamay@gmail.com
মতামত
আপনার মন্তব্য লিখুন
আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।