03 Nov

স্ত্রীধন

লিখেছেন:রূপা সেনগুপ্ত


ভোর হতে না হতেই  দুধ দোয়াতে আসে রামু গোয়ালা আর খবরের কাগজ নিয়ে বিকাশের সাইকেলের টুং টাং শব্দে জেগে ওঠে এই পাড়াটা। কেউ কেউ নিমদাঁতন হাতে পঞ্চায়েতের বসানো টিউবওয়েল এর কাছে এসে বিকাশকে ডেকে একটা খবরের কাগজ কিনে নেন। গুটি গুটি পায়ে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে দু চারজন বেকার বৃদ্ধ বের হয়ে এসে ওই কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পাড়াটা উদ্বাস্তু কলোনি পাড়া।

এখন ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়। বৃষ্টি আসে ঝেঁপে ঝেঁপে। শৈলবালার ঘুম ভাঙে সেই সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। দিনমণির চলার সঙ্গে শৈলও চলেন ফেরেন । সন্ধেবেলায় আর তেমন কিছু করার থাকে না শৈলবালার। কুপি জ্বালালে ধোঁয়ায় ঘর ভোরে যায়। হ্যারিকেনের পলতে বাড়ালে তেলের খরচ বেড়ে যায়। আজকাল বড্ড হিসেব করতে হয়। দেশ থেকে আনা ছোট হারিকেনটা মৃদু করে আলো ছড়ায় ঘরে। ছেলেমেয়েরা পায়খানা পেচ্ছাপ করতে গেলে শৈল বা বড় মেয়ে মিনা আলোটা নিয়ে এগিয়ে যায়। উঠোনে বর্ষার জল পেয়ে আগাছা আর ঝোপঝাড় বেড়ে গেছে। সাপের ভয় পান শৈলবালা। রাতে সাপের নাম নেন না তিনি। বলেন- লতা, লতা, লতা। তিনবার লতা বলতে হয়, এমনই তো তিনি শিখেছেন।

কালো মেঘ সরে গিয়ে সাদা মেঘ উঁকি দিতে শুরু করেছে। কলোনির এদিক সেদিক শিউলি ফুটে উঠেছে। ফুটেছে স্থলপদ্মও। সুরের পুকুরে সাদা শাপলা ফুটেছে অনেক। শৈলবালা স্নান সেরে তুলসিতলায় প্রদীপ দেখান। বাখারি দিয়ে তৈরি ছোট গেটের পাশে গন্ধরাজ ফুলের গাছটায় গত সন্ধ্যায় ফোটা ফুলগুলি নেতিয়ে পড়েছে। তবু কেমন একটা সুন্দর ঝিম ধরা গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। ধীরে ধীরে জলা জায়গা শুকোতে শুরু করেছে। কলোনির পরিবারগুলোতে শুরু হয়েছে পুজোর প্রস্তুতি। কারো বাড়ির ভাঙা টালি বদলে লাগানো হচ্ছে নতুন টালি। আর যাদের টিনের চাল, তারা ছ্যাঁদা ফুটোর হাত থেকে বাঁচতে চালে মেলে দেয় পিচচট। এদেশে কুমোরপাড়া থেকে দুর্গা মূর্তি এনে পুজো হয়। ওপার বাংলায় এ সময় নৌকা করে পালপাড়া থেকে কুমোর কাকা আসতেন। জমিদার বাড়ির দালানে থাকতেন তিনি। চলত মূর্তি গড়ার কাজ। প্রথমে কঞ্চির ওপর খড় দিয়ে তৈরি হয় কাঠামো। তারপর দুই দফায় মাটির প্রলেপ দিয়ে আঙুল চেপে তৈরি হয় মূর্তি। শৈলবালা ভাই বেণীমাধবের সঙ্গে ঠাকুর দালানে বসে মূর্তি গড়া দেখতেন। নতুন জামা, ফিতে আর গন্ধ তেল নিয়ে বাবা ফিরতেন গঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে। সারা গ্রাম জুড়ে গুড় দিয়ে নারকেলের পাক দেওয়ার গন্ধ আর শ্বেতশুভ্র শিউলি ফুল জানান দিত ; উমা মা আসছেন।

আজ সাজি ভর্তি ফুল তুলেছে মিনা। ঠাকুর সিংহাসনের সামনে বসে ফুলের সাজিটা হাতে টেনে নেন তিনি। সাজি ভর্তি শিউলি, টগর এর মাঝে দুটো পঞ্চমুখী জবা দেখে শৈল বুঝে যায় শাশুড়ি সরলাবালার লাগানো জবা গাছটায় ফুল ফুটেছে। ফুলটা নিয়ে ভাবতারিণী মায়ের পায়ের কাছে রেখে ছোট জা রেণুর মঙ্গলকামনা করেন শৈলবালা।

চল্লিশের দশক ছিল বাংলায় মৃত্যুর দশক। সেই সময় ওপার বাংলায় থাকতে এত মৃত্যু দেখেছেন যে আজকাল আর মৃত্যুকে ভয় পান না তিনি। তবু ছোট জা রেণুর প্রথম দুটি সন্তানের মৃত্যু আর তাঁর ব্যথাভরা মুখ শৈলকে কষ্ট দেয়। শৈল এবার একটা হলুদ কলকে ফুল নিয়ে তারকনাথ শিবের পায়ের কাছে রেখে ভাবেন, তাকেই কিছু একটা করতে হবে। রেণুর এই অনাগত সন্তান যাতে পৃথিবীর আলো দেখে তার একটা চেষ্টা অন্তত তাকে এবার করতে হবে।

সেসময় শিশু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল যথেষ্ট বেশি। অল্প বয়েসে অপুষ্ট শরীরে মা হওয়া , গ্রামাঞ্চলে ডাক্তার বদ্যির অভাব কিম্বা অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতসেঁতে প্রসূতিগার ছিল এইসব মৃত্যুর কারণ। গ্রামে পুরুষ ডাক্তার থাকলেও সন্তানসম্ভবা মেয়েদের চিকিৎসার কোন সুযোগ তাঁরা পেতেন না। এই কাজ বংশপরম্পরায় দাই-মায়েরাই করে থাকতেন।

পুজো সেরে বের হয়ে এসে শৈলবালা দেখেন দেওর অশোক সূতিকাগার তৈরি করতে ব্যস্ত। সাধারণত উঠোনের এক কোণে তৈরি হয় অস্থায়ী আতুরঘর। এই আঁতুরঘরগুলি চ্যাঁচার বেড়া আর খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি। বৃষ্টির ছাঁট, পোকা-মাকড় এসবের হাত থেকে তেমনভাবে রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকত না। রেণুর আগের দুই সন্তান ঠাণ্ডা লেগে আঁতুড়েই চলে যায়। তাই আঁতুরঘর দেখে শৈলবালা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। অজানা ভয়ে বুক কাঁপে তাঁর। সম্মুখে দাওয়ায় বসা রেণুর ফ্যাকাসে মুখ দেখে শৈলবালা চিন্তিত হন। দেওরকে ডেকে বলেন দাই নন্দর-মাকে ডেকে আনতে। আসলে অভিজ্ঞ শৈলবালা বোঝেন এই মহালয়ার আগেই মানে পিতৃপক্ষেই রেণুর সন্তান জন্ম নেবে। শুধু নন্দর মা কী বলেন তা দেখে নিতে চান তিনি। তার স্বামী অমল আর দেওর অশোকের হাতে যে তেমন টাকাপয়সা নেই সেটাও তিনি জানেন।

দুপুরে সবাই ঘুমোলে তিনি তোরঙ্গ খুলে তাঁর গয়নার বাক্সখানি খুলে বসেন। মনে পড়ে যায় বিয়েতে দানের গয়না ছাড়াও এই গয়নার বাক্সটা তাঁর হাতে তাঁর বাবা তুলে দেন। এটা তাঁর মৃত মায়ের গয়নার বাক্স। তারপর দেশভাগ হল।  সপরিবারে এদেশে পাড়ি দিলেন তাঁরা। এদেশে এসে যেটুকু যা করেছেন তা তো ওই গয়না বেঁচেই। কোন আফসোস নেই তাঁর। কারণ তাঁর বাবা বলতেন- এ হল স্ত্রীধন। এতে একমাত্র তোমারই অধিকার মা। এ ধন দিয়ে সাজবে না সাজাবে; তা একমাত্র তুমিই ঠিক করবে। বাক্স খুলে তাঁর মায়ের হাতের সেই হাঙরমুখী বালাটা বের করেন শৈলবালা। বালাটার গায়ে হাত বুলান তিনি। এটি তাঁর মায়ের ছোঁয়া মাখা। তাঁর পরম প্রিয়। তারপর দেওরের ঘরের দুয়ারে গিয়ে হাঁক পারেন- ঠাকুরপো। অশোক এলে তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে ওই বালাখানি হাতে দিয়ে বলেন- এই বালা বন্ধক বা বিক্রি যা হোক করে তুমি কাল রেণুকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাও। মানা করো না ভাই। মিনুকে দিয়ে লালচাঁদ রিক্সাওলাকে খবর পাঠাচ্ছি, সে ঠিক কাল সকাল করে চলে আসবে। এবার তোমার সন্তানকে বাঁচাতেই হবে। এ চেষ্টাটুকু করতে আমায় বাধা দিও না ভাই। হতচকিত অশোককে দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি পিছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা লাগান।

নিজের ঘরে ফিরে এসে, পরম শান্তিতে শৈলবালা পান সাজাতে বসেন।

[বানানবিধি/মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags: , , ,

 

 

 




  • খোঁজ করুন




  • আমাদের ফেসবুক পেজ

  • মতামত

    আপনার মন্তব্য লিখুন

    আপনার ইমেল গোপনীয় থাকবে।




    Notify me when new comments are added.

    যোগাযোগ


    email:galpersamay@gmail.com

    Your message has been sent. Thank you!

    গল্পের সময় পরিবার
    সমীর
    অগ্নীশ্বর
    দেবাশিস
    চিন্ময়
    পার্থ
    মিতালি
    জাগরণ
    দেবব্রত

    © 2016 - 2024 গল্পের সময়। ডিজাইন করেছেন অগ্নীশ্বর। নামাঙ্কন করেছেন পার্থ